দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম ধানের জাত ও নয়াকৃষি
এম. এ. সোবহান || Sunday 01 August 2010 ||দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষম ধানের জাত চাষ করে নয়াকৃষি
‘‘দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারে এমন ধান উদ্ভাবন করুন’ - প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা
বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরষ্কার বিতরনের সময় প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা বন্যা, খরা, লবণসহিঞ্চু জাতের ধান উদ্ভাবনের জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন (যায়যায় দিন ২৭ জুলাই ২০১০)। বিশেষত পানি, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক কম লাগে এমন জাতের ধানের জন্য প্রধান মন্ত্রীর উদ্বেগ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের চেয়ে মানুষের তৈরি দুর্যোগের ভয়াবহতা আরো গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী। কারণ উফশীজাত যা হাইব্রিড ধানের আর্শীবাদে বাংলাদেশের ধান ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা আজ ধ্বংশের দ্বার প্রান্তে পৌঁছছে। তদুপরি মরার উপর খাঁড়ার ঘার মত জিএম ধান প্রর্বতনের পাঁয়তারা চলছে (ফরিদা আখতার, প্রথম আলো, ২৬ জুলাই ২০১০)। বাংলাদেশের কৃষি এখন একটা ক্রান্তিলগ্ন অতিক্রম করছে। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করলে ভয়াবহ পরিনাম ভোগ করতে হবে। প্রধান মন্ত্রি যদি আসলেই তা চান তাহলে নয়াকৃষি সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া উচিত।
পরিবেশ প্রকৃতির সাথে সমন্বয় করে যুগযুগ ধরে এ দেশের কৃষককূল ধানসহ অন্যান্য ফসলের জাত নির্বাচন করেছেন। কৃষি ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন। প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল পরিবেশ উপযোগী ফসলের স্থানীয় জাত বাছাই ও আবাদ করেছেন। বংশানুক্রমে তা ধারণ ও সংরক্ষণ করে আসছিলেন তারা।
গত শতাব্দীর প্রথম দশকে এদেশে প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি গবেষণা শুরু হয়। ঢাকা শহরের তেজগাঁ এলাকায় একটি কৃষি খামার প্রতিষ্ঠিত হয়। যার নাম ছিল ঢাকা ফার্ম। এর দক্ষিণ পূর্ব প্রান্ডের প্রবেশ পথটি আজকের ফার্মগেট। এ খামারের মধ্যেই ছিল এদেশের একমাত্র কৃষি কলেজ। যার প্রবেশ পথটি আজকের কলেজ গেট বাসষ্টান্ড। এ খামারের মধ্যেই ছিল বৃটিশ ভারতের রাজকীয় কৃষি গবেষণা কেন্দ্র বা এগ্রিকালচার রিসার্স ইনসটিটিউট (এ আর আই)। ফসল ও প্রাণী সম্পদ গবেষণা পরিচালিত হত এ প্রতিষ্ঠানে।
ধান বাংলাদেশের আদি ফসলের একটি। হাজার হাজার ধানের জাত এ পরিবেশের ফসল। কৃষকের সম্পদ। ঢাকায় খামার ও গবেষণাগার প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধানসহ অন্যান্য ফসলের প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা শুরু হয়। স্যার আর এস ফিনলো, স্যার জোনস বাটলার, ড. হেক্টর, ড. বিসি কুন্ডু, ড. সৈয়দ হেদায়ত উল্লাহ, ড. শাহ হাসানুজ্জামান, জেএল সেন সহ বহু আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তি বর্গ ধান, পাট সহ অন্যান্য ফসলের কৃষিতাত্ত্বিক বুনিয়াদ প্রতিষ্ঠা করতে অবদান রাখেন। কৃষকদের হাতে গড়া জাতের মধ্য থেকে পিওর লাইন সিলেকশনের মাধ্যমে কিছু জাত বাছাই করে ব্যাপক চাষাবাদেও প্রচলন করা হয়।
যে সব ধান প্রায় হারিয়ে গিয়েছে সেইসব ধান আবার সংগ্রহ করে কৃষকদের মাঠে গবেষণা করে নয়াকৃষি
১৯৬০ সালে রকফেলার ও ফোর্ডফাউনডেশনের সহায়তায় ফিলিপাইনে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালে ইরি-৮ জাতের ধান প্রবর্তন করা হয়। এ ধারায় ইরি-৫ ও ইরি -২০ জাতগুলি প্রবর্তন করা হয়। পরবর্তীতে ইরির সহায়তায় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট থেকে ৫২টি উচ্চফলনশীল জাত ও পাঁচটি হাইব্রিড ছাড় করা হয়। ১৯৯৮ সালে প্রথম হাইব্রিড ধান প্রর্বতন করা হয়। এ যাবৎ ৬০টি হাইব্রিড ধান আমদানী করা হয়েছে।
উফশী ধান ও হাইব্রিড ধানের প্রধান চাহিদাগুলো হল রাসায়নিক সাব, বালাইনাশক, সেচের পানি ইত্যাদি। বহুগুণে সমৃদ্ধ স্থানীয় জাত বর্জন করে কৃষকরা উফশী ও হাইব্রিড ধান আবাদ শুরু করেছেন। কৌশলে কৃষকদের বাজারের বীজ, সার, বালাইনাশক ও সেচ নির্ভর কৃষি ব্যবস্থায় অভ্যস্ত করা হয়। কালক্রমে কৃষকরা বহুজাতিক বীজ কোম্পানী ও অন্যান্য উপকরণের জন্য ব্যবসায়ী কোম্পানীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বাজার নির্ভর উপকরণ ব্যবস্থায় কৃষককে সহায়তা দেওয়ার জন্য ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থাও কৃষকের দোর গোড়ায় পৌছে দেওয়া হয়। তবে এ পুরো ব্যবস্থায় গরীব কৃষককে বহুজাতিক এগ্রিবিজনেস কোম্পানীর শিকারে পরিনত করা হয়েছে।
উচ্চ ফলনশীল জাত ও হাইব্রিড ধান চাষ করতে পানি সেচ দিতে হয়। মাটির তলার পানির সাহায্যে সেচ দিতে গিয়ে এক দিকে যেমন পানির স্তর নীচে চলে যাচ্ছে অন্য দিকে পানির আর্সেনিকের মাত্রা বেড়ে গেছে। বর্তমানে ৬৪ জেলার মধ্যে ৬১ জেলার পানি আর্সেনিক দূষণে আক্রান্ত হয়েছে। শুধু পানিতেই নয় মাটির তলার পানি দ্বারা সেচ দিয়ে উৎপাদিত ধান সহ অন্যান্য ফসলেও আর্সেনিকের অনুপ্রবেশ ঘটেছে।
অন্য দিকে মুক্ত জলাশয়ের পানি রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও আর্সেনিকে দূষিত হয়েছে। মাছ সহ অন্যান্য জলজ প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক সম্বলিত উচ্চ ফলনশীলজাত ও হাইব্রিড ধান আবাদের ফলে মাটিতে বিদ্যমান জীব-অনুজীব ধ্বংস হয়েছে। অথচ যুগযুগ ধরে এ সকল জীব অনুজীব মাটির স্বাভাবিক গুণাগুণ বজায় রাখতে সহায়তা করছে। মনে রাখা দরকার যে ইরি ধান প্রবর্তনের সময় এ দেশের মাটিতে জৈব পদার্থসহ সকল মৌলিক উপাদান পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান ছিল।
বর্তমানে জৈব পদার্থ সহ কমপক্ষে পাঁচটি মৌলিক উপাদান যেমন নাইট্রোজেন ফসফরাস, পটাশ, সালফার ও জিঙ্কের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মাটিতে জৈব পদার্থেও পরিমাণ কমপক্ষে পাঁচভাগ থাকা বাঞ্ছনীয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে বর্তমানে মাটিতে জৈব পদআর্থের পরিমাণ শতকরা একভাগের নীচে। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে বোরন ও ম্যাঙ্গানিজের ঘাটতিও দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত ভাবে চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে অন্যসব মৌলিক উপাদানেরও ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
দেশীয় জাতের ধানে রোগবালাই নাই বললেই চলে।
বিদেশ থেকে আমদানী করা ধানের সঙ্গে কিছু মারাত্মক রোগ ও পোকার আক্রমন দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্যাকটেরিয়াল লিফব্লাইট, ব্যাকটেরিয়াল লিফষ্ট্রিফ ও বাদামী গাছ ফড়িং।
বাংলাদেশের কৃষি ব্যবস্থাকে এ ভগ্নদশা থেকে রক্ষা করার জন্য গত শতাব্দীর নব্বই দশক থেকে নয়াকৃষি আন্দোলন কাজ করে আসছে। আজ বাংলাদেশের তিন লক্ষাধিক কৃষি পরিবার সরাসরি এ আন্দোলনের সাথে যুক্ত। নয়াকৃষির কৃষকরা পরিবর্তনশীল পরিবেশে সহনশীল স্থানীয় জাতের ধানসহ অন্যান্য ফসল বৃষ্টি নির্ভর পরিবেশে জৈবসার ব্যবহার করে আনন্দের সাথে আবাদ করছেন।
প্রকৃতিক দূর্যোগ যেমন ক্ষরা, জলাবদ্ধতা ও লবণাক্ততা সহ অন্যান্য প্রতিকুলতা সহ্য করতে পারে তেমন স্থানীয় জাতের ধান নয়াকৃষি কৃষকের বীজ ঘরে আছে। বাংলাদেশের সকল কৃষকের জন্য এ সব বীজঘরের দরজা খোলা আছে।
নয়াকৃষির মুলনীতিই আনন্দ। আনন্দের সাথে জীবন যাপন। সৃষ্টিশীল কর্মকান্ডে ফসল উৎপাদন:
১. এ আনন্দের মধ্যে বিষের কোন প্রয়োজন নাই,
২. বীজ কৃষির চাবি যা কৃষকের হাতেই মানায়,
৩. জৈবসার দিয়ে চাষাবাদ,
৪. মিশ্রফসল ও শস্যাবর্তন প্রাণসম্পদের বিকাশ ঘটায়,
৫. আবাদি ও অনাবাদি উভয় ফসলই গুরুত্বপূর্ণ,
৬. মাটির তলার পানির সুরক্ষা নিশ্চিত করে সকল প্রাণের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করা,
৭. প্রাণবৈচিত্র রক্ষা ও বিকাশের মধ্য দিয়ে সার্বিক অগ্রগতি ঘটানো
৮. পৃহপালিত পশুপাখীকে পরিবারের সদস্যের মতো বিবেচনা;
৯. মাছসহ সকল জলজ প্রাণবৈচিত্র সংরক্ষণ ও বিকাশ এবং
১০. প্রাকৃতিক সম্পদ বৃদ্ধি করে আর্থিক অগ্রগতি নিশ্চিত করা যায়।
নয়াকৃষির কৃষকদের পরীক্ষায ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে যে প্রাণবৈচিত্র নির্ভর জৈবকৃষি তথাকথিত আধুনিক কৃষির চেয়ে:
১. খরচ কম ২. ফলন বেশী ৩. নির্ভরশীল/ঝুকি কম ৫. লাভজনক ৬. পরিবেশ বান্ধব ৭. বৈচিত্রপূর্ণ ৮. জ্ঞান সমৃদ্ধ ৯. সামাজিক এবং ১০.উন্নতির পথ।
জল বায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে কৃষি ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে এবং খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করতে সারা দেশে প্রাণবৈচিত্র নির্ভর উৎপাদন বা নয়াকৃষি ছাড়া সম্প্রসারণের কোন বিকল্প নাই।