মাটি ও মানব স্বাস্থ্য সম্পর্ক
এম. এ. সোবহান || Monday 26 August 2024 ||মাটি থেকেই প্রাণের সৃষ্টি আবার মাটিতেই শেষ। মাত্র ১১টা মৌলিক উপাদান মানব দেহের ৯৯% গঠন করে। এ উপাদানগুলিকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন মুখ্য এবং গৌণ। মুখ্য উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে-হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন এবং নাইট্রোজেন যা মানব দেহের ৯৯% গঠন করে। সাতটি গৌণ উপাদান যেমন-সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ফসফরাস, সালফার এবং ফ্লোরিন যা ০.৯% গঠন করে। এ ছাড়া আরো ১৫টি ট্রেস উপাদান যা মাত্র ০.১% গঠন করে। পরিমানে কম হলেও অন্যান্য উপাদানের কার্যকারিতার জন্য অপরিহার্য। এর মধ্যে রয়েছে (১) লোহা, (২) তামা, (৩) দস্তা, (৪) রুবিডিয়াম, (৫) সেলেনিয়াম, (৬) স্ত্রন্টিয়াম, (৭) মলিবডেনাম, (৮) সীসা, (৯) আর্সেনিক, (১০) ক্রোমিয়াম, (১১) কোবাল্ট, (১২) ভ্যানাডিয়াম, (১৩) ম্যঙ্গানিজ, (১৪) ক্যাডমিয়াম (১৫)ফ্লোরিন।
মূখ্য উপাদানগুলির কার্যকারিতা:
[১] অক্সিজেন—শ্বাস-প্রশ্বাস। একজন মানুষের দৈনিক ৫৫০ লিটার অক্সিজেন প্রয়োজন হয়।
[২] কার্বন—কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, নিউক্লিক এসিড এবং প্রোটিন গঠনে সাহায্য করে।
[৩] হাইড্রোজেন—পানির উপাদান হিসাবে অর্গানিক যৌগ গঠনে সহায়তা করে।
[৪] হাইড্রোজেন—নিউক্লিক এসিড, ডিএনএ, এবং আরএন এ গঠনে সহায়তা করে।
গৌণ উপাদান:
[১] ক্যালশিয়াম—অস্থি, প্রোটিন ও পেশী গঠন করে।
[২] ফসফরাস—অস্থি, দাঁত গঠন এবং স্নায়ু ও হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে।
[৩] পটাশিয়াম—স্নায়ু ও হৃদস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে।
[৪] সালফার—প্রোটিন গঠন ও কার্যকারিতা পরিচালনা করে।
[৫] সোডিয়াম—পেশী ও স্নায়ু সবল করে।
[৬] ফ্লোরিন—মানবদেহে তারল্য প্রবাহ বজায় রাখে। দাঁত ও হাড় গঠনে সহায়তা করে।
[৭] ম্যাগনেশিয়াম—এটিপি এবং নিউক্লিওটাইড বাঁধাইতে সহায়তা করে।
ট্রেস উপাদানের ভূমিকা:
সামান্য পরিমাণ ট্রেস উপাদান শরীরে ব্যবহার হয়, তবে তারা অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে।
প্রাথমিক ভাবে তারা উৎসেচকের কার্যকারিতার ক্ষেত্রে অণুঘটকের ভূমিকা পালন করে।
ক। লোহা—হেমোগ্লোবিন গঠনে সাহায্য করে যা ফুসফুস থেকে বিশুদ্ধ রক্ত সমস্ত শরীরে সরবরাহ করে।
কার্যকারিতা- (১) দেহ কোষে শক্তি সরবরাহ করে। (২) অক্সিজেন, নাইট্রোজেন এবং হাইড্রোজেনের সাথে মিশে প্রোটিন তৈরি করে।
দৈনিক চাহিদা-মহিলা ১৮ মিলিগ্রাম, পুরুষ-৮ মিলিগ্রাম।
শরীরে ঘাটতি হলে—মাথা ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, দ্রুত হৃদস্পন্দন, কফ-কাশি, ঘনঘন নি:শ্বাস, চামড়া, নখ, এবং ঠোট নীল হওয়া।
খাদ্য উৎস—মাছ, ডিম, বাদাম, ডাল, শাক-সবজি।
খ। দস্তা—দস্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রেস উপাদান যা কোষগঠন ও বৃদ্ধিতে অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। প্রোটিন, শর্করা, লিপিড, এবং শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করে।
কার্যকারিতা-(১) ঘা শুকাতে সাহায্য করে, (২) ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
দৈনিক চাহিদা- পুরুষ-১২ মিলিগ্রাম, মহিলা-১০ মিলিগ্রাম, গর্ভবতী মা-১২ মিলিগ্রাম।
ঘাটতি হলে-(১) রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, (২) চুলপড়া, (৩) পুরুষত্বহীনতা (৪) চোখে এবং চামড়ায় ঘা হয়।
খাদ্যের উৎস: গম, লাল চাল, বাদাম, মাংস, ডিম, দুধ, দই, ইত্যাদি।
গ। তামা: শরীরে প্রায় সব কোষেই তামা বিদ্যমান।
কার্যকারিতা— (১) শত্তি উৎপাদনে সহায়তা করে। (২) চামড়া, রক্তনালী এবং কোষকলায় শক্তি সরবরাহ করে। (৩) থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে প্রয়োজন হয়।
দৈনিক চাহিদা: ১৭ মিলিগ্রাম
ঘাটতি হলে-অষ্টিওপোরোসিসও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
খাদ্য উৎস্য—বার্লি, লাল চাল, রুটি, ডাল, গোল আলু, শাক ইত্যাদি।
ঘ। ম্যাঙ্গানিজ: অতি সামান্য পরিমাণ দেহে বিদ্যমান।
কার্যকারিতা—সংযোগ কোষ গঠনে সহায়তা করে। প্রজনন হরমোন উৎপাদন করে। স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিস্কের দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
খাদ্য উৎস্য—লাল চাল, ডাল, আনারস, চা, শাক, মিষ্টি আলু এবং বিট।
ঙ। সেলেনিয়াম- শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।
কার্যকারিতা—হৃদযন্ত্রের দক্ষতা বৃদ্ধি করে
দৈনিক চাহিদা- ৪০ মাইক্রোগ্রাম
ঘাটতি হলে—আঙ্গুলের নখের গোড়া সাদা হয়ে যায়
খাদ্য উৎস্য—দানাশস্য, মাংস, মুরগি, মাছ, ডিম ইত্যাদি।
চ। ক্রোমিয়াম—প্রোটিন শর্করা এবং লিপিড গঠনে সহায়তা করে।
কার্যকারিতা—ইনসুলিনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করে।
দৈনিক চাহিদা—৫০ মাইক্রোগ্রাম
ঘাটতি হলে—ডায়াবেটিস ও হৃদরোগ ঝুঁকি বাড়ায়।
খাদ্য উৎস্য—ব্রোকলি, গোল আলু, ডাল, গরুর গোশত, মুরগির মাংস, ফল বিশেষ করে আপেল, কলা।
ছ। মলিবডেনাম— শরীর থেকে বিষাক্ত বর্জ্য বেড়িয়ে যেতে সহায়তা করে। প্রোটিন উৎপাদনে সহায়তা করে।
দৈনিক চাহিদা—৪৫ মাইক্রোগ্রাম
খাদ্য উৎস্য—গরুর কলিজা, দুধ, দই, কলা, মুরগী, ডিম পালংশাক ইত্যাদি।
জ। কোবাল্ট: পূর্ণ বয়স্ক মানবদেহে আনুমানিক এক মিলিগ্রাম কোবাল্ট থাকে যার ৮৫% ভিটামিন বি-১২।
কার্যকারিতা—লোহিত কণিকা গঠনে সহায়তা করে। স্নায়ুতন্ত্রের দক্ষতা বৃদ্ধি করে।
ঘাটতি হলে—এনিমিয়া এবং স্নায়ু রোগ হয়।
খাদ্য উৎস্য—শাক, দুগ্ধ জাত খাদ্য, ডিম, দুধ, ও মাছ।
ঝ। ফ্লোরিন: পানীয় জলের মাধ্যমে দেহে প্রবেশ করে।
কার্যকারিতা—হাড় এবং দাঁত গঠনে সহায়তা করে।
ঘাটতি হলে—দাঁতের ক্ষয় হয়।
খাদ্য উৎস্য—পালংশাক, আঙ্গুর, গোল আলু, কিসমিস
ঞ। বোরন: শরীর বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
কার্যকারিতা— (১) হাড় গঠন, (২) ক্ষত সেরে ওঠা, (৩) মস্তিস্কের কার্যকলাপ বৃদ্ধি
ঘাটতি হলে—গ্রন্থিবাত বৃদ্ধি পায়।
ট। আইওডিন: দেহের ক্রমবৃদ্ধি ও বিকাশ।
কার্যকারিতা—হরমোনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান
দৈনিক চাহিদা— শিশুর জন্য ৯০ মাইক্রোগ্রাম, পূর্ণ বয়স্কদের জন্য ১৫০, মাইক্রোগ্রাম এবং গর্ভবতী মায়েদের জন্য ২৫০ মাইক্রোগ্রাম
ঘাটতি হলে—থাইরয়েড গ্লান্ড বেড়ে যায়।
খাদ্য উৎস্য—আইওডিন যুক্ত লবণ, আটার রুটি, দুধ, দই, পনির।
মানব দেহের জন্য প্রয়োজনীয় মৌলিক উপাদানগুলির মধ্যে হাইড্রোজেন, অক্সিজেন ও কার্বন ছাড়া বাকি সব উপাদান মাটি থেকেই পাওয়া যায়। তবে ইদানিং কালে উচ্চফলনশীল জাত ও হাইব্রিড ফসল আবাদের ফলে মাটির মৌলিক উপাদান প্রায় সবই নিঃশেষ হয়ে গেছে। ঘাটতি পূরণের জন্য নাইট্রোজেন, ফসফরাস, ও পটাশিয়াম রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে ফসল উৎপাদন করা হয়। কিন্তু অন্যান্য উপাদানের ঘাটতি থেকেই যায়। ঘাটতিযুক্ত মাটিতে আবাদের ফলে ফসলের মধ্যেও বেশীর ভাগ মৌলিক উপাদানের ঘাটতি থাকে। ঘাটতিযুক্ত ফল ফসল সেবনের ফলে মানব দেহেও ঘাটতি জনিত রোগ দেখা যায়। তদুপরি ফসলে রোগ-বালাই দমনের জন্য নানা রকম বিষ প্রয়োগ করা হয়। ফলে ফল ফসল বিষাক্ত হয়। বিষাক্ত খাবার খেয়ে মানুষ রোগাক্রান্ত হয়।
অতিতে মেসোপটেমিয়া, রোম, মায়া এবং আরো অনেক সভ্যতা আবির্ভাব ঘটেছে আবার বিলুপ্ত হয়েছে। কারণ, যে মাটির সে সব সভ্যতা দাড়িয়ে ছিল সে মাটি তারা স্বমহিমায় রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমরাও যদি মাটি সংরক্ষণে ব্যর্থ হই তাহলে তাদের পথ অনুসরণ ছাড়া আমাদের আর কোন গত্যান্তর থাকবে না।
তাই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে তথাকথিত আধুনিক কৃষির এগ্রো-ইকোলজি ধ্বংসের যে মহোৎসব চলছে তা বন্ধ করে সবুজ বিপ্লব প্রবর্তনের পূর্বে যে সব স্থানীয় জাতের ফসল আবাদ হোত তা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে,মাটিতে জৈব পদার্থ ফিরিয়ে দিতে হবে। বালাইনাশক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। মিশ্র ফসলের আবাদ বৃদ্ধি করতে হবে। মাটির তলার পানি দিয়ে চাষাবাদের পরিবর্তে ভূ-উপরিস্ত পানি এবং বৃষ্টি নির্ভর চাষাবাদ ব্যবস্থা চালু করতে হবে। মাটি ভাল থাকলেই মানুষের স্বাস্থ্য ভাল থাকবে।
১৯ আগষ্ট ২০২৪