জলবায়ু বিপর্যয় রোধে নারীর শুধু অংশগ্রহণ নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণেও ভূমিকা প্রয়োজন
ফরিদা আখতার || Sunday 07 November 2021 ||জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নারীর ওপর ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি এবং ভিন্ন মাত্রার। এই সত্য আজ এশিয়া, আফ্রিকাসহ পৃথিবীর প্রায় সব ভুক্তভোগী দেশে প্রতিষ্ঠিত।
বাংলাদেশের লক্ষ-কোটি নারী জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন, এবং ভবিষ্যতে আরও খারাপ পরিস্থিতির শিকার হবেন। কিন্তু তারা জানেন না যে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে প্রায় ২৫ হাজারের অধিক প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি বিশাল সম্মেলন হচ্ছে, ঠিক এই বিষয়টি নিয়েই আলোচনার উদ্দেশে।
এই সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় সব দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানরা গেছেন। বিশেষ করে ধনী দেশের সরকারগুলোর প্রধানরা উপস্থিত হয়েছেন মুখে মাস্ক পরে; তারা হাত মেলাচ্ছেন না, কনুই মেলাচ্ছেন।
তাদের সেই মাস্ক ঢাকা মুখের দিকেই চেয়ে আছে সকলে। সবাই দেখতে চায়, তারা তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে ২০৪০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমান কমাবার প্রতিশ্রুতি দেন কি না। তারাই বিশ্বের ৮০% কার্বন নিঃসরণের জন্যে দায়ী, অথচ ভুক্তভোগী হচ্ছে সারা বিশ্বের মানুষ।
আইপিসিসি বা আন্তঃসরকার জলবায়ু পরিবর্তনের প্যানেল বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে সর্বশেষ আগস্ট মাসের প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে মানুষ সৃষ্ট কারণে বায়ুতে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নিঃসরণ বেড়ে গেছে, যার কারণে আমরা অসময়ের বন্যা, অতিরিক্ত তাপমাত্রা, খরাসহ নানা ধরনের অস্বাভাবিক আবহাওয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি।
আইপিসিসির প্রতিবেদনের কথাও আমাদের দেশের লক্ষ-কোটি নারী জানেন না, তাদের জানার কথাও নয়। কিন্তু না জানলেও বন্যা, তাপমাত্রার বৃদ্ধি, খরার যে কষ্ট তা তারা অনুভব করছেন, সেই কথাই এই প্রতিবেদনে আছে।
জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে সব মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও নারীর ওপর ক্ষতির মাত্রা অনেক বেশি এবং ভিন্ন মাত্রার। এই সত্য আজ এশিয়া, আফ্রিকাসহ পৃথিবীর প্রায় সব ভুক্তভোগী দেশে প্রতিষ্ঠিত। সে কারণে গ্লাসগোতে জলবায়ু পরিবর্তন ও নারী শীর্ষক বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠান হয়েছে।
এসব অনুষ্ঠানের একটিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অংশগ্রহণ করেছেন। আরও ছিলেন এস্তোনিয়া ও আইসল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী, তানজানিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং ইউএন উইমেনের নির্বাহী পরিচালক। এখানে নারী সরকার প্রধানদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে, তাই বাংলাদেশ সেই সুযোগ পেয়েছে।
নারীদের প্রসঙ্গে আলোচনায় যা উঠে আসছে তা হচ্ছে : নারীর সামাজিক ও পারিবারিক অসম অবস্থান, বৈষম্য, নির্যাতনের যে অবস্থা বিদ্যমান তার সাথে জলবায়ু বিপর্যয় নারীর জীবনকে আরও দুর্বিসহ করে তুলছে।
এই সভা থেকে "Glasgow Women's Leadership on Gender Equality and Climate" শীর্ষক একটি ঘোষণাও বের হয়েছে। ঘোষণাটি সারা বিশ্বের সরকারি ও বেসরকারি নারী নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষর গ্রহণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে এবং জাতি সংঘের ৬৬তম Commission on the Status of Women এর অধিবেশনে ২০২২ সালের মার্চ মাসে উপস্থাপন করা হবে।
গ্লাসগো ঘোষণার গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নারীর বেঁচে থাকার অধিকার, স্বাস্থ্য, খাদ্য, পানি, স্যানিটেশন, মর্যাদাপূর্ণ কাজের অধিকারসহ নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে বলে আশংকা প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে এই ঘোষণার দুর্বল দিকও আছে। সেটা হচ্ছে : যারা এই জলবায়ূ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে তাদের চিহ্নিত করা হয়নি। এই অবস্থা পরিবর্তনে তাদের দায়িত্ব কী, সেটা না বলে শুধু নারীদের জন্যে অনেক কিছু করার কথা ফাঁকা বুলি হয়ে থাকার সম্ভাবনা প্রচুর।
তাছাড়া জলবায়ু বিপর্যয়ের জন্যে যেসব রাষ্ট্র দায়ী তাদের সরকার প্রধানরা সবাই পুরুষ হবার কারণে এই সভায় আমন্ত্রিত ছিলেন না। ফলে তাদের কোন দায় নেই।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস নারী, কিন্তু জলবায়ূ সম্মেলনে তাকে দেখা যাচ্ছে না। অন্যান্য ধনী দেশের উচ্চ পদস্থ কোন নারী উপস্থিত ছিলেন কি না, তা-ও জানা যায় নি।
তাহলে নারীদের জন্যে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে, তার কোনো আশ্বাস এখান থেকে পাওয়া যাবে না। নারী যেন জলবায়ু বিপর্যয় থেকে রক্ষা পায় সেই ব্যবস্থা নেয়ার দায় কার, সেটা স্পষ্ট নয়।
'জলবায়ু পরিবর্তন' বললে সার্বিক ক্ষতির অবস্থা বোঝার বিষয়টির গুরুত্ব একটু কমে যায়। আসলে যা ঘটছে তা পরিবর্তন নয়, পরিবর্তন সব সময়ই ছিল, কিন্তু তা প্রাকৃতিক কারণে যতটুকু হওয়ার ততটুকুই হতো। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা প্রধানত মানবসৃষ্ট, কিংবা বলা যেতে পারে পুঁজিতান্ত্রিক ও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা সৃষ্ট। এখানে নারীরা ভিন্নভাবে এবং বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে তাতে অবাক হবার কিছু নাই।
তবে নারীর প্রসঙ্গ শুধু ভুক্তভোগী হিসেবে আলোচনা করতে চাই না। নারীর দৃষ্টিতে জলবায়ু বিপর্যয় এবং তার প্রতিকার সম্পর্কে আলোচনা হওয়া চাই। আমরা নারী আন্দোলন করি, নারী অধিকারের দাবি জানাই। ভুক্তভোগীর ধারণা জলবায়ু বিপর্যয় নারীকে কতভাবে এবং কেমনভাবে আক্রান্ত করে এবং নারী সেটা কেমন করে সামাল দেন তা আলোচনার বাইরে থেকে যায়। আরও জরুরি নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে যারা দায়ী এবং যে কাজগুলো দায়ী তা চিহ্নিত করতে পারা।
এটা শুধু পরিবেশবাদী সংগঠনের হাতে রাখলেই হবে না। সারা বিশ্বে এখন নারীরা জলবায়ু বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। এমনকি পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোতেও অনেক নারী নেতৃত্বে আছেন। গ্রীন পিস, ফ্রেন্ডস অব দ্য আর্থ, নবধানিয়া, হ্যান্ডস অব মাদার আর্থসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতৃত্বে নারীরাই আছেন।
সুইডেনের গ্রেটা থুনবার্গ, উগান্ডার ভেনেসা নাকাতে, আইয়ারল্যাডের সাই ও'কোনার এবং আরও কয়েকজন কিশোরী ও তরুণী এখন যেভাবে কথা বলছেন তাতে বিশ্ব নেতারা একটু হলেও থ্মকে গেছেন। তাদের একটু হলেও জবাব দিতে হচ্ছে। এক পর্যায়ে জলবায়ু বিপর্যয় নারী আন্দোলনের প্রধান বিষয় হতেই হবে। দুঃখজনক হচ্ছে আমাদের দেশের নারী আন্দোলন এখনও বিষয়টিকে তাদের কাজের আওতায় আনছেন না।
সাধারণভাবে আমরা জানি ধনী দেশের মানুষের জীবাশ্ম জ্বালানী নির্ভর জীবনযাত্রা এবং সে জীবনযাত্রা টিকিয়ে রাখার জন্যে যেসব বহুজাতিক কোম্পানি সারা বিশ্বে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, নারীরা আজ তাদের কর্মকাণ্ডকে চিহ্নিত করতে পারছেন। এর মধ্যে দুই ধরনের আসামী আছে। এক. জ্বালানী তেল, কয়লা ও গ্যাস কোম্পানী, এবং দুই. ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড প্রডাকশান, বা বাণিজ্যিক ও শিল্প কারখানায় খাদ্য উৎপাদনের সাথে জড়িত কোম্পানি।
জীবাশ্ম জ্বালানী বা ফসিল ফুয়েলের কারণেই কার্বন নিঃসরণ কমানো যাচ্ছে না। গ্লাসগো সম্মেলনে মাত্র ৪০টি দেশ কয়লা নির্ভরতা কমাবে বলে অঙ্গীকার করেছে। এদের মধ্যে আছে ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, নেপাল রয়েছে কিন্তু ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান নেই। পরিবেশবাদীরা আশংকা করছেন, ২০৩০ বা ২০৪০ সালে কমাবার কথা বলে তারা আসলে আরো কিছু বছর কয়লার ব্যবহার চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন। এক পর্যায়ে কথা আর কাজের মিল পাওয়া না-ও যেতে পারে।
এদিকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফুড প্রোডাকশানের কথা বলে এবং বেশি উৎপাদনের লোভ দেখিয়ে তারা কৃষিকে ধ্বংস করেছে রাসায়নিক সার, কীটনাশক দিয়ে, মাটির তলার পানি তুলে সেচ দিয়ে পানি তলা নেমে গেছে। টিউবওয়েলের পানিতে দেখা দিয়েছে আর্সেনিক। কৃষক নারীরা হাজার বছর ধরে যে বীজ সংগ্রহ করে আসছেন, এখন বীজ প্যাকেটে বিক্রি হয় কোম্পানির নামে। বীজকে বিকৃত করে নাম দিয়েছে জেনেটিক মডিফিফিকেশন, জিএমও।
কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার এবং কৃষিযন্ত্রে জ্বালানীর ব্যবহার একদিকে জলবায়ূর ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে অন্যদিকে নারী কৃষি থেকে উৎখাত হয়ে বেকার হয়ে পড়ছে। পরিবারে অসুস্থ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, নারীর দায়িত্ব তাদের দেখাশোনা করার। পানি পাওয়া না গেলে নারীকে খাওয়ার পানি সংগ্রহের জন্যে যেতে হয় কয়েক কিলোমিটার দূর। খরাপ্রবণ এলাকা এবং উপকূলীয় এলাকায় যেখানে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে সেখানে খাওয়ার পানির ব্যাপক সংকট। পরিবারের সদস্যরা, বিশেষত ছেলেমেয়েরা কি পানি ছাড়া থাকতে পারবে? তাই নারীকেই ছুটতে হয় পানি আনতে।
উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের বিশেষভাবে নিত্যদিনের কাজকর্মে লবণাক্ত পানি ব্যবহার করায় নানা ধরনের রোগ, বিশেষ করে চর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিছু গবেষণায় উপকূলীয় অঞ্চলে নারীদের গর্ভপাতের হার বেড়ে গেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থাৎ নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে যারা গেছেন তারা নারীর ক্ষতির কথা তুলে ধরছেন। বিবিসিতেও বাংলাদেশের নারীদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেটা যথেষ্ট নয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফোরাম, বা প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে নারীর আংশগ্রহণ খুব সীমিত। কপ-২৬ এ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে যে সরকারি প্রতিনিধি দল গেছে তাতে মাত্র ৭ শতাংশ নারী আছেন। তারা নারীদের প্রসঙ্গ কতটুকু আনতে পারবেন? সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় অনুপস্থিত থেকে অবস্থা পরিবর্তন করা যাবে না।
বাংলাদেশে বড় পুকুরিয়া এবং ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত কয়লা খনিতে যেসব দুর্ঘটনা হয়েছে এবং তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামনের কাতারে নারীরাই ছিলেন। উর্বর চাষের জমিতে কয়লা খনির প্রকল্প বন্ধের জন্য যে আন্দোলন হয়েছে এবং ২৬ আগস্ট, ২০০৬ সালে ৩ জন তরুণ শহীদ হয়েছিলেন এবং ২০০ জন পুলিশের গুলিতে আহত হয়েছিলেন, এর প্রতিবাদে ৫০,০০০ মানুষের মিছিলের সামনের কাতারে ছিলেন নারীরা।
জলবায়ূ দুর্যোগের জন্য আজ এই কয়লাই সারা বিশ্বে এক নম্বর কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কয়লার ব্যবহার বন্ধ করা ছাড়া কার্বণ নিঃসরণ কমানো যাবে না, ফলে তাপমাত্রা ১.৫ এর নীচে রাখা যাবে না। আমাদের দেশে কয়লা ভিত্তিক প্রকল্পগুলো অবিলম্বে বন্ধ করা হবে বলে সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অন্তত কপ-২৬ এ যাবার আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন। তার বাস্তবায়ন এই দেশের নারীরা দেখতে চান।
নারীরা সকল পর্যায়ে – উপকুল থেকে শুরু করে হাওর, বাওর সবখানে – জলবায়ু বিপর্যয়ের মোকাবেলা করছেন নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে। এই সক্ষমতা আমাদের আরও বাড়াতে হবে, এবং তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই লেখাটি ৬ নভেম্বর ২০২১ তারিখে 'জলবায়ু বিপর্যয় রোধে নারীর শুধু অংশগ্রহণ নয়, সিদ্ধান্ত গ্রহণেও ভূমিকা প্রয়োজন' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।