দিল্লীর কৃষকদের কাছে থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয় কী?
ফরিদা আখতার || Thursday 10 December 2020 ||যদিও দিল্লিতে তিনটি রাজ্যের কৃষকরা এসেছেন, তার মানে এই নয় যে ভারতের অন্য রাজ্যের কৃষকরা এই তিনটি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন না। আসলে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতবর্ষে। দিল্লিতে সকলের পক্ষে আসা সম্ভব নয়। দিন যতই যাচ্ছে এবং সরকারের অনমনীয় আচরণের কারণে কৃষকদের প্রতি সমর্থনও বাড়ছে। বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলও কৃষকদের দাবি সমর্থন করছে।
The Business Standard বাংলা টিবিএস প্রকাশিত ১০ ডিসেম্বর ২০২০
কন কনে শীতের মধ্যে এবং দিল্লিতে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সংখ্যা বেশি জেনেও লক্ষ লক্ষ কৃষক, নারী-পুরুষ মাইলের পর মাইল হেঁটে, কেউ ট্রাক্টরে করে পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তর প্রদেশ থেকে দিল্লীর কাছে সিঙ্গুর বর্ডারে ১২ দিন ধরে বিক্ষোভ করছেন। পুলিশ তাদের আটকাবার জন্যে ব্যারিকেড দিয়েছে, রাস্তা খুঁড়ে রেখেছে, কিন্তু কিছুতেই এই কৃষকদের রুখতে পারে নি সরকার। তারা তাঁদের দাবীতে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি আইনের বিরোধিতায় অটল রয়েছেন। তাঁদের দাবি একটাই, সরকার নতুন যে তিনটি কৃষক বিরোধী আইন করেছে তা তুলে নিতে হবে।
যদিও দিল্লিতে তিনটি রাজ্যের কৃষকরা এসেছেন, তার মানে এই নয় যে ভারতের অন্য রাজ্যের কৃষকরা এই তিনটি আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন না। আসলে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতবর্ষে। দিল্লিতে সকলের পক্ষে আসা সম্ভব নয়। দিন যতই যাচ্ছে এবং সরকারের অনমনীয় আচরণের কারণে কৃষকদের প্রতি সমর্থনও বাড়ছে। বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলও কৃষকদের দাবি সমর্থন করছে।
পাঞ্জাব ও হরিয়ানা সবুজ বিপ্লবের সুচনা করেছিল, কিন্তু সেখানকার কৃষক আজ আর ভাল নেই। বাংলাদেশে যারা নির্বিচারের সবুজ বিপ্লবের পক্ষে বলেন, পাঞ্জাবের অভিজ্ঞতা তাদের জন্য শিক্ষণীয়। এই রাজ্যের কৃষকের আয় শহরের অদক্ষ শ্রমিকের আয়ের চেয়েও কম, এবং কৃষিতে টিকে থাকতে হলে সবুজ বিপ্লবের প্রযুক্তি দিয়ে আর হবে না। ফলে এই কৃষকরা সরকারের নতুন আইনে আরো ক্ষতিগ্রস্ত হবেন বলে তারা প্রতিবাদে নেমেছেন। তারা দিল্লীর কাছাকাছি হওয়ার কারণে "দিল্লী চলো" কর্মসচীতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তবে দিল্লীর কাছে এসে যখন তারা অবরোধে বসলেন তাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন অনেকেই। এই কৃষকদের খাইয়েছে বিভিন্ন মসজিদ এবং গুরুদুয়ার। কৃষকরা নিজেরাও রাস্তার ওপরই বসে রান্না করে খেয়েছে।
গত ২৭ সেপ্টেম্বর মাসে তিনটি কৃষি আইন ভারতের রাজ্য সভায় পাশ হয়েছে। এই তিনটি বিল হচ্ছে:
১. কৃষকের উৎপাদন ব্যবসা ও বাণিজ্য (প্রচার ও সুবিধাদি) বিল,২০২০ (Farmer's Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Bill, 2020), এর মাধ্যমে কৃষকরা বিভিন্ন এগ্রিবিজনেস কোম্পানি, পাইকারী ব্যবসায়ি, রপ্তানীকারক কিংবা বড় রিটেইলারের সাথে করে সরাসরি ব্যব্বসা করতে পারবে।
২. কৃষকদের (ক্ষমতায়ন এবং সুরক্ষা) মূল্য আশ্বাস এবং খামার পরিষেবার চুক্তির বিল, ২০২০ (the Farmers (Empowerment and Protection) Agreement of Price Assurance); এর মাধ্যমে আগাম-মূল্য নির্ধারণ করে চুক্তি-ভিত্তিক চাষ ব্যবস্থা আইনসিদ্ধ করা হবে এবং
৩. অত্যাবশ্যক পণ্য (সংশোধনী) বিল, ২০২০ The Essential Commodities (Amendment) Bill 2020, এর আওতায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকা থেকে খাদ্যশস্য, ডালশস্য, তৈলবীজ, পেঁয়াজ এবং আলু জাতীয় পণ্য সরিয়ে নেওয়া হবে এবং নির্দিষ্ট কিছু কৃষি পণ্য মজুত রাখার উর্ধ সীমা তুলে দেওয়া হবে।
এই তিনটি বিলের সারকথা হচ্ছে রাষ্ট্র কৃষিতে নিউলিবারেল অবাধ বাজার ব্যবস্থাকেই আইন করে কায়েম করল। এমনই যেন কেন্দ্রীয় কৃষি ও কৃষি কল্যাণ মন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমর কৃষকদের বাজারে ছেড়ে দিয়ে বলছেন, যাও বাছা তোমরা যার যার ফসল নিয়ে যেভাবে পারো "স্বাধীনভাবে" বিক্রি করো, সরকার তোমাদের দায়দায়িত্ব আর নেবে না। ভারতে দীর্ঘ দিনের প্রচলিত ফসলের নূন্যতম সহায়ক মূল্য (এমএস পি) কৃষকদের এক ধরণের সুরক্ষা দিতো, তারা তাদের ফসল বিক্রি করে ন্যূনতম মূল্য পাওয়ার নিশ্চয়তা পেতো। শিল্প ও নগরায়নের স্বার্থে কৃষি ও কৃষকের প্রতি যে কাঠামোগত অবিচার আরোপ করে রাখা হয়, তার কিছুটা সুরাহা হোত। কিন্তু নতুন তিনটি বিল এমনভাবে করা হয়েছে যে কৃষকদের "স্বাধীন" বা মুক্ত করার নামে আসলে বড় বড় কোম্পানির কাছে বন্দি বা হাওলা করে দেয়া হয়েছে। কৃষকরা এসব আইনের অর্থ বোঝেন, তাই তারা এর ঘোরতর বিরোধিতা করছেন। তাঁদের অভিযোগ দেশের কৃষি ক্ষেত্রে এবং ফসল বিপণন ব্যবস্থা গুটিকয় কর্পোরে্ট কোম্পানির হাতে তুলে দিতেই এই সব আইন বানানো হয়েছে।
তিনটি বিলের আওতায় কৃষক আর 'মান্ডি'((mandi) বা বিদ্যমান কৃষিপণ্যের পাইকারি বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে বেচাকেনা না করে সরাসরি অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বা কর্পোরেশনগুলোর সাথে প্রতিযোগিতামূলক দামে বিক্রি করতে পারবেন। কিন্তু কৃষকরা বলছেন মান্ডি ব্যবস্থার মাধ্যমে বিক্রিতে অনেক সমস্যা থাকলেও তারা কৃষকের স্বার্থ বোঝে। অতএব মান্ডির ব্যবস্থাপনা ঠিক করা হোক, কিন্তু বড় বড় কোম্পানির সাথে তাদের ব্যবসা কখনোই সমপর্যায়ের হবে না।
ভারতে যারা নতুন কৃষি বিলের বিরুদ্ধে কৃষকের বিক্ষোভের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন তাদের বক্তব্য পড়ে বোঝা যায় এই তিনটি বিলের একটিতেও এতোদিনের কৃষকদের সমস্যার প্রেক্ষিতে যেসব ব্যবস্থার নেয়ার কথা ছিল তার কোন সুরাহাই হয় নি। বরং উলটা কৃষকদের নতুন সমস্যার মুখোমুখি করে দেয়া হয়েছে। কৃষি বিষয়ক এক্টিভিস্ট, কবিতা কুরুগান্তি বলছেন ফসলের নূন্যতম সহায়ক মূল্য (এমএস পি) সবাই পায় না, এটা ঠিক। সেটা যেন সবাই পায় তার ব্যবস্থা নেয়া দরকার ছিল, ক্ষুদ্র কৃষকের দরকষাকষি শক্তি বাড়ানো, কৃষি পণ্য মজুত করার ব্যবস্থা করা যেন সুবিধাজনক সময়ে তারা বিক্রি করতে পারে – এ সবই দরকার। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তাদের ঋণগ্রস্থতা থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা নেয়ার দরকার ছিল। অথচ সরকার উলটো কাজ করেছেন। তারা কোম্পানিকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন যেন তারা কৃষি পণ্য কেনা, প্রক্রিয়াজাত করা এবং মজুত করার ক্ষেত্রে কোন বাধা না পায়। অর্থাৎ তারা হাত ধুয়ে তাদের দায়িত্ব থেকে সরে যাচ্ছে, আর কৃষকদের অসম বাজার ব্যবস্থায় ছুঁড়ে ফেলছে।
খাদ্য ও কৃষি বিশেষজ্ঞ দেবিন্দর শর্মা ফসলের নূন্যতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) কৃষকের জন্য কত প্রয়োজন তার কিছু উদাহরণ তুলে দেখিয়েছেন যে মধ্য প্রদেশে ক্রেতারা যখন ভেন্ডি ৪০ রুপি/কেজি কিনছে, তখন কৃষক পেয়েছে কেজিতে মাত্র ১ রুপি। রাগে ক্ষোভে কৃষকরা ভরা মাঠে ট্রাক্টর তুলে সব নষ্ট করে ফেলেছে, কিংবা কেউ গরুকে খাইয়ে দিয়েছে। শুধু মধ্য প্রদেশ নয় সারা ভারতেই কৃষকের এই সমস্যা ভোগ করতে হয়। কাজেই এমএসপি বহাল রাখতে চাওয়া কৃষকের জন্য খুব ন্যায্য। অন্তত যেন একটি মূল্য এমন থাকে যে ফসলের মূল্য এর চেয়ে কম হবে না।
দেবিন্দর বলছেন, যে কৃষক সারা দেশের মানুষের খাদ্য যোগান দেয় তারা নিজেরা দরিদ্র অবস্থায় থাকে। তাদের বছরের আয় মাত্র ২৭,০০০ রুপী। এটা সত্যি, এমএসপি সুবিধা পেয়েছে মাত্র ৬% কৃষক, বাকী ৯৪% কৃষক বাজারের ওপরেই নির্ভরশীল ছিল এবং সেই বাজারে তারা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এমএসপি তাদের নূন্যতম মূল্যের আশ্বাস দেয় এবং সে সুযোগই সম্প্রসারিত করা দরকার। এবং এমএসপিকে আইনীরূপ দেয়া দরকার। যে বাজার কৃষককে কেবল ঠকিয়েছে তাকে আবারও সেই বাজারের প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেয়ার তো কোন অর্থ নাই।
এই তিনটি বিলের প্রতিবাদে কৃষকদের বিক্ষোভের মুখে কৃষি মন্ত্রী বলতে বাধ্য হয়েছেন যে এমএসপি থাকবে। কিন্তু তিনটি বিলে যেভাবে কোম্পানি এবং ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে তাতে কৃষক এই বিল রদ করা ছাড়া আর কিছু মানতে রাজী নয়। কেন্দ্রীয় সরকার তাদের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে এই আইনে যেসব আপত্তি আছে তা সংশোধন করার জন্যে, কিন্তু কৃষকরা বলছে যে খারাপ আইনে সংশোধন করার কিছু নাই, একে বাতিল করতে হবে।
বাংলাদেশে কৃষকরাও ফসলের মূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে একই অবস্থায় আছেন, কিন্তু তাদের নূন্যতম মূল্য সুবিধা এখনো দেয়া হয় না। তারা বাজারের ওপরই নির্ভরশীল। ফসল ভাল হলে কৃষকের মাথায় হাত ওঠে। টমেটো, আলু, বেগুনসহ শীতকালীন সব্জির ভাল ফলন হলে দাম এতোই নেমে যায় যে কৃষক সে ফসল মাঠ থেকে তুলে আনবে এমন খরচও পোষায় না। তারাও মাঠের ফসল মাঠেই রেখে দেয়। রাগে দুঃখ ফসল রাস্তায় এনে ফেলে দেয়। এই সব চিত্র পত্র-পত্রিকায় প্রায় ছাপা হয়, কিন্তু এর প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা নেয়ার কেউ নেই। আবার চুক্তিভিত্তিক চাষের উদাহরণও আমাদের দেশে আছে। যেমন তামাক চাষ। তামাক কোম্পানি কৃষকের সাথে আগাম দাম ঠিক করে ঋণ, বীজ, সার-বিষ দিয়ে কৃষককে দিয়ে চাষ করায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত তামাক পাতার গ্রেড ঠিক নাই বলে চুক্তির মূল্য থেকে কম মূল্যে কৃষককে দিতে বাধ্য করে। কৃষক কোন মতে উৎপাদনের খরচ তুলে আনে। কিন্তু লাভ না হলেও চুক্তির ফাঁদে পড়ে প্রতি বছর করে যেতে হয়। এই ব্যবস্থা চলছে বে-আইনী ভাবে, তাও বা কেউ দেখছে কি?
অবাধ বাজার ব্যবস্থার মধ্যে কৃষি ও কৃষককে নির্বিচারে নিক্ষেপ করা অর্থাৎ রাষ্ট্র এবং সরকারের মজবুত নীতি, নৈতিক এবং উন্নতির সহায়ক ভূমিকা পালনের দায়দায়িত্ব পালন না করে, কৃষি ও কৃষি ব্যবস্থাকে এতিম করে ছেড়ে দেওয়া মারাত্মক ভুল নীতি। দিল্লীর কৃষক বিক্ষোভ সেই কথাটাই আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে। দিল্লীর কৃষকদের কাছে থেকে বাংলাদেশের শিক্ষণীয় দিক এটাই।