স্বাস্থ্য ব্যবসা এতটা নির্দয় হবে কেন
ফরিদা আখতার || Friday 23 June 2023 ||মাহবুবা রহমান আঁখি মারা গেছেন; মারা গেছে তাঁর নবজাত শিশুটিও, যার নাম রাখারও সুযোগ হয়নি মা-বাবার। এই মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। স্রেফ হাসপাতাল ও চিকিৎসকের অবহেলার কারণেই নির্মমভাবে একটি পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ঘটনাটি ঘটেছে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে গাইনি ও প্রসূতি বিভাগে এবং এখন পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপকভাবে আলোচিত।
আঁখি কুমিল্লা থেকে এসে ঢাকার সেন্ট্রাল হাসপাতালে ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে প্রসূতিকালীন চিকিৎসা বা পরামর্শ নিচ্ছিলেন বলে জানা যায়। গত ৯ জুন প্রসব ব্যথা উঠলে তাঁকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে আনা হয়। সেখানে সি-সেকশন সার্জারি করা হয়। জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নবজাতকের মৃত্যু হয় এবং আঁখির অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। এর পর তাঁকে ল্যাবএইড হাসপাতালের আইসিউতে নেওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১১ জুন মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যু হয়। ল্যাবএইডের ভাষ্যমতে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে থাকার পরও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ঠেকানো গেল না– এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। এখানে চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুলের বিষয়টি আড়াল করা হচ্ছে। এ নিয়ে কথা বলা দরকার।
ঘটনাটি মামলা এবং আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ এনে আঁখির স্বামী ইয়াকুব ডা. সংযুক্তা সাহা, হাসপাতালের গাইনি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসক, ব্যবস্থাপকসহ কয়েকজনকে আসামি করে ধানমন্ডি থানায় মামলা করেছেন। সেই মামলায় ডা. সংযুক্তা সাহার দুই সহযোগী ডা. শাহজাদী মুস্তার্শিদা সুলতানা ও ডা. মুনা সাহাকে ওইদিন রাতেই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। পরদিন তাঁরা আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তাঁদের জবানবন্দি রেকর্ড করে বিচারক এ দুই চিকিৎসককে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত সেন্ট্রাল হাসপাতালে অস্ত্রোপচার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। আইসিইউ ও জরুরি সেবার মান ‘সন্তোষজনক’ না হওয়ায় এই নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিদর্শক দল।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সংযুক্তা সাহার ওপরেও দেওয়া হয়েছে। অধিদপ্তরের ‘লিখিত অনুমোদন ছাড়া’ ওই চিকিৎসক সেন্ট্রাল হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ সেবা দিতে পারবেন না। এ ছাড়া এই ঘটনায় রোগীর চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকদের কাগজপত্র বাংলাদেশ মেডিকেল ও ডেন্টাল কাউন্সিলে পাঠানো, রোগীর চিকিৎসার সব খরচ বহন করা, ভুক্তভোগীর পরিবার ক্ষতিপূরণ দাবি করলে আইনি সহায়তা দেওয়ার নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই নিষেধাজ্ঞাগুলো খুব শক্ত নয়। না মানলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে, এর কোনো নির্দেশনা নেই। তবে এ ঘটনা শুধু ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতালেই ঘটছে না; বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিত্র কমবেশি এ রকমই।
এই ঘটনায় কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। আঁখি একজন নির্দিষ্ট চিকিৎসক (বিশেষজ্ঞ) ডা. সংযুক্তা সাহার অধীনে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। প্রসব ব্যথা উঠলে তাঁকে সেন্ট্রাল হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল সেই বিশেষ চিকিৎসকের সেবাপ্রাপ্তির আশাতেই। অথচ তিনি হাসপাতালে ছিলেন না– এই কথা রোগী এবং তাঁর পরিবারকে জানানো হয়নি। এমনকি কাজটি (সি সেকশন) আরেকজন বিশেষজ্ঞের বদলে জুনিয়র ডাক্তার দিয়ে সম্পন্ন করার চেষ্টা হয়েছে। এই একই কাজ অন্যান্য হাসপাতালেও হয়। কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা না ঘটলে (অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত না গড়ালে) ভুক্তভোগী নারী এবং তাঁর পরিবার এর বোঝা বহন করে যায়। কেউ জানতেও পারে না।
ঢাকা সেন্ট্রাল হাসপাতালের মতো একটি প্রতিষ্ঠিত হাসপাতালের আইসিইউ ঠিকমতো কাজ করে না। রোগীর সংকটাপন্ন অবস্থায় তাঁকে আরেকটি বেসরকারি হাসপাতালে নিতে হয়– এটা মেনে নেওয়া যায় না। সেখানে নিয়েও রোগী বাঁচানো যায়নি।
আঁখির পরিবারের দুঃখ ঘোচানোর সাধ্য কারও নেই। কিন্তু আঁখি কি একাই এমন ঘটনার শিকার হয়েছেন? এর পেছনে যেসব কারণ রয়েছে, তা খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এসব মৃত্যু আসলে হত্যাকাণ্ড। দিন দিন স্বাস্থ্যসেবার মানের যেভাবে অবনতি ঘটছে, তাতে এই হত্যাযজ্ঞ থামবে না।
আরও একটি বড় সমস্যা যা ইদানীং প্রায় মহামারির আকার ধারণ করেছে, তার উল্লেখ করতে চাই। শহরের এবং মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুর জন্ম এখন সি-সেকশন ছাড়া হচ্ছেই না; বলা যায়। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কথা স্মরণ করছি। তিনি এই বিষয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিলেন। মাসিক গণস্বাস্থ্যের একটি সংখ্যার (৩৬ বর্ষ ৩য়-৪র্থ সংখ্যা)/আষাঢ়-শ্রাবণ ১৪২৪) প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছিল, ‘বাংলাদেশে অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ানের হার উদ্বেগজনক’। অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্মদানের প্রয়োজন হতে পারে মা ও নবজাতকের জীবন সংকটাপন্ন হলে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে একটি দেশের সি-সেকশনের হার ১০-১৫% এর আশপাশে থাকা উচিত। কিন্তু বাংলাদেশে সি-সেকশেনের হার ক্রমাগত বাড়ছে। ২০০৪ সালে মোট ডেলিভারির মাত্র ৫% সি-সেকশন হতো। ২০১৬ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৫০%। ক্লিনিকগুলোতে ৮০% ডেলিভারিই হচ্ছে সি-সেকশন। সরকারি হাসপাতালে এই হার ৩৮%।
ঢাকা শহরে গাইনি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা স্বাভাবিক প্রসব করাতেই যেন জানেন না। তাঁদের কাছে নারীরা গর্ভাবস্থায় পরামর্শ নিতে এলে সি-সেকশনের তারিখ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ক্লিনিক ও বড় বড় হাসপাতালে প্যাকেজ ঘোষণা করা হচ্ছে। এতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের যেমন স্বার্থ আছে; তেমনি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার আগ্রহও প্রবল। এতে তাদের ব্যবসা ভালো হয়। নরমাল ডেলিভারিতে ব্যবসা ভালো হয় না। আরও উদ্বেগের বিষয়, জেলা-উপজেলা পর্যায়েও ক্লিনিক গড়ে উঠেছে। সেখানে সিজারিয়ান অপারেশন হচ্ছে। ঢালাওভাবে না বললেও জেলা-উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরাই ক্লিনিকে রোগী পাঠাচ্ছেন এবং সেখানে গিয়ে তাঁরা আবার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হয়ে যাচ্ছেন। এখানে এ ধরনের অস্ত্রোপচারের যথাযথ ব্যবস্থা আছে কিনা, সেটা দেখার কোনো কর্তৃপক্ষও নেই। করোনাকালে যখন হাসপাতালে রোগী নেওয়া হতো না, তখন গ্রামের মহিলাদের স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। অথচ এদের কিছু যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, তারা ক্লিনিকে গেলে সিজারিয়ান করতেই হতো। এ ক্ষেত্রে দাইমা তাঁদের প্রসব করিয়েছেন।
এটাও সত্যি, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত, এমনকি অনেক নিম্ন-মধ্যবিত্ত কিংবা গ্রামের সচ্ছল পরিবারের নারী তাঁদের সন্তান জন্মদান করাতে চান সিজারিয়ানের মাধ্যমে। তবে সে কারণে চিকিৎসকের অবহেলা ও হাসপাতালের অব্যবস্থাপনার দায় মুছে যেতে পারে না। আমরা জানি না, মাহবুবা রহমান আঁখি নিজের সিদ্ধান্তে সিজারিয়ান করতে চেয়েছিলেন, নাকি তাঁকে সরাসরি অস্ত্রোপচারের টেবিলে তোলা হয়েছিল।
আঁখির মৃত্যু এমন অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসছে। বেশি প্রকট হয়ে উঠেছে বেসরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা এবং তাদের নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবসার বিষয়টি নজরদারির জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিষেধাজ্ঞা খুব দুর্বল এবং দায়সারা। আঁখির স্বামীর মামলা চালানোর ক্ষমতা কতদিন থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের অঢেল মুনাফার টাকা দিয়ে মামলা মোকাবিলা করবে। নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে কি তাদের কিছু যায় আসে? এক আঁখির মৃত্যু হয়েছে; শত আঁখি ঘরে ঘরে ধুঁকছে। আমরা কত দিন চেয়ে চেয়ে দেখব?
এই লেখাটি (সমকাল) ২৪ জুন ২০২৩ তারিখে 'স্বাস্থ্য ব্যবসা এতটা নির্দয় হবে কেন' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।
ফরিদা আখতার: সভানেত্রী, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা