জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে পাওয়ার আশা ক্ষীণ
ফরিদা আখতার || Sunday 21 September 2014 ||জাতিসংঘের আয়োজনে ২৩ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবারের সভায় কী ফল আসবে তা নিয়ে আগেই অনেকে হতাশ হয়ে আছেন-এ কারণে যে, ধনী দেশ, যারা পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি, কার্বন নির্গমনসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলোর জন্য প্রধানত দায়ী, তারাই উল্টো উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চাপ দিচ্ছে কার্বন নির্গমন কমাবার অঙ্গীকারের জন্য।
অন্যদিকে তারা নিজেরা এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ কিংবা প্রযুক্তিগত সাহায্য দেবে কিনা-তার কোনো ইশারাও নেই। গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড (GCF) করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তাদের জন্য ধার্য অর্থ দেয়ার বিষয়টি নিয়ে অঙ্গীকার করতে দেরি করেই যাচ্ছে। এ গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড মেক্সিকোর কানকুন শহরে ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে সবাই একমত হয়ে ২০১১ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং কথা ছিল ২০২০ সালের মধ্যে ১০০ বিলিয়ন ডলার অর্থ সংগ্রহ করা হবে।
এ অর্থ দেয়ার কথা ধনী দেশের এবং অর্থ পেলে উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজ করবে। তাই অর্থ দিতে দেরি হলে এ কাজও আপনা থেকে দেরি হবে এবং পৃথিবীর অবস্থা আরও শোচনীয় হতে থাকবে। জিসিএফ প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধনী দেশগুলো 'কানে দিয়েছি তুলো,' নীতি গ্রহণ করে চুপ মেরে বসে আছে। শুধু ব্যতিক্রম হচ্ছে জার্মানি। তারা অন্তত বলেছে, তারা এ ফান্ডে অর্থ দিতে আগ্রহী। এদিকে জি৭৭ এবং চীন এ বছর জুন মাসে ১৫ বিলিয়ন ডলার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য কাজ করতে পারার সম্ভাবনা নির্ভর করছে এ তহবিলের ভাগ্যের ওপর, তা না হলে নিউইয়র্কের সভার সাফল্য কতখানি হবে, তা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন থেকে যাবে।
এটা খুব দুঃখজনক, ধনী দেশগুলো নিজেরা অর্থ দেয়ার ব্যাপারে একদিকে গড়িমসি করছে অন্যদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর ক্রমাগতভাবে চাপ সৃষ্টি করছে অঙ্গীকার করার জন্য যে তারা কত কার্বন নির্গমন কমাবে। ধনী দেশের এ আচরণ জাতিসংঘের জলবায়ু চুক্তির (United Nations Framework Convention on Climate Change) লঙ্ঘন এবং অনৈতিক। কারণ তারা ভুক্তভোগী দেশকেই সমস্যা সমাধানে দায় চাপাচ্ছে, নিজেদের দায়িত্ব পালন করছে না। এ বড় অন্যায় কথা। উন্নয়নশীল দেশগুলো কানকুন সম্মেলনে জানিয়েছিল, তারা অবশ্যই নির্গমন কমাবার উদ্যোগ নেবে, কিন্তু এর জন্য যে অর্থ ও প্রযুক্তি সহায়তা দরকার সেটা দিতে হবে। কিন্তু 'নিজের বেলায় অাঁটিসুটি, পরের বেলায় চিমটি কাটি' নীতি অবলম্বনকারী ধনী দেশের অসহযোগিতার কারণে জিসিএফএ'র বাঙ্ খালি পড়ে আছে এবং এ পর্যন্ত কোনো প্রযুক্তি সহযোগিতাও দেয়া হয়নি।
ধনী দেশের মানুষের জীবনযাত্রা এবং তাদের উন্নয়ন বিশ্বের কার্বন নির্গমন তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ। জলবায়ু পরিবর্তনের আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংগঠন (Intergovernmental Panel on Climate Change) (IPCC) ১৯৯০ সালের ভিত্তিতে ২০২০ সালের মধ্যে ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ কমাবার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, কিন্তু তারা বলছে মাত্র ১৭ শতাংশ কমাবে। এ কার্বন নির্গমনের পরিমাণ কমাবার মাত্রা আরও বাড়াতে হবে-এমন কোনো অঙ্গীকার তাদের নেই। ধনী দেশের মধ্যে তিনটি বড় বড় দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও জাপান কিয়োটো চুক্তিতেই স্বাক্ষর করেনি, তবুও তাদের কার্বন নির্গমনের মাত্রা কমাবার জন্য অন্যান্য ধনী দেশের মতো বেঁধে দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, কমাবার কোনো ইচ্ছে বা পরিকল্পনা তাদের নেই, বরং কানকুনে যা কমাবে বলেছিল তার চেয়ে বাড়িয়ে দেয়ার সম্ভাবনা আছে। যুক্তরাষ্ট্র হাস্যকরভাবে প্রস্তাব দিচ্ছে, তারা ২০২০ সালের মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ কমাবে, অথচ তারাই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গমনকারী দেশ। এটা হচ্ছে বিশ্ববাসীর প্রতি চরম তামাশা।
এ ধরনের মনোভাব নিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের শীর্ষ সম্মেলন শুধু কি বড় বড় কথার মধ্যেই শেষ হবে? উন্নয়নশীল দেশ এবং পৃথিবীর মানুষকে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি থেকে বাঁচানোর আর কি কোনো পথ খোলা থাকবে না?
ধনী দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে অঙ্গীকার ব্যর্থ হওয়ার অর্থ হচ্ছে, সেসব দেশের বড় বড় কোম্পানি জলবায়ু নিয়ে ব্যবসায় নামবে। বলা যায়, এরই মধ্যে নেমে গেছে। তারা সবুজ প্রযুক্তির কথা বলে তাদের মুনাফা লাভের জন্য প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে এবং সেগুলো বাজারজাত করছে। কৃষিতে জেনেটিক কারিগরি করে জলবায়ু পরিবর্তন প্রযুক্তির বাজার সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশেও এরই মধ্যে লবণ, খরা ও বন্যাসহনশীল জাতের বিদেশি প্রযুক্তি-নির্ভর জিএম ধান উৎপাদনের কথা বলা হচ্ছে, অথচ আমাদের দেশে সে জাতের ধান আগে থেকেই ছিল। এভাবে কৃষি উৎপাদন বহুজাতিক কোম্পানি গ্রাস করে নিচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ক্ষুদ্র কৃষক এবং ভোক্তারা।
এক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলো শুধু জিসিএফের মতো তহবিল থেকে টাকা পাওয়ার আশায় না থেকে তাদের নিজেদের দেশকে কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করা যায় তার নিজস্ব পরিকল্পনা করা দরকার। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের চেষ্টা থাকে তহবিলের অর্থ পাওয়ার দিকে। এবং জেনে বা না জেনে তারা বহুজাতিক কোম্পানির দেয়া তথাকথিত 'সমাধানের' দিকে সহজেই ঝুঁকে পড়ে।
আমরা ক্ষুদ্রভাবে কাজ করে দেখেছি, এখনও কৃষকরা নিজেদের জ্ঞান ব্যবহার করে দেরিতে বৃষ্টি হলে কোন জাতের ধান লাগাবে তা ঠিক করে রাখেন। বন্যাসহনশীল বা খরা সহনশীল জাত সংরক্ষণ করে রাখেন এবং প্রয়োজনমতো ব্যবহার করেন। যদিও সরকার এসব কাজে সহযোগিতা দেয় না, কৃষকরা নিজেদের উদ্যোগেই তা করে ফেলেন। তাদের নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য।
নিউইয়র্কের সম্মেলন থেকে কিছু পাওয়ার আশা না করে নিজেদের কাজ নিজেরাই করার পরিকল্পনা করা ভালো। আমাদের দেশেও যেসব কারণে কার্বন নির্গমন বেশি হয় সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা একান্ত জরুরি। পরিবেশসম্মত জীবনযাপন শহরের মানুষের মধ্যে প্রচার করতে হবে, যেমন গাড়ি ব্যবহার কমাতে হবে। অন্যদিকে যারা এরই মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, উৎখাত হয়েছেন নিজের ভূমি থেকে তাদের দিকে আমাদের নিজেদের এগিয়ে আসতে হবে।
অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে নয়, নিজের সমাধান আমাদের নিজেদেরই করতে হবে।