কৃষক ও প্রাণবৈচিত্র্যের স্বার্থে বীজনীতি ও বীজ আইন সংস্কার করুন
ফরিদা আখতার || Thursday 22 September 2022 ||শুধু প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশসংক্রান্ত উচ্চতর বিজ্ঞানে নয়, কৃষিবিজ্ঞানের খুবই প্রাথমিক এলাকা হচ্ছে বীজ ও কৃষকের বীজ ব্যবস্থা। খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনগুলোয় তাই এ কথা প্রায়ই স্বীকার করা হয় যে, কৃষকই জানেন উন্নত মানের খাদ্য একমাত্র ভালো বীজ থেকেই আসে। আন্তর্জাতিক খাদ্য ও কৃষি সংস্থাকেও স্বীকার করতে হয় যে, খাদ্য সার্বভৌমত্ব অর্জনের জন্য কৃষকের বীজ ব্যবস্থার সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি, পাশাপাশি কৃষকের অধিকার তো অবশ্যই। (দেখুন, ফারমার সিড সিস্টেমস: আ ক্রিটিক্যাল কন্ট্রিবিউশন টু ফুড সভিরেনটি অ্যান্ড ফারমার্স রাইট)।
ফসলের চাষাবাদ বা ফসলকে গার্হস্থ্যবিদ্যার অন্তর্গত করার ইতিহাস অনেক পুরনো, কমপক্ষে ১০ হাজার বছর আগে থেকে এর শুরু। কৃষকের বীজ ব্যবস্থার ইতিহাসও তেমনি অতি প্রাচীন। বাংলাদেশে তিন নদীর মোহনা ও বদ্বীপে যখন থেকে আবাদ শুরু হয়েছে সেই অতীত কাল থেকে কৃষক বীজ আবিষ্কার করতে শুরু করেছেন, নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন। সেই বীজের ব্যবস্থাপনার জন্য কৃষকের কার্যকর বীজ ব্যবস্থাপনার বিদ্যা ও চর্চাও গড়ে উঠেছে।
খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলেছে বলে নয়, এটা স্রেফ কাণ্ডজ্ঞান যে, এ কৃষকরা মূলত বীজ উদ্ভাবন ও বীজ আবিষ্কার করেছেন যার ওপর সারা দুনিয়ার মানুষ খাদ্যের জন্য নির্ভরশীল। যেসব ফসল কৃষক পরিবার আবাদের অধীনে এনেছেন তার সবই কৃষকেরই উদ্ভাবন, কৃষকের আবিষ্কার। বাংলাদেশে সেই আবিষ্কারের সংখ্যা কমপক্ষে ১৫ হাজার। কৃষকের আবিষ্কারের এ ঐতিহ্যগত প্রণোদনা, বীজের ওপর কৃষকের অধিকার ও যত্নশীল তত্ত্বাবধানের ক্ষয় ঘটেছে মারাত্মকভাবে। আজকাল বিজ্ঞানী বা করপোরেট কোম্পানি যে বীজ তাদের আবিষ্কার বলে দাবি করে তাদের মূল উৎস কিন্তু কৃষকেরই বীজ। তারা সেই সত্য লুকোতে চায় বলে ধানের নাম হয় সংখ্যা দিয়ে। যেমন ব্রি ২৯, ব্রি ২৮ ইত্যাদি। এতে কৃষকের বীজকে একটু বদলিয়ে তাকে নিজেদের আবিষ্কার বলে দাবি করার সুবিধা তৈরি হয় এবং আধুনিক বলে দেখানো যায়। তাই বলা হয়, নম্বরি বীজ আদতে কৃষকের বীজ চুরি করার একটা পদ্ধতি হয়ে উঠেছে, এতে বীজের উৎস গোপন রাখা সম্ভব হয় এবং এখন বীজ কোম্পানিগুলো অনায়াসে কৃষকের বীজ ডাকাতি করতে পারে। বীজ ডাকাতিকে বলা হয় ‘বায়োপাইরেসি’। এ বিষয়গুলো দীর্ঘকাল ধরেই আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হচ্ছে; নতুন কিছু নয়।
কৃষকের বীজ ব্যবস্থা মানে তাহলে বিজ্ঞানী কিংবা সরকারি উদ্যোগে প্রাতিষ্ঠানিক বীজ ব্যবস্থার বিপরীতে বাংলাদেশের কৃষকদের উদ্ভাবিত স্থানীয় জাতের বীজ। ল্যাবরেটরিতে ‘বিজ্ঞানীদের’ উদ্ভাবিত বীজের মধ্যে সংখ্যা এবং বিভিন্ন ব্যবহারের দিক থেকে বিচার করলে বাংলাদেশে এখনো কৃষকদের বীজের গুরুত্বই বেশি। এ কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। কৃষকের বৈচিত্র্যপূর্ণ ধান যদি না থাকত তাহলে আমাদের মুড়ি, চিড়া, খৈ, পোলাও, খিচুড়ি, পিঠা, পায়েস ইত্যাদির নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক চাহিদা মেটানো অসম্ভব হতো। ঈদ, পূজায় বা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রয়োজনীয় খাদ্য তৈরি করা যেত না। পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন করাও সম্ভব হতো না।
বাঙালি ভেতো বলে পরিচিত হলেও তারা শুধু ভাত খায় না। আমাদের গ্রামের কৃষকরা বিভিন্ন মৌসুমে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য তৈরি করেন এবং তার জন্য চাই নির্দিষ্ট জাতের ধান। তাই তারা সেভাবেই তাদের জমি অনুযায়ী ফসল উৎপাদন করেন। যে জাত তাদের কাছে নেই, কৃষকরা একে অন্যের সঙ্গে বিনিময় করেন। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, তথাকথিত আধুনিক জাতের জন্য বাজারনির্ভরতা যত বাড়ছে ততই কৃষকের নতুন জাত আবিষ্কার ও বীজ ব্যবস্থায় ধস নামছে। খাদ্য ও বীজের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ক্ষেত্রে তা মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে।
কৃষকরা হাজার বছর ধরে নানা নামের এবং নানা ধরনের ধানের বীজ, সবজি, ডাল তেল নিজ নিজ এলাকার ভৌগোলিক ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চাষ করে আসছেন। এটাই আমাদের ঐতিহ্য। অথচ মাত্র ৫০-৬০ বছর আগে বিদেশের কিছু প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় যে ধানের বীজ উদ্ভাবন করা হয়েছে এবং এক কথায় ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে ‘আধুনিক জাত’ বলে, সেসবই এখন বাংলাদেশে কৃষিজমির অধিকাংশ অংশজুড়ে আছে এবং এ সম্প্রসারণের দায়িত্বে আছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ গ্রামে কৃষকদের নিজেদের রাখা স্থানীয় জাতের ধানের চাষ না করে ‘আধুনিক’ জাত উৎপাদন সম্প্রসারণ করছেন। বিজ্ঞানীরা নতুন জাত আবিষ্কার করবেন, সেটা ভিন্ন তর্ক। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা যখন আধুনিক জাত জবরদস্তি সম্প্রসারণ করছি তখন কৃষকের মাঠে দেশী জাত সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না কেন? কৃষকের বীজ গেল কোথায়?
বলা বাহুল্য, এ আধুনিক জাতের সঙ্গে প্যাকেজ হিসেবে জড়িয়ে আছে রাসায়নিক সার-কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচের জন্য ডিপ ও শ্যালো টিউবওয়েল ইত্যাদি। আরো লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা কাজ করছেন আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইআরআরআই) শাখা হিসেবে বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (বিআরআরআই)। অথচ ব্রির কাছে কৃষকের উদ্ভাবিত ধানের জাত সংগ্রহ করা আছে প্রায় ৭ হাজার ৪৩৯টির মতো। কিন্তু তাদের কী অবস্থা, আদৌ সেই বীজ থেকে ধানের চারা গজাবে কিনা তার কোনো খবর আমরা জানি না। যখন কৃষকের মাঠ থেকে বীজ ব্যাংকে জমা হয় তখন সেটা মৃত মানুষের লাশের মর্গের মতো। হারিয়ে যেতে সময় লাগে না। বিজ্ঞানীরাও তাই সব সময়ই দাবি করেন এয়ার কন্ডিশন লাগানো বীজ ব্যাংকে নয়, বীজ শুধু কৃষকের হাতে কৃষকের মাঠেই নিরাপদ। বীজ ব্যাংক তখনই ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে যখন কোনো দৈব দুর্যোগের ফলে কৃষক তার বীজ হারিয়ে ফেলেন। বিপর্যয়ের প্রস্তুতি হিসেবে বীজ ব্যাংকের দরকার আছে, কিন্তু আমরা খোদ কৃষি ব্যবস্থার মধ্য থেকেই বীজ নষ্ট কিংবা হারিয়ে ফেলেছি। এর দায় কে নেবে?
ব্রি নিজে বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে উদ্ভাবন করেছে উফশী এবং হাইব্রিড মিলে মাত্র ১০৮টি তথাকথিত আধুনিক জাত। এ ১০৮ জাতের সবগুলো কৃষকের মাঠপর্যায়ে সাফল্য পায়নি, কয়েকটি টিকেছে মাত্র। নিজেদের ঐতিহ্যময় ধানের জাত সংরক্ষণ ও প্রসার নিয়ে কাজ না করে তারা শুধু তথাকথিত আধুনিক জাতের প্রবর্তনের জন্য সর্বস্ব চেষ্টা করে যাচ্ছেন। খরচ হচ্ছে লক্ষ কোটি টাকা। কারণ বুঝতে অসুবিধা হয় না, আধুনিক জাতের সঙ্গে সার-কীটনাশকসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী স্বার্থ জড়িত রয়েছে, আমাদের নিজস্ব স্থানীয় জাতে সেই বালাই নেই। তাই আমাদের নিজস্ব জাত প্রবর্তন এবং তার প্রচারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে। সেটা সজ্ঞানে করা হয়েছে সার, বিষ ও সেচ মেশিন কোম্পানির স্বার্থে।
বাংলাদেশে কৃষকের সংখ্যা জানার জন্য কোনো শুমারি নেই, আছে জমির হিসাব, ফসলের হিসাব, সার-কীটনাশক ব্যবহারের হিসাব। কৃষি পরিসংখ্যান বর্ষগ্রন্থ (২০১৬) অনুযায়ী ১৯ লাখ, ৫৪ হাজার একর নিট আবাদি জমির ৩১ শতাংশ একফসলি, ৪৮ শতাংশ দো-ফসলি ও ২১ শতাংশ তিনফসলি জমি। বলা হয়ে থাকে যে, জনসংখ্যার ৫০ শতাংশ মানুষের জীবিকা কৃষি, আর ৭০ শতাংশ মানুষ পরোক্ষভাবে কৃষির সঙ্গে জড়িত। একটি সাম্প্রতিক (২০১৮) সালের রিপোর্ট অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল স্ট্যাটিস্টিকস থেকে জানা যায়, প্রায় ২ কোটি ৪৪ লাখ মানুষ কৃষির সঙ্গে জড়িত; কৃষি শ্রমিক আছেন প্রায় ৭৩ লাখ এবং ১৬ লাখের বেশি আছেন অন্যান্য কৃষিকাজে। এদের সঙ্গে পরিবারের সদস্য সংখ্যা যুক্ত করলে প্রায় ৫০ শতাংশের মতো মানুষ কৃষিতে যুক্ত ধরে নেয়া যায়। এরা সবাই কি আধুনিক জাতের ধানের আবাদ করছেন? উত্তর হচ্ছে না। এদের মধ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, যাদের জমির পরিমাণ এক হেক্টরের কম, তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। অথচ বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান তথ্য দিচ্ছে শুধু আধুনিক বা মডার্ন ভ্যারাইটি (এমভি) জাতের ধানের আবাদ সম্পর্কে। এ প্রতিষ্ঠানের মতে, মোট জমির ৯০ শতাংশ বোরো ধান, ২৫-৩০ শতাংশ আউশ এবং ৫০-৫৫ শতাংশ রোপা আমন চাষ করা হচ্ছে। এ তথ্যের মধ্যেই আছে যে, একমাত্র বোরো ধানের ক্ষেত্রে আধুনিক জাত বেশি চাষ করা হচ্ছে কিন্তু আউশ ও আমন বিশেষ করে বোনা আমন এখনো কৃষকের উদ্ভাবিত ধানের জাতের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু সে বিষয়ে আমাদের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাথাব্যথা নেই। সজ্ঞানে তারা কৃষকের বীজ হারিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে।
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের বীজনীতি ও বীজ আইন কি কৃষকের উদ্ভাবিত জাতের সুরক্ষার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে? সম্প্রতি ঝিনাইদহ সদর উপজেলার আসানসোল গ্রামের কৃষক হরিপদ কাপালীর উদ্ভাবিত একটি নতুন জাত ‘হরি ধান’ আবিষ্কার এবং ১৯৯৯ সালের পর থেকে এ ধানের বিষয়টি ব্যাপকভাবে প্রচার ও জনপ্রিয়তা পেলেও হরিপদ কাপালীর জীবিত অবস্থায় ধানটি একটি জাত হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। সেই দুঃখ নিয়েই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেছেন। যদিও শুধু হরিপদ কাপালী নন, স্বীকৃতি পায়নি কৃষকদের উদ্ভাবিত হাজার হাজার জাতের ধানও। এগুলো যেন আপনা থেকে হাওয়ায় ভেসে এসেছে। এর পেছনে শত শত বছর ধরে কৃষক পর্যবেক্ষণ করেছেন, নিজের জমির উপযোগী নির্দিষ্ট জাত নির্বাচন করেছেন। তবে এটাও ঠিক, আমরা হরিপদ কাপালীর মতো অন্য কৃষকদের কোনো ধানের জাতের নাম কখনো নিজের নামে করতে দেখিনি কিংবা এ ধানের স্বীকৃতি নিয়েও তারা দৌড়ঝাঁপ করেননি। কারণ কৃষক ব্যক্তির স্বীকৃতি বা নিজের স্বার্থে কাজ করেন না, কাজ করেন পুরো কৃষকসমাজের জন্য। তাই তার আবিষ্কৃত ধানের যেমন পেটেন্ট নেই, তেমনি নামের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করা অকৃষকসুলভ আদিখ্যেতাও নেই। কৃষকের ধানের নাম দেখে বোঝার উপায় নেই এ ধান কোন কৃষক উদ্ভাবন করেছেন। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি; পাটজাগ, গোপালভোগ, বেতিশাইল, দুধসর, টেপাবোরো, কালাবকরী ইত্যাদি ১৫ হাজার রকমের নাম। এখানে কোনো কৃষকের নাম নেই। ভারত উপমহাদেশ থেকে আদি ধান জাতের ক্রমবিকাশ ঘটেছে এবং সৃষ্টি হয়েছে ধান গণের (জিনাস)। ধান গণের নাম ‘ওরাইজা’; পরবর্তীকালে সৃষ্টি হয়েছে ওরাইজা সেটাইভা এবং ওরাইজা গ্লাবেরিমা। জাতের ইংরেজি শব্দ হচ্ছে ভ্যারাইটি এবং ধানের জাত ধরেই ধানের বৈচিত্র্য নির্ণয় করা হয়।
সরকারি স্বীকৃতি বা বাংলাদেশের তথাকথিত বীজ আইন, বীজনীতি ও বীজ রেজিস্ট্রিকরণ আইনই স্থানীয় জাতের আবাদ সম্প্রসারণ না হওয়ার মূল কারণ। বীজ আইন ও বীজের বিধিবিধান পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, এ আইন বা নীতি করা হয়েছে যেন স্থানীয় জাতের সম্প্রসারণ না হয়। পুরো বীজ আইন ও বীজের বিধিবিধান কৃষকের বিরুদ্ধে; কোম্পানির পক্ষে। এসব আইন ও বিধিবিধানের মধ্য দিয়েই বিষাক্ত খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। বীজ আইন ও বীজের বিধিবিধান তৈরি হয়েছে কৃষকের বীজ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেশী ও বহুজাতিক কোম্পানির বীজের বাজার প্রতিষ্ঠার জন্য।
জাতীয় বীজনীতি (১৯৯৯)-এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সর্বোচ্চ মানের উন্নত বীজ কৃষকের কাছে সহজে এবং দক্ষতার সঙ্গে পৌঁছে দেয়া (১.১ ধারা)। আরো সুস্পষ্ট করে বলা হয়েছে, কৃষকদের মাঝে উন্নত জাতের বীজের ‘গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যবহার’ বাড়ানো (১.২.৩)। বীজ অনুমোদন ও নিবন্ধীকরণের ক্ষেত্রে বেসরকারি ব্যক্তি, কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের কথা আছে কিন্তু ‘কৃষক’ নেই (৪.৪.৩)। দেখাই যাচ্ছে, তথাকথিত উন্নত বীজ কৃষকের কাছে পৌঁছানো হবে কিন্তু কৃষকের বীজ রক্ষার কোনো ধারা নেই। সবচেয়ে হাস্যকর হচ্ছে, স্থানীয় জাতের প্রসঙ্গ এসেছে কেবল স্থানীয় উন্নত ও জনপ্রিয় জাত হিসেবে কিন্তু সেগুলোও কৃষকের নিয়ন্ত্রণে নয়, বিএডিসির বীজ উইং সেগুলো ‘বিশুদ্ধকরণ’ ও সংরক্ষণের দায়িত্বে থাকবেন (১১.২.৯ ধারা)। স্থানীয় জাতকে বিশুদ্ধকরণের ভাষা ঔপনিবেশিক ও বর্ণবাদী। ব্রিটিশ শাসনামলে যেমন এ দেশে মানুষকে ‘নেটিভ’ বলা হতো তেমনি স্থানীয় জাতকে বিশুদ্ধকরণ করে জাতে তুলতে হবে।
বাংলাদেশে একটি বীজ আইন, ২০১৮ আছে যা সিড অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৭ (Ordinance No. XXXIII of 1977) রহিত করে প্রণীত হয়েছে। এ আইন দিয়ে সম্পূর্ণ আমলানির্ভর (বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিব, মহাপরিচালক, চেয়ারম্যান ইত্যাদি) নিয়ে একটি বিশাল জাতীয় বীজ বোর্ড গঠন করা হয়েছে। এদের সঙ্গে কৃষি বা কৃষকের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের কাজ হচ্ছে ‘সরকার কৃষি ক্ষেত্রে ব্যবহার্য এবং বিক্রয়যোগ্য যেকোনো ফসল বা জাতের বীজের গুণগত মান নির্ণয় করিবে’। এ কাজ করার যোগ্যতা তাদের আছে কিনা সেটার কোনো মানদণ্ড ঠিক হয়নি।
আইনে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির মাধ্যমে বীজের সনদ দেয়ার বিধান আছে; কিন্তু সেটা বীজ বিক্রয় ইত্যাদির জন্য বেশি প্রযোজ্য, কৃষকের উদ্ভাবনের কোনো স্থান এ আইনে নেই। বলা বাহুল্য, এ বীজ আইন কৃষকের বীজের জন্য নয়, এ আইন বীজ বাণিজ্যের জন্য।
কাজেই আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে, হরিপদ কাপালী জীবিত থাকাকালীন এবং ২০১৭ সালে তার মৃত্যুর পর তার ছেলে রূপকুমার কেন এত দিনেও কোনো স্বীকৃতি পাননি। বিষয়টি ব্যক্তি হরিপদ কাপালী কিংবা তার ছেলে রূপকুমারের হরি ধানের স্বীকৃতির প্রশ্ন নয়। এটা সারা বাংলাদেশের লাখ লাখ কৃষকের স্থানীয় জাত সংরক্ষণ, উদ্ভাবন, সংগ্রহ, বিনিময় সবকিছু নিয়েই আমাদের উত্কণ্ঠা।
দ্রুত করপোরেট স্বার্থে প্রণীত বীজ আইন ও বীজের বিধিবিধান বদলাতে হবে। কৃষকের স্বার্থ, বিশেষত বাংলাদেশের প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি কঠোর নজর রেখে নতুনভাবে আমাদের বীজ ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিয়ে ভাবতে হবে।
ফরিদা আখতার: নির্বাহী পরিচালক
উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)
বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই লেখাটি ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ তারিখে 'কৃষক ও প্রাণবৈচিত্র্যের স্বার্থে বীজনীতি ও বীজ আইন সংস্কার করুন' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।