বিকৃত বেগুনের প্রচার
ফরিদা আখতার || Thursday 13 September 2012 ||তরিতরকারীর মধ্যে বাংলাদেশে্ বেগুন সবারই অত্যন্ত পছন্দের। খুব আনন্দ করেই আমরা এই সব্জি খাই।কিন্তু আতংকের বিষয় এই বেগুনে অন্য প্রজাতির ‘জীন’ ঢাকানো হচ্ছে। বেগুনের স্বাভাবিকত্বের হানি ঘটিয়ে এই বিকৃতির দরকার কি? বলা হচ্ছে, যে বেগুন আমরা এতকাল খেয়ে এসেছি সেই বেগুনে নাকি দোষ আছে। দাবি করা হচ্ছে, ‘ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা ছোট ছোট বেগুন গাছের কচি ডগা ছিদ্র করে ভেতরে প্রবেশ করে এবং খায়। কীড়া কচি ও বাড়ন্ত বেগুন ছিদ্র করে ভিতরের নরম শাঁস খায়’ ইত্যাদি। এই তথ্য কারা প্রচার করছে? করছে ভারত থেকে প্রকাশিত ABSP II এর বিটি বেগুনের ওপর সচিত্র প্রচারপুস্তিকায়।এই প্রচারপুস্তিকা ইংরেজীতে ছিল। বাংলাদেশে নিষ্ঠার সাথে এই প্রচারপুস্তিকাটির বাংলা অনুবাদ বিলি করা হচ্ছে। প্রথম পাতায় বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে হুবহু একই ভারতীয় বই প্রচারিত হচ্ছে।তবে ভারতের চন্দন ভট্টাচার্য্যের আঁকা চিত্রগুলো সবই রয়ে গেছে, আর সেই চিত্রে আছেন ভারতের কৃষক পরিবার।স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের কৃষকদের সাথে কোন মিল নেই।
আমি সেখান থেকেই তথ্য নিয়ে লিখছি।এই প্রচারপুস্তিকাটির নাম “ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী বিটি (Bt) বেগুনঃ বার বার জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী” ইংরেজী যাকে বলে Frequently Asked Questions বা FAQ । ওয়েবসাইট দেখুন www.absp2.net। বিটি বেগুন প্রকল্পের অংশীদার বেশীর ভাগ বিদেশী সংস্থা যেমন ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস ফর দি একুইজিশান অব এগ্রবায়োটেক এপ্লিকেশান (ISAAA), ইউনিভার্সিটি অব ফিলিপাইন্স, লসবেনোস (UPLB), সাউথ ইস্ট এশিয়ান রিজিওনাল সেন্টার ফর গ্রাজুয়েট স্টাডি এন্ড রিসার্চ ইন এগ্রকালচার (SEARCA) এবং বীজ কোম্পানী যেমন ভারতের MAHYCO, যার সাথে বহুজাতিক কোম্পানী মনসান্তোর অংশীদারিত্ব রয়েছে। কাজেই এই গবেষণা কেবল বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের,এমন দাবী করা যাবে না।
বিটি বেগুন নিয়ে আগেও প্রতিবাদ হয়েছে, আমি নিজেই কয়েকবার লিখেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের সরকার বিটি বেগুনের ব্যাপারে অতি উৎসাহী। এই বেগুন প্রবর্তন করা হচ্ছে নিরবে। খুব আওয়াজ উঠছে না। কখন জানি বাজারে অবাধে পাওয়া যেতে থাকবে, আমরা জানতেও পারবো না। বাংলাদেশে গাজীপুরে অবস্থিত কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BARI) এই গবেষণা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএইডের বিশেষ কর্মসুচী ABSP II এর অধীনে। ভারতে এই বেগুন নিয়ে প্রচুর বিরোধিতা ও হৈ চৈ হয়েছে এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ছাড়পত্রও পেতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু হায়, বাংলাদেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয় নীরব আর কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বিটি বেগুন ও বিটি আলুর ব্যাপারে অত্যন্ত উৎসাহী। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের ২০১১ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত একটি সভায় তিনি জিএম ফসলকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁর মতে জিএম ফসল কীট দমনে ভাল ভুমিকা রাখবে। উৎসাহ প্রকাশের এক পর্যায়ে তিনি জিএম ফসল নিয়ে যারা বিরোধিতা করছেন তাঁদের ওপর বিরক্ত হয়ে তথ্য প্রমাণ হাজির করতে বলেছেন।এমনকি তিনি বিরোধিতা কারীদের কথাকে ‘ফতোয়া’ বলে প্রমাণ ছাড়া গ্রহনযোগ্য নয় বলে উড়িয়ে দিয়েছেন (ডেইলী স্টার, মার্চ ৩০, ২০১১)।মতিয়া চৌধুরী দাবি করেন তিনি কীটনাশক পছন্দ করেন না। তিনি মনে করছেন জিন প্রযুক্তি কীটনাশক ব্যবহার কমাবে এবং ৩০ – ৪০% ফসল কীটের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে। যদি তাই হোত এবং জীন প্রযুক্তি নিজেই যদি ক্ষতিকর ভুমিকা না রাখতো তাহলে এর বিরোধিতা করার প্রশ্নই উঠতো না। যারা বিটি বেগুন,বিটি আলু, গোল্ডেন রাইসসহ অন্যান্য জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের বিরোধিতা করছেন তারা প্রমাণ ও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সহকারেই করছেন।বিজ্ঞান হিশেবে জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের ভালমন্দ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে আমরা যেগুলো নিয়ে আপত্তি করছি সেগুলো বিজ্ঞানের দিক থেকেও ত্রুটিপুর্ণ। এবং ইতিমধ্যে তার ভাল দিকের চেয়ে ক্ষতিকর দিকগুলোই বেশি প্রমাণিত হতে শুরু করেছে। কৃষি মন্ত্রী গ্রীন পিস, ETC group, Friends of the Earth, Grain, Navdanya সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের ওয়েব সাইট দেখলেই প্রমাণ পাবেন। যারা এখানে ব্যাবসায়িক স্বার্থে বিটি বেগুন উৎপাদন করতে চাচ্ছেন তাদের প্রচারে বিভ্রান্ত হলে চলবে না। একটি দেশের কৃষিমন্ত্রীকে কোম্পানির স্বার্থ নয়,কৃষকের স্বার্থ দেখতে হবে। জনগণের খাদ্য সার্বভৌমত্বের বিষয়টি প্রযুক্তি ও পরিমানগত ভাবে উৎপাদন বৃদ্ধি বোঝায় না। প্রাণ বৈচিত্র ও পরিবেশের জন্য নিরাপত্তা এবং কৃষিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর জনগণের নিয়ন্ত্রণও বোঝায়। জিএম প্রযুক্তি কীটনাশক, আগাছানাশক মুক্ত ভাববার কোন কারণ নেই। কৃষি মন্ত্রী দাবি করেছেন কীটনাশক বিক্রতা কোম্পানী বিটি বেগুনের বিরধিতা করছে। আসলে তা ঠিক নয়,বরং তারাই জিএম প্রযুক্তির সাথে যুক্ত। জিএম প্রযুক্তির বিরোধিতা প্রথমত করছেন সচেতন বিজ্ঞানিরা। তাদের গবেষণার সূত্র ধরে পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সচেতন সংগঠন এর বিরোধিতা করছে। এর ভয়াবহ পরিণতির কথা ভেবে এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন কৃষকের স্বার্থ রক্ষাকারী বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগঠন।
বিটি বেগুনের প্রচারপুস্তিকার তথ্য থেকে বোঝা যায় বেগুন বাংলাদেশে ব্যাপক পরিমানে আবাদ হয়। বিবিএস ২০০৭ অনুযায়ী বাংলাদেশ ৫৭,৭৪৫ হেক্টর জমিতে ৩,৩৯,৭৯৫ মেট্রিক টন বেগুন উৎপন্ন হয় যা দেশের মোট সব্জি আবাদী এলাকার ২৫.৪% ভাগ। বিটি বেগুন সম্পর্কে প্রচারপুস্তিকায় বলা হচ্ছে,এই বেগুন ডগা ও ফল ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী। বিটি হোল Bacillus thuringiensis এর সংক্ষিপ্ত নাম, যা মাটিতে বসবাসকারী ব্যক্টেরিয়াম Cry1Ac নামক জিন ধারণ করে এবং একটি পোকানাশক প্রোটিন তৈরী করে।এই প্রোটিন বেগুন গাছের ডগা, পাতা এবং ফলের মধ্যে ঢুকে পড়ে এবং সেখান থেকে খাদ্য খেয়ে বেঁচে থাকে। এই প্রোটিন পোকার জন্য বিষাক্ত, তাই বেগুনে পোকা লাগে না বা কোন ছিদ্র হয় না।
তাহলেই কি এই বিটি বেগুন নিরাপদ হয়ে গেল? আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংগঠনগ্রীন পিসের মতে বিটি বেগুনের মধ্যে একটি বহিরাগত ব্যাক্টেরিয়ার জিন প্রবেশ ঘটানো হয় এবং এই ব্যক্টেরিয়া গাছটিকেই কীড়া থেকে মুক্ত রাখার জন্য বিষাক্ত করে দেয়।তাছাড়া জিএম সবজিতে এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধক মার্কার থাকে। তার মানে মানুষ এই সবজি খেলে তার শরীরে এন্টিবায়োটিক কাজ করবে না,অথচ যে কোন ইনফেকশান হলে এন্টিবায়োটিক নেয়ার প্রয়োজন মানুষের থাকতে পারে।
এখনো খোলা বাজারে বিটি বেগুন এসেছে বলে মনে হয় না। সরকারের গবেষণাগারে এর পরীক্ষা ঠিক কিভাবে হচ্ছে আমরা জানি না। তবে এর স্বাস্থ্য সমস্যার দিকগুলো বিচার না করে ছেড়ে দেয়া হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
ইতিমধ্যে পাবনা জেলায় কৃষকদের দিয়ে বিটি বেগুনের গবেষণা করা হচ্ছে। উবিনীগের একটি গবেষণায় জয়নাল আবেদীন খান ও তার সহকর্মীরা পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলায় অবস্থথিত আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং যেসব কৃষক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তাঁদের সাথে কথা বলেছেন।
ঈশ্বরদীর আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কীটতত্ত্ব বিভাগের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন এই গবেষণা কেন্দ্রে বিটি বেগুনের চাষ হয়েছে তবে এখন তা মাঠে নেই। বিটি বেগুনের চারা গাজীপুর থেকে দিয়েছিল। গবেষণা প্লটে চাষ করা হলেও কোন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা একটা বেগুনও খেয়ে দেখেন নি। তাঁরা বরং এই বেগুন হওয়ার পর টুকরা টুকরো করে গর্তে পুঁতে ফেলেছেন। তাঁরা জেনেছেন বিটি বেগুনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পোকা ধরবে না, সারা বছর চাষ করা যাবে। সার-বিষ দিতে হবে না, উৎপাদন খরচ কম হবে। কিন্তু এটা খেতে নিরাপদ কিনা এ ব্যাপারে তাঁরা জানেন না। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের মতে বিটি বেগুন গবেষণা পর্যায়ে রয়েছে।মাঠ বা কৃষক পর্যায়ে এই বেগুনের বীজ বা চারা এখনও দেয়া হয় নাই।
যে বেগুন পোকায় খাবে না সেই বেগুন মানুষ খাবে কি করে এবং মানুষ খেলে কোন ক্ষতি হবে কি না প্রশ্ন করা হলে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের উত্তর ছিল এ রকমঃ যে বেগুন পোকায় খাবে না সেই বেগুন মানুষ খাবে এই জন্যই তো গবেষণা করা হচ্ছে। তবে ‘এ বেগুন আমার ছেলে-মেয়েকে কখনও খেতে দেব না’।
যদিও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বেগুন উৎপাদন করে মাটিতে পুঁতে ফেলছেন তবুও প্রশ্ন থেকে যায় কোনভাবে এই বেগুন বাজারে আসছে কিনা। তাই দাশুরিয়া ও মুলাডুলি হাট এবং বাজার, ঈশ্বরদী বাজার এবং রাজাপুর বাজারে অবস্থিত সবজি ব্যবসায়ী ও বীজ ভান্ডারের দোকান থেকেও তথ্য নেয়া হয়েছে। বিক্রেতারা অবশ্য বিটি বেগুন নামে কোন বেগুন চেনেন না। নামও শোনেন নি।তাঁদের ধারণা বিটি বেগুন বাজারে আসলে অবশ্যই জানতে পারবেন। তবে ঈশ্বরদী বাজারের একজন সবজি বিক্রেতা জানান ঈশ্বরদী এলাকায় ছিদ্র ছাড়া একটি বেগুন ‘ঝুমকা বেগুন’ নামে পরিচিত। এই বেগুনে সাধারণ বেগুনের তুলনায় অনেক কম পোকা ধরে।গাছ ২হাত থেকে ২.৫ হাত লম্বা ও আকার গোলাকার হয়।বেগুনের আকার ছোট ও লম্বাটে।এই বেগুন এখানে নতুন, দাম কম। সাধারণ বেগুনের দাম ৩০টাকা হলে ঝুমকা বেগুন ১৫টাকা। সপ্তাহে দুই একদিন এই বেগুন বাজারে আসে। চাহিদা অনেক কম। এই বেগুনে কীটনাশক ব্যবহার করে। এই ঝুমকা বেগুনই বিটি বেগুন কিনা তিনি নিশ্চিত নন।এই বেগুন বিক্রেতা কৃষকদের কাছ থেকে প্রায় নয় জাতের বেগুন কিনে বিক্রি করেন, ১.যশোরী বেগুন ২.দেশী বেগুন (হালকা সাদার মধ্যে হালকা বেগুনী রং) ৩. দেশী বেগুন (সম্পূর্ণ বেগুনী) ৪. ইরি বেগুন (গোল), ৫. সুইটা বেগুন (গোল ও কাটাযুক্ত) সবুজের মধ্যে হালকা সাদা রং, ৬. সাদা গোল বেগুন, ৭. সাদা ডিম বেগুন, ৮. ইরি বেগুন (গোল), হালকা বেগুনী ৯. শয়লা বেগুন (লম্বা)। এই বেগুন গুলো দামের দিক থেকেও ভাল - ১৫ টাকা থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত কেজি। তবে দেশী গোল বেগুনের কদর এখনো বেশী, ক্রেতারা ৪০ টাকা কেজি কিনে ফেলেন।
আমাদের দেশে বেগুনের জাতের অভাব নাই। এতোদিন উফশী ও হাইব্রীড জাতের বেগুন এনে ভয়ানক পরিমানে কীটনাশক ব্যবহার করে মানুষের যথেষ্ট ক্ষতি করা হয়ে গেছে। এই কীটনাশক দেয়া বাণিজ্যিক চাষের বেগুনের কোন গুণ বা স্বাদ নেই। এখন মরার ওপর খাড়ার ঘা হিশেবে জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের মাধ্যমে বেগুন গাছকেই বিষাক্ত করে দেয়া হচ্ছে, এবং বহুজাতিক কোম্পানির কাছে বেগুনের মতো সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য একটি সবজিকে জিম্মি করে রাখা হচ্ছে। গবেষণা শেষ হলেই তাদের পেটেন্ট হয়ে যাবে। বেগুন এমন সবজি যে নারীরা ঘরের আঙ্গিনায় দু’একটি গাছ লাগিয়ে ঘরের প্রয়োজন মেটাতে পারেন। তাদের কীটনাশক লাগে না, চুলার ছাই দিয়ে পোকা দমন করতে পারেন। আর নেহায়েত দুএকটি ছিদ্র থাকলেও তা সবজি কুটার সময় আদরে যত্নে কেটে ফেলে দেন। তাতে খাদ্যের স্বাদের কোন ক্ষতি হয় না।
আমাদের বেগুন আমাদেরই থাকুক। এর মধ্যে ব্যাক্টেরিয়ার ‘জিন’ ঢুকিয়ে ভুত বানাবেন না।