পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি
শাহীনুর বেগম || Wednesday 01 November 2017 ||রানা প্লাজা ধসে পড়া এবং তাজরীনের অগ্নিকান্ডের পর থেকে শ্রমিকরা মূলত অসন্তোষ প্রকাশ করে। এরপর শ্রমিকরা ৮০০০ হাজার টাকা মজুরি বাড়ার জন্য মালিকপক্ষের কাছে প্রস্তাব দেয়। শ্রমিকদের দিক থেকে মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব মালিকরা আয়ত্বে না নেয়ায় আন্দোলনে রূপ নেয়। অবশেষে ৬ জুন পোশাক শ্রমিকদের বেতন কাঠামোর জন্য মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামোর লক্ষ্যে মালিকপক্ষ বোর্ডে ৩.৬০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণে প্রস্তাব দেন। মালিকপক্ষের দেয়া প্রস্তাব নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল। এরপর মালিকরা অনেক দেনদরবার শেষে মজুরি বোর্ডের প্রস্তাবে সম্মতি জানান। ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো ৬২৭ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩০ টাকা। ২০০৬ সালে বেতন বৃদ্ধি করে ১.৬৬২.৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরপর ২০১০ সালে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৩.০০০ টাকা। মজুরি বোর্ডের সাথে মালিকপক্ষ এবং শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বৈঠকে মজুরি বাড়ানো নিয়ে দরকষাকষির পর মজুরি বোর্ড ৪ নভেম্বর, ২০১৩ তারিখে ন্যূনতম মজুরি ৫৩০০ টাকা ঘোষণা করে। মজুরি বোর্ড ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করার পরও শ্রমিকরা রাস্তায় আন্দোলন করছে। এতে করে হয়তো আমাদের মনে হতে পারে, যে একজন শ্রমিক গার্মেন্টসে ঢুকেই ৫৩০০ টাকা মজুরি পাবে, টাকার দিক থেকে একেবারে কম তো নয়। তাহলে শ্রমিকরা এখনো আন্দোলন করছে কেন? আমরা জানি পোশাক শিল্পের মধ্যে কয়েকটি ভাগ আছে। যেমন-ওভেন, নীটওয়ার, এবং সোয়েটার কারখানা। এই তিনটি ভাগ অনুযায়ী শ্রমিকদের মজুরিরও ভাগ রয়েছে।
• ওভেন কারখানায় প্যান্ট, জ্যাকার্ড এবং শার্ট তৈরি হয়। ওভেন কারখানায় পুরুষ এবং নারী শ্রমিকরা মিলে উৎপাদন করে। তবে এখানে নারী শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এই শ্রমিকদের মাসিক হিসেবে মজুরি দেয়া হয়।
• সোয়েটার কারখানায় সোয়েটার তৈরি করা হয়। এখানে নারী শ্রমিক এবং পুরুষ শ্রমিক মিলে কাজ করে। সোয়েটার কারখানায় প্রোডাকশন হিসেবে মাসিক হিসেবে মজুরি দেয়া হয়।
• নীটওয়্যার কারখানায় কেবল গেঞ্জি তৈরি হয়। নীটওয়ার কারখানায় কোন নারী শ্রমিক নাই।
• পুরুষ শ্রমিকরা মূলত এই কারখানায় কাজ করে। এই শ্রমিকদের মজুরি প্রোডাকশন হিসেবে মাস শেষে মজুরি দেয়া হয়।
• নীটওয়্যার কারখানার মালিকদের সংগঠন হচ্ছে,বাংলাদেশ নীটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ)।
• ওভেন এবং সোয়েটার কারখানার মালিকদের সংগঠন হচ্ছে, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)।
ওভেন, নীটওয়্যার এবং সোয়েটার কারখানার শ্রমিকদের উৎপাদন, শ্রমঘন্টা, শ্রমিকের ধরণ, ওভারটাইম এবং মজুরির ভাগও সেভাবে নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু এবারে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রে পোশাক শিল্পের ভাগগুলো অনুযায়ী শ্রমিকদের নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করা হয় নাই। ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার পর যে সব কারণে শ্রমিকরা আন্দোলনে নেমে আসে, তাহলো-
১.মজুরি বোর্ডের ঘোষণার পর পরই মালিকদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব প্রত্যাখান করা
২.ওভারটাইমের টাকা নির্ধারণ করা
৩.খাদ্য ও যাতায়াত ভর্তুকি কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা
৪.সোয়েটার খাতের শ্রমিকদের মজুরি কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত না করা।
শ্রমিকরা মূলত এ্ই কয়েকটি কারণে আন্দোলন করে। বেসিক বাড়ানোর দাবিতে উত্তপ্ত থাকলেও ৩ হাজার টাকা থেকে বাড়ানো হয়নি। নতুন বেতন কাঠামো চিত্রটি এমন:
• বেসিক বেতন------৩০০০ টাকা
• বাড়ী ভাড়া-------- ১২৮০ টাকা
• চিকিৎসা ভাতা----- ২৫০ টাকা
• যাতায়াত ভাড়া----- ২০০ টাকা
• খাদ্য ভর্তুকি বাবদ----৬৫০ টাকা
নতুন এই মজুরি কাঠামোতে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, বেসিক যেহেতু বাড়ে নাই ফলে মাস শেষে তাদের ওভারটাইমের টাকাও কম পাবে। একজন শ্রমিক দিনে দুই থেকে চার ঘন্টা ওভারটাইম করে। প্রতি ঘন্টায় ১২ টাকা হিসেবে ওভারটাইমের টাকা দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে শ্রমিকদের কথা হচ্ছে, ওভারটাইমের মজুরি তারা পূর্বের বেতন অনুযায়ী পাবে। অন্যদিক থেকে খাদ্য এবং যাতায়াত ভাতাকে মূল বেতনের সাথে অন্তর্ভূক্তির বিষয়টি শুভংকরের ফাঁকি এবং দূরভিসন্ধি। এসব ভাতা অনেক কারখানায় এখনো কার্যকর আছে। এটি মূল বেতনে যোগ করা হলে, শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হবে। ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব ঘোষণার পর সোয়েটার কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করার কারণ সোয়েটার কারখানায় বেতন দেয়া হয় প্রোডাকশন হিসেবে। এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের দিক থেকে প্রস্তাব ছিল প্রতি পিচের মূল্য বৃদ্ধি করার জন্য। বোর্ড সেটি করে নাই, ফলে শ্রমিকদের মধ্যে এই সব বিষয়ের এখনো ঘোরপাক খাচ্ছে। শ্রমিকদের কথা না শুনে শিল্প পুলিশরা এবং আইন শৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা নিরহ, গরীব শ্রমিকদেরকে গুলি করে মেরে ফেলছে। নতুন বেতন কাঠামোতে বেসিক না বাড়িয়ে বাড়ীভাড়া, চিকিৎসা ভাতা এবং খাদ্য ভর্তূকি বাবদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এখন গেজেট আকারে প্রকাশ হবে। মজুরি বোর্ডের ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি ১লা ডিসেম্বর, ২০১৩ তারিখ থেকে বাস্তবায়িত হবে।
মজুরি বোর্ডের পরিচিতি:
অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এ কে রায়কে চেয়ারম্যান করে ৮ সদস্যবিশিষ্ট মজুরি বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডে একজন নিরপেক্ষ সদস্য, পোশাক কারখানার মালিকপক্ষ থেকে একজন, শ্রমিক পক্ষের একজন, পোশাক কারখানা মালিক পক্ষের দুইজন প্রতিনিধি রাখা হয়েছে।
১.মজুরি বোর্ডের সচিব, সালাহউদ্দিন মাহমুদ
২.আরশাদ জামাল, বিজিএমইএ-র পরিচালক
৩.সিরাজুল ইসলাম রনি, শ্রমিক প্রতিনিধি, বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি
৪.কাজী সাইফুদ্দিন আহমেদ, মালিকপক্ষের প্রতিনিধি
৫.অধ্যাপক কামাল উদ্দিন, মজুরি বোর্ডের স্বতন্ত্র সদস্য
৬.ফজলুল হক, মজুরি বোর্ডের স্থায়ী প্রতিনিধি।
মজুরি নিয়ে দর কষাকষি:
পোশাক কারখানার শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির কথা উঠলেই মালিকেরা বলেন, সর্বনাশ হয়ে যাবে। গার্মেন্ট ব্যবসা অন্য দেশে চলে যাবে। তবে এটি সত্যি যে শ্রমিকদের জীবন-যাপন ব্যয়সহ সব দিক বিবেচনায় নিয়ে মজুরি নির্ধারণ করলে শ্রমিকরা সন্তোষ্ট থাকবে, আর শ্রমিক সন্তোষ্ট থাকলে কারখানার উৎপাদনও বেড়ে যাবে। ১৯৮৫ সালে প্রথমবারের মতো ৬২৭ টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়। ১৯৯৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৩০ টাকা। ২০০৬ সালে বেতন বৃদ্ধি করে ১৬৬২.৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এরপর ২০১০ সালে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৩০০০ টাকা। এবারে মজুরি বোর্ড শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ঘোষণা করে ৫৩০০ টাকা।একজন মানুষের খাওয়া-পরা থাকা সে যত গরিবীভাবেই হোক, ৮০০০ টাকার নিচে হয় না। সেখানে শ্রমিকদের চাওয়া মজুরি খুব বেশি নয়। কিন্তু গার্মেন্ট মালিকরা মানছিল না। এ অবস্থায় শ্রমিকদের পথে নামা ছাড়া উপায় কি? শ্রমিকরা কিভাবে বাঁচবে পরিবার পরিজন নিয়ে? শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কোনো দরকষাকষির বিষয় নয়।
শ্রমিকরা মূলত রানা প্লাজা ধসে পড়া এবং তাজরীনের অগ্নিকান্ডের পর থেকে অসন্তোষ প্রকাশ করে। সেই অসন্তোষ দিন দিন আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। এরপর শ্রমিকরা মজুরি বাড়ার জন্য মালিকপক্ষের কাছে প্রস্তাব দেয়। শ্রমিকদের দাবি ছিল ৮ হাজার টাকা। আর এই ৮ হাজার টাকা বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা ৬ মে, থেকে রাস্তায় নামে। ২০১০ সালে ন্যূনতম মজুরি ছিল ৩০০০ হাজার টাকা। এবারে মালিকপক্ষ থেকে ৬০০ টাকা বাড়িয়ে ৩৬০০ টাকা নতুন মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব আসে। মালিকপক্ষ থেকে নতুন বেতন বাড়ানোর প্রস্তাব শোনার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসে। এমন পরিস্থিতিতে সুর পাল্টায় মালিকরা। তখন মালিকপক্ষ ৪৫০০ টাকা প্রস্তাব দেন। মালিকপক্ষের এই প্রস্তাব শুনে শ্রমিকরা এবার ব্যাপকভাবে রাস্তায় নামে এবং আন্দোলনের রূপ নেয়। তখন মালিকরা ঘোষণা দেন, “মজুরি বোর্ড যা নির্ধারণ করবে সেই হারেই আমরা মজুরি পরিশোধ করবো”। মজুরি বোর্ডের নতুন মজুরি প্রস্তাব ঘোষণার পর মালিকপক্ষ বললো, ‘মজুরি বোর্ডের দেয়া প্রস্তাব কোনভাবেই কাম্য নয়। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ-র প্রতিনিধিরা সাংবাদিকদের বললো, চলতি অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত তৈরী পোশাক খাতসহ রফতানি খাতের ওপর ১ দশমিক ২ শতাংশ হারে উৎসে আয় কর আরোপের প্রস্তাব করেন। তবে শেষ পর্যন্ত তা দশমিক ৮ শতাংশ ধার্য করা হয়। এই কর অত্যাধিক দাবি করে তারা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মূল্য কমে যাওয়ায় চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পোশাক শিল্প। শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৫৩০০ টাকা দিতে হলে প্রধানমন্ত্রির হস্তক্ষেপ চাই। সরকারের কাছে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে ডলারের বিশেষ মূল্য নির্ধারণের দাবি বার বার করে আসচ্ছিল মালিকপক্ষ। এবারে শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোকে পুঁজি বানিয়ে মালিকপক্ষ সরকারের কাছে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দাবি করেছে। অন্যথায় ৪৫০০ টাকা নতুন মজুরি মেনে নিতে হবে। মালিকপক্ষের এ ধরণের ঘোষণার পর ১৩ নভেম্বর শ্রম মন্ত্রণালয়-এ মালিকপ্ক্ষ, বিজিএমইএ প্রতিনিধি এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের এক বৈঠক করেছে। বৈঠকে বিজিএমইএ এবং মালিকপক্ষ শ্রম মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল যে মজুরি বোর্ডের প্রস্তাবিত ৫৩০০ টাকা মজুরি দিতে রাজি আছে, তবে মালিকদেরকে সুনির্দিষ্ট ৩টি বিষয়ে সুবিধা দিতে হবে।
৩টি সুবিধা হচ্ছে:
১.বর্তমানে শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ হারে উৎসে কর দিলেও এখন মালিকপক্ষ দিতে চাইছে মাত্র শূন্য দশমিক ২৫ শতাংশ।
২.ব্যাংকঋণের সুদের হার কমাতে হবে
৩.ইউরোপ, আমেরিকা এবং কানাডার বাজারে পোশাক রফতানিতে ২ শতাংশ নগদ সহায়তার দিতে হবে।
২০১০ সালে যখন মজুরি বাড়ানো হয়, তখনো প্রধানমন্ত্রী নীতিসহায়তার নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরই ন্যূনতম মজুরি ৩ হাজার টাকা নির্ধারণের বিষয়ে সব পক্ষ একমত হয়। এবারে ২০১৩ সালে মজুরি বোর্ড ন্যূনতম মজুরি প্রস্তাব দিয়েছে তা মেনে না নিলে আন্তর্জাতিকভাবে সরকারের সুনাম ক্ষুন্ন হতে পারে বিবেচনায় মালিকদের দেয়া ৩টি বিষয় সুবিধা দিতে রাজি হয়েছে। এর পর গার্মেন্ট মলিকপক্ষ মজুরি বোর্ডের প্রস্তাবিত ন্যূনতম মজুরি মেনে নিয়েছে। প্রথম দিকে তো মালিকপক্ষ মজুরি বাড়ানোর ক্ষেত্রে মাত্র ৬০০ টাকা বাড়ায়ি ৩৬০০ টকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো।
ন্যূনতম মজুরিতে ক্ষুব্ধ শ্রমিকরা:
শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ দরকষাকষির ভিত্তিতে হওয়া উচিত নয়। শ্রমিকদের ন্যূনতম জীবন-যাপন নিশ্চিত করবে এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নির্ধারণ করা উচিত। মালিকরা ৩৬০০ টাকার বেশি মজুরি দিতে সক্ষম নন এমন দাবি করেছিলেন। মজুরি বাড়লে তাদের মুনাফা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় মজুরি বাড়াতে চান না। অথচ মোট উৎপাদন খরচের কত শতাংশ মুনাফা করছে এর সঠিক তথ্য সরকার এবং আমাদের কাছে এখনো অজানা। ফলে মালিকরা শুধু লাভ কমছে, কমছে বলে চিৎকার করলেও তার কোন তথ্য প্রমান নাই। রানা প্লাজার ধস এবং তাজরীন গার্মেন্ট কারখানায় আগুনসহ বিভিন্ন দূর্ঘটনা মালিকদের অবহেলা এবং উদাসীনতা তারই ফল। তাই এর দায়ভার মালিকদেরই নিতে হবে। ৮ হাজার টাকা বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা ৬ নভেম্বর থেকে রাস্তায় নামে। ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে শ্রমিকরা। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে একাধিকবার আপত্তি করার পরও সেসব আমলে না নিয়ে সরকার মজুরি নির্ধারণ করেছে, এতে করে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়েছে। শ্রমিকদের কথা হচ্ছে, ‘মালিকপক্ষ যে আপত্তিপত্র দিয়েছে তা বিবেচনা করা হলো। অথচ আমরা শ্রমিকরা যে আপত্তিপত্র দিলাম তা বিবেচনায় নেয়া হলো না’। এ প্রসঙ্গে শ্রমিকরা বলেছে ‘আমাদের দাবির কাছাকাছি হলেও মেনে নেয়া যেতো। মজুরি বোর্ডের প্রস্তাবিত নতুন বেতন কাঠামো বাস্তবায়নের দাবিতে শ্রমিকরা গাজীপুর, সাভার এবং আশুলিয়া এলাকায় বিক্ষোভ এবং সড়ক অবরোধ করছে। এই পরিস্থিতিতে পুলিশের সাথে শ্রমিকদের ধাওয়া পাল্টা এবং সংঘর্ষ ঘটে। এতে করে পুলিশসহ অনেক শ্রমিক আহত হয়। ইতিমধ্যে কয়েকজন শ্রমিকের মৃত্যূও হয়েছে। পুলিশ এবং শ্রমিকদের সংঘষের ফলে গাজীপুরে কোনাবাড়ি, জরুন, কবিরপুর, জিরানী, লক্ষীপুরা, বড়বাড়ি, জামগড়া, কাশিমপুর এবং সাভারের হেমায়েতপুরে প্রায় ৮০টি পোশাক কারখানা ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। শ্রমিকদের আন্দোলনরত এলাকায় নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে শিল্প পুলিশ ছাড়াও অতিরিক্ত পুলিশ, বিজিবি এবং র্যা ব মোতায়েন করা হয়েছিল।
শ্রমিকদের ওপর পুলিশি হামলা:
ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে শ্রমিকরা। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে একাধিকবার আপত্তি করার পরও সেসব আমলে না নিয়ে সরকার মজুরি নির্ধারণ করেছে, এতে করে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়েছে। শ্রমিকদের ক্ষব্ধ হওয়ার কারণ, মালিকরা শ্রমিকদের বলেছেন, ওভারটাইমের রেট বর্তমান মজুরি অনুযাই হবে না। আগে যে ভারে ওভারটাইম পেয়েছে সেই হিসেবে পাবে। একইভাবে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে শার্ট, প্যান্ট এবং গেঞ্জি কারখানার শ্রমিকদের জন্য, কিন্তু সোয়েটার কারখানার শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় নাই। শ্রমিকদের জানানো হয় নাই কোন মাস থেকে নতুন মজুরি বাস্তবায়িত হবে। এই বিষয়গুলোর উত্তর পাওয়ার জন্য শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসলে কারখানার শিল্প পুলিশ আন্দোলনরত শ্রমিকদের ওপর কাঁদানে গ্যাস, জনকামান, রাবার বুলেট নিক্ষেপ এবং সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করে। মালিকরা আইন শৃংখলা বাহিনীকে দিয়ে নিরীহ, খেটে খাওয়া শ্রমিকদের নামে মামলা দিয়েছে। শ্রমিকরা মামলা-হামলার ভয়ে ঘর থেকে বের হতে পারছে না। এমন অবস্থায় পুলিশরা শ্রমিকদের ঘরে ঘরে ঢুকে মাইর-পিট করছে। নারী শ্রমিকদের অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করছে। অনেক শ্রমিকদের ছেলেমেয়েরা না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।
১৮ নভেম্বর গাজীপুরের কাশিমপুরে মালিকদের ভাড়া করা পুলিশ বাহিনীর বন্দুকের গুলি তরতাজা দুইজন শ্রমিকের জীবন কেড়ে নেয়। ঐ নিহত দুইজন শ্রমিকের পরিবারে এখন কেবলই কান্নার রোল। পুলিশের গুলিতে নিহত শ্রমিক বাদশার মিয়া সবে মাত্র ৩ মাস হয় বিয়ে করেছিল। স্ত্রী রূপার হাতের মেহেদীর রং মোছার আগেই স্বামীকে কেড়ে নিল পুলিশের গুলি। শ্রমিক বাদশার রোজগারে সংসার চলতো। বৃদ্ধ মা এবং সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলায় ডাঙ্গি গ্রামে রেখে বাদশা জীবন-জীবীকার তাগিদে গাজীপুরে আসে গার্মেন্ট শিল্পে কাজ করার জন্য। কিভাবে চলবে বাদশার পরিবার-পরিজন?
একইভাবে রংপুরের পীরগাছা উপজেলার মংলা গ্রামের মেয়ে নুরজাহান আক্তার রুমা। ১৮ নভেম্বর পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় রুমা। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলো রুমা। রুমা ১০ বছর ধরে গাজীপুরের শ্রীপুরে জিএমএম কম্পোজিট নিটিং কারখানায় চাকরি করতো। বাবা-মার অভাবী সংসারে সহযোগিতা করতে বড় সন্তান হিসেবে ঐ কারখানায় চাকরি নিয়েছিল। তিন বছর আগে রংপুর কাউনিয়া উপজেলার বুড়িরহাট গ্রামের বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের সঙ্গে রুমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর রুমা স্বামীসহ একই কারখানায় চাকরি করতো। রুমার স্বামীর দেয়া তথ্য থেকে জানা যায়, পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়ার পথেই রুমা মারা যায়। ফরিদপুর জেলার নিহত শ্রমিক বাদশা মিয়া এবং রংপুরের নিহত শ্রমিক রুমার মা, তাদের ছেলেমেয়ে-র হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবার আশা নিয়ে বেঁচে আছেন।
(তথ্যসুত্র: দৈনিক পত্রিকা-কালেরকণ্ঠ, প্রথম আলো, ইত্তেফাক, যুগান্তর, সমকাল এবং শ্রমিকদের দেয়া তথ্য)।
শ্রমবিকাশ কেন্দ্র, প্রতিবেদক: শাহীনুর বেগম