চৈত্র সংক্রান্তি ১৪২৬
উবিনীগ || Monday 13 April 2020 ||আজ চৈত্র মাসের ৩০ তারিখ ১৪২৬ সাল (ইংরেজী ১৩ এপ্রিল, ২০২০)। বছর ব্যাপী একটা বৃত্তে ঘুরে এসে বাংলা সন আবার সেই একই বৃত্তেরই যখন আবার পূর্বানুবৃত্তি করে, তাকে আমরা বলি, সংক্রান্তি। সংক্রান্তি মানে যা শেষ তা একই সঙ্গে শুরু। বৃত্তের যে কোন বিন্দুই একই সঙ্গে শুরু এবং শেষ। সময় আমাদের বারবার ফিরে আসে, তাই আমরা এর নাম দিয়েছি ঋতু।
বর্ষের হিশাবে আমরা ঢুকছি ১৪২৭ সালে। এই দিনের বিশেষ আয়োজনে চৈত্র সংক্রান্তি পালন। বিষয়টি এমন নয় যে একটি বছর শেষ ঘোষণার জন্য, কিম্বা পরদিন নতুন বছর শুরু হচ্ছে বলে ‘নববর্ষের’ প্রস্তুতির দরকারে। চৈত্র সংক্রান্তি ঘরে ঘরে পালন করার বিষয়। মানুষের শরীর ও প্রকৃতির মধ্যে সম্বন্ধ রচনার যে চর্চা এই নদিমাতৃক সবুজ বদ্বীপে বহু দীর্ঘকাল ব্যাপী জারি আছে তাকে চেনা ও জানা খুব দরকারি কাজ। মানুষের শরীর ও প্রকৃতির সঙ্গে তার নিবিড় সম্বন্ধ যদি আমাদের জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ভিত্তি হোত, তাহলে আজ আমাদের করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ মহামারীতে ভীত সন্ত্রস্ত হতে হোত না।
মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির প্রাণবন্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত সম্বন্ধ রচনার যে চর্চা বাংলার কৃষক সমাজ হাজার বছর ধরে করে এসেছেন, সেই দিকে সকলের নজর ও মনোযোগ ফেরানোর জন্যে প্রায় দুই দশক ধরে গ্রামে গ্রামে নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষক এবং ঢাকায় প্রবর্তনার উদ্যোগে চৈত্র সংক্রান্তিতে ১৪ রকম শাক রান্নার আয়োজন আমরা করে আসছি। আমাদের দেহ বা জীবাবস্থার সঙ্গে গ্রহনক্ষত্র, গাছপালা, জীবঅণুজীবসহ সকল প্রাণ এবং অপ্রাণের সম্বন্ধ রয়েছে। এই সম্বন্ধ যেন আমরা একালে নতুন করে বুঝি, আমাদের পূর্বসূরীদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে গর্ব করতে পারি, তার জন্যই চৈত্রসংক্রান্তি উদযাপন। চৈত্রের মহাবিষুব সংক্রান্তি পালনের পেছনে যে জ্ঞানকলা, বিজ্ঞানবুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি – বিশেষত কৃষিকাজের মধ্য দিয়ে প্রাণ ও প্রকৃতির পুনরুৎপাদন ও বিকাশের অতি আবশ্যিক কর্তব্য পালনের রীতি – কোন অবস্থাতেই আমরা যেন তা ভুলে না যাই। আমাদের পূর্ব পুরুষ সব কিছুই ঠিক করেছেন, এমন রোমান্টিকতায় আমরা ভুগি না। কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতার মূল্য অপরিসীম। তার সূত্রগুলো যেন আমরা না হারাই সেটাই ছিল নয়াকৃষির সাধনা।
এবছর তেমন কিছু করা যাবে না, কারণ করোনা ভাইরাসের কারনে শহরে এবং গ্রামে মানুষ লকড-ডাউন অবস্থায় আছে, কেউ ঘর থেকে বের হতে পারছে না। তবুও বাড়ীর আশে পাশে যে অনাবাদী শাক আছে তাকে কুড়িয়ে এনে রান্না হবে আজ ঘরে ঘরে। কারণ চৈত্র সংক্রান্তির দিনে ১৪ রকম শাক খাওয়ার সঙ্গে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। বিশেষত কুড়িয়ে পাওয়া শাকে, যে শাক অনাবাদি। আবাদি ফসলের বাইরেও প্রকৃতি রাণী নিজে নিজে যা আমাদের জন্য উৎপাদন করে থাকেন।
কুড়িয়ে পাওয়া শাকের মধ্যে চৈত্রে তিতা শাক (গিমা শাক) অবশ্যই থাকা চাই। ‘চৌদ্দ’ সংখ্যাটা প্রতীকী। আসলে বেশী পাওয়া গেলে আরও ভাল। তবে চৌদ্দ রকম শাক পাওয়াই এখন কঠিন হয়ে গেছে। কিন্তু অনবাদী শাক গ্রামে মা ও বোনেরা যখন খুঁজতে বেরোয় তার মূল্য অপরিসিম। কারন এর মধ্য দিয়ে জানা যায় আবাদী ফসল আধুনিক কায়দায় করতে গিয়ে অনাবাদি ফসলের বিশাল ক্ষেত্রে কতোটা ক্ষতি আমরা করে ফেলেছি। আবাদি ফসল করতে গিয়ে প্রকৃতির ক্ষতি করবার মাত্রা দিয়ে বোঝা যায়, আমরা জীব হিশাবে এই দুনিয়ায় অন্য সকল প্রাণের জন্য বিপদ ও বালাই, নাকি আসলেই আমরা প্রকৃতির সন্তানসন্ততি। নয়াকৃষির শুরুই হয়েছে এই অনাবাদি জগতের রহস্য বোঝার তাগিদ থেকে।
আমাদের কৃষকরা আদিকাল থেকেই এটা বুঝতেন। এখনও নয়াকৃষিতে সেই কৃষকরাই ঐক্যবদ্ধ যারা কৃষিকে তাদের জীবনের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত বিষয় হিশাবেই বিবেচনা করেন। তাদের জ্ঞানচর্চার ধারা ধরে রাখার জন্যই চৌদ্দ রকম শাক তোলা ও খাওয়ার রীতি আমরা ঘটা করে করি। চৈত্র সংক্রান্তিতে চৌদ্দ রকম শাক খাওয়া তো আসলে সব রকম গাছপালা প্রাণ ও প্রাণীর হালহকিকতের খোঁজ নেওয়া। এটা নারীর সূক্ষ জ্ঞান চর্চাও বটে। তাঁরাই অনাবাদী শাকশব্জির হদিস রাখেন। এই জ্ঞান নারীদের মধ্যে মা থেকে মেয়ে, নানী-দাদী থেকে নাতনী, পাড়া প্রতিবেশী ভাগাভাগি করে শেখে।
চৈত্র সংক্রান্তি হচ্ছে প্রকৃতি ও গ্রহ নক্ষত্রের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ ঝালিয়ে নেবার দিন। আমরা জীব হিসাবে বিশ্বপ্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নই এটা উপলব্ধি করা, জানা এবং সেই উপলব্ধিকে চরিতার্থ করবার জন্যই নানান আচার, উৎসব ও উদযাপন। খাদ্য ব্যবস্থা তার অন্যতম দিক। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে বিশেষ বিশেষ খাবার পরিকল্পিত ভাবে খাওয়া নিয়ম। এই দিন প্রাণীজ আমিষ নিষিদ্ধ। তাছাড়া আবাদি ফসল আমরা তো সারা বছরই খাই, চৈত্র সংক্রান্তিতে তাই অনাবাদি শাকশব্জি খাওয়াই রীতি; অর্থাৎ চাষের শাকশব্জি না, বরং কুড়িয়ে এনে চৌদ্দ রকমের শাক এবং চৈতালি মৌসুমের সবজি, পাতা, মুড়া ইত্যাদি খেয়ে চৈত্র সংক্রান্তি পালন করতে হবে।
এটা তাহলে পরিষ্কার গ্রামীণ জনগোষ্ঠির কাছে সাংস্কৃতিক ও ভাবগত তাৎপর্য ছাড়াও চৈত্র সংক্রান্তির সঙ্গে জীবন যাপনের সম্পর্ক অনেক গভীর। একটি বছর যখন পার হয়ে যায়, আবার বছর ঘুরে আরেকটি বছর ফিরে আসে, তখন সবকিছুই একই রকম থেকে যাবার কথা না। হবার কথাও নয়। যেহেতু আমাদের গ্রামীণ পরিবেশ ও জীবের জীবন মূলত কৃষির সাথে যুক্ত, তাহলে কৃষির পরিবর্তনের সাথে আমাদের চাষাবাদে ও খাদ্যব্যবস্থায় কিছু না কিছু পরিবর্তন হবার কথা। তাই প্রকৃতির সঙ্গে সারা বছর কী আচরণ করলাম তার বিচারের দিন চৈত্র সংক্রান্তি। প্রতিবছর কৃষির অবস্থা এক থাকছে না। আবাদ করার অর্থ আমাদের প্রয়োজন ও চাহিদা মেটাবার জন্য প্রকৃতিতে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যা থাকবার কথা তার বদলে নিজেদের চাহিদা মেটাবার জন্য খাদ্য উৎপাদন। চৈত্র সংক্রান্তিকে তাই বলা যায় সারাবছর ব্যাপী আবাদি ফসলের কারণে অনাবাদি প্রকৃতির ক্ষয়ক্ষতি নিরূপনের দিন। সেই জন্যই চৈত্র সংক্রান্তিতে আলান পালান জঙ্গল মাঠ পতিত জমি থেকে লতা পাতা শাকশব্জি কুড়িয়ে খাবার বিধান। কোন জাত বা প্রজাতির অভাব ঘটলে কৃষক নারী বুঝতে পারে কৃষি চর্চায় একটা দোষ ঘটেছে যার সংশোধন দরকার। চৈত্র সংক্রান্তি কৃষির ভুল সংশোধনের দিন।
করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) নিষ্ঠুর সংক্রমণ মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে, মানুষের শরীর দুর্বল হলে, তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকলে কোভিড-১৯ সোজা শ্বাস যন্ত্র ধ্বংস করে দিয়ে মানুষ মারে। সারা পৃথিবীতে লাখে লাখে মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে এবং মারা যাচ্ছে। ধনি দেশে যেখানে কৃষি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, প্রকৃতিকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলেছে, প্রাণ বৈচিত্র বলতে কিছু রাখে নি, সেখানে কোভিড-১৯ এর আক্রমণ ভয়াবহ।
বাংলাদেশে আমরা এখনো অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে আছি। আমাদের কৃষি এখনও পুরাপুরি কৃষকের হাত থেকে ছুটে যায় নি। কিন্তু আমরা কি বহুজাতিক কর্পোরেশান ও আধুনিক নগরায়নের ভ্রান্তি ও ভুল পথ পরিহার করতে পারব? আমাদের নারী কৃষকরা এখনও নিজেদের মতো করে তাদের চর্চা বজায় রেখেছেন এবং গাছ-গাছালি, ফসল রক্ষা করে চলেছেন। আমরা কি নারীর এই জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ক্ষমতার জায়গা গুলো থেকে কিছু শিখব? আমাদের নদীর পানি কি বিশুদ্ধ থাকবে? আমাদের পলি কি উর্বরতা কি ধরে রাখতে পারবে?
সেটা নির্ভর করবে কোভিড-১৯ মহামারির বিপরীতে আমরা আমাদের হারিয়ে যাওয়া প্রজ্ঞা কতোটা আবার আত্মস্থ করতে পারি।
পৃথিবী ‘মানুষ’ নামক প্রাণীর ভোগের জন্য নয়, এটা সকল প্রাণের আবাসস্থল। এই গোড়ার শিক্ষাটা এবার যেন আমরা চৈত্র সংক্রান্তিতে বারবার আওড়াই।
নতুন বছর ১৪২৭ আসছে। শুভ হোক।