পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা; শ্রমিক-কর্মচারীরা পাবেন তো?
ফরিদা আখতার || Sunday 29 March 2020 ||দেরিতে হলেও গার্মেন্ট শিল্পসহ করোনার ক্ষতি মোকাবেলায় রফতানিমুখী খাতকে ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে ভাষণে এ ঘোষণা আসে। এ তহবিলের অর্থ দ্বারা শুধু শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাবে। বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়া কভিড-১৯ বৈশ্বিক মারীর প্রভাবে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানাসহ দেশের বহু গুরুত্বপূর্ণ শিল্প-কারখানা কঠিন সংকটে নিমজ্জিত হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে যারা শতভাগ রফতানির ওপর নির্ভর করেন তাদের অবস্থা কঠিন। সামনে আরো দুর্দিন হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সে কারণে তারা সরকারের কাছে বড় ধরনের ভর্তুকি তহবিল চেয়েছেন।
গার্মেন্ট শিল্পে প্রায় সবসময়ই শ্রমিকদের বকেয়া বেতনের দাবিতে আন্দোলন করতে দেখা যায়। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ সদস্যভুক্ত মালিকরা নিয়মিত শ্রমিকদের বেতন দেন এমন উদাহরণ খুব কম আছে। এখন করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক সংক্রমণের কারণে বিদেশের বায়াররা ক্রয়াদেশ বাতিল করছে। ফলে মালিকরা শ্রমিকের বেতন দিতে পারছেন না, এমন ঘোষণা দিয়েছেন অনেকেই। শুধু বিজিএমইএ নয়, বিকেএমইএ—কেউই শ্রমিকদের বেতন দিচ্ছে না। লে-অফ ঘোষণা করছে কিছু কারখানা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রমিকরা যদি কাজই করে থাকেন তাহলে তাদের বেতন দেয়ার সঙ্গে পণ্য বায়ার কিনল নাকি কিনল না, তার সম্পর্ক থাকবে কেন? বিক্রির মুনাফা কি পোশাক কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের সঙ্গে শেয়ার করেন? পুঁজিপতি যদি বিনা পয়সায় তার কোনো পণ্য কাউকে বিক্রি না করেন তাহলে শ্রমিকের শ্রমশক্তির দাম তারা কেনার সঙ্গে সঙ্গে মিটিয়ে দিচ্ছেন না কেন? ২৩ মার্চ একটি নিটওয়্যার কারখানা নোটিস ঝুলিয়ে জানিয়ে দিয়েছে এই বলে যে লে-অফকৃত শ্রমিকদের ১০ এপ্রিলের আগে বেতন দেয়া সম্ভব নয়। যুক্তি কী? বায়ারদের অর্ডার বাতিল। সরকার যদি জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ৫ হাজার টাকা প্রণোদনা দিয়ে থাকে তাহলে বায়ার পণ্য নিচ্ছেন না, যুক্তি দেখিয়ে যারা শ্রমিকের বেতন দেননি বা দিচ্ছেন না, তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বাজারের ঝুঁকি নেন বলেই পুঁজিপতি মুনাফার ভাগ পান। সেই ঝুঁকির মুখে যদি তার ব্যবসার ক্ষতি হয় তাহলে তার দায় শ্রমিক কেন নেবেন?
এর আগে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বিদেশী বায়ারদের উদ্দেশে নাগরিক টেলিভিশনের মাধ্যমে একটি ভিডিওবার্তা দিয়েছেন। তার বক্তব্য ছিল, বায়াররা যেন তাদের অর্ডার বা ক্রয়াদেশ বাতিল না করে এবং যা উত্পাদন করা হয়েছে তা যেন তারা নিয়ে নেয়। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস বিস্তারের কারণে বাংলাদেশের ১ হাজার ৮৯ গার্মেন্টের ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে। ফলে এ ফ্যাক্টরিগুলোয় ১২ লাখ শ্রমিক সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে ধারণা করা হয়। রুবানা হক তার ভিডিওবার্তায় বারবার পুরো গার্মেন্ট সেক্টরের ৪১ লাখ শ্রমিকের কথাই উল্লেখ করেছেন; তাদের কাজ হারানো, না খেয়ে থাকা, এমনকি পযধড়ং সৃষ্টি হতে পারে বলেও তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন।
এই একই সময়ে যখন স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা হলো, তখন গার্মেন্ট কারখানায় শত শত শ্রমিকের একত্রে কাজ করা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে—এমন প্রশ্ন উঠেছিল। এ যুক্তিতে বিভিন্ন শ্রমিক ও সামাজিক সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি উঠেছিল—২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত গার্মেন্ট শ্রমিকদের সবেতনে ছুটি দেয়া হোক। শ্রমিকরা কাজ না করে বাড়ি থাকবেন নিজের ইচ্ছায় নয়, সার্বিক পরিস্থিতির কারণে। কাজেই তাদের বেতন যেন কাটা না হয়। কিন্তু শ্রম মন্ত্রণালয়ে ত্রিপক্ষীয় সভা করে এসে বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক একাত্তর টেলিভিশনের এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, কোনো পোশাক কারখানায় ছুটি ঘোষণা করা হচ্ছে না। তিনি জানালেন, পোশাক শ্রমিকদের নেতারাই কারখানা বন্ধের বিপক্ষে মত দিয়েছেন। এ বিষয়ে শ্রমবিকাশ কেন্দ্র তথ্য নিয়ে জেনেছে যে সেদিনের সভায় পোশাক শ্রমিক প্রতিনিধিদের মধ্যে ২৫টি সংগঠন উপস্থিত ছিল। এ সভায় উপস্থিত প্রতিনিধিদের মধ্যে নয়টি সংগঠন পোশাক শিল্প-কারখানা বেতনসহ সাময়িক বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছিল। ১৫টি সংগঠন পোশাক শিল্প-কারখানা খোলা রাখার পক্ষে মত দেয়। যে সংগঠনগুলো পোশাক শিল্প-কারখানা খোলা রাখার পক্ষে মত দেয় তারা বলেছে, শুধু কারখানা বন্ধ দিলেই হবে না, পোশাক শ্রমিকদের চলতি মাসের মজুরিসহ ছুটি দিতে হবে। অর্থাৎ সবেতনে ছুটির কথাই তারা বলেছে। সরকার বা পোশাক শিল্প মালিকদের প্রতিনিধিদের কেউই শ্রমিকদের এ দাবি মানেননি। দেখা যাচ্ছে রুবানা হক আমাদের সঠিক তথ্য জানাননি।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান আরো এক ধাপ এগিয়ে বলে ফেলেছেন যে দেশে প্রায় ৬ কোটি ৩৫ লাখ শিল্প-কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করেন। শুধু গার্মেন্ট সেক্টরের শ্রমিকদের দায়িত্ব নিলে হবে না। দায়িত্ব নিলে সব শ্রমিকের দায়িত্ব নিতে হবে। এখন সরকারের পক্ষে এ দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়। বাহ! একজন শ্রম প্রতিমন্ত্রীর মতোই কথা বটে! যদি কভিড-১৯ সংক্রমণ জাতীয় সমস্যা হয় তাহলে সরকারকে সব শ্রমিকের দায়িত্ব নিতে হবে, শুধু পোশাক কারখানার শ্রমিক নয়। এমনকি রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, গৃহকর্মীসহ যারা কারখানাকেন্দ্রিক শ্রমজীবী নয়, দিন আনে দিন খায়, তাদের দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে। শুধু পোশাক কারখানার শ্রমিকদের দায়িত্ব নিলে চলবে না। কিন্তু সরকার দূরের কথা, মুন্নুজান শ্রম প্রতিমন্ত্রী হয়েও তা নিচ্ছেন না। এভাবে দায়িত্ব পাশ কাটিয়ে যাওয়া অন্যায় এবং বিবেচনাবর্জিত চিন্তা। অথচ মুন্নুজান একবারও ভেবে দেখেননি এই শ্রমিকদের ঘামের টাকায় তার মন্ত্রী হওয়া, তার মন্ত্রণালয় চলা সবই হচ্ছে, অথচ এখন তাদের সম্ভাব্য বিপদ থেকে রক্ষার প্রশ্নে তিনি খোঁড়া অজুহাত খাড়া করেছেন।
এ লেখা যখন লিখছি (২৭ মার্চ) তখনো অনেক গার্মেন্ট কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়নি, অনেক গার্মেন্টে বকেয়া বেতন দেয়া হয়নি। বকেয়া বেতন না দেয়া কোনো মতেই মেনে নেয়া যায় না। বর্তমানে যে লকডাউন চলছে, তাতে দিনমজুরদের কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। অন্যান্য কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করতে পারছেন না। কিন্তু গার্মেন্টে ‘বিশেষ নিরাপত্তা’ ব্যবস্থায় কাজ করানো হচ্ছে। এখন যখন সরকারের পক্ষ থেকে রফতানিমুখী শিল্প-কারখানার জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করা হলো, তখন বিজিএমইএ তাদের সদস্যদের নিজ নিজ কারখানা বন্ধ করে দিয়ে সরকারের নির্দেশ মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে। ভাইরাস সংক্রমণ এড়ানোর জন্য সবাইকে ঘরে থাকতে প্রধানমন্ত্রী যে নির্দেশনা দিয়েছেন, তা অনুসরণে যতদিন সরকারি ছুটি থাকবে, ততদিন কারখানা বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছেন রুবানা হক। এ পরামর্শের পরও কারখানা চালু রাখার কোনো যুক্তি নেই। বিশেষ ক্ষেত্রে কারখানা চালু রাখতে চাইলে শ্রমিকদের পূর্ণ স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা দিতে হবে। ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির উদাহরণ হচ্ছে চিকিত্সকদের সুরক্ষা পোশাক তৈরিতে বিজিএমইএর চলমান উদ্যোগে যুক্ত থাকা কারখানা। তারা চাইলে কারখানা খোলা রাখতে পারবে।
মূল প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রমিকের বেতনের কী হবে? এ ব্যাপারে কারখানা মালিক, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ সবসময় যে তালবাহানা করে, তাকে প্রশ্রয় দেয়া জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী কাজ হবে। শ্রমিকরা বাড়িতে থাকলেই তো হবে না, তাদের খেতে হবে। এই পেটের জন্যই তো এত খাটুনি তারা করেন। কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত বিজিএমইএর চিঠিতে এ বিষয়ে কোনো আভাস পাওয়া যায়নি।
বায়ারদের কাছে আবেদন জানানোর সময় বাংলাদেশের শ্রমিকদের প্রতি ‘মানবিক’ হওয়ার কথা বলা কপটতা বা হিপোক্র্যাসির মধ্যে পড়ে। কারখানার মালিকরা নিজেরা শ্রমিকদের প্রতি ‘মানবিক’ নন, কিন্তু আশা করেন মানবধর্ম শুধু বিদেশী বায়াররা পালন করবে। পোশাক শিল্পপতিদের বেশির ভাগই শুধু নিজেদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেন; সেটা করুন, ঠিক আছে। সেটাই পুঁজিবাদের ধর্ম। কিন্তু শ্রমিকদের জন্য মানবতার কথা বলে নিজেদের মুনাফাকারী স্বার্থ আদায় খুবই জঘন্য মানসিকতা। জাতীয় অর্থনীতিতে অবদানের জন্য আমরা পোশাক তৈরি কারখানার বড় একটি অংশের অবদান স্বীকার করি। জাতীয় স্বার্থেই তাদের প্রতি সরকার ও রাষ্ট্রের সহযোগিতা আমরা চাই। কিন্তু যারা শ্রমিকদের মাসের শেষে বেতন দেন না, বেতন বকেয়া রাখেন এবং করোনাভাইরাসের অজুহাত দেখিয়ে বেতন দিতে পারছি না বলে বিদেশী বায়ারদের কাছে কান্নাকাটি করেন, তাদের এই কপট মায়াকান্নাকে সন্দেহের চোখে দেখার দরকার আছে।
বাংলাদেশে চার হাজারেরও বেশি পোশাক কারখানায় ৪২ লাখেরও বেশি শ্রমিক রয়েছেন। এ খাত থেকে বছরে ৩০ বিলিয়নের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। সে কারণে পোশাক খাত অগ্রাধিকার পায়, গুরুত্ব পায়। কিন্তু গুরুত্বটা কে পায়? শ্রমিক নাকি মালিক? আমরা দেখেছি সরকারের নেক নজর সবসময় গার্মেন্ট-নিটওয়্যার মালিকরাই পেয়েছেন, শ্রমিকরা পাননি। তাই এবার যখন ৫ হাজার কোটি টাকা সরাসরি শ্রমিকদের কথা বলেই প্রণোদনা হিসেবে দেয়া হলো, তখন আর কোনো যুক্তিতেই শ্রমিকদের বেতন না দিয়ে শুধু দয়া করে ছুটি দিলে হবে না। বায়ারদের ক্রয়াদেশ বাতিল হোক বা না হোক, শ্রমিকদের বেতন দিয়ে দিন।
সে পর্ব এখন শেষ। গার্মেন্ট মালিকরা জানিয়েছেন, তাদের ৪ হাজার কোটি বেতন দিতে লাগে, প্রণোদনা হিসেবে দেয়া হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। আশা করি, আর কালবিলম্ব না করে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা হবে এবং সেটা যেন অবশ্যই করা হয়, তার জন্য সরকার বিশেষ নজরদারি করবে।
দৈনিক বর্ণিক বার্তা'য় প্রকাকাশিত হয় মার্চ ২৯, ২০২০
ফরিদা আখতার: নির্বাহী পরিচালক; উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)