ভয়াল ২৯ এপ্রিল যেন আর না আসে সেই চেষ্টা কি আমরা করছি!
ফরিদা আখতার || Saturday 07 May 2022 ||ঘূর্ণিঝড়ের ভয়ংকর রাতে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া সম্ভব ছিল না। শেষ সময়ে অনেকে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়ে, যাবার সময় মা-বাবাকে নারিকেল গাছের সাথে বেঁধে রেখে যান।
২৯ এপ্রিল। ১৯৯১ সালের এই দিনে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল কক্সবাজার, মহেশখালী, চকরিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, সন্দ্বীপ, হাতিয়া, সীতাকুণ্ড পতেঙ্গাসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলীয় এলাকা। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিমি (১৫৫ মাইল/ঘণ্টা) এবং তার সাথে ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছ্বাস। এই ঝড়ে মৃত্যুবরণ করেন ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন মানুষ এবং তার চেয়েও বেশি মানুষ আহত হয়। আশ্রয়হীন হয়েছিল কোটি মানুষ। ক্ষয়ক্ষতির বিচারে এই ঘূর্ণিঝড় বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হিসেবে পরিচিত।
মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে বঙ্গোপসাগরে গভীর নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছিল ২২শে এপ্রিল থেকেই। ২৪ এপ্রিল নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয় এবং ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকে; ২৮ ও ২৯ এপ্রিল তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়ে রাতে আঘাত হানে এবং এর গতিবেগ পৌঁছায় ঘণ্টায় ১৬০ মাইলে।
ক্ষয়ক্ষতির কারণ হিসেবে পত্রপত্রিকায় লেখা হচ্ছে 'সেসময় অনেকেই ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা বুঝতে পারে নি বলে সাইক্লোন সেন্টারে যায় নি। বার বার মাইকিং করা সত্ত্বেও বাড়ি ঘর ছেড়ে যেতে চায় নি'। এটাও ঠিক যে তখন সাইক্লোন সেন্টারও যথেষ্ট ছিল না। যাবেই বা কোথায়? পরিবারে বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। শেষ সময়ে অনেকে ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়ে যাবার সময় বৃদ্ধ মা-বাবাকে নারিকেল গাছের সাথে বেঁধে গেছেন। বাতাসের তীব্র গতিতে গাছের সাথে দুলতে দুলতে কেউ কেউ বেঁচেও গিয়েছিলেন, আবার ভেসেও গেছেন এমন দুঃখের কথাও আমরা শুনেছি চকরিয়া উপজেলার বদরখালির মানুষের কাছে। ঘূর্ণিঝড়ের আগে আমরা সেই এলাকায় গবেষণার কাজে গিয়েছিলাম বলে এলাকার মানুষের সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের পরে আমরা এলাকায় আবার যখন ফিরে যাই তখন জেনেছিলাম অনেক কথা। নারীরা বলেছিলেন আমরা গরু-ছাগল হাঁস-মুরগি রেখে যাই কেমন করে? এটা নিয়ে অনেকে হেসেছিলেন, কিন্তু ওদের কথায় এটা পরিষ্কার ছিল যে পরিবার বলতে ওদের কাছে শুধু মানুষ নয়, ঘরের পশুপাখিও তাদের পরিবারের অংশ। তাদের ফেলে যাবেন এমন স্বার্থপর তারা নন। সাইক্লোন শেল্টারগুলোতে গবাদীপশু রাখার ব্যবস্থা তখন ছিল না, এখনও নেই। শুধু মানুষ বাঁচানোর চেষ্টা। আবার এই মানুষ যখন অন্য প্রাণীর জন্যে আকুল হয় তখন তাদের সচেতনতার অভাবের কথা বলা হয়।
১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় অনেক বেশি মাত্রার ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু এতো ক্ষয়ক্ষতি কি শুধুমাত্র সে কারণেই হয়েছে? এতো তীব্র মাত্রার ঘূর্ণিঝড় হলে তো ক্ষয়ক্ষতি হবেই। কিন্তু মানুষের কি কোন দায় নেই? এতোদিনেও এই কথাটি কেউ বলছেন না যে রপ্তানিমুখী চিংড়িচাষের জন্যে গত শতাব্দীর আশির দশকে উপকূল অঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্যারাবন বা ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে ঘের বানানো হয়। চকরিয়া সুন্দরবনের প্রায় ৩৫৭৭ হেক্টর বন এলাকা চিংড়ির জন্যে সাফ করে দেয়া হয়েছিল। চিংড়ি রপ্তানি করে দেশে ডলার আসবে তাই এর নাম হয়েছিল 'হোয়াইট গোল্ড'। সোনালী আঁশ পাট ধ্বংস করে সাদা সোনার দিকে ছুটেছে দেশ বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ এর পরামর্শে। এরশাদ আমলে এই চিংড়ি চাষ ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। চিংড়ি চাষের বিরোধিতা করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হতো। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর আমরা সেখানে গিয়ে মানুষের আহাজারির মধ্যে শুনতে পাই প্যারাবন ধ্বংস হবার কারণে ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে। তাই এলাকার মানুষের পরামর্শে ১৯৯২ সাল এখন পর্যন্ত উবিনীগের উদ্যোগে বদরখালি ইউনিয়ন থেকে মহেশখালি চ্যানেল পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার কেওড়া ও বাইন লাগানো হয়, আবার ১৯৯৭ সালে ৫০ একর জমিতে লাগানো হয়। ধাপে ধাপে এই প্যারাবন লাগাবার কাজ চলছে যা এখন পর্যন্ত অব্যাহত আছে। বলাবাহুল্য, এখনও চিংড়িঘেরের ব্যবসায়ীরা সুযোগ এলেই গাছ কাটতে উদ্যত হয়। সারাক্ষণ পাহাড়া দিয়ে রাখতে হয়। ১৯৯১ সালের পর ছোট-বড় আরও কয়েকটি ঘূর্ণিঝড় (যেমন ইয়াশ),, কিন্তু যেখানে প্যারাবনের গাছগুলো বড় হয়ে গেছে সেখানে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কম হয়েছে, এটা প্রমাণিত। চিংড়ি ঘেরের মালিকরা প্যারাবন কেটে ঘের বানিয়েছে এবং প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা খরচ করে বাঁধ মেরামত করছে অথচ প্যারাবন দিয়ে ঘেরা জায়গায় কোন বাঁধ নষ্ট হয় নি।
এলাকার কৃষকরা জানিয়েছেন এই প্যারাবনে প্রচুর পরিমানে উলু খেড় (উলু ঘাস) আছে। উলু খেড় (উলু ঘাস) গরু ও ছাগলের জন্য খুব ভাল খাদ্য। কয়েক মাস একাধারে গরু ও ছাগলকে এই ঘাস খাওয়ালে গরু-ছাগল মোটাতাজা হয়ে উঠে। অন্যান্য ঘাস ও গাছপালা আপনা থেকে গজিয়ে ওঠে। প্যারাবনে প্রচুর পাখি, কাঁকড়া ও মাছ দেখা যায়। বর্ষা মৌসুমে মাছেরা ডিম দেয়ার জন্য প্যারাবনে চলে আসে। প্যারাবনের ভিতরে ও আশেপাশে প্রচুর পরিমাণে চিংড়ি মাছ পাওয়া যায়। প্যারাবনের এলাকা মাছের ডিম পারার জন্যে খুব ভাল জায়গা, পাতা এবং শেকড় মাছের খাদ্য হিসেবেও খুব ভাল।
এলাকার ছোট ছোট ছেলেমেয়ে এবং মহিলা কেওড়া ফলের মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে কেওড়া ফল খায়। অধিকাংশ কেওড়ার ফল পাকার পর গাছ থেকে ঝরে পড়েছে। সেই ফলের বীজ থেকে কেওড়া ও বাইন গাছের নীচে হাজার হাজার ছোট ছোট চারা গজিয়ে ওঠে, যা আবার নতুন করে লাগানো যায়। পাখিদের আনাগোনাও অনেক বেড়ে যায় বিশেষ করে বক পাখি, টিয়া, ঘুঘু, চড়াই, ডাহুক, পানকৌড়িসহ অনেক পাখি দেখা যায়। কিছু বন্য পশু তাদের খাদ্য খুঁজে পায়।
কেওড়া চারার তুলনায় বাইন চারা অনেক বেশি দেখা যায়। কেওড়ার গাছ তুলনামূলক দুর্বল, এজন্য ডালপালা ভাঙ্গে বেশি। তবে এই ভাঙ্গা ডালপালা ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কুড়িয়ে নিয়ে যায় রান্নার খড়ি হিসেবে। অন্যদিকে বাইনের গাছ এতো শক্ত যে ছোট ডালে প্রাপ্তবয়স্ক একজন উঠলেও ডাল ভাঙ্গে না। কেওড়া গাছের পাতা খুবই নরম এবং গরু ছাগলের খুব পছন্দের এজন্যও কেওড়া গাছের সংখ্যা কম দেখা যায়।
আজ ভয়াল ২৯শে এপ্রিল স্মরণ করতে গিয়ে বলতে চাই এই তান্ডবের ভয়াবহ ক্ষতি প্রকৃতির কারণে নয়, মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের কার্যকলাপের ফল। প্যারাবন ধ্বংস করে যে ডলার এসেছে তা কি জনগণের কোন উপকারে লেগেছে? লাগেনি। চিংড়ির ব্যবসাও এখন তেমন রমরমা নয়, কারণ পশ্চিমা দেশে এখন "সচেতনতা " বেড়েছে, তারা এন্টিবায়োটিক দেয়া চিংড়ি খাবে না বলে দিয়েছে। তারা বলে নি, প্যারাবন ধ্বংস করা চিংড়ি খাবো না!!
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মধ্যে বন্যা খরার মতো ঘূর্ণিঝড়ের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে এবং আমাদের উপকূল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিশ্বে চিহ্নিত হয়ে আছে । অথচ কোন নীতিনির্ধারণী আলোচনায় ম্যানগ্রোভ রক্ষার জন্যে চিংড়ি ঘের বন্ধ করার কোন উদ্যোগ দেখি না। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ ধ্বংস করে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেও থামানো যাচ্ছে না।
ভয়াল ২৯ এপ্রিল যেন আর না আসে সেই চেষ্টা কি আমরা করছি? ঘূর্ণিঝড় ঠেকানো না গেলেও ক্ষয়ক্ষতি তো ঠেকাতে পারি।
ছবি: আব্দুল জব্বার, মোহাম্মদ আলী আকবর ও আবুল কালামের সৌজন্যে
তথ্য: উবিনীগ মাঠ কর্মীদের প্রতিবেদন
বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই লেখাটি ২৯ এপ্রিল, ২০২২ তারিখে 'ভয়াল ২৯ এপ্রিল যেন আর না আসে সেই চেষ্টা কি আমরা করছি!' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।