নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়
ফরিদা আখতার || Wednesday 23 March 2022 ||প্রতিদিন খাবারের জন্যে শুধু চাল আর ডালের হিসাব করলেই তো হয় না, তার সাথে তেলও লাগবে, লাগবে জ্বালানিও। একটি পণ্যের দাম বাড়লে, অন্য সব কিছু কেনা সাধ্যের বাইরে চলে যায়- এটা সকলেই বোঝে...
নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম হু হু করে বাড়ছে, টিসিবি'র ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ লাইন, হুড়োহুড়ি এবং শেষপর্যন্ত অনেকেরই কিনতে না পেরে ফিরে আসা – এই তথ্যগুলো যথেষ্ট কষ্টদায়ক এবং যন্ত্রণার। এই বেদনা নিজেদের অভিজ্ঞতায়ও বুঝতে পারি। এটাই এখন সকলের আলোচনার মূল বিষয়।
এবছর ফেব্রুয়ারি মাস থেকে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হচ্ছে এবং রাজনৈতিক মহলও একটু সরগরম হয়ে উঠছে। কারণ একই সময়ে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। অর্থনীতির সব সূত্র মেনে দাম বৃদ্ধ্বির ব্যাপার যে ঘটছে না- তাও পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে। অর্থাৎ চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধানের কারণ ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্যিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কারণও বিদ্যমান। সাথে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্রমাগত নিত্যনতুন বিপর্যয়।
দাম বৃদ্ধির বিষয়টা এখন ঘটেছে তা নয়, গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অন্তত পত্রিকাগুলো দেখলে তাই মনে হয়। দাম কেন বাড়ছে, সেটাই এখনও সরকার খুঁজে পাচ্ছে না। বিশ্লেষকরা কথার মালা গেঁথে চলেছেন- টেলিভিশনের টক শো'তে। একেকজনের এক এক ব্যাখ্যা শুনে, সাধারণ মানুষ দিশেহারা হচ্ছে। কারণ শেষপর্যন্ত ভোক্তা হিসেবে উচ্চ শ্রেণির মানুষের জন্য খুব পার্থক্য না হলেও মধ্য, নিম্নবিত্ত এবং সীমিত আয়ের মানুষের জীবনধারন কঠিন হয়ে পড়ছে।
খুব সহজভাবে আমরা জানি, আমন ধান ওঠার পর ধানের দাম কম থাকার কথা। কিন্তু যেকোন কারণেই হোক নভেম্বর-ডিসেম্বরেই ধান এবং চালের দাম বেশি ছিল। পত্রিকায় লিখেছে, মিল পর্যায়ে চালের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে শুরু থেকেই, তার প্রভাব পড়েছে পাইকারি এবং খুচরা বিক্রেতাদের পর্যায়ে; তারাও দাম বাড়িয়ে দিলেন। সেটা কতখানি যুক্তিসঙ্গত ছিল- তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কিন্তু শেষপর্যন্ত ভোক্তাদের পকেটেই গিয়ে এর আঘাত পড়ে। তাদের বেশি দাম দিয়েই কিনতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
নিত্য খাদ্যপণ্যের মধ্যে চালের পাশাপাশি ডাল, ভোজ্য তেল, আটা ইত্যাদির দামও বেড়েছে এবং তা বেড়েই চলেছে। কোথায় গিয়ে ঠেকবে জানে না কেউ। সবজির মৌসুমেই সবজির দামও চড়া ছিল। মধ্যবিত্ত পরিবারে চিনি, আটা, লবণ, পেঁয়াজ, রসুন, মসুর ডাল, ছোলা, শুকনা মরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, ধনিয়া, জিরা, আদা ও তেজপাতা ইত্যাদি লাগে এবং খুচরা পর্যায়ে সেগুলোর দামও বেড়েছে। এইসব পণ্যের অনেকগুলোই আমদানি করা। নির্দিষ্ট রপ্তানিকারক দেশেও সরবরাহ সমস্যা হয়েছে কিনা- সেটাও সব ক্ষেত্রে জানা যায়নি।
আমদানি নির্ভর কয়েকটি পণ্যের মধ্যে ভোজ্য তেল অন্যতম। ভোজ্য তেল বলতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হয় সয়াবিন তেল যা মূলত আমদানি করা। দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদার ৯০% আমদানির মাধ্যমে মেটাতে হয়। রান্নাবান্নায় সয়াবিন তেল খেতে প্রায় সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। পাম অয়েলও অনেক ব্যবহার হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৮০ লাখ টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেল আমদানি করা হয় যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, আর্জন্টিনা থেকে। এ বছর আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলে বৈরি ও শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিনের উৎপাদনে ব্যাহত হয়েছে। ফলে তেলের দাম বেড়ে গেছে।
বাংলাদেশে সয়াবিন তেল আমদানিকারকরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বলাবাহুল্য; তারা আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির সুযোগ নিয়ে মজুদ করার চেষ্টা করছেন বলে সংবাদ মাধ্যমে বলা হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির এ পরিস্থিতির দায় ভোক্তার ঘাড়েই চাপাতে চান তারা। এমনকি তারা সরকারের নির্ধারণ করা মূল্য মেনে চলেনি, তারা নিজেদের মতো করেই দাম বাড়িয়ে রেখেছেন। প্রতিদিন খাবারের জন্যে চাল আর ডালের হিসাব করলে তো হয় না, তার সাথে তেলও লাগবে। লাগবে জ্বালানিও। একটি পণ্যের দাম বাড়লে, অন্য সব কিছু কেনা সাধ্যের বাইরে চলে যায় এটা সকলেই বোঝে।
এখানে আরও কিছু কথা যুক্ত করা দরকার। দেশে উৎপাদনের পরিমাণ অথবা আমদানি ঠিক থাকলে এবং তার কারণে দাম ঠিকঠাক থাকলেই, দেশের মানুষের প্রতি সরকারের দায়িত্ব ফুরিয়ে যায় না।
বিষয়টা সয়াবিনের ক্ষেত্রেই দেখার চেষ্টা করি। সাধারণ সয়াবিন আমদানি হয় না, যেটা আমদানি হয় সেটা হচ্ছে জেনেটিকালি মডিফাইড বীজ বা জিএমও বীজ থেকে উৎপাদিত সয়াবিন। এই সয়াবিন মানুষের খাদ্যের জন্য সরাসরি উৎপাদন করা হয় না, এটা মূলত: গোখাদ্য। এবং তা উৎপাদিত হয় মূলত বাণিজ্যিকভাবে এবং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পদ্ধতিতে; বিশাল আকারের লাইভস্টক (প্রাণিসম্পদ) ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহারের জন্যে।
ধনী দেশের মাংস ও দুধের চাহিদা অত্যন্ত বেশি; তাই বাণিজ্যিকভাবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল পদ্ধতিতে মাংস এবং দুধ উৎপাদনের গরুকে ফিড (পশুখাদ্য) হিসেবে জিএম সয়াবিন খাওয়ানো হয়। এর জন্যে প্রয়োজন হয়- ব্যাপক পরিমাণ সয়াবিনসহ অন্যান্য উপাদানের। আমাদের দেশেও পোলট্রি ও পশুখাদ্য হিসেবে এই জিএম সয়াবিন আনা হয়।
খাদ্যের বাণিজ্যিক চাহিদা মেটাতে গিয়ে সবচেয়ে দুঃখজনক হচ্ছে এর জন্যে 'বিশ্বের ফুসফুস' নামে খ্যাত ব্রাজিলের আমাজন বন ধ্বংস করা হচ্ছে। একইসাথে এ ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থা বিপুল কার্বন নির্গমনের জন্যে দায়ী বলে প্রমাণিত হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে- কার্বণ নিঃসরণ প্রশ্নে বন ধ্বংসের প্রশ্ন ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। ধনী দেশের একাংশ ২০৩০ সালের মধ্যে বন ধ্বংস বন্ধ করবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। আমরাও দেখতে চাই, সয়াবিনসহ গোখাদ্যের জন্যে ব্রাজিলের আমাজন বন রক্ষা হয় কিনা।
তাছাড়া ভোজ্যতেল হিসেবে জিএম সয়াবিন খাওয়া স্বাস্থ্যের দিক থেকেও ক্ষতিকর বলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। জেনেটিকালি মডিফাই করতে গিয়ে এরমধ্যে ব্যাক্টেরিয়ার জিন ঢোকানো হয় যেন পোকা না লাগে এবং একইসাথে একে কোম্পানির তৈরি আগাছানাশক- 'রাউন্ডআপ রেডিগ্লাইফসফেট' সহনশীল করে তোলা হয়। এর কারণে যে সয়াবিন ভোজ্য তেল হিসেবে স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী হতে পারতো- তা না হয়ে উল্টো নানান রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এপর্যন্ত জিএম সয়াবিনের যেসব স্বাস্থ্য ক্ষতির কথা জানা গেছে, তা হচ্ছে- লিভার অকেজো হয়ে যাওয়া, মুটিয়ে যাওয়া, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্ট হওয়া এবং শিশুদের অটিজম হওয়া। সমস্যা হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য বলতে যা আমদানি করা হয়- তা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে কোনো ছাড়পত্র নেওয়ার বিষয়ে চিন্তাও করা হয় না। এসব পণ্য মানুষের ব্যবহারের জন্য আদৌ নিরাপদ কিনা বা ব্যবহারে কোনো ক্ষতি আছে কিনা- জানার কোনো চেষ্টা নেই। আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয়ের অভাব সব ক্ষেত্রেই আছে, এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়।
যুদ্ধ ধ্বংসাত্মক, মানুষের মৃত্যু, আহত হওয়া, ঘরবাড়ি ধ্বংস হওয়া, শরণার্থীতে পরিণত হওয়ার মতো- দুঃখজনক ঘটনা ঘটেই চলেছে। যুদ্ধে কে জিতলো বা হারলো- সেটা বড় কথা নয়। যুদ্ধ কারো কোনো উপকার করতে পারে না।
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ্বের কারণে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে এমন ধারণাও করা হচ্ছে। সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়। কারণ বিশ্ববাণিজ্যের হিসাবনিকাশ অনেক ভাবে হয়। নিত্যপণ্যের মধ্যে গমের দাম বাড়লো কিনা- এই প্রশ্ন অনেকেরই আছে। কারণ রাশিয়া বিশ্বের সর্ববৃহৎ গম উৎপাদনকারী দেশ, ইউক্রেনের স্থান পঞ্চম। এই দুটি দেশ বিশ্বের এক-চতুর্থাংশ গম রপ্তানি করে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ্বের কারণে গমের দাম ২.৫% বেড়েছে। কিন্তু, এই দুটি দেশের একটিও বাংলাদেশে গম রপ্তানি করছে না, বাংলাদেশের গম প্রধানত আসে ভারত থেকে। রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ পরোক্ষভাবে হলেও বাংলাদেশের গম আমদানিতে প্রভাব ফেলছে, কারণ যুদ্ধের কারণে কৃষ্ণসাগর দিয়ে কোন কার্গো আসতে পারবে কিনা সে অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের গমের রপ্তানি চাহিদা বেড়েছে। ভারত গমের দাম বাড়িয়েছে বিধায়, বাংলাদেশে গমের দাম বেড়েছে।
বাংলাদেশে আমদানি করা গমের ৭০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। সম্প্রতি মাত্র দু'সপ্তাহের ব্যবধানে মণ প্রতি গমের দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকা বেড়েছে। আমাদের বুঝতে হবে, কোনো একটি দেশের ওপর এককভাবে আমদানির জন্যে নির্ভরশীল হলে, অসম বাণিজ্যের অবস্থা তৈরি হয়। পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও আমরা একই অবস্থা দেখি।
নানান কারণেই নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে; একইসাথে কমেছে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা- এই সত্য সরকারের উচ্চ মহলে মানতে না চাইলেও—সেটাই বাস্তবতা। কোভিড মহামারি যে শুধুমাত্র জনস্বাস্থ্যের বিষয় ছিল না, এর সাথে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়েছিল তা এখন পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার প্রতিরোধমুলক ব্যবস্থা নিতে গিয়ে লকডাউন, শাটডাউনসহ মানুষের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ সাধারণ মানুষের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, আয় কমেছে ৯৫ শতাংশ মানুষের, কাজ হারিয়েছেন ৬২ শতাংশ পেশাজীবী এবং কর্মহীন হয়েছেন ২৮ শতাংশ মানুষ। এই সব মানুষকেই প্রতিদিন বাজারে গিয়ে খালি হাতে বা স্বল্প পরিমাণ কিনে ঘরে ফিরতে হয়, কারণ নিত্যপণ্যের দাম তাদের নাগালের বাইরে।
টিসিবির ট্রাকে বিক্রি যে সমাধান নয়, তা ইতিমধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে, কারণ সমস্যার ওজন অনেক বেশি। মন্ত্রী এবং উচ্চপর্যায় থেকে সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার যে কৌশল নেওয়া হয়েছে তাও কাজে লাগছে না। তাই প্রয়োজন প্রতিটি পণ্যের উৎপাদন ও আমদানির বিষয় পর্যালোচনা করে এ বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার। খাদ্যপণ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব, আর সেটাই আমাদের করতে হবে। আমদানি নির্ভরতা কমাতে হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই লেখাটি ১৫ মার্চ, ২০২১ তারিখে 'নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।