২২ মে, বিশ্ব প্রাণবৈচিত্র্য দিবস, ২০১৭

‘প্রাণবৈচিত্র্য ও টেকসই পর্যটন’
প্রাণবৈচিত্র্য ইংরেজীতে বায়োডাইভারসিটি (biodiversity) এখন একটি পরিচিত ও সংগ্রামী শব্দ। বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন (১৯৯২) এর সময় পরিবেশ বিপর্যয়ের নানা দিক তুলে ধরতে গিয়ে এই শব্দটির প্রচলন হয়, এটা আদি কোন ইংরেজি শব্দ নয়। বায়ো (প্রাণ) এবং ডাইভারসিটি (বৈচিত্র্য) এক করে এই শব্দটি তৈরি হয়েছে পরিবেশ কর্মীদের দ্বারা। এরপর প্রাণ ও প্রকৃতির বৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্যে International Day for Biological Diversity জাতিসংঘ ঘোষণা দিয়েছিল। প্রথমে শীতকালে দিবসটি থাকলেও ২০০০ সালে সিদ্ধান্ত হয় গ্রাষ্মকালে, ২২ মে তারিখে হবে। প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়। এবার প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে ‘প্রাণবৈচিত্র্য ও টেকসই পর্যটন’।
উন্নয়নের সাথে মানুষের জীবন যাত্রা বদলেছে, খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র সব কিছুই বদলেছে। কিন্তু সকলের অজান্তে যা হয়ে গেছে তা হচ্ছে বৈচিত্র্য সীমিত হয়ে গেছে। সারা বিশ্বে সবাই এখন মোটামুটি একই ধরণের খাবার খায়, একই ধরণের পোষাক পরে , একই ধরণের বাড়ী ঘরে থাকে। বাংলাদেশে বসে নিউইয়র্কের মতো বাড়ীঘর, আসবাবপত্র খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি চালিয়ে যাওয়াই তো উন্নতির লক্ষণ। বাংলাদেশের জীবনযাপন উন্নত নয় বলে আন্তর্জাতিক মান ঠিক করা হয়, যার মধ্যে আমাদের খাদ্য, বস্ত্র সবকিছুই বদলে যায়। রাষ্ট্রের দায়িত্ব জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের ব্যবস্থা করা। কিন্তু তা না করে প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের হুমকিতে রেখেও সরকারের কাছে গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা।
আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারবো না যে আধুনিক কৃষি এসে খাদ্যের বৈচিত্র্য কমিয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার ধানের বৈচিত্র্যের দেশে এখন মাত্র ৬০-৭০টি তথাকথিত আধুনিক জাতের ধান যা প্রধানত রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও মাটির তলার পানি নির্ভর, এখন আমাদের দেয়া হচ্ছে। এই আধুনিক জাত এতো দুর্বল ও পরনির্ভরশীল যে কোন প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ সইতে পারে না। এবার সুনামগঞ্জের হাওরে ধানের বিপর্যয়ে কৃষক সর্বস্বান্ত হয়েছে তাঢ় জনয়ে দায়ী আধুনিক বোরো ধান, বি আর ২৮ ও ২৯ এবং এর জন্যে সৃষ্ট সেই বেরি বাঁধ। অথচ এই হাওর অঞ্চলে স্থানীয় বোরো ধানের জাতের অভাব ছিল না। কমপক্ষে ২০ট জাত ছিল যা বেশি পানি হলে টিকে থাকতে পারতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাত হচ্ছে রাতা, টেপি বোরো, সাইটা বোরো, খৈয়া বোরো ইত্যাদি। এর সাথে ছিল হাওরে মাছের বৈচিত্র্য, যার সাথে জড়িয়ে আছে এই অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা ।
আধুনিক জীবন যাপনে অভ্যস্থ মানুষের খাদ্যাভ্যাস এমন যে কোন মোসুমে কি ফল এবং সব্জি হয় তা তারা জানে না। এখন ফল ও সব্জির বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। মাত্র কয়েকটি ফল সারা বছর এবং সব খানে পাওয়া যায়। যেমন কলা, পেপে, আপেল (সবুজ ও লাল), তরমুজ, কমলা, আনারস। এর সাথে দুএকটি বাড়তি থাকে কোথাও কোথাও। যে কলা বাণিজ্যিক উৎপাদনে হয় তা একমাত্র জাত নয়। বিভিন্ন দেশে কলার জাতের শত শত বৈচিত্র্য রয়েছে। অথচ মাত্র ১টি বা দুটি (সবুজ ও হলুদ রংয়ের) জাতের বাণিজিক চাষ করতে গিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে জাতগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। সারা বছরের মৌসুমি বৈচিত্র্য কমিয়ে শীতের ফসল গরমে পাওয়া যাচ্ছে বলে বাহবা কুড়াচ্ছে। যে টমেটো শীতে খাবার কথা তা এখন গরম কালেও সালাদে খাচ্ছে। বাহ। বাংলাদেশ মাছের বৈচিত্র্যের দেশ, কিন্তু বাজারে পাওয়া যাচ্ছে মাত্র কয়েক ধরণের মাছ।
প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার সাথে এবার মেলানো হয়েছে পর্যটনের ধারণা। বিশ্বে সব দেশের মানুষ ভ্রমণ করতে পছন্দ করে । টাকা জমিয়ে নিজ দেশের এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়, কিংবা অন্য দেশে চলে যায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখা অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু পর্যটনের ক্ষেত্রে প্রাণবৈচিত্র্য কতখানি গুরুত্বপুর্ণ? এটা এখনো পরিস্কার নয়। পর্যটকরা যেখানে যাবেন সেখানে যে খাবার পাওয়া যায় তা খেলে সে অঞ্চলের প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার উদ্যোগ নেয়া হোত। এখন দেখা যায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করে তারা কোকাকোলা ও বার্গার খাচ্ছে! ফলে সে অঞ্চলের খাদ্যের কোন প্রচার হোল না, এবং তা আরও বেড়ে ওঠার সুযোগ পেল না। পর্যটকরা জানতেও পারলেন না কোন জায়গার খাবার কেমন, তাদের জীবন যাপন কেমন। অন্যদিকে নগর জীবনে রেস্টুরেন্ট সংস্কৃতি হিসেবে লন্ডন, নিউ ইয়র্কে বাঙ্গালী খাবার, থাই, মেক্সিকান এমন কি বাঙ্গালী খাবারের কদর বাড়ছে। আমাদের দেশের খাবারের বৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে, অন্যদিকে তা ব্যাবসার অংশ হয়ে গেছে।
নয়াকৃষি আন্দোলনের কাজ দেখার আগ্রহ অনেকের। দেশ বিদেশের অনেক মানুষ নয়াকৃষির কাজ দেখতে টাঙ্গাইল, পাবনা (ঈশ্বরদী), কুষ্টিয়া, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায় আসেন। নয়াকৃষির এই কেন্দ্র বিদ্যাঘর নামে পরিচিত। টাঙ্গাইল রিদয়পুর বিদ্যাঘর ঢাকার কাছে হওয়ার কারণে বেশি লোকের আনাগোনা হয়। এখানে তাঁরা নয়াকৃষির কৃষকদের ধানের সংগ্রহ, সব্জি চাষ, মুরগী পালন ইত্যাদী দেখেন। সাথে তাঁতীদের তাঁত বোনা ও টাঙ্গাইলের নকশী বুটি শাড়ী যা প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে, দেখার সুযোগ হয়। ঈশ্বরদী আরশীনগর বিদ্যাঘরে সব্জি চাষ, দেশীয় গরুর জাত ও শত শত আমের জাত সংরক্ষণ দেখার সুযোগ আছে। চকরিয়া পদ্মাবতী বিদ্যাঘরে উপকুলের কৃষি, ধানের জাত এবং সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্যারাবন দেখার সুযোগ আছে। ১৯৯১ সালে ঘুর্ণিঝড়ের পর উবিনীগের উদ্যোগে মাতামুহুরী নদীর ধারে ৭ কিলোমিটার প্যারাবন লাগানো হয়েছিল যা এখন বড় বনের আকার নিয়েছে।
নয়াকৃষি ও উবিনীগ, নয়াকৃষি আন্দোলন বিদ্যাঘরে কিছু ছবি:
১. নয়াকৃষি। ২. উবিনীগ।
এগুলো দেখা এবং বোঝা এবং প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের বিষয়ে নিজ দায়িত্ব পালন করার জন্যে অনুপ্রাণিত হতে পারেন এসব এলাকা ঘুরে দেখা এবং স্থানীয় জনগোষ্টির সাথে কথা বলার মধ্য দিয়ে। ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান দেখা পর্যটনের গুরুত্বপুর্ণ বিষয়। এখানেও খেয়াল করলে দেখা যাবে রাজা, নবাব, দরবেশ কিংবা জমিদারেরাও পানির ব্যবস্থা বিভিন্নভাবে করেছেন, কৃষির জন্যে অবকাঠামো করে দিয়েছেন। দুর্ভাগ্য হচ্ছে পর্যটনের জন্যে সেই অবদানকে গুরুত্ব দিয়ে দেখানো হয়না। গাইডদের ব্যাখ্যায় ও তা অনুপস্থিত থাকে।
আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা হলে বাংলাদেশ হয়ে উঠতে পারে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান।