কাঁচা মরিচ সংকট: আমদানি কোন সমাধান নয়
ফরিদা আখতার || Saturday 15 July 2023 ||কাঁচা মরিচের এই সংকট কি উৎপাদন ঘাটতির সংকট নাকি সংঘবদ্ধ মহলের কারসাজি, সে বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কোন বক্তব্য প্রচার মাধ্যমে আমাদের চোখে পড়ে নি।
এবার ঈদুল আজহার আগে থেকে কাঁচা মরিচের দাম বৃদ্ধি নিয়ে যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তার দ্রুত সমাধান দেয়া হয়েছে আমদানির অনুমতি দিয়ে। গত বছরের ২৪ আগস্ট থেকে কাঁচা মরিচ আমদানি বন্ধ ছিল, কিন্তু এ বছর জুলাই মাসে হঠাৎ কাঁচা মরিচের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় ১০ মাস পর ৪৮ হাজার ৩৮০ মেট্রিক টন কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। আমদানি বন্ধের কারণ ছিল দেশের কাঁচা মরিচ উৎপাদনকারী কৃষকরা যেন ন্যায্য মূল্য পায়। আমদানির কারণে বাজারে সরবরাহ বেড়ে গেলে মরিচের দাম কমে, আর তাতে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষকের বিষয় এবার আর মনে রাখেনি সরকার।
এ বছর কী এমন ঘটলো যে হঠাৎ অস্বাভাবিক দাম বেড়ে গিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেছে? কাঁচা মরিচ নিত্যদিনের বাজারের মধ্যে অল্প হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ আইটেম হিসেবে কিনতে হয়। কিন্তু কাঁচা মরিচ পেঁয়াজের মতো মসলার অংশ নয় যে কাঁচা মরিচ না পেলে এমন লংকাকাণ্ড ঘটাতে হবে। কিন্তু সেটাই হলো। দামটাও বেড়েছে অতিরিক্ত। কাঁচা মরিচের দাম ৫০০-৬০০ টাকা কেজি থেকে ১০০০ টাকা কেজি পর্যন্ত উঠে ছিল! অর্থাৎ একটি পরিবারে ১০০ গ্রাম কাঁচা মরিচ কিনতে হলেও তাকে ৫০-১০০ টাকা খরচ করতে হবে। অন্যান্য আইটেমের ক্ষেত্রেও তাহলে একটা চাপ পড়েছে।
কাজেই ফেসবুকে যারা হাহাকার করতে পছন্দ করেন তারা গরম গরম পোস্ট দিয়েছেন। এবং তাই সরকার সবাইকে সন্তুষ্ট করতে ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দিয়ে দিলেন। শহরের মধ্যবিত্তদের খুশি করতে গিয়ে কৃষকের ক্ষতি হবে সেই বিবেচনা করা হলো না। কিন্তু তাতে মরিচের দামের যে তুলকালাম, তা কি কমলো?
জুনের শেষে অর্থাৎ কোরবানির ঈদের এক সপ্তাহ আগেও কাঁচা মরিচের কেজি ছিল ২০০ টাকার নিচে। কিন্তু ঈদের সময় হঠাৎ তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ালো ৬০০ টাকা কেজি। যা একেবারেই অস্বাভাবিক। মরিচ বা লাল মরিচের গুঁড়ো রান্নার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ মসলা, কিন্তু কাঁচা মরিচের ব্যবহার একেবারে আলাদা। ভর্তা, সালাদ, এবং খাওয়ার সময় বাড়তি ঝাল হিসেবে বাড়িঘরে ব্যবহার হয়। হোটেলে ভাত খেলে তা অনেকটা বিনা পয়সাতেই টেবিলে পাওয়া যায়, আর সাধারণ স্ন্যাকস যেমন চটপটি ইত্যাদিতে লাগে। কাঁচা মরিচে পুষ্টিগুণ আছে (ভিটামিন এ এবং সি), তাছাড়া আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম, পটাসিয়ামও পাওয়া যায়। নিম্নবিত্ত ও গরিব মানুষের জন্য কাঁচা মরিচ তরকারিতে বাড়তি উপাদান যুক্ত করে। মরিচ দিয়ে পান্তাভাত খাওয়ার কথা আমরা সব সময়ই শুনি। গরিব মানুষের সকালের খাদ্য এটাই।
দেশে কাঁচা মরিচের চাহিদা বছরে গড়ে ১৫ লাখ টন, যার প্রায় শতভাগ দেশেই উৎপাদন করা হয়। খরা বা প্রাকৃতিক কারণে কম হলেও তা খুব বড় ধরণের ঘাটতি সৃষ্টি করে না। কাঁচা মরিচ রবি ফসল এবং বর্ষাকালেও হয়। বাণিজ্যিকভাবে কয়েকটি জেলায় বিশেষভাবে উৎপাদন হলেও ক্ষুদ্র কৃষক তাদের নিজের ব্যবহার এবং অর্থকরী ফসল হিসেবে জমিতে লাগান। বিশেষ করে যারা মিশ্র ফসলের চাষ করেন তাদের ফসলের মিশ্রণের মধ্যে মরিচ অবশ্যই থাকে। কাঁচা মরিচের দাম বেড়েছে বলে দাম বাড়ানোর কারণ খতিয়ে না দেখে বাণিজ্যমন্ত্রী আমদানি করার অনুমতি দিলেন কিসের ভিত্তিতে? কৃষকদের বিষয়টা কি আদৌ তাদের বিবেচনায় ছিল কি? ছিল না, তা বুঝতেই পারছি।
বিষয়টিকে আমি আরো একটু অন্যভাবে দেখতে চাই। খবরের কাগজের শিরোনামে ভরে গেছে ভারতের সাথে বাংলাদেশে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ট্রাকে ট্রাকে মরিচ আমদানি হয়ে আসছে ভারত থেকে। সাতক্ষীরার ভোমরা বন্দর, বেনাপোল, সোনা মসজিদ, হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ভারতীয় কাঁচা মরিচ আসতে শুরু হয়েছে। দ্রুত কাঁচামাল খালাসে সহযোগিতা করছে কাস্টম ও বন্দর সংশ্লিষ্টরা। কাঁচা মরিচ পচনশীল পণ্য, কাজেই বন্দরে ফেলে রাখা যাবে না।
এর সাথে যুক্ত আর একটি খবরের দিকে নজর দিতে চাই। 'ঢাকা ট্রিবিউনে'র একটি খবরে (৮ জুলাই ২০২৩) জানা যায়, জুলাই মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারের নীচে নেমে গেছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশ সমূহের আমদানি মূল্য ১.১ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার কারণে বৈদেশিক রিজার্ভ কমে গিয়ে হয়েছে ২৯.৯৮ বিলিয়ন ডলার। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো হচ্ছে ভারত, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, মালদ্বীপ, এবং শ্রীলংকা। প্রতি দুই মাসে এই দেশগুলোর সাথে আমদনি বিল পরিশোধ করতে হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার এই সংকটের সময় কেন কাঁচা মরিচ আমদানি করার জন্য এলসি খোলার অনুমতি দেয়া হলো? কাঁচা মরিচের এই সংকট কি উৎপাদন ঘাটতির সংকট নাকি সংঘবদ্ধ মহলের কারসাজি সেই বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কোন বক্তব্য প্রচার মাধ্যমে আমাদের চোখে পড়ে নি। দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের প্লান্ট প্রটেকশান উইং এর বরাতে বলা হয়েছে ২৫ জুন থেকে ২৯ জুন পর্যন্ত প্রায় ৫১,৩৮০ টন কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে, অথচ এই ৫ দিনে মাত্র ৫২৮.৫৯ টন আমদানি করা হয়েছে। এলসি খোলার অনুমতি ৪৪ জন ব্যবসায়িকে দেয়া হয়েছে, এই অনুমতি অনুযায়ী তারা ১৭৯ বিলিয়ন টন কাঁচা মরিচ আমদানি করতে পারবেন। আগামী ৩ মাস এই অনুমতি কার্যকর থাকবে।
আমদানি করতে গিয়েও দামের কারসাজি চলছে। আমদানিকারক ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন তারা ৩২ টাকা কেজি দরে মরিচ কিনছেন আর আমদানি শুল্ক দিচ্ছেন ৩২ টাকা কেজি। সেই হিসাবে আমদানি করা কাঁচা মরিচের দাম দাঁড়ায় ৬৫ টাকা কেজি। কিন্তু বাজারে এখনও মরিচের দাম স্থিতিশীল হয়নি, এখনও ৩০০ টাকা কেজিতেই ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে। তাহলে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে এই আমদানি করা কোন সমাধান ছিল না তাই প্রমাণ হয়। যতোই আমরা অসাধু ব্যবসায়ীদের দোষারোপ করি না কেন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে এমন সাহস তাদের হতো না । বাণিজ্যমন্ত্রী কি মরিচের এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির দায় নেবেন না? অথচ আমরা তাকে নির্বিকারই দেখছি। সাড়াশব্দ নেই কৃষিমন্ত্রীর দিক থেকেও। মরিচের এই অস্বাভাবিক দাম হওয়াটা কৃষকের জন্য কি ভাল? তাতো নয়। যে বাড়তি দাম বাজারে দেখা যাচ্ছে সেই দাম কৃষক পাচ্ছে না, পাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে আমদানির কারণে কৃষক তাদের উৎপাদিত মরিচ বিক্রির ক্ষেত্রে হুমকির শিকার হচ্ছে। যে বিশাল পরিমাণ আমদানির অনুমতি দেয়া হয়েছে তাতে ব্যবসায়ীরা দেশের কৃষকদের কাছ থেকে না কিনে আমদানির দিকেই ঝুঁকবে।
মরিচ আদিতে মেক্সিকোর ফসল হলেও আমাদের দেশে এর অনেক জাত আছে যা বিভিন্ন জেলাতে বিভিন্ন জাতের পাওয়া যায়। এগুলোর অনেক সুন্দর নাম আছে যেমন বিন্দি, আকাশি, উব্দে , ধানি, সাইটা, বোম্বাই, সাহেব মরিচ ইত্যাদি। অন্যদিকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি), বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা) এবং বিভিন্ন কোম্পানি হাইব্রিড মরিচ বাজারে এনেছে, যা বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়।
বাজারে দেশীয় কাঁচা মরিচ পাওয়া যায় না । হাইব্রিড মরিচ উৎপাদনে সার-কীটনাশক দেয়ার কারণে এর স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়, এবং শরীরে যে পুষ্টি পাওয়ার কথা তা পাওয়া যায় না। কাজেই এই হাইব্রিড মরিচ আমদানি করে জনগণের কোন উপকার হবে না । সামনে আরো সংকটের বীজ বপণ করা হয়েছে।
কাঁচা এবং শুকনো মরিচ আমাদের খাদ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, এর সাথে কৃষকের আর্থিক সামাজিক অবস্থা নির্ভর করে। মরিচ নিয়ে এই খেলা যে শুরু হয়েছে আমাদের জন্য অশনি সংকেত।
অতএব সাবধান!!
• লেখক: প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী
বিশেষ দ্রষ্টব্য
এই লেখাটি (The Business Standard) ১৩ জুলাই, ২০২৩ তারিখে 'কাঁচা মরিচ সংকট: আমদানি কোন সমাধান নয়' এই শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।