ক্ষোভ, আশা ও তার জবাব: শ্রমিক আন্দোলনে নারীর শক্তি বিকাশ
সীমা দাস সীমু || Wednesday 01 November 2017 ||থাইল্যান্ডের একটি পুরাতন শহর চিয়াং মাই। প্রাকৃতিক সুন্দর্যের এই শহরের Loykroh সড়কে The Centara Duangtawan Hotel এ ১৮-২১ ডিসেম্বর, ২০১৪ অনুষ্ঠিত হলো Asia pacific Regional workshop on “Women Leading, Women organising” for women trade union organisers. ট্রেড ইউনিয়নে নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিই শুধু নয় নেতৃত্বের পর্যায়ে নারীদের অবস্থান দৃঢ় করাও এই কর্মশালার একটি দিক ছিল।
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা ছিলেন-বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, মায়ানমার, কম্বোডিয়া, ফিজি, শ্রীলংকা, মালেয়াশিয়া ও পাকিস্তান এর প্রতিনিধিবৃন্দ। ২৪ জন অংশগ্রহণকারী এই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। বিস্কুট ফ্যাক্টরি, প্রিন্ট ফ্যাক্টরি, গৃহ শ্রমিক, গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশন, শিক্ষক ইউনিয়ন, কৃষি শ্রমিক ইউনিয়ন, আইনজীবি, গবেষণার কাজে যুক্ত নারী প্রতিনিধিরা তাদের নিজ নিজ দেশের শ্রমিক আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরেন।
অধিকাংশ শিল্পে বিশেষ করে ইনফরমাল সেক্টরে নারীরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে বলা যায় যে গার্মেন্টস, ইলেকট্রোনিক্স, খাদ্য ও সেবা শিল্প যেমন-গৃহকর্মে সহায়তা, শিশুর পরিচর্চা, প্রশিক্ষণ এবং নাসিং পেশায় বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নারীরাই নিয়োজিত রয়েছেন। তবুও এই নারীরাই থাকেন অবহেলিত, হয় বৈষম্যের শিকার। পুরুষ শ্রমিকের সমান কাজ করে তারা বেতন পায় কম। নারীর নেতৃত্বে শ্রম আন্দোলনের ঐতিহাসিক সাফল্য সত্বেও ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বে এমন কি ট্রেড ইউনিয়ন সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রেও নারীরা পিছিয়ে রয়েছেন।
এই কর্মশালায় শ্রমবিকাশ কেন্দ্র’র পক্ষ থেকে আমি অংশগ্রহণ করি। বাংলাদেশে গার্মেন্ট সেক্টরের শ্রমিকদের মধ্যে ৮৫% নারী যারা বর্তমানে অনেক সমস্যার সম্মুখিন হচ্ছেন তাদের কথা তুলে ধরি। দেশের রপ্তানী আয়ের সবচেয়ে বড় খাত পোশাক শিল্প। এই সেক্টরে ৪০ লাখেরও বেশী শ্রমিক কাজ করে যাদের মধ্যে বেশীরভাগ নারী শ্রমিক। সেই শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ এখনও নিরাপদ হয় নি। প্রায় ৫ হাজার পোশাক কারখানার মধ্যে অনেক কারখানায় ন্যূনতম মজুরী কাঠামো এখনও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। কারখানায় গঠনমূলক ও আইনগত ট্রেড ইউনিয়ন মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সুসম্পর্ক বৃদ্ধি করে। বিন্তু এখন পর্যন্ত বেশীরভাগ পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ নাই। পোশাক শিল্পের মালিকেরা ট্রেড ইউনিয়নকে শিল্পের জন্য ক্ষতিকর মনে করে। এখন পর্যন্ত ৪ হাজারের বেশী প্রতিষ্ঠান ট্রেড ইউনিয়নের বাইরে রয়েছে বলা হচ্ছে। ফলে শ্রমিকেরা বিশেষ করে নারী শ্রমিকেরা ট্রেড ইউনিয়নের সুযোগ থেকে হচ্ছে বঞ্চিত।
ফিলিপাইনের সেন্টার ফর ট্রেড ইউনিয়ন এন্ড হিউম্যান রাইট্স এর প্রতিনিধি ডেইজী আরাগো বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীরা নানাবিধ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের লড়াই করতে হচ্ছে। ইদানিং ট্রেড ইউনিয়নে নারীদের অংশগ্রহণ আশংকাজনকভাবে কমছে। ১৩ বছরের ব্যবধানে ২০০১ সালে যেখানে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ১৩.৩% তা কমে ২০১৪ সালে হয়েছে ৪%। আংশিকভাবে শ্রমিকেরা ইনফরমাল নিয়োগ এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পায় যেখানে শ্রমিকেরা সব সময় পারমানেন্ট নিয়োগ পায় না। ফলে শ্রমিক ইউনিয়নের অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে।
ইনফরমাল সেক্টর ইউনিয়নকে ধ্বংস করছে। সাধারণত রেগুলার এবং পারমানেন্ট শ্রমিকেরা ইউনিয়ন করার সুযোগ পায়। ফিলিপাইনে ইউনিয়নভুক্ত শ্রমিকদের মধ্যে শতকার ৩০ ভাগ নারী শ্রমিক। ইউনিয়নের শক্তি হচ্ছে সম্মিলিতভাবে দর কষাকষির অধিকার। কিন্তু মাত্র ২,৩৮,০০০ শ্রমিক ইউনিয়নভুক্ত যারা এ সুযোগ পায়। সুতরাং শ্রমিক বঞ্চনার বহু স্তর এখনও ফিলিপাইনে বিদ্যমান রয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার সেরাজেন নগরীতে অবস্থিত ইন্টার ফ্যাক্টরি লেবার ফেডারেশনের নেত্রী ডিয়ানা নভিতা কঠোর পরিশ্রম করে প্রশিক্ষণ দিয়ে এবং সাপ্তাহিক রেডিও প্রোগ্রামের মাধ্যমে তথ্য সরবরাহ করে নারী শ্রমিক ও নারী নেত্রীদের সেবা প্রদান করছেন।
প্রশিক্ষণের উপস্থাপকরা আরও উল্লেখ করেন যে ইউনিয়ন গঠনের সচেতনতা সৃষ্টি করতে পারলে এর মাধ্যমে আরও অনেক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হতে পারে।
জুডি টাগুইয়ালেক, সদস্য, এশিয়া প্যাসিফিক ফোরাম অন ওমেন, ল এন্ড ডেভেলাপমেন্ট এবং ফিলিপাইনের শিক্ষক সমিতির সভাপতি, তিনি বলেন, অর্থনৈতিক বিষয়গুলিতে শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা যেমন গুতুত্বপূর্ণ তেমনি এর মাধ্যমে শ্রমিকদের অন্যান্য অধিকার আদায়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে।
চার দিনের এই কর্মশালার একটি অংশ ছিল অংশগ্রহণকারীদের লড়াই এ সামিল হওয়ার জন্য প্রস্তুতিমূলক একটি বক্তৃতা অনুশীলন করা। বক্তৃতা উপস্থাপনার মাধ্যমে নারীরা অগ্নি ঝড়া, তেজদীপ্ত এবং আশাব্যাঞ্জক আহ্বানে সকলকে সংকল্পবদ্ধ করে। বক্তৃতা দানের অনুশীলনকে এই কর্মশালার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসাবে গণ্য করা হয়। বিষয়বস্তু গঠন, কৃষ্টি কাঠামো প্রশিক্ষণ, শ্রমিক নেতা এবং শ্রমিকদের নারী দৃষ্টিকোন থেকে বিভিন্ন বিষয় বিশ্লেষণ করার দক্ষতা বৃদ্ধি করে। একইভাবে বিষয়, ফলাফল, পছন্দ, কাঠামো অংশগ্রহণকারীদের অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিক নির্দেশনা প্রদান করে। এই কর্মশালাটি ছিল প্রথম বারের মত একটি কার্যকরী এবং বাস্তব প্রশিক্ষণ।