হারভেস্টার বেচা হলো, কৃষি শ্রমিকের জন্য কী?
ফরিদা আখতার || Tuesday 05 May 2020 ||বাংলাদেশে বোরো ধান কাটার সময় কৃষি শ্রমিক সংকট ও উচ্চ মজুরি নিয়ে কথা হয়। এটা নতুন নয়। কিন্তু এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয় আজ পর্যন্ত কোনো সমাধান নিয়ে আসতে পারেনি। অর্থনীতিবিদদের তরফে কোনো অর্থপূর্ণ আলোচনা দেখিনি। দুঃখজনকভাবে শিল্প ও কৃষি খাতের ভারসাম্য ও সম্পর্ক বজায় রেখে জাতীয় উৎপাদন ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়নি। সেটা মারাত্মক হয়েছে ‘উন্নয়ন’ সম্পর্কে আমাদের কিছু বদ্ধমূল ধারণার নামে। যেমন কৃষি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে চকচকে নগরে পরিণত করাই উন্নয়ন। নগরায়ণই সভ্য হওয়ার পথ। ফলে দেশের অর্থনীতিতে কৃষির অবদান (জিডিপির) ১৯৯০ সালে ৩৮ শতাংশ থেকে ক্রমাগতভাবে কমে ২০১৮ সালে ১৩ দশমিক ৭ শতাংশে নেমেছে। প্রয়োজনীয় মনোযোগ এবং সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কৃষি খাত নিয়ে সরকার বিক্ষিপ্ত ও সমন্বয়হীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যা আত্মঘাতী হতে বাধ্য।
তেমনি একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বোরো ধান কাটাকে কেন্দ্র করে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে (৩০ এপ্রিল, ২০২০) বলেছেন, ধান কাটার সময় শ্রমিক সংকটের সমস্যা থেকে কৃষকদের রক্ষা করতে মেশিন আমদানির পরিকল্পনা করছেন। তিনি আরো জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে এই ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, তিনি কোন স্টাডি বা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে বুঝলেন যে এতে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? পরিবেশের ক্ষতির কথা না-হয় বাদ রাখলাম। বাংলাদেশে কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সঠিক পথ কী হবে সে সম্পর্কে আমাদের প্রচুর গবেষণা ও বিশ্লেষণের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু একজন মন্ত্রীর সিদ্ধান্তে এসে গেল কৃষি মেশিন! এটা অবিশ্বাস্য!
মন্ত্রী বলেছেন, ‘প্রতি বছর রাজস্ব খাতে ৯ হাজার কোটি টাকা রাখা হয় শুধু কৃষি খাতের যেকোনো প্রয়োজন মেটানোর জন্য। সেখান থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা লাগে সার ও অন্যান্য কারণে। অর্থাৎ সেটাও যায় ব্যবসায়ীদের কাছে। বাকি ৩ হাজার কোটি টাকা দিয়ে ধান কাটার মেশিন কেনার ব্যাপারে খোঁজ নিতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। সেগুলো কৃষকদের কাছে নামমাত্র মূল্যে দেয়া হবে। কারা সেই কৃষক, যারা ধান কাটার মেশিন কিনতে সক্ষম? প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে আগামী বছরই এটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে।
অথচ ১২ এপ্রিল গণভবনে বরিশাল ও খুলনা বিভাগের সব জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকরা বেকার রয়েছেন বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত কৃষি শ্রমিক যাতে যেতে পারেন, সেজন্য তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি পরিষ্কার বলেছেন, ‘মজুরের অভাবে ধান কাটা যেন বন্ধ না হয়। কৃষি শ্রমিকরা যেখানে যান, সেখানে যেতে দিতে হবে। তারা যেন এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গিয়ে ফসল কাটতে পারে, তার সুযোগ-সুবিধা করে দিতে হবে। কোনো ফসল যেন নষ্ট না হয়। উৎপাদন অব্যাহত রাখতে হবে।’ তাহলে মাস না যেতেই শ্রমিকের ব্যবহার কমে যায় এমন মেশিন এনে ধান কাটার নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এসেছে নাকি যারা এই মেশিন বিক্রি করতে না পেরে বসে ছিলেন, তারাই পরিস্থিতি সেভাবে সৃষ্টি করেছেন?
আমরা জানি, কভিড-১৯-এর এই কঠিন পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে লকডাউনের কারণে গণপরিবহন চলাচল না থাকায় কৃষি শ্রমিকরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারছেন না। সে কারণেই কৃষকরা শ্রমিক পাচ্ছেন না। সরকার এরই মধ্যে এ বিষয়ে শ্রমিকদের আনার ব্যবস্থা করার ঘোষণাও দিয়েছিল এবং হাওড় অঞ্চলে বেশকিছু বাসে করে শ্রমিক এনে কাজও শুরু হয়েছিল জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতায়।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ব্রি) গবেষণায় দেখা যাচ্ছে হাওড়ের ৫০ শতাংশ জমি সমতলে এবং ৫০ শতাংশ জমি মূল হাওড়ের ৯ লাখ হেক্টর জমি কাটতে শ্রমিকের প্রয়োজন প্রায় ৮৪ লাখ। কিন্তু সেখানে ১৫ লাখ (১৮%) শ্রমিকের ঘাটতি আছে, যা অনায়াসে এ সময় অন্যান্য বেকার মানুষদের দিয়ে সমাধান করানো যায়। কিন্তু সেই অর্থ আমরা মেশিন কোম্পানির হাতে তুলে দিচ্ছি।
কৃষি শ্রমিকদের পাশাপাশি এ দেশের ক্ষুদ্র কৃষকদের কথাও আমাদের ভাবতে হবে। কারণ কৃষি যান্ত্রিকীকরণের বিষয়টি শুধু এ বছর বোরো ধান কাটার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না, এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে আমাদের কৃষকদের ওপর। আগেই বলেছি বাংলাদেশের সার্বিক অর্থনীতিতে কৃষির অবদান ক্রমেই কমে আসছে। তবুও যেটুকু আছে, তা মূলত টিকিয়ে রেখেছেন আমাদের দেশের ক্ষুদ্র কৃষকরাই, যারা মোট কৃষি পরিবারের ৮০ শতাংশের বেশি। ২০০৮ সালের কৃষিশুমারি অনুযায়ী মোট কৃষি পরিবারের প্রায় ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ কৃষি শ্রমিক পরিবার, কৃষি শ্রমের ওপরই তাদের আয় নির্ভর করে। কাজেই কৃষি পরিবারের সংখ্যা জানা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কৃষি শ্রমের ওপর নির্ভরশীল পরিবারের সংখ্যাও জানা দরকার, যা প্রায় ৮৭ লাখেরও বেশি। অর্থাৎ তাদের সংখ্যা গার্মেন্ট শ্রমিকের (৪৫ লাখ) চেয়েও বেশি। তারা ফসলের মৌসুমে ভালো আয় করতে পারেন, কিন্তু অন্য সময় তাদের অকৃষি কাজ যেমন ভ্যান, রিকশা চালানো ইত্যাদি চালাতে দেখা যায়। একটি বড়সংখ্যক কৃষি শ্রমিক ঢাকা শহরে এসে রিকশা চালান, আবার মৌসুমে গ্রামে গিয়ে ধান কাটেন। তাদের প্রতি সরকারের বা নীতিনির্ধারকদের কোনো নজর নেই।
মনে হচ্ছে সরকারের কাছে কৃষি বলতে শুধু মাঠের ফসলকেই বোঝানো হচ্ছে। মাঠে এখন বোরো ধান আছে, অতএব বোরো ধান কেটে আনতে হবে—এটাই কৃষির জন্য সরকারের ব্যবস্থা। বোরো ধান অনেক কৃষকের জন্য বছরের মূল ফসল। কাজেই একদিকে ধানের উৎপাদন যেমন গুরুত্বপূর্ণ, অন্যদিকে বিশালসংখ্যক কৃষক, যারা ধানের সঠিক মূল্য পান না, তাদের উৎপাদন খরচও ওঠে না, তাদের সহায়তার কোনো পরিকল্পনা এখনো নেয়া হয়নি। বলা হয়, কৃষি লাভজনক নয় বলে ক্ষুদ্র কৃষকরা কৃষি থেকে সরে আসছেন; কিন্তু ক্ষুদ্র কৃষক তবুও অন্য কোনো উপায় না দেখে কৃষিকাজেই থেকে যান, কিন্তু মধ্যম ও বড় চাষীরাও লাভজনক না হলে কৃষিতে থাকতে চান না। একদিকে দিনে দিনে উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে ধানের ন্যায্য দাম পাওয়ার জন্য সরকারের কোনো নীতি নেই, যা আগে থেকেই কৃষককে কৃষিতে লেগে থাকার নিশ্চয়তা দিতে পারে। এ অবস্থায় বর্গাচাষীরাও বর্গায় জমি নিতে সাহস পান না। পত্রপত্রিকায় বলা হচ্ছে কৃষি শ্রমিকরা শহরে যাচ্ছেন ‘ভালো আয়’ করার জন্য। একথা পুরোপুরি সত্য নয়। কৃষক বা কৃষি শ্রমিকের যে দক্ষতা, তাতে তারা বড়জোর গতর খাটিয়ে রিকশা, ভ্যান গাড়ি, ঠেলা গাড়ি চালাতে পারেন। তাতে যে আয় হয়, সেটা কি দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা করার মতো? তাছাড়া নগরায়ণের যে পরিকল্পনা করা হচ্ছে, মেট্রোরেল ইত্যাদির পর শহরে রিকশা-ভ্যান থাকবে কিনা, সেটাও দেখার বিষয়।
এমন পরিস্থিতিতে আমরা দেখছি একশ্রেণীর কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবসায়ী মুনাফার সুযোগ নিয়ে নিচ্ছেন এবং তারা তা কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই করছেন। এই আচরণ এর আগেও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় দেখেছি। যেমন ১৯৯৮ সালের বন্যার পর হাইব্রিড ধান আলোক-৬২০১ দেয়া হলো, যা পরবর্তী কালে ব্র্যাক কৃষককে ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে গছিয়ে দিলেও তারা নেয়নি। এবার কভিড-১৯ মোকাবেলায় কৃষি খাতে সরকারের যে ভর্তুকির ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তার সুবিধা নিতে চান যন্ত্র ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে জাপানি ও চীনা কোম্পানি এবং এসিআই মোটরসের মতো বহুজাতিক কোম্পানি। জাপানি একটি কম্বাইন্ড হারভেস্টার ২৮ লাখ টাকায় কিনলে সরকার ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দিয়ে তার দাম হবে ১৪ লাখ টাকা। চীনা কোম্পানির ব্র্যান্ডের দাম ২০ লাখ টাকা, সরকার দেবে ১০ লাখ। এসিআই মোটরস এরই মধ্যে টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করেছে। একটি দৈনিকের খবর হচ্ছে, ‘সরকার কৃষির যান্ত্রিকীকরণে ২০০ কোটি টাকার ভর্তুকি দিচ্ছে। প্রথম পর্যায়ে ১০০ কোটি টাকা মোটামুটি কৃষক পর্যায়ে চলে গেছে। বাকি ১০০ কোটিও ছাড় করা হয়েছে।’ এই টাকা কৃষকের হাতে নয়, ভর্তুকির এই সুবিধা হিসেবে পাবে কোম্পানি।
এই হারভেস্টার মেশিন যদি আসলেই কৃষকের জন্য উপকারী হতো তাহলে এর বিক্রি স্বাভাবিক সময়ই বাড়ত, কারণ কৃষি শ্রমিক সংকট তো সবসময় ছিলই। অথচ এবার এই দুঃসময়ে এ ধরনের কৃষিযন্ত্রের বিক্রি বেড়ে গেল ৪০০ গুণেরও বেশি। পত্রিকার খবরে জানা যায়, ২০১৯ সালে শীর্ষ দুটি কোম্পানি মাত্র ৪০টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার বিক্রি করেছিল, কিন্তু এ বছর তা এক হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। যাদের এই মেশিন পড়ে ছিল তাদের মজুদ হারভেস্টার বিক্রি প্রায় শেষ! ভর্তুকির নগদ সুবিধা আর কোনো খাতে এত আনন্দ দিয়েছে বলে আমার মনে হয় না। এতে হারভেস্টারের প্রতি নজর ঘুরে গিয়ে কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণের বড় বড় তত্ত্ব-উপাত্ত হাজির হয়ে যাচ্ছে এবং শ্রমিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের দিক থেকে দৃষ্টি সরে যাচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয় কি শুধু সার-কীটনাশক-যন্ত্র ব্যবসায়ীদের জন্য?
তাহলে দেখা যাচ্ছে এখানে সরকারের দ্বৈত নীতি কাজ করছে, একদিকে শ্রমিক যেন বেকার না হন তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, অন্যদিকে শ্রমিক কমানো মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন অবস্থায়ও আনুষ্ঠানিকভাবেই হারভেস্টার মেশিন দেয়া হচ্ছে। সস্তা শ্রম বলে গার্মেন্ট শ্রমিকদের শহরে এনে কাজ করানো হচ্ছে, অন্যদিকে কৃষি শ্রমিকের বেলায় মেশিনের চিন্তা হচ্ছে।
হারভেস্টার কেনা ও তার জন্য ভর্তুকি দেয়া সরকারের ভুল নীতি। বিপর্যয়ের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা ফাঁদা অনৈতিক। দরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সঠিক নীতিনির্ধারণের জন্য সঠিক গবেষণা ও বিশ্লেষণ। বিশেষত সেই বিশ্লেষণে তিনটি বিষয় বিবেচনায় রাখতে হবে। কৃষি শ্রমিকদের কাজ ও যথার্থ মজুরি নিশ্চিত করা, কৃষকের ফসলের দাম নিশ্চিত করা এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের ওপর জীবাশ্মভিত্তিক ভারী যন্ত্রপাতির কুফল বিবেচনা করা।
লেখাটি প্রকাশিত হয় দৈনিক বণিক বার্তা ৫ মে ২০২০
ফরিদা আখতার: নারী নেত্রী
নির্বাহী পরিচালক, উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)