সেবা যখন হেলিকপ্টারবিলাসী, গরিবের বেঁচে থাকাই দায়
ফরিদা আখতার || Monday 24 July 2023 ||একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকের শিরোনাম “Private chopper service booming in Bangladesh” Dhaka Tribune, জুলাই ১৪, ২০২৩, অর্থাৎ বেসরকারি হেলিকপ্টার সেবার রমরমা ব্যবসা হচ্ছে বাংলাদেশে। মোট ১৩টি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ৪২টি হেলিকপ্টার বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে এয়ার অপারেটর সার্টিফিকেট নিয়ে এ ব্যবসা পরিচালনা করছে। তাদের ব্যবসায় যুক্ত হয়েছে ধনীদের বিলাসী সেবা দেওয়া। মাত্র ৫ থেকে ৭ জন যাত্রী নিয়ে এই হেলিকপ্টারে যারা চড়েন তারা প্রতি ঘণ্টায় ৬৬,০০০ থেকে ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা খরচ করছেন। কেউ শুধু আনন্দ-ফুর্তির জন্য ১০ মিনিটে ৫,৫০০ টাকা খরচ করছেন, কেউ পদ্মা সেতু দেখতে চাইলে ১৬,৫০০ টাকায় রাউন্ডট্রিপ দিতে পারেন। এই প্রতিবেদনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শেষ অংশ হচ্ছে, Joyride, but not for all।
এই হেলিকপ্টার ভ্রমণ খুব আরামদায়ক, আনন্দদায়ক, সময় কম লাগে। কিন্তু এই সেবা শুধু মুষ্টিমেয় কিছু পরিবার ও ব্যক্তির জন্য। সবার জন্য নয়। এর মধ্যে সামান্য অংশ আছে ধনী রোগীকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্যে; বাকি সবটাই আনন্দের এবং বিলাসী জীবনযাপনের অংশ। বিষয়টা কি উন্নয়নের লক্ষণ নাকি বিদ্যমান ধনী-গরিবের এক নিষ্ঠুর ফারাক–সেটি দেখার বিষয়।
অন্য আরও একটি খবরের শিরোনাম ‘দেশের ১২ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কিনতে পারেন না’ [প্রথম আলো ৬ জুলাই, ২০২৩] এর দিকে নজর দেওয়া যাক। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদনের বরাতে এই খবর প্রকাশিত হয়েছে, দেশের ১২ কোটি ১০ লাখ মানুষের স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কেনার সামর্থ্য নেই। অর্থাৎ ৭০% এরও বেশি মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অর্থাৎ তাদের পুষ্টি চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এই ধরনের দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ওপরের দিকেই আছে, ষষ্ঠ অবস্থানে আছে। দেশে পুষ্টিহীনতা অনেক বেড়ে গেছে, বিশেষ করে নারী এবং শিশুদের মধ্যে।
দেশের সাধারণ মানুষ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে হিমশিম খাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট ইউনিট পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতির যে হিট ম্যাপ করেছে তা সংস্থাটির ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের মাসিক খরচের প্রধান খাত যেমন খাদ্য (আটা, ডিম, মাংস) এবং স্বাস্থ্যসেবায় মূল্যস্ফীতি বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৯.৩% হলেও আটায় ২৯.৩%, ডিম ও মাংসে ২৩.৯%; অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১৬.৭% [বণিক বার্তা, জুলাই ১১, ২০২৩]। অর্থাৎ গড় মূল্যস্ফীতির তুলনায় সাধারণ মানুষ যা ক্রয় করেন সেসব পণ্যে তিনগুণ বেশি দাম দিতে হচ্ছে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে সব পণ্যের দাম কিন্তু সেভাবে বাড়েনি। জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর দ্রব্য সিগারেট, বিড়ি, জর্দা, তামাকজাত দ্রব্যের মূল্যস্ফীতি ঋণাত্মক ০.১% এবং পানীয় পণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে মাত্র ৪.৩%। অদ্ভুত দেশ বটে। মানুষের যা প্রয়োজন তার দাম বেড়েছে। এদিকে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবায় মূল্যস্ফীতি ২০.১%।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে দেশ যে উন্নত হচ্ছে তা সব জনগণ ভোগ করতে পারছে না। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের দারিদ্র্য যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে ধনী-গরিবের ব্যবধান। জনসংখ্যার মাত্র ১% মানুষের হাতে রয়েছে ১৬.৩% সম্পদ আর নিচের অর্ধেক জনসংখ্যার হাতে রয়েছে মাত্র ১৭.১%, এই তথ্য দিয়েছে World Inequality Report 2022 [ The Daily Star, December ৯, ২০২১] । অন্য আরও একটি তথ্যমতে মাত্র ১০% মানুষের আয় ১৯৮৪ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত বেড়েছে ২১% থেকে ২৭%, একই সময়ে নিম্ন আয়ের ১০% মানুষের আয় কমেছে ৪.১৩% থেকে ৩.৯৯%। অর্থাৎ দিনে দিনে ধনী আরও ধনী হচ্ছে, তারা গাড়ি ছেড়ে হেলিকপ্টার ধরেছে, মাটিতে তাদের আর পা পড়ছে না, অন্যদিকে গরিব মানুষ শুধু বেঁচে থাকার জন্য দু’মুঠো ভাত খাবে সেটিও জোগাতে পারছে না। তাদের অবস্থা দিনে দিনে নাজুক হচ্ছে। খাদ্যের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষার প্রসংগ এখানে আর আনলাম না। সেখানেও রয়েছে বৈষম্য ও বঞ্চনা। স্বাস্থ্যসেবা সরকার দিচ্ছে মাত্র ২০ থেকে ৩০% মানুষকে, অন্যদিকে বেসরকারি মুনাফাভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে ৭০%।
সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পেতে হলেও ব্যক্তির নিজস্ব ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেন্ডিচার) ৬৭% (২০১৫), এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯%। তাহলে সরকার এই গরিব মানুষ, যারা বেসরকারি হাসপাতালে যেতে পারছে না, তাদের কতটুকুই বা সাহায্য করল? স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে অথচ সেই স্বাস্থ্য খাতে বাজেটে প্রতি বছর ব্যয় কমানো হচ্ছে। গ্রামে গঞ্জে মানুষের কত রোগ হচ্ছে, নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবাও কমে যাচ্ছে।
অন্যদিকে বিনা নজরদারিতে বেড়ে উঠছে ‘প্রাইভেট হাসপাতাল’। সেটি ছড়িয়ে পড়ছে উপজেলা পর্যায়েও। এখানে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নয় ওষুধ, ডায়াগনস্টিক ও ডাক্তারের ফি বাবদ গুনতে হয় হাজার হাজার টাকা। একটি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে আউট অব পকেট ব্যয়ের ৬৫% হচ্ছে ওষুধে। প্রয়োজনীয় ওষুধের পরিবর্তে রোগীদের ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়তি ও অপ্রয়োজনীয় ওষুধ। ডাক্তারের চেম্বারের সামনে, ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের মোটরসাইকেল দেখলে বোঝা যায় দেশে স্বাস্থ্যসেবা বলে কিছু নেই, আছে শুধু ওষুধ খাওয়া!
দুঃখজনক হচ্ছে, সাধারণ মানুষ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যে যায়, সেখানে তাদের সেবা বঞ্চিত হতে হয়। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়ার দীর্ঘসূত্রতা, চিকিৎসকের অপর্যাপ্ততাসহ নানা কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে বেসরকারি ডাক্তারের কাছে চলে যায়। এমনকি ওষুধের দোকানে গিয়ে কোনো প্রকার রোগ নির্ণয় ছাড়াই জ্বর, ব্যথা ইত্যাদির জন্যে ওষুধ কিনে নেন। তারা অসুস্থ হয়ে ঘরে বসে থাকতে পারেন না তাহলে পরিবার না খেয়ে মরবে। তাই রোগ সারানো নয়, উপসর্গ সারালেই তারা বেঁচে যায়। আমরা একটি ছোট গবেষণায় দেখেছি যে বিত্ত এবং নিম্ন আয়ের মানুষের মাসিক খরচের একটি নির্দিষ্ট অংশ ওষুধ কিনতে ব্যয় হয়। খাদ্যপণ্যের পরই গুরুত্বপূর্ণ খরচ হচ্ছে ওষুধ কেনা। পনেরো হাজার টাকা মাসিক খরচের মধ্যে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকারই ওষুধ লাগে। দারিদ্র্যের আরও অনেক সূচক থাকলেও স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রসঙ্গ বেশি টেনে আনছি কারণ, স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে দরিদ্র সবাই অর্থনৈতিকভাবে আর একধাপ নিচে নেমে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক উন্নত হচ্ছে এবং এশিয়ার অন্যতম দ্রুত উন্নয়নশীল দেশের অন্যতম একটি হয়ে উঠেছে। এই উন্নয়নের পাশাপাশি বাড়ছে মানুষের বঞ্চনা। স্বাভাবিকভাবেই উন্নয়নের সুফল কেউ না কেউ নিশ্চয়ই পাচ্ছে। তাদের সংখ্যা কম, যারা সুফল পাচ্ছে না তাদের সংখ্যা বেশি। এই কথা আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকরা জানেন। পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল ইসলাম বলেছেন, এটা একটা সাধারণ সূত্র যে কোনো অর্থনীতি দ্রুত বাড়লে আয় বৈষম্যও বাড়বে [The Daily Star, 9 December, 2021]। অর্থনীতির সূত্র মেনে গরিবকে আরও গরিব হতে দেওয়ার নীতি কোনো দেশে জেনেবুঝে রেখে দেওয়া যায়, এটা মেনে নেওয়া যায় না। তাহলে এই উন্নয়ন নীতিবিবর্জিত। পৃথিবীর সব দেশেই আয় বৈষম্য রয়েছে, কিন্তু সেই আয় বৈষম্য মেটাবারও কর্মসূচি আছে। বাংলাদেশে মনে হচ্ছে এই মানুষগুলোকে মরতে দেওয়ারই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
চাকচিক্যময় শহর, মেট্রোরেল, বহুতল ভবন, পদ্মা সেতুসহ অনেক কিছুই হচ্ছে এবং হবে। এগুলো দেখে বাংলাদেশকে ‘উন্নত’ দেশ মনে হতে পারে, সেটা হচ্ছে সারা শরীর রোগাক্রান্ত, অথচ মাথায় সোনার মুকুট এমন একটি চিত্র। বাহ সুন্দর বটে!!
বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় আছে, ২০২৬ সালে তার উত্তরণ ঘটবে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে। এটি খুশির কথা। কিন্তু এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য শুধু জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখালেই যথেষ্ট নয়, কিংবা গড় আয় ২৭৯৩ মার্কিন ডলার দেখিয়েও যথেষ্ট হবে না যদি মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক নাজুকতা সূচকে (Human Asset Index এবং Economic vulnerability Index) উন্নতি দেখানো না যায়। হিউম্যান এসেট ইনডেক্সে জনসংখ্যার মধ্যে পুষ্টিহীনতা, শিশু মৃত্যুর হার, শিক্ষার হার ইত্যাদি রয়েছে, যা বাংলাদেশে মোটেও সন্তোষজনক অবস্থানে নেই। যেই বিশাল গড় আয় আমরা দেখছি তা ধনীদের আয়েরই প্রতিফলন, সাধারণ মানুষের নয়। তাইতো তারা হেলিকপ্টারে চড়ে আনন্দ ফুর্তি করে, আর গরিব মানুষ না খেয়ে মরে।
এ অবস্থার পরিবর্তন রাজনৈতিক পরিবর্তন ছাড়া সম্ভব নয়। সেই রাজনৈতিক পরিবর্তনের আশায় রইলাম।
বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই লেখাটি (সমকাল) ২৩ জুলাই ২০২৩ তারিখে 'সেবা যখন হেলিকপ্টারবিলাসী, গরিবের বেঁচে থাকাই দায়' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।
ফরিদা আখতার: সভানেত্রী, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা