নাহিদ হত্যা: বাবা বিচার না চেয়ে সবার বিবেকে আঘাত করেছেন
ফরিদা আখতার || Tuesday 26 April 2022 ||আসলে তাঁরা বলতে চেয়েছেন বিচার পাই না, ন্যায়বিচার হয় না, অপরাধীরা পার পেয়ে যায় তাই বিচারের প্রহসন চাই না। বিচার চাইতে পাল্টা আরো নির্যাতনের শিকার হবার আশংকায় কেউ এখন আর বিচার চায় না।
রমজান মাসে ঈদের বাজারের জন্য মধ্যবিত্তদের কাপড়-চোপড়সহ সকল পণ্যের কেনাকাটার একটি এতিহ্যবাহী স্থান হচ্ছে নিউ মার্কেট। নাম নিউ মার্কেট হলেও এর বয়স সত্তর বছর হচ্ছে প্রায়। তৎকালীন সময়ের আধুনিক বিপণি কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল আধুনিক নামে 'নিউ মার্কেট'। সেই ঐতিহ্য এই কালে এসেও এতো শপিং মলের দাপটেও বিন্দুমাত্র কমাতে পারে নি।
নিউ মার্কেট একা নয়, এর আশে পাশে আরও বেশ কয়েকটি মার্কেট যেমন আছে তেমনি আছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেমন ঢাকা কলেজ, ইডেন গার্লস কলেজ, একটু দূরে গেলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, এবং বলাকা সিনেমা হল সব কিছু মিলিয়েই নিউ মার্কেট। বর্তমানে যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রী তারা জন্ম থেকেই এই নিউ মার্কেট দেখেছে, তাদের মা-বাবারাও এই নিউ মার্কেট দেখে এবং ব্যবহার করে কাটিয়েছেন।
কিন্তু এখানেই ঘটে গেল এক মর্মান্তিক সংঘর্ষ! এই রমজান মাসে। করোনার কারণে দুই বছর মানুষ ঈদের বাজার করতে পারেনি, তাই এবার একটু ভিড় দেখা যাচ্ছে। এমন একটি ব্যস্ত সময়ে ১৮ এপ্রিল রাত ১১টায় নিউ মার্কেট ও ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা শুরু হয়, চলেছে টানা দুই তিন দিন। খুব সাধারণ ঘটনা, দুটি ফাস্টফুডের দোকানের (ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল) কর্মচারীদের মধ্যে বিরোধের জেরে এই সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। সেখানেই শেষ হতে পারতো, হতাহতের ঘটনা পর্যন্ত গড়ালেও নিউমার্কেটের ভেতরে যারা ছিলেন তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারতো, কিন্তু সেটা হয় নি।
পরের দিনের সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকা কলেজ সহ আশেপাশের রাস্তায়। টেলিভিশন ও সকল সংবাদ মাধ্যম লাইভ করেছে, পুলিশের সাথে শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ীদের সাথে সংঘর্ষ, ইটপাটকেল ছোড়াছুড়ি হয়েছে, টিয়ার গ্যাস, গুলি – যেন এক রণক্ষেত্র। এখানে হতাহতের ঘটনা ঘটবে না তা তো হতে পারে না। হয়েছেও তাই। অনেকে আহত হয়েছেন দু'জন তরতাজা তরুণ প্রাণ হারিয়েছে। দুর্ভাগ্য আমাদের।
এই সংঘর্ষের কোনো পক্ষের সাথে যুক্ত না হয়েও নাহিদ হোসেন, একজন কম্পিউটার সরঞ্জামের ডেলিভারি ম্যান, ওদিকে যেতে সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে গিয়ে নিহত হয়েছেন। নাহিদের বয়স মাত্র ২০ বছর, মাত্র ৬ মাস আগে এই অল্প বয়সেই ডালিয়ার সাথে তার বিয়ে হয়েছে। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় ছিল সে। সংসারের দায়িত্ব তার ওপরেই ছিল। নাহিদ সম্পর্কে এসব তথ্য আমাদের আবেগপ্রবণ করে। সোশাল মিডিয়াতে তার স্ত্রীর হাতের মেহেদীর রং দেখানো হয়েছে, কিন্তু এটা কি যথেষ্ট?
এমন নয় যে ইট-পাটকেল গোলাগুলির মধ্যে নাহিদ পড়ে গিয়েছিলেন, সেরকম কিছু হয় নি। নাহিদ সংঘর্ষের এলাকায় গিয়েছিল, কিন্তু তাকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কেন? কী অপরাধ ছিল তার? একটি ইংরেজি দৈনিকের ছবি ভাইরাল হয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে তার ওপর হামলা হয়েছে, তাকে হেলমেট পরা কিছু যুবক হাতুড়ি, রামদা দিয়ে মারছে, তাকে কোপানো হয়েছে। এই সময় পুলিশ কোথায় ছিল? কেন তারা এই হত্যাকারীদের বিরত করতে পারলো না? গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হলেও তাঁকে বাঁচানো যায়নি। যারা তাকে কুপিয়েছে তাদের ছবি আছে, তাদের চেনা যাচ্ছে; অর্থাৎ হত্যাকারীদের পরিষ্কারভাবে শনাক্ত করা যাচ্ছে; কিন্তু কাউকে আসামিও করা হয়নি, এবং গ্রেপ্তারও হয়নি। ছাত্রলীগের কর্মীদের নাম এবং পরিচয় পাওয়া গেলেও কিছু করা হচ্ছে না।
আরও একজন নিহত হয়েছেন তিনি হচ্ছেন মোরসালিন। একটি দোকানের কর্মচারী। মোরসালিনের বড় ভাই অজ্ঞাত পরিচয় ১০০-১৫০ ব্যাক্তির বিরুদ্ধে নিউমার্কেট থানায় মামলা করেলেও নাহিদের বাবা কোন মামলা করেননি। তিনি বলেছেন কারো কাছে বিচার চাই না। বিচার চেয়ে কী হবে? কার কাছে বিচার চাইব? মামলাও করতে চাই না। নাহিদের মা নার্গিসেরও একই কথা, 'আমরা বিচার চাই না। নাহিদকে তো ফেরত পাব না। বিচার চেয়ে কী হবে? বিচার চাইলেই তো আর বিচার পাব না। আমার ঘর-সংসার কীভাবে চলবে?' এসব কথা যে আমাদের শুনতে হয় এর চেয়ে লজ্জার আর কী হতে পারে?
নাহিদের বাবা বিচার চান না, আসলে কি তাই? কি পরিস্থিতিতে কোন বাবা নিরপরাধ সন্তানের নৃশংস হত্যার বিচার কি না চাইতে পারেন? তাঁর এই কথা সরবে যারা বিচার দাবী করে তার চেয়েও বেশি উচ্চ স্বরে শোনা যাচ্ছে, বিচার চাই, বিচার চাই রবে। নাহিদের স্ত্রী ডালিয়া সুলতানা কথায় তার প্রতিফলন ঘটছে। তিনি বলেছেন "আমরা গরিব বইলা কেউ বিচারের কথা কয় না। কিন্তু আমি ন্যায্য বিচার চাই। গরিব বইলা আমাগো বিচার থাকবো না, তা না"।
বিচার চাই না, কার কাছে বিচার চাইবো এমন কথা এর আগে সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত বদরুন্নেসা কলেজের ছাত্রী সামিয়া আফরিন প্রীতির বাবাও একই কথা বলেছেন, বিচার চাই না। আসলে তাঁরা বলতে চেয়েছেন বিচার পাই না, ন্যায়বিচার হয় না, অপরাধীরা পার পেয়ে যায় তাই বিচারের প্রহসন চাই না। এভাবে প্রচুর ঘটনার উদাহরণ দেয়া যাবে যেখানে হত্যাকাণ্ড, খুন, নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের বিচার চাওয়ার ইচ্ছাও খুন হয়ে গেছে। বিচার চাইতে পাল্টা আরো নির্যাতনের শিকার হবার আশংকায় কেউ এখন আর বিচার চায় না।
নাহিদের ঘটনা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নাহিদ যদি শিক্ষার্থী হতো হয়তো তার হত্যার বিচার চেয়ে মিছিল মিটিং হোত। কিন্তু সে সাধারণ একজন নাগরিক। তার পক্ষে কেউ নামছে না। যারা বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না, তারা বিবেকের তাড়নায় পত্র-পত্রিকায় লিখছেন, সংবাদমাধ্যমও যথাসাধ্য বিষয়টি তুলে ধরছে। কিন্তু এর রেশ কি বেশিদিন ধরে রাখা যাবে? আমার সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
আমরা যারা নারী আন্দোলন করি আমরা জানি নির্যাতিত নারী যদি সমাজের প্রভাবশালীদের অংশ না হয়, কিংবা যারা নির্যাতন করছে তারা যদি বেশি প্রভাবশালী হয়- যাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে প্রশাসন , মিডিয়া, বিচার বিভাগ কেউ সাহস করে না সেক্ষেত্রে নির্যাতিত নারী কোন বিচার পায় না। বরং বিচার চাওয়ার অপরাধে তাকে এবং তার পরিবারকে আরো হয়রানির শিকার হতে হয়। কিশোরী মুনিয়া হত্যার বিরুদ্ধে কেউ কি কিছু করতে পেরেছে? বরং তার বোন বিচার চাইতে গিয়ে নিজেই বিপদে পড়েছে। আর যিনি অপরাধী তিনি সমাজের উচ্চ মহলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন অনায়াসে।
আমরা দেখেছি শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরী না দেয়ার জন্যে শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে রাস্তায় নামে আর দাবী-দাওয়া তোলে। তাদের মজুরি দেয়ার আশ্বাস না দিয়েই তাদের ওপর চড়াও হয় মালিক পক্ষ, পুলিশও তাদের পেটায়। প্রশাসন একবারও কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে প্রশ্ন তোলে না শ্রমিকদের পাওনা দেয়া হচ্ছে না কেন? এই শ্রমিকরা কি কখনো বিচার চেয়েছে, না বিচার পেয়েছে?
নাহিদের বাবা বিচার না চাইলেও নাহিদের স্ত্রী বিচার চেয়েছেন। কোনো আইনজীবি বা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান কি তার পক্ষে বিচার চাওয়ার লড়াইটা করতে পারে না? এই উদ্যোগগুলো কেন দেখা যাচ্ছে না?
গরিব এবং নির্যাতিত মানুষ বিচার না পাওয়ার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক অরাজকতা এবং ক্ষমতাসীনদের সাথে সম্পৃক্ততার কারণে বেপরোয়া আচরণ এবং প্রশাসনের প্রশ্রয়। তাই যদি হয়, তাহলে এই আদরের দুলালদের বিরুদ্ধে বিচার চাওয়ার তো কোন সুযোগ নেই।
গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা একটি দেশকে আন্তর্জাতিকভাবে মানবাধিকার লংঘনের দায়ে চিহ্নিত করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে নির্যাতিত হয়েও বিচার না চাওয়া কি বিচার না পাওয়ার সম পর্যায়ে পড়ে না? এটা কি তাহলে মানবাধিকার লংঘন নয়? আন্তর্জাতিক মহল কি এই বিষয়ে নিশ্চুপ থাকতে পারে? আর দেশের বিচার বিভাগ কি এই অমানবিক পরিস্থিতির নীরব দর্শক হয়ে থাকবেন?
বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই লেখাটি ২৫ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে 'নাহিদ হত্যা: বাবা বিচার না চেয়ে সবার বিবেকে আঘাত করেছেন' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী