টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির কিছু চিত্র
উবিনীগ || Saturday 03 August 2019 ||দেলদুয়ারসহ টাঙ্গাইল জেলার প্রায় সব এলাকায় বেশ কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধির করনে ধলেশ্বরী ও ধলেশ্বরীর শাখা এলেংজান নদী সহ স্থানীয় কয়েকটি নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ধলেশ্বরী নদীর নিকটবর্তী লাউহাটি ইউনিয়নের পাঁচুরিয়া, স্বল্পনাড়ু, মাঝিবাড়ি, কাতুলী, পাহাড়পুর, বিলশা, দাড়িয়াপুর, হেড়ন্ডপাড়া, চর লাউহাটি, বন্নি, স্বল্পনাড়ু– ৭নং, তাঁতশ্রী দক্ষিণ পাড়া, কাতুলী, ডামখন্ডসহ ফাজিলহাটি, এলাসিন ও দেউলী ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের মধ্যে নদীর কাছাকাছি গ্রাম তারুটিয়া, স্বল্পনাড়ু, পাঁচুরিয়া, ডামখন্ড, হেরন্ডপাড়া গ্রামের অবস্থা বেশি ভয়াবহ। ঘরের ভিটামাটি, ঘরের ডোয়া ভেঙ্গে মাচার ডোলসহ নদীতে গেছে। নদীর বাঁধ ভাঙ্গনের কারনে অনেকের বাড়ি ভেঙ্গে গেছে।
নদীর পানি বৃদ্ধির করনে গ্রামগুলোর ক্ষয়ক্ষতি:
ডামখন্ড গ্রামে ৪টি গরু মারা গেছে। পাঁচুরিয়া গ্রামের ১ জন কৃষক অন্য বাড়িতে ধান সরিয়ে নেওয়ার সময় নদীর স্রোতে নৌকাসহ ধান ডুবে গেছে। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী নিয়ে কৃষকেরা বিপাকে আছেন। ২ জন গৃহস্থের ১৫/২০ টা হাঁস পানির সাথে ভেসে গেছে। অনেক খোঁজ করার পরও পাওয়া যায়নি। অনেকের ছাগল মারা গেছে। কারণ বন্যার পানিতে বাড়ি-ঘর, মাঠ ডুবে যাওয়ায় খাবার দিতে পারছে না। ফলে না খেয়েও মারা গেছে। কেউ কেউ উচুঁ এলাকায় আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে গরু-ছাগল রেখে আসছেন। রান্না বান্নার খুবই সমস্যা হচ্ছে। কেউ কেউ অন্য বাড়িতে রান্না করে আনছেন। আবার অনেকে কলা গাছের ভুর বানিয়ে, চৌকি/ চেয়ারের উপর আগলা চুলায় রান্না করছে। মানুষের স্বাভাবিক চলাফেরা ব্যাহত হচ্ছে।
ফসলের ক্ষয়ক্ষতি:
গ্রামের কৃষকদের বাড়ির আলানে-পালানে লাগানো সীম, লাউ, বেগুন, পেঁপে, ধুন্দুল, পুঁইশাক, ডাঁটা, চালকুমড়া, পেঁপে, মরিচ, ঢেঁড়শ, কলা গাছ, আদা, হলুদ মারা গেছে। বাড়ি এবং মাঠে লাগানো লেবু গাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
মাঠে আবাদ করা করলা, সীম, চালকুমড়া, পাট, লেবু বেশি ক্ষতি হয়েছে। আমন ধানের মধ্যে বড় দিঘা, দুধ কলম, হিজল দিঘা, পাটজাগ, শামুভাঙ্গা, ঢেপর, পুইটা ঢেপর, চামাড়াদিঘা, লাল ঢেপা, সাদা ঢেপা, ভাওয়াইলা দিঘা ধান বন্যার পানি এসে নদীর ভাঙ্গনে মাটিতে তলিয়ে গেছে। রোপা বি আর ২৮, বি আর ২৯, বিআর ১১, এই সব ধান ডুবে গেছে। অনেক কৃষকের পানিতে জাগ দেওয়া পাট ভেসে গেছে।
ধানের-জমি-তলিয়ে-পাতা-জেগে-আছে
বাবুপুর গ্রামের কৃষক মোঃ আক্কাছ আলী, জয়নাল শিকদার বলেন, দেউলী ইউনিয়নের বাবুপুর, আত্রাব, আলালপুর, ঝুনকাই, নয়াপাড়া গ্রাম বন্যায় ডুবে গেছে। বাবুপুর গ্রামের প্রায় ২০০ কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। বসতভিটায় আবাদ করা পুঁইশাক, ধুন্দুল, বেগুন, ঢেঁড়শ, পেঁপে, কলা, নষ্ট হয়ে গেছে। কৃষকদের মাঠে চাষ করা আমন ধান ঢেপর, দিঘা ডুবে গেছে। মাঠে চাষ করা পাট, ঢেঁড়শ, ধুন্দুল, পালংশাক, ডাঁটা পানিতে ডুবে গেছে। অনেকের পাটের জাগ ভেসে গেছে। কৃষক নূর শিকদার বলেন, ”আমার আবাদ করা ৩০ডিসিমাল জমির চাষ করা পেঁপে, ধুন্দুল ডুবে নষ্ট হয়ে গেছে”।
বেগুন ও ধুন্দুল ফসলের মাঠ নষ্ট হয়েছে
আটিয়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম নান্দুরিয়া, গড়াসিন, কান্দাপাড়া, মৌশাকাঠালিয়া, হিংগানগর গ্রামে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায় এসব গ্রামে মাঠে চাষ করা বেগুন, পাট, ধুন্দুল, ইরি ধানের জালা (চারা), আদা, হলুদ, লেবু কলা, ধইঞ্চা ডুবে গেছে। মাঠে লাগানো ধানের পাতার আগা দেখা যায়। এসব গ্রামের বাড়িতে লাগানো সবজীর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। আবাদ করা জমিতে কৃষকরা জাল ফেলে মাছ ধরছে।
ধানের-বীজতলা-ডুবে-গেছে
পাথরাইল ইউনিয়নের বিষ্ণুপুর, চন্ডি, গোপালপুর গ্রামে বন্যার পানিতে মাঠের জমি ডুবে যাওয়ায় কৃষকরা আমন ধান লাগাতে পারছেন না। কেউ কেউ ধান লাগিয়েছেন কিন্তু পানিতে ডুবে গেছে। কারো কারো ধানের জালা ডুবে গেছে। মাঠের চারিদিকে তাকালে পানি ছাড়া আর কিছু চোখে পড়ে না।
সোনাতনী এবং ঘোড়জান ইউনিয়নে বন্যায় ক্ষয়-ক্ষতি: শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ
শাহজাদপুর থানার সোনাতনী এবং ঘোড়জান ইউনিয়নে জুলাই, ২০১৯ মাসের ৫ তারিখ থেকে বন্যার পানি বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১০ জুলাই বেশির ভাগ মানুষের বাড়িতে পানি উঠে যায়। বেশিরভাগ প্রাথমিক স্কুল এবং মসজিদে পানি ঢুকে। এছাড়া রাস্তা, কারো কারো বাড়ির টিউবওয়েল পানিতে ডুবে যায়। মানুষ পানি বন্দি হয়ে ঘরের মধ্যে চকি উচুঁ করে ও টং তৈরী করে বসে আছে।
বিভিন্ন ধরনের সাপ ও পোকা মাকড়ের আতংকে পরিবারের সদস্যরা দিন কাটাচ্ছে। কেউ কেউ মাচা/ চৌকিতে চুলা পেতে রান্না করে খাচ্ছে। সারাদিনে কষ্টে একবার রান্না করছে ও অন্যন্য সময় চিড়া মুড়ি খেয়ে থাকছে। বিভিন্ন ধরনের বিপদের সময়। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সাথে নৌকা ও ভেলা ছাড়া যোগাযোগ করতে পারছে না । নদী ভাঙ্গনের কারনে অনেক ঘর বাড়ি নৌকায় করে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। বাড়ির সব জায়গায় পানি থাকায় গরু, ছাগল রাখতে অসুবিধা হচ্ছে। মাচা পেতে রাখছে। নিজের জায়গা না থাকলেও যেখানে উঁচু জায়গা আছে সেখানে গরু রাখছে। কেউ কেউ রাখার জায়গার অভাবে বিক্রি করে দিচ্ছে। গরু-ছাগলের খাবার অভাব দেখা দিয়েছে। ধানের খড়, কুড়া, চালধোয়া পানি, ভাতের মাড়, ধইঞ্চা পাতা, কলার পাতা, জিকা গাছের পাতা, গমের ভুষি খাওয়াচ্ছে। খাবার সংকট থাকায় এসব খাবার পরিমাণেও কম খাওয়াচ্ছে।
গরুর-ঘাস-নষ্ট-হয়েছে
এই ২টি ইউনিয়নের যেসব বাড়িতে পানি ঢুকেছে সেসব বাড়ির সমস্ত সবজী মারা গেছে। যেমন- মিষ্টিকুমড়া, ঢেঁড়শ, পুঁইশাক, লালশাক, ডাঁটাশাক, বেগুন, মরিচ, কচু, বরবটি, সীমের চারা, লাউয়ের চারা, পটল, পেঁপে মারা গেছে। সোনাতনী ইউনিয়নের সমস্ত মাঠের জমির ধান ডুবে গেছে। কোথাও ধানের পাতা দেখা যায় নাই। সোনাতনী ইউনিয়নে এবার কোন ধানের বীজ কৃষকের হাতে আসবে না। মাঠে ২/১টা জমিতে ধইঞ্চা, পাট দেখা গেছে।
ডুবে-যাওয়া-ধানের-জমিতে-উপর দিয়ে চলাচল করছে
ঘোড়জান ইউনিয়নের কিছু জমিতে ধানের মাথা দেখা গেছে। ক্ষতিগ্রস্থ ধানের জাতের নাম- কার্তিকঝুল, বকঝুল, হিজলদিঘা, মালভোগ, সাদাঢেপা, কালোঢেপা, কালাদিঘা, সাদাদিঘা।
ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংখ্যা: সোনাতনী ইউনিয়ন
নং | গ্রামের নাম | মোট পরিবার সংখ্যা | ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার সংখ্যা: |
০১ | বানতিয়ার | ৫০০ পরিবার | ৩০০ পরিবার |
০২ | ছোটচামতারা | ৩০০ পরিবার | ২০০ পরিবার |
০৩ | বড়চামতারা | ২৫০ পরিবার | ২০০ পরিবার |
০৪ | সোনাতনী | ১৫০ পরিবার | ১০০ পরিবার |
০৫ | ধিতপুর | ৪০০ পরিবার | ৩০০ পরিবার |
০৬ | শ্রীপুর | ৩০০ পরিবার | ২০০ পরিবার |
০৭ | কুরশী | ৪৫০ পরিবার | ৩৫০ পরিবার |
০৮ | মাকড়া | ১৫০ পরিবার | ১০০ পরিবার |
০৯ | আগবাঙলা | ২৫০ পরিবার | ২০০ পরিবার |
১০ | পাঁচবাঙালা | ২৫০ পরিবার | ২০০ পরিবার |
১১ | ভুমুরিয়া | ২০০ পরিবার | ১৭৫ পরিবার |
১২ | দাশুড়িয়া | ৩০ পরিবার | ৩০ পরিবার |
১৩ | ক্ষিদ্র দাশুড়িয়া | ১০০ পরিবার | ১০০ পরিবার |
১৪ | দৈকান্দি | ১০০ পরিবার | ১০০ পরিবার |
১৫ | বানিয়া সিংহলি | ১০০ পরিবার | ১০০ পরিবার |
নদীর পানির প্রচন্ড স্রোতের কারনে বানতিয়ার গ্রামের ৫০টি পরিবার ভেঙ্গে গেছে। এলাকার জনগণের সহায়তায় বাড়িঘর কিনারায় আনতে পেরেছেন। একইভাবে বড়চামতারা ২৫টি, ভুমুরিয়া ৪০টি, সোনাতনী গ্রামের ৩০টি বাড়ি প্রচন্ড স্রোতে ভেঙ্গে গেছে। বানতিয়ার বাজারের মাছের চান্দিসহ ১২আনা ভেঙ্গে নদীগর্ভে চলে গেছে।
ঘোড়জান ইউনিয়নে ২১টি গ্রাম এর মধ্যে বড়ঘোড়জান, হাটঘোড়জান, চরধিতপুর, বালিয়াকান্দি, কৈরট, মুরাদপুর গ্রাম বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
বীজ রক্ষণাবেক্ষণ:
বিভিন্ন ধরনের আমন ধানের বীজ আর কৃষকের কাছে নাই। এবং বন্যা পরবর্তীতে আমন ধান আর বপন করা যাবে না। এই মৌসুমে মাঠে যে বিভিন্ন ধরনের সবজী ছিল তার বীজ সংগ্রহ করতে পারে নাই। এই মৌসুমের বীজগুলোর জন্য বাজার কিংবা অন্য এলাকার কৃষকের উপর নির্ভর করতে হবে। আগামী শীত মৌসুমে সবজী বপন কিছুটা পিছিয়ে যাবে কারন মাঠের পানি দ্রত শুকাবে না। শীত মৌসুমের সবজী বীজ যার বাড়িতে পানি উঠে নাই সেখানে আত্নীয়/প্রতবিশেীর বাড়তিে রেখে আসছে।
বন্যায় মোকাবেলা :
- নৌকা ও কলার ভেলায় যাতায়াত করছেন। পুরুষেরা কাজের জন্য শহরে চলে গেছেন।
- অনেকে মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন।
- কেউ কেউ গরু, ছাগল বিক্রি করে দিচ্ছেন।
- কৃষকের সাথে আলাপ করে জানা গেছে বন্যার সময় বিভিন্ন জাতের বীজ নিয়ে কৃষকেরা শংকায় আছে। যাদের বাড়িতে পানি ডুকেছে তারা কেউ কেউ দূরে আত্মীয়র বাড়িতে বীজ রেখেছে। অনেকে বস্তায় বীজ ভরে ঘরের মটকার সাথে ঝুলিয়ে রেখেছে।
- যার বাড়ি ভঙ্গেে গছেে সে বন্যার কারনে অন্যরে বাড়তিে কয়কেদনিরে জন্য বসবাস করছ।