মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিক পাঠানো কি নিরাপদ?
ফরিদা আখতার || Wednesday 01 November 2017 ||মালয়েশিয়ার সরকার বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিক নিয়োগ করবে পর্যায়ক্রমে ৩ বছরের মধ্যে। গত বছর (২০১৪ সালের জুন মাসে) এ ঘোষণা দিয়েছে মালয়েশিয়া সরকার। এতে বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে বেশ খুশি খুশি ভাব ছিল, কারণ বিদেশে শ্রমিক রফতানি কমে যাওয়ায় এমন ঘোষণা সরকারের সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছিল। তখন বলা হচ্ছিল, একমাত্র সরকারই জনশক্তি রফতানি করবে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করলে দালালদের খপ্পরে পড়ে শ্রমিকরা প্রতারিত হন। এ কথা অনেকখানি সত্য সন্দেহ নেই; কিন্তু সরকারের মাধ্যমে গেলে নিরাপদ এমন গ্যারান্টি কি সরকার দিচ্ছে? সরকারের ঘোষণার পর এবং কম খরচে যাওয়া যাবে বলে অনেকে আগ্রহী হয়েছিলেন, সেজন্য নিবন্ধীকরণের কাজও করা হয়েছিল। এ বছর জুন মাসে ঘোষণা আসে, ৫ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় নেয়া হবে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নতুন এক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, এর নাম দেয়া হয়েছে Business to Business (B2B) । বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে নেয়া হলেও এদের নাম-ঠিকানা এরই মধ্যে সরকারের সঙ্গে ১৫ লাখ শ্রমিক নেয়ার জন্য যে চুক্তি হয়েছে তার মধ্যে প্রায় ১৪ লাখ শ্রমিকের তথ্যভাণ্ডার বা ডাটাবেজ তৈরি করা হয়ে গেছে। সেই ডাটাবেজ থেকেই শ্রমিক নেয়া হবে। সরকারের সঙ্গে এই চুক্তির ধরনের নাম দেয়া হয়েছে Government to Government (G2G) Recruitment Agreement। এখন আমরা বিটুবি এবং জিটুজি’র প্রতিযোগিতা দেখব। কিন্তু কে দেবে শ্রমিকের নিরাপত্তা?
অনেক আশা নিয়ে একটি ভালো জীবন গড়ার আশায় শ্রমিকরা বিদেশে কাজ করতে যান। তারা জানেন, বিদেশে কাজ করা সহজ নয়; কিন্তু একটু ভালো বেতন পাওয়া যাবে, তা জমিয়ে পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবে। তারা জানে, সেখানে তাদের দেখাশোনার কেউ থাকবে না, তাদের স্বাভাবিক জীবন বলেও কিছু থাকবে না, তবুও যদি জীবনের কয়েকটি বছর একটু কষ্ট করা যায় তাহলে পরিবারের সদস্যরা একটু সুখের মুখ দেখতে পাবে। ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে পারবে। এ ভাবনা থেকেই বিদেশ যেতে ইচ্ছুক শ্রমিকরা বিশাল লাইন ধরে। এমনকি অবৈধ পথে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিচ্ছে তারা এক অজানা সুখের আশায়। প্রায় ৬০০ কোটি ডলার বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আসে শুধু রেমিট্যান্স হিসেবে, যা এ শ্রমিকদের খেয়ে না খেয়ে জমিয়ে রাখা টাকা থেকে পাঠানো হয়। এর সুফল পাচ্ছে দেশের অর্থনীতি; কিন্তু এ গরিব শ্রমিকদের নিরাপত্তার কথা কেউ বিবেচনা করছে না।
সরকারিভাবে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক নেয়ার জন্য চুক্তি যখন হয়েছে, তখন ভরসা পাওয়ার কথা যে, শ্রমিকদের ন্যূনতম নিরাপত্তা পাওয়া যাবে। এরা কেউ অবৈধভাবে যাচ্ছে না যে, এদের যে কোনো কাজে দেয়া হবে। সরকারের এ ব্যাপারে কথা বলতে অসুবিধা কোথায়? কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার দুই সরকারের মধ্যে চুক্তির মাধ্যমে যারা যাচ্ছে, মালয়েশিয়া সরকার তাদের এমন কাজে নিয়োগ করবে যেখানে মালয়েশিয়ার কোনো শ্রমিক কাজ করতে আগ্রহী নয়। তাদের পছন্দ নয় বলে অন্য দেশ থেকে শ্রমিক আনছে প্লান্টেশন, নির্মাণ, শিল্প এবং সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিতে। মালয়েশিয়ায় এ কর্মক্ষেত্রকে ইংরেজি অক্ষরের তিনটি ডি (3D) বলা হয়, যার অর্থ হচ্ছে ডেঞ্জারাস (বিপজ্জনক), ডিফিকাল্ট (কঠিন) এবং ডার্টি (নোংরা)। বলেছেন খোদ উপপ্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি ড. আহমদ জাহিদ হামিদি। “ÒThe government has to bring in foreign workers, including those from Bangladesh as Malaysians are not interested to work in the 3D sectorÑ ‘dangerous’, ‘difficult’ and ‘dirty’,Ñ Deputy Prime Minister Datuk Seri Dr. Ahmad Zahid Hamidi”. (Daily Express, Aug. 8, 2015).
তিনি এ কথা বলেছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদের সঙ্গে ৩০ মিনিটি বৈঠক করার পর। এখানে তিনি পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, যেহেতু মালয়েশিয়ার শ্রমিকরা এ কাজ করবে না তাই বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশসহ অন্য দেশ থেকেই শ্রমিক আনতে হবে; কারণ এ শিল্প ও ব্যবসা তো চলতেই হবে।
অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে যে শ্রমিক মালয়েশিয়ায় যাচ্ছে তারা মূলত তিন ডি বা বিপজ্জনক, কঠিন ও নোংরা কাজে যাচ্ছে, যার অর্থ হচ্ছে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছে! আগস্ট মাসের ৮ তারিখে মালয়েশিয়ার বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত খবরে এ কথা জানা যায়। এতে মালয়েশিয়ার মানবাধিকার কর্মীসহ সমাজের সচেতন মানুষ ক্ষুব্ধ হন। তাদের কথা হচ্ছে, যা মালয়েশিয়ার শ্রমিকের দৃষ্টিতে বিপজ্জনক, কঠিন ও নোংরা, তা বাংলাদেশী ও অন্য সব দেশের মানুষের জন্যও একইভাবে বিপজ্জনক, কঠিন ও নোংরা হিসেবে দেখা উচিত। মালয়েশিয়ার সরকার নিজের স্বার্থ দেখছে বলে তারা অন্য দেশ থেকে শ্রমিক এনে এ কাজ করাচ্ছে, কারণ এটা তাদের জন্য বিলিয়ন ডলার ব্যবসার কাজ। কিন্তু বাংলাদেশের জন্যও তো শ্রম রফতানি বিলিয়ন ডলার ব্যবসা। কাজেই এখানে শ্রমিকদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পাঠালে বিদেশ যাওয়ার আগ্রহ কমে যাবে। শ্রমশক্তি রফতানিতে ধস নামবে। মজার বিষয় হচ্ছে, সরকার এ ব্যাপারে তোয়াক্কা না করলেও বাংলাদেশের শ্রমিকদের মধ্যে বিষয়টি সম্পর্কে কমবেশি জানাজানি আছে। মালয়েশিয়ায় আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পরিচিতজনদের অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে, প্লান্টেশনের কাজ খুব কঠিন, তাই এ কাজ করতে বাংলাদেশের শ্রমিকরা আগ্রহী নন। এতে মজুরিও খুব বেশি নয়। তাই গত ২ বছরে ৫০ হাজার শ্রমিক পাঠানোর পরিকল্পনা হাতে নিলেও মাত্র ৭ হাজার পাঠাতে পেরেছে সরকার। তাহলে বাংলাদেশ সরকার জেনেশুনে কেন এ ধরনের চুক্তি করছে যেখানে শ্রমিকের জীবনের আশঙ্কা রয়েছে? উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশের ৬ লাখ শ্রমিক মালয়েশিয়ায় আছে।
তিন ডি’র কাজে মালয়েশিয়ার শ্রমিকদের আগ্রহ না থাকায় উপপ্রধানমন্ত্রী ড. আহমদ জাহিদ বিরক্ত হয়েছেন। তিনি মনে করছেন, এর ফলে মালয়েশিয়ায় একসময় বিদেশি শ্রমিক সংখ্যা দেশীয় শ্রমিকের তুলনায় বেড়ে যাবে মধ্যপ্রাচ্যের মতো, যেটা দেশের জন্য ভালো হবে না। তাই তারা নৌকায় করে আসা শ্রমিকদের কোনো ধরনের দয়া দেখাননি, তাদের খাওয়া বা ওষুধ কিছুই দেননি। অবৈধ শ্রমিকের ব্যাপারে তারা কঠোর অবস্থান নিয়েছেন।
মালয়েশিয়ার নির্মাণ খাত বেশিরভাগ বিদেশি শ্রমিকনির্ভর। মালয়েশিয়ার একটি শ্রমিক সার্ভেতে দেখা গেছে, (২০১০) মোট ৪৩.৭ লাখ শ্রমিকের মধ্যে ৩২ শতাংশ বিদেশি, যার বেশিরভাগ এসেছে ফিলিপাইন, নেপাল ও বাংলাদেশ থেকে। (Theantdaily, 8 Sept.2015). এখানে শ্রমিকরা নানা ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হন। অন্যদিকে মালয়েশিয়ার শ্রমিকরা অভিযোগ করে যে, বিদেশি শ্রমিকরা ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস-বি এবং টিবির মতো ছোঁয়াচে রোগ ছড়ায় এবং অনেক ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। এখানে মালয়েশিয়ার শ্রমিক ও বিদেশি শ্রমিকদের মধ্যে বিরোধ আছে।
পামঅয়েল প্লান্টেশনের কাজ বেশিরভাগ (৮৮.৭) বিদেশি শ্রমিকনির্ভর। প্লান্টেশনে ব্যাপক কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, যা শ্রমিকদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। একসময় এ কাজ মালয়েশিয়ার নারী শ্রমিকরাই বেশি করত। এ বিষয় নিয়ে পরিবেশ ও শ্রমিক সংগঠনের সমালোচনার কারণে বন্ধ হয়েছে। তাই এখন এ কাজ বিদেশি শ্রমিক দিয়ে করানো হয়। পামঅয়েলের কাজের মধ্যে পাম ফল পাড়ার কাজ খুব কঠিন। লালচে সোনালি রঙের এ ফল ৬৫ ফুট উঁচু গাছের মাথায় ধরে এবং একেকটি থোড় প্রায় ৬০ পাউন্ডের মতো ওজন হয়। এত উঁচু থেকে নামাতে গিয়ে অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। পাম গাছের কাঁটা চোখে ঢুকে যাওয়া কিংবা গাছ থেকে পড়ে গিয়ে কোম্পানি ট্রাক্টরের নিচে পিষ্ট হওয়ার ঘটনা ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া পাম গাছে পারাকোয়াট নামক নিষিদ্ধ কীটনাশক স্প্রে করতে হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। (Wall Street Journal, July 25, 2015)। পামঅয়েল প্লান্টেশন মালয়েশিয়ার জন্য খুব বড় ব্যবসা। বছরে প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের পামঅয়েল তারা রফতানি করে। অথচ এখানে স্থানীয় শ্রমিক এমনকি বিদেশের শ্রমিকও কাজ করতে আগ্রহী হয় না। তাই তাদের পাচার করা শ্রমিকের ওপর নির্ভর করতে হয়।
আল জাজিরা প্রতিবেদন Worked to Death (30 November, 2012) থেকে জানা যায়, মালয়েশিয়ায় তিন-ডি অবস্থায় কাজে দুর্ঘটনা, অসুস্থতা ও আত্মহত্যার কারণে বছরে ১ হাজার শ্রমিক মারা গেছেন। সেখানে তাদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেই, থাকার ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত এবং কোনো তদারকি নেই।
শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে কাজ করতে চান, আমরাও মনে করি শ্রমিকদের সম্পূর্ণ নিরাপত্তা দিয়ে তাদের উপযুক্ত করে পাঠানো হোক। মালয়েশিয়ার সরকার অভিযোগ করে বলে, সেখানে যে শ্রমিক যায় তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বা দক্ষ নয়। তাই তাদের অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে খুব কম বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কাজ করানো হয় এবং তিন-ডি এর মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা হয়। আর যত পারে শোষণ করে, বেতনও বেশি নয় এবং যে কাজ ঝুঁকিপূর্ণ সে কাজে নিয়োগ করে। অথচ বাংলাদেশ থেকেই প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা আছে, সেটা কেন ঠিকমতো দেয়া হয় না- এ প্রশ্ন আসতে পারে। বাংলাদেশে শ্রমিকদের গরু-ছাগলের মতো বেচাকেনা করা হয়, এ কথা একজন বাংলাদেশী শ্রমিক ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছেন। কথাটি একেবারে মিথ্যা নয়।
আমরা চাই, বাংলাদেশের শ্রমিকরা যথাযোগ্য মর্যাদা নিয়ে বিদেশ যাবেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব উভয় দেশের সরকারকে নিতে হবে। তারা এদেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রেখেছেন, তাদের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব কি সরকার নিতে পারে না? এ শ্রমিকরা কারও দয়ার ওপর যাচ্ছেন না। তারা কম হোক বেশি হোক, সরকারি মাধ্যম হোক কি বেসরকারি- টাকা-পয়সা দিয়েই যাচ্ছেন। তাদের প্রতি অমানবিক আচরণ করার বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে।