'আমার মাটি, আমার মা, কেড়ে নিতে দেব না'
ফরিদা আখতার || Wednesday 01 November 2017 ||হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার চান্দপুর চা বাগানের শ্রমিকদের ধানি জমি রক্ষার যে আন্দোলন চলছে তার প্রতি সংহতি প্রকাশ করে এই লেখা শুরু করছি। তবে খবরটি কেন জানি মিডিয়ায় একেবারে নীরব হয়ে আছে। ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্রেকিং নিউজের আশায় পথ চেয়ে থাকে, ক্যামেরা নিয়ে ছুটে যায় দৃশ্য ধারণ করিয়ে দর্শকদের দেখাতে। কিন্তু এর কিছুই দেখলাম না চা শ্রমিকদের আন্দোলনের ক্ষেত্রে। একটি ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার (২০ ডিসেম্বর, ২০১৫) বড় করে ছবি দিয়ে খবর করার কারণে চোখে পড়েছে। এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সদ্য ধান কাটা জমিতে নারী ও পুরুষ কৃষকরা বসে আছেন। একটি পোস্টার মাটিতে পুঁতে দেয়া হয়েছে, লেখা আছে 'চান্দপুর চা বাগানের ধান্য জমিতে স্পেশাল ইকোনমিক জোন হতে দেব না'। আরও দুইটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, নারীরা লাঠি নিয়ে বসে আছেন, পুরুষদের পাশে তীর-ধনুক। তবে ইংরেজি পত্রিকা সাধারণ মানুষ তেমন পড়েন না। তাই অনেকেরই নজরে নাও পড়তে পারে। নিউএজ, বণিকবার্তাসহ আরও দুই-একটি ইংরেজি ও বাংলা দৈনিকে খবরটি এসেছে। তবে কেন জানি প্রগতিশীল আন্দোলনের বাইরে বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া হচ্ছে না।
তবে চা শ্রমিকরা কারও পানে চেয়ে থেমে নেই। প্রায় ২৪টি চা বাগানের শ্রমিকরা একত্র হয়ে ঘোষণা দিয়েছেন, 'আমার মাটি, আমার মা/কেড়ে নিতে দেব না।' তারা বলছেন, প্রয়োজনে রক্ত দেব; কিন্তু মাটি নিতে দেব না। তারা এই মাটিতে ১৫০ বছর ধরে বংশপরম্পরায় চাষাবাদ করে আসছেন অথচ এখন বলা হচ্ছে, এখানে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে, তাই তাদের এই জমি দিয়ে দিতে হবে। এই মাটি আগে চাষের উপযোগী ছিল না। এই শ্রমিকরাই এতকাল ধরে বনজঙ্গল পরিষ্কার করে চাষ শুরু করেছেন নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য। তাদের যে অবিশ্বাস্য ধরনের কম মজুরি দেয়া হয় (অর্থাৎ মাত্র ৬৯ টাকা দিনে), তাতে সংসার চালানো কোনোমতেই সম্ভব নয়, এটা সবাই বোঝে। বাংলাদেশের নূ্যনতম মজুরির যে আইন আছে তার চেয়েও কম মজুরিতে এ শ্রমিকরা কাজ করে যাচ্ছেন। মূলধারার শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গেও তাদের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। তাই অনেকেই জানেন না যে, সকাল-বিকাল যে চা খাওয়া হয় তা উৎপাদিত হয় ভয়ানক শ্রমিক শোষণের মাধ্যমে। এই চা পানের মাধ্যমে এবং চা শ্রমিকদের আন্দোলনে নীরব ভূমিকা রেখে আমরা সবাই এই পাপের ভাগীদার হচ্ছি। তবুও চা বাগানের শ্রমিকরা নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকার পথ করে নিয়েছেন প্রায় ৬০০ একর জমিতে চাষ করার মাধ্যমে। এর মধ্যে সরকার ৫১২ একর জমি তাদের কাছ থেকে নিয়ে স্পেশাল ইকোনমিক জোন বা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ একবারও এ শ্রমিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করার প্রয়োজন বোধ করেনি সরকার। এর ফলে ১৬ হাজার চা শ্রমিকের জীবন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। সরকারকে এক সপ্তাহের আলটিমেটাম দিয়ে শ্রমিকরা এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার দাবি জানিয়েছেন। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা জানিয়েছেন, যদি দাবি পূরণ করা না হয় তাহলেই ১৬৩টি চা বাগানের শ্রমিকরা আন্দোলন যোগ দেবেন। আমরা সে দাবি সমর্থন করি। এ আন্দোলন শুধু চা শ্রমিকদের আন্দোলন হিসেবে থাকা উচিত নয়, এর সঙ্গে মানবাধিকার আন্দোলন, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন এবং ধানের জমি বা খাদ্য ফসলের জমি রক্ষার আন্দোলন জড়িত হয়ে পড়বে। এ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে কী ধরনের কারখানা তৈরি হবে তা আমরা জানি না। এ শিল্পগুলো পরিবেশের কোনো ক্ষতি করবে কিনা তা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন করা হয়েছে কিনা কেউ জানে না। আমরা শুধু এটা জানি যে, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশের প্রচলিত অনেক আইন প্রয়োগ করা হয় না। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের 'উৎসাহ' দেয়ার জন্য অনেক আইন শিথিল করা হয়। তাহলে শ্রমিক অধিকার, পরিবেশ রক্ষা কোনোটাই খাটবে বলে মনে হয় না।
বিষয়টি শুধু বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে কী হবে না তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এর ভালোমন্দ দিক বিচারের জন্যও আমি আজ লিখতে বসিনি। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পেছনে যদি বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্দেশ্য থাকে এবং সে উদ্দেশ্য সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও চা বাগানের শ্রমিকদের চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা এই জমি নিতে হবে কেন? কেন খাদ্যের উৎস থেকে তাদের বঞ্চিত করা হবে? কোন যুক্তিতে? শ্রমিকদের আশঙ্কা, এ অর্থনৈতিক জোন হলে তাদের উৎখাত করা হবে, তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও কিছু থাকবে না। তারা বঞ্চিত হবে খাদ্য উৎপাদনের জন্য, জমি ব্যবহারের অধিকার থেকে।
চা শ্রমিকরা ১৩ ডিসেম্বর থেকে আন্দোলন করছেন, কারণ এই তারিখ থেকে স্থানীয় প্রশাসন জমি মাপার কাজ শুরু করে দিয়েছে। হবিগঞ্জ প্রশাসন জানিয়েছে, চা বাগানের শ্রমিকরা প্রায় ৯৫১ একর ডানকান কোম্পানির লিজ নেয়া জমিতে শতাধিক বছর ধরে ধান চাষ করে আসছে বলে কিছু পত্রিকায় লেখা হয়েছে। তারা শ্রমিকের মজুরি এত কম দিয়ে এবং সামান্য কিছু রেশন দিয়ে রাখতে পারছে ধান চাষের এ সুযোগ থাকার কারণে। এ ধান উৎপাদন করে তারা খাদ্যের চাহিদা এবং অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে পারছে কিছুটা হলেও। কিন্তু সম্প্রতি ডানকান ব্রাদার্স ৫১১ একরের বেশি জমি ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে চুনারুঘাট উপজেলায় বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করে। তারাও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেনি। শ্রমিকরা এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। অর্থাৎ প্রশাসন ও কোম্পানি নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, অথচ যাদের খাদ্য ও জীবন-জীবিকা এর ওপর নির্ভরশীল তাদের কোনো মতামত নেয়া হচ্ছে না! এ শতাব্দীতে এসেও দাসশ্রম ভাবনা থেকে বের হতে না পারা লজ্জার। আমরা নিন্দা জানাই এমন মনোভাবের।
বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পেছনে যে তথাকথিত 'উন্নয়নের' টোপ আছে তার প্রতি অনেকেই সমর্থন দিচ্ছে এবং দেবে। তাদের কিছু যায় আসে না যদি ১৬ হাজার চা শ্রমিকের জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উন্নয়নের বলি কাউকে না কাউকে তো হতেই হবে। তা এই চা শ্রমিকরা হলেই বা অসুবিধা কী! তারা আরও যুক্তি দিচ্ছে যে, বড় কিছু পেতে হলে স্বল্প মেয়াদে কিছু ক্ষতি মেনে নিতে হয়। এখানেও এই ক্ষতি মেনে নিতে হচ্ছে কোনো মন্ত্রী-মিনিস্টারকে নয়, চুনারুঘাটের মতো এলাকার গরিব চা শ্রমিকদের। তাদের জন্য অতো মায়াকান্না কেঁদে লাভ কী? অর্থনৈতিক জোন হলে তারাও কিছু কাজ পেয়ে যেতে পারে। একটু মুড়ি-মুড়কি পেলেই হবে। কী লাভ হবে তা এখনও সবই হিসাব; কিন্তু বাস্তবে কী হবে তা নেতিবাচক দিক জানবে একমাত্র ভুক্তভোগীরাই। ইতিবাচক দিক ভোগ করবে ধনীরাই। সরকার দেশকে মধ্যম আয়ের দেশ করার জন্য হন্যে হয়ে ওঠেপড়ে লেগেছে। তারা সুন্দরবন ধ্বংস করে বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তুলছেন। সারা দেশের ৭টি অঞ্চলে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন গড়ে তুলে বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য এগিয়ে চলেছে। অথচ এ কাজ করতে গিয়েও যে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রয়োজন তাও মেনে চলা হচ্ছে না। চা শ্রমিকরা যে আন্দোলন করছেন তা মেনে নিয়ে অন্য কোনো জায়গায় এ বিশেষ অর্থনৈতিক জোন করতে অসুবিধা কোথায়?
বিদেশি বিনিয়োগ আমাদের দরকার আছে, তবে তার জন্য মানুষের অধিকার হরণ করা কোনোমতেই সমর্থন করা যায় না। অন্যান্য দেশেও বিশেষ অর্থনৈতিক জোন আছে, সেখানেও অনেক সমস্যা আছে। বাংলাদেশে আমরা উন্নয়ন চাই; কিন্তু অবিচার চাই না। মানুষের পেটে লাথি মেরে যে উন্নয়ন সে উন্নয়ন আমরা চাই না।
ফরিদা আখতার : নারীনেত্রী ও উন্নয়নকর্মী