দাবদাহ, খরা ও ফসলের অবস্থা
উবিনীগ || Monday 26 April 2021 ||দৈনিক পত্রিকার খবরের পর্যালোচনা
সারা দেশে বৃষ্টিহীন অবস্থা ও তীব্র দাবদাহ চলছে। গড়ে ৩৫ থেকে ৪২ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রা বিভিন্ন জেলায় অনুভুত হচ্ছে। চৈত্র বৈশাখ মাসে (ইংরেজি মার্চ-এপ্রিল মাসে) যে বৃষ্টি হবার কথা তা হয় নি। এমনকি যে সামান্য কালবৈশাখী হয়েছে তাও বৃষ্টিবিহীন। এটা বর্ষা মৌসুম নয়, খরারই মৌসুম। তা সত্ত্বেও স্বাভাবিক অবস্থায় এই সময় কিছুদিন বৃষ্টি হয়। এবং এই সময়ে যেসব ফসল কৃষকের মাঠে আছে, তাতে খুব উপকারে লাগে। গত বছর এই সময়ে খুব বেশি বৃষ্টি হয়েছিল বলে কৃষকের ফসলের অনেক ক্ষতি হয়েছিল। কিন্তু এবার তার উলটো। মোটেও বৃষ্টি নেই। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি, তাতে দেখা যাবে কি কি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
বোরো ধানে হিট শক
৪ এপ্রিল রাতে ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে গরম ‘লু’ হাওয়ায় গোপালগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ জেলায় হাজার হাজার হেক্টর জমির বোরো ধানের শীষ নষ্ট হয়ে সাদা হয়ে গেছে। গোপালগঞ্জ কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে,এ বছর গোপালগঞ্জে ৭৮ হাজার হেক্টর জমিতে বোরোর চাষ হয়েছে। এসব জমিতে এখন ফ্লাওয়ারিং স্টেজ চলছে। অর্থাৎ ধানের শীষে দুধ এসেছে। মাত্র আধা ঘণ্টার ‘লু’ হাওয়ায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়া ও কাশিয়ানী উপজেলার শত শত হেক্টর জমির বোরো ধানের শীষ সাদা হয়ে গেছে [ দেশরূপান্তর, ১২ এপ্রিল, ২০২১ ]।
হাওরের বোরো ধানও রক্ষা পায় নি। ৪ এপ্রিল রাতের লু’ হাওয়া এখানেও লেগেছে। নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জের হাওড়াঞ্চলের বোরো ফসল “হিট শকে” আক্রান্ত হয়। সেদিন সন্ধ্যার পর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত হাওড়ের বিভিন্ন এলাকায় এক ধরনের তপ্ত হাওয়া বয়ে যায়। তবে ওই রাতে চাষীরা কোন ক্ষয়ক্ষতি টের পাননি। পরদিন রোদ ওঠার পর তারা জমিতে গিয়ে দেখেন,যেসব জমির বোরো ধান গাছে সবেমাত্র ফুল বের হচ্ছিল (ফ্লাওয়ারিং স্টেজ) অথবা চালে রূপান্তরিত হচ্ছিল (মিল্কিং স্টেজ) সেসব ধানগাছের শীষ ক্রমশ শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। গাছের কচিপাতাগুলো মরে যাচ্ছে। বেশিরভাগ ধান চিটায় পরিণত হচ্ছে।
পরদিন ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের একটি প্রতিনিধি দল ক্ষতিগ্রস্ত হাওড়াঞ্চল পরিদর্শন করে স্থানীয় গণমাধ্যম কর্মীদের নিশ্চিত করেছেন, এটি ‘হিট শক’। দীর্ঘক্ষণ তপ্ত বাতাস প্রবাহের কারণেই এমনটি ঘটেছে। তবে যেসব ধান ইতোমধ্যে চালে পরিণত হয়েছে সেগুলোর খুব একটা ক্ষতি হয়নি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে ব্রি-ধান ২৯ ও হাইব্রীড জাতের। কারণ,এ ধানগুলো একটু দেরিতে ফলে। হাওড়ের বেশিরভাগ চাষী এ জাতগুলোই বেশি আবাদ করেন।
কৃষি বিভাগের হিসাবে নেত্রকোনার সাতটি উপজেলার অন্তত ১৫ হাজার হেক্টর জমি হিট শকে আক্রান্ত হয়েছে। অন্যদিকে কিশোরগঞ্জে আক্রান্ত হয়েছে আরও ২৬ হাজার হেক্টর জমি। বিপুল এই জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় শুধু নেত্রকোনাতেই অন্তত ৮৬ হাজার ৫২০ মেট্রিক টন ধান কম উৎপাদন হবে বলে আশংকা করা হচ্ছে [দৈনিক জনকণ্ঠ ১৩ এপ্রিল, ২০২১]
বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) এর মহাপরিচালক, ড.মো.শাহজাহান কবীর দৈনিক জনকন্ঠ পত্রিকায় লিখেছেন গত ৪ এপ্রিল দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টিহীন কালবৈশাখীর সঙ্গে তীব্র তাপপ্রবাহে যেসব জমির ধান ফুল ফোটা পর্যায়ে ছিল,সে সব এলাকায় ধানের শীষ শুকিয়ে যায়। বৃষ্টিহীন তীব্র তাপপ্রবাহে বাতাসের তাপমাত্রা প্রায় ৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছিল। ফলে সেগুলোর পরাগরেণু শুকিয়ে ধান চিটা হয়ে যায়। তবে যেসব এলাকায় ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টি ছিল যেমন ঢাকা-গাজীপুরসহ বেশ কিছু স্থানে সে সকল স্থানে তাপমাত্রা দ্রুত কমে যায় এবং ফলনে কোন বিরূপ প্রভাব ফেলেনি।
ড. শাহজাহান কবীরের লেখায় আরও জানা যায় যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হিসাবে হিট শকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ৪৮ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান আক্রান্ত হয়েছে। এরমধ্যে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ আবাদের পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সে হিসাবে ১০ থেকে ১২ হাজার হেক্টর জমির ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। বাকি জমিগুলোর ধান বিভিন্ন মাত্রায় (১০-৮০ভাগ পর্যন্ত) ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ক্ষতির বিশয়টি ছিল এমন যেসব জমির ধান ফুল-ফোটা পর্যায়ে ছিল না,সেগুলোর ক্ষতি হয়নি আর যেখানে ফুল-ফোটা পর্যায়ে ছিল সেটাতে অধিকাংশ (প্রায় ৩০-৪০%) ক্ষতি হয়েছে।
উল্লেখ্য, চলতি বোরো ধানের আবাদ ১ লাখ ২৯ হাজার হেক্টর বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭৬০ হেক্টরে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে হাইব্রিড আবাদ বাড়ানো হয় প্রায় ২ লাখ হেক্টর। অর্থাৎ হাইব্রিড বোরো ধানের আবাদ বাড়িয়ে সরকার লক্ষ্যমাত্রা অ র্জন করতে চান। কিন্তু হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল ধানে এই খরা সহ্য করার ক্ষমতা নেই।
মৌসুমী ফলের ক্ষতি
নোয়াখালির সুবর্ণচর উপজেলায় ১৩৯৫ হেক্টর জমিতে তরমুজের চাষ হয়েছে। এই মৌসুমে অতিরিক্ত খরার কারণে তরমুজের আকার অপেক্ষাকৃত ছোট হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি না হওয়ায় তরমুজ বড় হচ্ছে না বলে কৃষকরা মনে করেন।
গত তিন মাসে মাত্র দু’দফায় ধূলি ভেজানো মাত্র ১০ মিলিমিটার বৃষ্টি হওয়ায় আম, লিচু ও কাঁঠালের স্বাভাবিক বৃদ্ধি থমকে আছে।
বরেন্দ্র এলাকায় পানির স্তর নেমে গেছে
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বরেন্দ্র বহুমুখী সেচ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএফ) বগুড়ার পল্লী উন্নয়ন ও গবেষণা অ্যাকাডেমির (আরডিএ) একাধিক গবেষণা নিবন্ধের তথ্যানুযায়ী ১৯৮০ সালের শুরুতে বরেন্দ্র এলাকায় পানির স্তর ছিল ৩৯ ফুট নিচে। বর্তমানে সেই পানির স্তর কোথাও ৮০ থেকে ৯০ ফুট আবার কোথাও ১১০ থেকে ১৬০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমে গেছে।
বরেন্দ্র বহুমুখী সেচ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পরিচালিত সেচ পাম্পের সংখ্যা বর্তমানে ১৫ হাজার ১০০ । এক হিসাব অনুযায়ী বোরো মৌসুমে সেচ কাজের জন্য বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে লক্ষাধিক সেচ পাম্প চালু রয়েছে। এতে সাময়িকভাবে বোরো ফসলের উৎপাদন হলেও দীর্ঘস্থায়ীভাবে প্রাকৃতিক ঝুঁকির মুখে পড়ছে উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে উঁচু বরেন্দ্র ভূমি এলাকা [দৈনিক ইনকিলাব, ৭ এপ্রিল,২০২১]।
অর্থাৎ পানির স্তর নেমে যাওয়ার কারণ শুধু প্রাকৃতিক নয়, বোরো মৌসুমে সেচ কাজে ব্যাপকভাবে গভীর নল কূপ বসিয়ে ভূগর্ভস্থ পানি তোলাও অন্যতম প্রধান কারণ যা বরেন্দ্র এলাকার গবেষণায় দেখা যাচ্ছে।
একি পরিস্থিতি দেশের দক্ষিণ প্রান্তেও দেখা যাচ্ছে। কক্সবাজারের অধিকাংশ এলাকায় সুপেয় পানির জন্য স্থাপন করা নলকূপগুলোতে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বিশেষ করে অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায়, উখিয়া, টেকনাফ,রামু ও চকরিয়ার বিভিন্ন এলাকায় এই সংকট দেখা যাচ্ছে।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী সূত্র বলেছেন,বোরো চাষাবাদের জন্য স্থাপন করা গভীর নলকূপের কারণে পানির স্তর দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ার ফলে টিউবওয়েলে পানি উঠছে না। এ মৌসুমে বসত-বাড়ির নলকূপের পানি দিয়ে বাড়ির আশ-পাশে জমি চাষাবাদ করা সম্ভব হতো। টিউবওয়েলে পানি না থাকার কারণে জমিগুলো অনাবাদী হয়ে পড়ে আছে। [দৈনিক ইনকিলাব, ১৮ এপ্রিল,২০২১]।