‘অস্বাভাবিক খরা’ ও নয়াকৃষি
উবিনীগ || Friday 30 April 2021 ||দেশে করোনার ভয়াবহতার পাশাপাশি খরা ও দাবদাহ চলছে; চৈত্র-বৈশাখ মাস জুড়ে কোন বৃষ্টি নেই। এই সময় বৃষ্টি হবার কথা নয়, তবে সামান্য হলেও বৃষ্টি হয়। অস্বাভাবিক বিষয় হচ্ছে কাল বৈশাখীও হয়েছে বৃষ্টি বিহীন। সারা বৈশাখ মাস শুকনো খড়-খড়ে গিয়েছে, তাপ মাত্রাও অত্যন্ত বেশী। বাতাসে জলীয়বাষ্প নেই বললেই চলে। এমন পরিস্থিতিতে নয়াকৃষির কৃষকদের অবস্থা কেমন তা জানার চেষ্টা আমাদের সব সময়ি থাকে। তাছাড়া মৌসুমের পরিবর্তন নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে ফসলের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে বোঝার চেষ্টা করা হয়। নয়াকৃষির প্রধান দুটি এলাকা থেকে তথ্য নিয়ে একটি প্রতিবেদন এখানে পেশ করা হচ্ছে। লক ডাউন থাকায় গ্রামে যাওয়া সম্ভব হয় নি, কিন্তু মোবাইল ফোনে কথা বলে কৃষকদের অবস্থা জানা গেছে। তথ্য নেয়া হয়েছে ১৮ এপ্রিল, ২০২১ (নাটোর) এবং ১৯ এপ্রিল, ২০২১ (টাঙ্গাইল)।
নাটোরের কৃষকরা বলেন, বর্তমানে যে খরা হচ্ছে তা অস্বাভাবিক। আসলে বৃষ্টিহীনতা চলছে বিগত ৫ মাস ধরে। মাটি শুখনা খটখটে হয়ে আছে। টাঙ্গাইলেও কৃষকের একি কথা। “এই বছর বৃষ্টির দেখা নাই। রোদ্রের কারনে বাইরে বের হওয়া যায় না। মাঠে আবাদ করে কৃষকরা খুব ক্ষতিগ্রস্থ”। নাটোর খরা প্রবণ এলাকা আর টাঙ্গাইল বন্যা প্রবণ হলেও এবারের খরা কাউকে ছাড়ে নি। সব জায়গাতেই মাটির অবস্থা খুব খারাপ। কৃষক রেজিয়া বেগমের ভাষায় “খরায় মাটি পুড়ে তামার মতো হয়ে আছে”।
শীতকালে বোনা বেশ কিছু ফসল মাঠেই ছিল যেমন টাঙ্গাইলে ডাঁটা, ঢেঁড়স, পুঁইশাক, চিচিঙ্গা, ধুন্দুল। কৃষকরা বলছেন বৃষ্টির অভাবে গাছ বড় হচ্ছে না, “জালায়ে মইরা গেছে”, “খড়ার জন্য টেনটেনা ধরে আছে” “ডাঁটা থুবরা ধরে আছে”। চকে কোন সবজী নাই। স্বল্পনাড়ু গ্রামের নয়াকৃষির কৃষক তারিকুল ইসলাম বলেন,২০ ডিসিমাল জমিতে নলী বেগুন লাগাইছিলাম। ফুল ধরে থাকছে না। ফলও আসে না। ২/১টা ফল আসলেও বড় হচ্ছে না।
পাবনার ঈশ্বরদীতে সব্জি চাষ বেশি হয়। কিন্তু এবার মাঠে বেগুন, শসা, ঝিঙ্গা, করলা, ঢেঁড়স। বেগুন গাছের আগা শুকিয়ে যাচ্ছে। গরমে বেগুনের ফুল সিদ্ধ হয়ে ঝরে যাচ্ছে। ফলন কম হয়েছে। এলাকার কৃষকরা বলেন, “একটু যদি মাঝে মধ্যে বৃষ্টি হতো সমস্যা হতো না। গতবার এক বিঘা জমি থেকে এই সময় প্রতি সপ্তাহে বেগুন তুলতাম ৮-১০ মণ। এবার তুলতে পারছি দেড় থেকে দুই মণ”।
টাঙ্গাইলের কৃষক শাহনাজ বেগম ও মো: নূরুজ্জামান এই খরায় স্থানীয় জাতের বেগুন এবং হাইব্রীড বেগুনের পার্থক্য পর্যালোচনা করেছেন:
হাইব্রীড ও উফসী বেগুনে রাসায়নিক সার ও বিষ ব্যবহারের কারনে বেগুন গাছের ডোগা নরম হয়ে থাকে এ কারনে পোকা ডোগা বেশি খেয়েছে। জমিতে গাছের ডোগা হেলে পড়েছে বেশী। রোদ হলেই পোকা খাওয়া ডগাগুলো ঢলে পড়ে শুকিয়ে গেছে রোদে ফুল শুকিয়ে যাচ্ছে, ব্গেুনেও পোকাও বেশী লাগছে। কারণ বেগুনগুলো একটু নরম বেশী। গাছের পাতাগুলোও রোদে মুড়িয়ে গেছে অনেক। বেগুন বোটা থেকে ঝড়ে ক্ষেতে পড়ে থাকে। বোটা পঁচন রোগও বেশী হয়।
দেশীয় শিংনাথ, সইলা, নলী বেগুনের গাছগুলোর ডগা একটু শক্ত বেশী। ফলে পোকা কম লাগছে। কিছু ডগা পোকা খেলেও রোদে কম ঢলে পড়ছে। বেগুনের বোটা একটু শক্ত হওয়ার কারনে ঝড়ে পড়ছে কম ও বেগুন পোকাতে কম খেয়েছে। নয়াকৃষির জমিতে সার-বিষ না দেওয়ায় এবং জমিতে বাঁশের কুঞ্চি ও ডাল পালা পুঁতে দেওয়ার কারনে পাখি বসেছে। কুঞ্চি ও ডালে বসে পাখি পোকা খেয়ে ফেলে। দু-একটা পোকা লাগলেও সেগুলো গাছের তেমন ক্ষতি করতে পারে না। দেশী বেগুন আবাদে খরচও কম লাগে। এবং স্থানীয় হাট বাজারে কেজি প্রতি অন্য বেগুনের চেয়ে ১০ টাকা বেশী দামে বিক্রি করা যায়।
পাবনার ঈশ্বরদীতে কৃষকরা স্থানীয় জাতের বেগুন করেছেন, যশোরী, আটঘরিয়া, চৈরা, শ্যামলাগোল ও ঘৃত কাঞ্চন। বাণিজ্যিক বেগুন চাষীরা হাইব্রিড বেগুন-লুনা, ইস্পাহানী, বেঙ্গতুরা ও চাকা চাষ করেছেন।
এখানে কৃষকরা একটা তুলনামুলক চিত্র তুলে ধরেছেন।
নং | বিবরন | হাইব্রিড বেগুন | স্থানীয় বেগুন |
১ | ফলন | হাইব্রিড বেগুন ধরে বেশি কিন্তু টিকে কম। | স্থানীয় বেগুন যতটুকু ধরে টিকে থাকে। |
২ | পোকা মাকড়ের আক্রমন | পোকা মাকড়ের আ্ক্রমন খুব বেশি | পোকা মাকড়ের আক্রমন কম |
৩ | পঁচন | বেগুন গাছেই পচেঁ গেছে | বেগুন গাছে খুব কম পচেঁছে |
৪ | সার বিষ ব্যবহার | প্রচুর পরিমাণে সার বিষ ব্যবহার করা হয়েছে | সার বিষের ব্যবহার করা হয়নি। |
৫ | ভিটামিন | গাছে ফুল আসা ও ফল টিকানোর জন্য ভিটামিন দিতে হয় বার বার | স্থানীয় জাতের বেগুনে এইসব দিতে হয়নি। |
৬ | দামের পার্থক্য | স্থানীয় বেগুনের চেয়ে কেজিতে কমপক্ষে ১০ টাকা কম যায়। | হাইব্রিড বেগুনের চেয়ে কমপক্ষে ১০ টাকা বেশি যায়। |
৭ | ঘরে রাখা | হাইব্রিড বেগুন তুলে ২/৩ দিনে ঘরে রেখে খাওয়া যায় | প্রায় এক সপ্তাহ ঘরে রেখে খাওয়া যায় |
৮ | বীজ রাখা | বীজ রাখা যায় না | বীজ রাখা যায় |
৯ | রোদে, তাপে বেগুনের অবস্থা | খরায়, বেগুন গাছেই সিদ্ধ হয়ে যায় | স্থানীয় জাতের বেগুন সিদ্ধ হয় না |
১০ | ফুল পঁচা ও ঝরা | খরায় ফুল পচেঁ ঝরে যাচ্ছে | খুবই কম পঁচন। |
ঈশ্বরদী উপজেলার ২ জন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার কাছে এইবার খরার বেগুনের ফলন সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়
মুলাডুলি ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বলেন, আমার ব্লকে কৃষকরা খুব একটা বেগুন চাষ করেনি। কিছু কৃষক যশোরী এবং আটঘরিয়া বেগুন চাষ করেছে। হাইব্রিড বেগুন করে নাই। খরার কারনে বেগুনের ফলন কম হইছে। বাজারে বেগুনের চড়া দাম। বেগুন যদি প্রতি বছররে মতো ফলন হতো তাহলে এতো দাম থাকতো না। যেখানে কৃষকরা এক বিঘায় বেগুন তুলে সপ্তাহে ৯-১০ মণ এবার সেখানে খুব জোর হলে ২ থেকে আড়াই মণ।
প্রতি বছর কৃষি কর্মকর্তারা বিটি বেগুন বীজ বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, কিন্তু এবার তাঁদের কোন বিটি বেগুনের বীজ দেওয়া হয়নি। দিলেও তিনি কৃষককে দি্তেন না বলে জানান। এর আগে কৃষক তাদের অনেক কথা শুনিয়েছে। ঈশ্বরদী উপজেলায় কোন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকে এবার বিটি বেগুনের বীজ দেয়া হয় নি।
লক্ষীকুন্ডা ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বলেন, এই এলাকায় হাইব্রিড বেগুন নাই। কৃষকরা এখন যশোরী বেগুন চাষ করেছে। খরার কারনে ফলন অনেক কম হয়েছে। তবে যতটুকু ফলন হোক দাম ভাল পাচ্ছে। গতবার কৃষকরা করোনার কারনে বেগুন সহ অন্যান্য সবজির দাম পায়নি। এই বছর এক বিঘা জমি থেকে ৩ থেকে সাড়ে তিন মণ বেগুন প্রতি সপ্তাহে তুলতে পারছে। অন্য বছর ৮/১০ মণ বেগুন পাইতো।
নাটোরের বড়াই গ্রামে যেসব জমি ডিপটিওবয়েলের আওতায় আছে, ঐ জমিতে কৃষকরা কিছু যশোরী বেগুন, শ্যামলা বেগুন, ঢেড়স ও মিষ্টি কুমড়া করেছে কিন্তু খুব ভাল হয়নি। কৃষকের ভাষায় “আল্লার দেয়া পানিতে যে ফসল হয়, সেচের পানিতে তা হয় না”।
শসা গাছ বাড়ছে না। ফুল টিকছে না, ফলন কম হচ্ছে। গাছ কুচড়িয়ে মারা যাচ্ছে। ঝিঙ্গা, ঢেড়স, করলা গাছ বাড়ছে না। চালকুমড়া গাছে জোড় নাই,টলে যাচ্ছে। শুধু ফসল না বাড়ির আঙ্গিনায় আম গাছের গুটি শুকিয়ে পড়ে যাচ্ছে,কাঁঠাল বড় হচ্ছে না,পেঁপে গাছ শুকিয়ে যাচ্ছে ফল বড় হচ্ছে না।
নাটোরের কৃষক ইমতাদুল ও ইকরামুল হক বলেন,এই অস্বাভাবিক খরায় আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে রসুনের”। রসুন এখানকার এই মৌসুমের প্রধান ফসল। অস্বাভাবিক খরার কারনে রসূনের ফলন কম হয়েছে। প্রতি বিঘায় কমপক্ষে ৫-৭ মণ কম হয়েছে। এখন বৈশাখ মাস। বৈশাখের প্রথম দিনই বৃষ্টি হয়।
কিছু ফসল বোনার কথা ছিল চৈত্র-বৈশাখ মাসে। আউশ ধান ও পাট বুনার সময় বৃষ্টি না হওয়ার কারণে বীজ ঠিকমতো গজিয়ে উঠতে পারে নি। অতিরিক্ত খরায় বীজ শুকিয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইলের কৃষক আলমগীর মিয়ার জমিতে পাট লাগানো পর আর গজায় নাই। তাই বেশির ভাগ কৃষক পাট লাগাতে পারে নাই। তিল লাগানোর পর গজাইছে কিন্তু খড়ার কারনে “ঝিম ধরে আছে”। ধইঞ্চা বোনা এই সময় কৃষকের জন্যে খুব জরুরি। কিন্তু বৃষ্টির অভাবে ধইঞ্চা বোনা যায় নি। বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করছে সবাই।
তবুও নয়াকৃষি পদ্ধ্বতিতে চাষাবাদের কারণে মাটি ও পরিবেশে যে ভিন্ন প্রভাব থাকে তা দেখার চেষ্টা করা হয়েছে। এখানে পাবনার কৃষকদের পর্যালোচনা দেয়া হোল।
নং | নয়াকৃষি কৃষকের অবস্থা | অনয়াকৃষি কৃষকের অবস্থা |
১ | অতিরিক্ত খরা হওয়ার পরও নয়াকৃষি কৃষকের জমিতে জো আছে। | খরাতে কৃষকের জমি মাটি শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে। |
২ | নয়াকৃষি কৃষকের জমিতে কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য- বিভিন্ন ধরনের শাক পাওয়া যাচ্ছে। | কৃষকের জমিতে কোন রকম কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য পাওয়া দেখা যাচ্ছে না। |
৩ | নয়াকৃষি কৃষকের জমিতে গরু ছাগলের খাদ্যের জন্য ঘাস আছে। | জমিতে কোন ঘাস নেই। |
৪ | খরাতে নয়াকৃষির জমিতে বোরে ধানে শিষ ছোট হলেও ধান আছে | খরার কারনে কৃষকের জমির ধান চিটা হয়ে গেছে। |
৫ | খরায় পুকুরের পানি কমে গেছে, পানি গরম হয়েছে। কিন্তু মাছের ক্ষতি খুবই কম। | কৃষকের পুকুরে মাছ গরমে দূর্বল হয়ে মারা যাচ্ছে। পুকুরের পাশ দিয়ে হাটলে মরা মাছের দূগন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। গরমে পানি দিয়ে গন্ধ্ বের হচ্ছে। |
৬ | খরার কারনে আম, লিচু, জাম কম আছে। | কৃষকের লিচু গাছে লিচু নাই। আম গাছে ডাটা আছে শুধু। |
তথ্য দিয়েছেনঃ
আজমিরা খাতুন, ফাহিমা খাতুন লিজা, গোলাম মোস্তফা রনি এবং রবিউল ইসলাম চুন্নু