কৃষিতে সাফল্য বনাম কৃষকের টিকে থাকা
ফরিদা আখতার || Monday 20 January 2014 ||মাঘ মাস চলছে, এখন কৃষির ভরা মৌসুম। একদিকে কৃষকের ঘরে নতুন ধান, অন্যদিকে রবি ফসলে মাঠ রঙ্গীন হয়ে আছে। এই সময় সব ধরণের সবজি, মসলা, তেল ও ধানের ফসল মাঠটাকে নানা রঙ্গে ভরিয়ে তোলে। দেখতে সত্যিই সুন্দর, চোখ জুড়ে যায়। কৃষক আনন্দে থাকে, ঘরে নতুন ধানের চালের নানা পিঠা-গুড় দিয়ে আপ্যায়ন চলছে। শুধু গ্রামে নয়, শহরেও আজকাল পিঠার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। এই সব মিলে বাংলাদেশ আসলেই একটা সুন্দর ও সুজলা-সুফলা দেশ।
এই সবই এদেশের ক্ষুদ্র কৃষকদের অবদান। তারাই দেশের নানা স্থানে স্থানীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে ফসল উৎপাদন করে চলেছেন দিনের পর দিন। তাদের কারণেই ভাতের ধান উৎপাদনের পাশাপাশি পিঠার ধান (যেমন মুক্তাহার, কালরাজ), মুড়ির ধান (ঘিগজ), খৈয়ের ধান (ঝিংগাপোড়া), চিড়ার ধান(কলামোচা) আলাদাভাবে উৎপাদিত হচ্ছে। গুটিকয় উদাহরণ দিলাম, আছে অনেক জাতের। এলাকা বিশেষে নানা ফসল উৎপাদিত হয়ে বাজারে আসছে। শহরের মানুষ এসব ভোগ করছেন। কারো কারো নিজের গ্রামের জমি-জমা থেকে ফসল এখনো আসে, তাঁরা জানেন এই বৈচিত্র্যে আনন্দ অনেক গভীর। এ নিয়ে মনের অজান্তে অহংকার আসে, “আমার গ্রামের বাড়ী থেকে এসেছে, একেবারে খাঁটি”। অর্থাৎ বাজার থেকে যা আমরা কিনে খাই তার মধ্যে “খাঁটি” পাওয়া একটু কষ্টকর হয়ে উঠতে পারে। কারণ বাজারে যা আসে তা বাণিজ্যিক চাষের, তার মধ্যে খাঁটির চেয়ে মুনাফা হয় এমনভাবে উৎপাদন করাই গুরুত্বপুর্ণ হয়ে ওঠে।
এসব কথা বলছি, কৃষি সম্পর্কে আবেগ প্রকাশের জন্যে নয়, বরং বর্তমান সময়ে কৃষির যে গতি প্রকৃতি দেখছি তার ব্যাপারে একটু আলোকপাত করার জন্যে। আমরা জানি বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা এখনো কৃষি থেকেই আসে, এই তথ্য পরিসংখ্যান থেকেই জানা যায়। আমাদের দেশে ক্ষুদ্র কৃষকরা সংখ্যায় বেশী। বাংলাদেশে মোট খানার ৫৯% কৃষক, তার মধ্যে ক্ষুদ্র কৃষক (যাদের জমির পরিমান ৩ একরের চেয়ে কম) প্রায় ৮৪% । অর্থাৎ ক্ষুদ্র কৃষকরাই আমাদের মুল খাদ্যের যোগান দিয়ে আসছেন। কৃষি মানে ক্ষুদ্র কৃষকের চাষ। কিন্তু এই ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থ কৃষিতে রক্ষা হচ্ছে কি?
কৃষিকে বলা হয়, স্বাধীন পেশা। কৃষক যা উৎপাদন করতে চান তাই করতে পারেন। নিজের জন্যে রেখে বাড়তি উৎপাদন বাজারে নিয়ে গেলে অ-কৃষি পেশার মানুষ খেতে পারে। শহরের মানুষের ভাগ্যেও খাদ্য জোটে। কিন্তু এটা কি সবটুকু সত্যি? আসলেই কি কৃষক নির্ধারণ করতে পারেন কি উৎপাদন করবেন আর কি করবেন না? কি করলে তাঁর নিজের এবং যারা এই ফসল ভোগ করেন তাঁদের উপকার হবে? কৃষকের জমিতে কি ফসল উৎপাদন হবে তা কি অন্যেরা এসে নির্ধারণ করে দিচ্ছেন না? একটি ছোট উদাহরণ দিচ্ছি। দেশের বেশ কিছু জেলাতে তামাক চাষ হচ্ছে রবি ফসলের জমিতে। কুষ্টিয়া ও বান্দরবান জেলায় ব্যাপকভাবে চাষের পাশাপাশি এখন অন্যান্য অনেক জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। তামাক বিরোধী সাংবাদিকদের সংগঠন ‘আত্মা’ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তামাক চাষের ওপর যে প্রতিবেদন তৈরী করেছেন তার থেকে বিভিন্ন জেলায় তামাক চাষের খবর জানা যাচ্ছে। এর মধ্যে দেখছি লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী ও সদর উপজেলায় তামাক চাষ গত বছরের তুলনায় বেড়ে গেছে; এবারে ৪২০০ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। গত বছর এই দুটি উপজেলায় চাষ হয়েছিল ২০০০ হেক্টর জমিতে। (প্রাইম নিউজ, ১৫ জানুয়ারি, ২০১৪ http://www.primenewsbd24.com/archives/38879) এর ফলে খাদ্য ফসলের ক্ষতি হবে এমন তথ্য কৃষি কর্মকর্তাদের জানা সত্ত্বেও সরকারের পক্ষ থেকে তামাক চাষ বন্ধ করার কোন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। কৃষি কর্মকর্তাদের মতে তামাক চাষের পর ইরি ফসল করলে তার ফলন ৪ থেকে ৫ মণ কমে আসবে। অর্থাৎ ঘাটতি সৃষ্টি হবে।
কুষ্টিয়ায় যেখানে গম, মসুর, ধান, আঁখ ও ছোলা হোত সেই ধরণের ৪০,০০০ হেক্টর জমিতে শুধুই তামাক চাষ হচ্ছে, (বিডি প্রেস.নেট, ৬ জানুয়ারি, ২০১৪ http://bdpress.net/home/index.php?page=description&news=1389007298)। আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি খাদ্য ফসলের কত ক্ষতি হচ্ছে। সাংবাদিকরা আরও অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তাদের দৃষ্টিতে কক্সবাজার ও বান্দরবান এলাকায় মাতামুহুরী নদীর পারে তামাকের ব্যাপক চাষ তো নয়, এ হচ্ছে ধ্বংসলীলা।
সরকারের দিক থেকে সামান্য উদ্যোগ নিলেই এই ব্যাপক ক্ষতি থেকে দেশকে রক্ষা করা যায়। তামাক কোন খাদ্য ফসল নয়, অথচ খাদ্যের জমিতেই তার মাতবরি। খাদ্য ফসলের জমিতে তামাক চাষের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করলে প্রথম ধাপের সফলতা পেতে পারি। কিন্তু তারপরেও কাজ আছে। খাদ্য ফসলের জন্য সহায়তা দেয়া একান্তই জরুরী। অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন কৃষক নিজের ইচ্ছাতেই নগদ টাকা পাবে বলে তামাক চাষ করছে। আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হয়; কিন্তু কুষ্টিয়া ও বান্দরবান জেলায় উবিনীগের গবেষণায় পরিস্কার যে তামাক কোম্পানি লোভ সৃষ্টিকারী ফাঁদ পাতা ও সরকারের পক্ষ থেকে খাদ্য ফসলের সুবিধার দেয়ার অভাবেই এই ঘটনা ঘটছে।
বিগত সরকারের সময়কালে কৃষিতে বেশ কিছু সফলতার দাবী করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে, কৃষকদের ১০ টাকায় ব্যাংক হিশাব খুলতে সহায়তা করা, কৃষি ঋণ, কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড দেয়া ইত্যাদি। অন্যদিকে ফসলের দিক থেকে সফলতা দেখানো হয়েছে ধান, গম ও ভুট্টা উৎপাদনে। ধান প্রধানত বোরো ধান। যদিও কৃষকের জন্য বোরো মৌসুমে রবি ফসলটাই খুব গুরুত্বপুর্ণ, কারন সব্জি, তেল, মসলার চাষ এই মৌসুমেই করতে হয়। ভুট্টা আমাদের প্রধান খাদ্য নয়, ভুট্টা পোল্ট্রি ফিড হিশেবেই কাজে লাগে। কাজেই এই সাফল্য কৃষকের দিক থেকে নয়। তবে আউশ ধানের প্রণোদনা হিশেবে বীজ, সেচ, সার দেয়ার কারণে আউশ চাষ বেড়েছে এটা ভাল লক্ষণ অবশ্যই। গত বছর ১০ লাখ ৫৩ হাজার হেক্টর জমিতে আউশ ধান উৎপাদিত হয়েছে ২১ লাখ ৫৮ হাজার টন (বণিক বার্তা, ৩০ মে, ২০১৩) । কিন্তু এখনো যে বিষয়টি মোটেও সুরাহা হয় নি, সেটা হচ্ছে, কৃষকের ফসলের দাম নির্ধারণ ও সময় মতো বিক্রির ব্যবস্থা করা। আমরা সরকারী সুত্রে ভাল ফলনের খবর পাই কিন্তু কৃষক উৎপাদিত ফসল বিক্রি করে তার খরচ তুলতে পারলো কিনা তার কোন হিশাব পাই না। সরকার যতোই উপকরণ সহযোগিতা দিক না কেন, তার দাম কৃষককে দিতেই হয়। সার-বিষ ডিলাররা ঠিকই তাদের উপকরণের দাম পেয়ে যায়, কিন্তু কৃষক কিছুই তার ঘরে তুলতে পারে না। সব খরচ মিটিয়ে তাকে অনেকটা খালি হাতেই বাড়ী ফিরতে হয়। দুই হাজার বারো সালের একটি তথ্য তুলে ধরছি। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কৃষকের ধানের দাম ৫০০ টাকা মণ হওয়ায় প্রতি মণে ২০০ টাকা লোকসান গুনতে হয়েছে। ডিজেল, সার, কীটনাশক, পাওয়ার টিলার ও পানির দাম শোধ করে তার হাতে কিছু থাকে নি। অথচ চাতাল ও মিল মালিকরা কম দামে ধান পেয়ে চাল বানিয়ে লাভ করতে পেরেছে অনেক। (৬ জুন, ২০১২, দৈনিক ইত্তেফাক) । সব্জির ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় একদিকে ক্রেতারা বেশী দামে কিনছে, অন্যদিকে কৃষক তার ফসলের ন্যায্য মুল্য পাচ্ছে না। ঢাকায় যে সব্জি কেজি প্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা, কৃষক বিক্রি করছে মাত্র ১৫ থেকে ২০ টাকায়। এ ব্যাপারে কোন সরকারই সফলতা দেখাতে পারে নি। কৃষককে ন্যায্য মুল্য দেয়া যেন সরকারের কোন দায়িত্ব নয়, তাদের কাজ শুধু সার-কীটনাশক-ডিজেল দেয়া! এতেই তাদের সাফল্য গোনা হয়ে যাবে।
এসবই জানা কথা। আমি নতুন কিছুই বলছি না। কিন্তু বারে বারে পুরণো কথা বলেও যখন দেখছি কোন সমাধান হচ্ছে না, তখন আমাদেরকে একই কথা নেকের বিরক্তি উৎপাদন করেও বলে যেতে হয়। আমরা কৃষির সাফল্য বলতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাফল্য বুঝি, এবং সেটা হয় মুলতঃ সার-কীটনাশক বিক্রতাদের বিশাল ব্যবসা। অন্যদিকে ফসল উৎপাদন করার ব্যাপারে কৃষকের স্বাধীন ইচ্ছার মর্যাদা না দিলে এবং সে অনুযায়ী সহায়তা না দিলে, বিশেষ করে বিক্রির ক্ষেত্রে এবং ফস্লের দাম পাওয়ার ক্ষেত্রে; তাহলে কৃষি মন্ত্রণালয় হয়তো সফল হবে কিন্তু কৃষক বাঁচবে না। সে এক পর্যায়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে, এবং ঢাকায় এসে রিক্সা চালাবে।
বিশ্বব্যাপী কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ চলছে, অথচ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই প্রমাণিত যে ক্ষুদ্র কৃষকের উৎপাদনের মাধ্যমেই দেশের খাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব, এবং একই সাথে কৃষি কেন্দ্রিক জীবন জীবিকাও রক্ষা পাবে। আমরা কি বাংলাদেশে সেই পথে হাটছি?
আমাদের দরকার কৃষকের টিকে থাকার ব্যবস্থা করা, তাহলেই কৃষি টিকবে, আর কৃষকও বাঁচবে।