তামাক সেবন এবং তামাক চাষ কেন বন্ধ করা প্রয়োজন ?
এম. এ. সোবহান || Tuesday 14 June 2022 ||তামাকের আর এক নাম বিষ। তামাকের সর্বাঙ্গে বিষ। তামাক গুল্ম হিসাবে যেমন বিষ; পণ্য হিসাবেও তেমনই বিষ। তামাক’কে আমরা যে নামেই চিনি তা কেবলই বিষ। তামাক নিরব ঘাতক। তমাক মানেই মানুষ তথা প্রাণীকূলের অপকার।
তামাকের একটি ব্যবহারের কথা আমরা জানি যা মানুষের উপকার হিসাবেও গণ্য করা যায়। আজ আমি তামাকের তেমনই একটি ব্যবহারের কথা জানাতে চাই।
বাংলাদেশের দক্ষিণের উপকূলীয় অঞ্চলের কৃষকরা আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে চাষাবাদের কাজে যখন মাঠে যান তখন তারা কাজের ফাঁকে হুকেয় করে তামাক সেবন করেন। তামাক সেবন শেষে হুকোর পানি বদল করেন।হুকোয় ব্যবহৃত পানি তারা ফেলে দেন না।বরং একটি পাত্রে ধারণ করেন।
মাঠে সে সময় পানি থাকে। পানিতে জোঁক থাকে। জোঁক মানুষকে এবং গরুকে কামড়ে ধরে। জোঁক কামড়ে ধরলে ছাড়ানো বেশ কষ্টসাধ্য কাজ।কৃষকরা তখন পাত্রে রাখা হুকোয় ব্যবহৃত পানিতে হাত ভিজিয়ে জোঁক ধরেন। জোঁক সহজেই কামড় ছেড়ে দেয়। এ অবস্থাই জোঁককে পাত্রে রাখা হুকোর পানিতে ছেড়ে দেয়া হয়। জোঁক সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু বরণ করে।
জোঁকের মৃত্যুর কারণ তামাকের নিকোটিন। আমরা যারা তামাক সেবন করি তারা কি জানি? কত মারাত্মক বিষ আমরা জেনে শুনে পান করছি। আমাদের সন্তানদের, প্রিয়জনকে পরোক্ষ ধুম পানের শিকারে পরিণত করছি। বিষের সাগরে ভাসিয়ে দিচ্ছি। আমার জোড় হাত বিনীত প্রার্থনা ধুমপানছেড়ে দিন। তামাক সেবন ত্যাগ করুন। পরিবেশকে বিষ মুক্ত করুন। সন্তানদের নির্মল বায়ু সেবনের সুযোগ দিন।
তামাক সেবন প্রত্যক্ষ যেমন ক্ষতিকর, পরোক্ষ সেবনও প্রায় সমভাবে ক্ষতিকর। মানব দেহে নিকোটিনে সংবেদনশীল স্থান মানুষের মস্তিস্ক। স্বাভাবিক চিন্তা শক্তিকে বিঘ্নিত করে। মেধা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। সেবনকারি ব্যক্তির বয়স যত কম হয় ক্ষতির পরিমান তত বেশী হয়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা আরও কার্যকর করা জরুরী প্রয়োজন।
তামাক সেবন যেমন কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন তেমনই তামাক উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। কারণ, তামাক চাষ কৃষি পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। গাছ হিসাবে তামাকের এলিলোপ্যাথিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মাঠে থাকা অবস্থায় আশে পাশে অন্য গাছকে বাড়তে বাঁধা দেয়।এমনকি তামাক গাছ কেটে নেয়ার পরেও তামাক গাছের শিকড়, পাতার অংশ ইত্যাদি যা মাটিতে থেকে যায় তার বিষক্রিয়ায় পরবর্তী ফসল উৎপাদন ব্যহত হয়।
আমরা জানি তামাক একই জমিতে বেশী দিন চাষ করা হয় না। তামাক চাষ শুরু হয়েছিল রংপুর জেলায়। পরে তা চলে যায় কুষ্টিয়ায়। এখন হচ্ছে বান্দরবনে। তামাক আবাদের স্থান পরিবর্তনের অনেকগুলি কারণ রয়েছে। তামাক দ্রুত মাটির উৎপাদিকা শক্তি নষ্ট করে দেয়। তামাক পাতা প্রক্রিয়াজাত করার জ্বালানি কাঠের অভাব দেখা দেয়।
তামাক গাছের শিকড়ে এক ধরণের পরগাছা জন্মায়। তামাকের শিকড়েই এর বীজ গজায়। এর নাম অরোব্যাঙ্কি (orobanche)। কুষ্টিয়ায় স্থানীয় ভাবে একে মূলা বলে। বংশগত ভাবে এ প্রজাতিকে হতভাগ্য। এর পাতা ও কান্ডে কোনো সবুজ কণিকা (chlorophyll) নাই।
সালোকসংশ্লেষনের মাধ্যমে খাদ্য উৎপাদন করতে পারে না। ফুলেফলে শোভিত অরোব্যাঙ্কি একটি সুদর্শন গাছ। তবে খাদ্যের জন্য পরনির্ভরশীল। পরগাছা। অবলম্বন (host) হিসাবে তামাক প্রথম পছন্দ। সোলানেসি পরিবারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ফসল অরোব্যাঙ্কির বিকল্প অবলম্বন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে গোলআলু, বেগুন, টমেটো, মরিচ, ইত্যাদি।
অরোব্যাঙ্কি একটি আগ্রাসি পরগাছা। একই জমিতে বারবার তামাক চাষ করলে এ পরগাছার আক্রমণ বেড়ে যায়। ফলে তামাকের ফলন কমে যায়। তাই তামাক চাষী বাধ্য হয়ে নতুন জমিতে তামাক চাষ করেন।
গোলআলু, বেগুন, টমেটো ও মরিচের মত গুরুত্বপূর্ণ ফসলের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার স্বার্থে অরোব্যাঙ্কির মত পরগাছার বিস্তার ঠেকাতে তামাকের চাষ বন্ধ করা প্রয়োজন। তদুপরি তামাকের মত মারাত্মক ফসলের চাষাবাদ বজায় রাখতে গিয়ে নতুন নতুন জমিতে তামাক চাষ সম্প্রসারণ করলে খাদ্য উৎপাদন ব্যহত হবে। দেশ খাদ্য ঘাটতিতে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে জরুরী ভাবে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।