বিটি বেগুনের ব্যর্থতা মিথ্যাচার দিয়ে ঢাকা যাবে না
ফরিদা আখতার || Tuesday 23 September 2014 ||জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অর্থাৎ প্রাণ নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বাংলাদেশে এখন এক হুমকির সৃষ্টি করছে। আমরা জানি, প্রাণের গঠন কাঠামোর গোড়ায় রয়েছে এক ধরনের গঠন সংকেত, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘জিন’। তার সেই গঠনে বিকৃতি ঘটানোর কারিগরি আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। প্রাণের মূল বৈশিষ্ট্যে বিকৃতি ঘটিয়ে যা তৈরি হয়, তাকে বলা হচ্ছে জেনেটিক্যালি মডিফাইড অর্গানিজম বা জিএমও। এটা প্রকৃতির স্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। অস্বাভাবিক ঘটনা। আর বিকৃতিটা প্রকৃতির মধ্যে ঘটছে না, ঘটছে প্রাণের গঠন সংকেতের মধ্যে। ফলে তার পরিণতিও অস্বাভাবিক হওয়ারই কথা। বিকৃতি ঘটানো বিজ্ঞান কি বিজ্ঞান নয়— এ তর্কে না গিয়েও বলা যায় এই প্রযুক্তি খাটিয়ে বীজে ও ফসলে বিকৃতি ঘটানোর ফল পরিবেশ, মাটি ও সর্বোপরি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর পড়তে বাধ্য। অথচ এর প্রভাব সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে যেভাবে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় বহুজাতিক কোম্পানি বিকৃত বীজের ফসল উত্পাদনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বিটি বেগুন তেমনই একটি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তৈরি বিকৃত বীজের ফসল। এ ফসল সাধারণ মানুষের খাদ্য, তাই পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য এর হুমকির ব্যাপকতা অনেক বেশি।
বিটি বেগুনের জন্য নয়টি স্থানীয় জাতের বেগুন নিয়ে bacillus thuringienesis ব্যাকটেরিয়া থেকে ক্রিস্টাল জিন বেগুনে সংযোজন করা হয়েছে। এর মধ্যে চারটি স্থানীয় জাতের বেগুন কৃষকপর্যায়ে চাষের অনুমোদন দেয়া হয়েছে এবং তাদের নামের সঙ্গে সংখ্যা বসে গেছে। যেমন উত্তরা (বিটি বেগুন-১), কাজলা (বিটি বেগুন-২), নয়নতারা (বিটি বেগুন-৩) এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্ভাবিত একটি জাত ঈশ্বরদী-০০৬ হয়ে গেল বিটি বেগুন-৪। কৃষকের কাছে যখন বেগুনের জাত থাকে তখন সেটা দেখতে কেমন, স্বাদ কেমন, কোথায় হয় এসব গুরুত্বপূর্ণ। বেগুন শুধু খাদ্য নয়, সেটা ভাষা, সংস্কৃতি, স্মৃতি, সামাজিক জ্ঞানচর্চা ও প্রাণ ব্যবস্থাপনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। কৃষক এসব বাস্তবতা ধারণ করে সুন্দর নাম রাখেন। অথচ ল্যাবরেটরিতে ঢুকলেই ফসলের জাত সংখ্যায় পরিণত হয়।
কোম্পানি নিয়ন্ত্রিত ও কোম্পানির অধীন বিজ্ঞানীরা এ বেগুন উদ্ভাবনে মৌলিক কোনো ভূমিকা রাখেননি। তারা কৃষকের রেডিমেড স্থানীয় জাতের বেগুনের ক্রিস্টাল জিন ঢুকিয়ে একটি ‘বিশেষ পোকা দমনে’র উপযোগী করেছেন বলে দাবি করছেন। বেগুনের রঙ, আকৃতি বা অন্যান্য চরিত্র একই রয়ে গেছে। কেউ দেখলে তাই আলাদা করার উপায় নেই যে কোনটা আসল উত্তরা আর কোনটা বিটি-১। সংখ্যা দিয়ে নাম দেয়ার ঘটনা নতুন নয়। এটা আমরা ধানের জাতের ওপর প্রয়োগ করতে দেখেছি। যেমন— বিআর-৮, বিআর-১১, বিআর-৫০ ইত্যাদি। অথচ আগে ছিল শঙ্খপটি, কালামানিক, কালিজিরা, তুলসীমালা, টেপাবোরো, হিজ দিঘা আরো কত অসংখ্য নাম। সংখ্যা দিয়ে চেনার বিষয় ঘটে কয়েদখানায় দাগি আসামিদের জন্য। আমাদের বেগুনগুলো কি তাহলে কয়েদি হয়ে গেছে?
প্রাণের নিজস্ব বিবর্তনের নিয়মে ও স্বাভাবিকভাবে প্রাকৃতিক উপায়ে নতুন জাত আবিষ্কারের পেছনে প্রাণ ও প্রকৃতি অসামান্য শক্তিশালী ভূমিকা রাখে। এর তুলনায় প্রাণের বিকৃতি ঘটিয়ে বিকৃত পদ্ধতিতে ফসলের জাতে সেই শক্তি কখনই থাকে না। জেনেটিক কারিগরির দাপট এখানে টিকছে না। বিটি বেগুনের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের পরিণতির কথা না ভেবে কৃষককে মাঠপর্যায়ে বিটি বেগুন চাষ করতে দেয়া হয়। এটা ছিল বায়োসেফটি বা প্রাণের নিরাপত্তা-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিবিধানের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। কৃষকের মাঠে বিটি বেগুন চাষের সময় বাংলাদেশের পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দেয়া শর্তও মানা হয়নি। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ও আদৌ তার শর্ত পালিত হচ্ছে কিনা, সেটা পর্যবেক্ষণ করেনি কিংবা তা পর্যবেক্ষণের কোনো ব্যবস্থা রাখেনি। বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, তারা বিটি বেগুন চাষে শতভাগ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বাবধান করেছেন। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। বিটি বেগুন চাষ করে ভালো কোনো ফলই দেখাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা।
কৃষিতে বিশেষ করে খাদ্যফসলে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা বায়োটেকনোলজির ব্যবহার নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। বাংলাদেশে অনেকেই এ বিতর্ক সম্পর্কে জানেন, যদিও সাধারণ মানুষের কাছে সব তথ্য হাজির করা হয়নি। বিটি বেগুন খাদ্যফসলের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে শুধু নয়, এশিয়ায় প্রথম একটি জিএম খাদ্যফসল। অন্য দেশে বিটি বেগুনের গবেষণা ও মাঠপর্যায়ে চাষের অনুমতি দেয়া হয়নি, কারণ বিটি বেগুন খাদ্য হিসেবে নিরাপদ কিনা সেটা এখনো জানা যায়নি। পরিবেশের জন্যও বিটি বেগুন চাষে ক্ষতির শঙ্কা নিয়ে উত্কণ্ঠা আছে বিজ্ঞানীদের মধ্যে। কিন্তু বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা প্রকল্পটি বহুজাতিক কোম্পানির অর্থে এবং তাদের সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধানে করার কারণে নিজেদের মেধা ও মতামত প্রকাশ করতে পারছেন না। এর প্রতিফলন আমরা দেখছি ২০০৫ সাল থেকে প্রতি পদে পদে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বারি) এ গবেষণা করছে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির বিশেষ কর্মসূচি Agriculture Biotechnology Support Project (ABSP II)-এর অধীনে। বারি বিটি বেগুনের বীজ ভারতের মাহিকো কোম্পানি থেকে এনেছে। তাদের কাজ হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষকদের দিয়ে এর পরীক্ষা করানো। বারি গাজীপুর কার্যালয়ে নিজ জমিতে ২০০৫ থেকে গবেষণা শুরু করেছে। একই সময়ে ভারতেও শুরু হয়েছিল। ২০০৯ সালে ভারতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ২০১০ সালের শুরুতে পরিবেশ মন্ত্রণালয় স্থগিত করে দেয়। এর পরেই বাংলাদেশে বিটি বেগুন বাজারজাতের জন্য মনসান্টো ও মহারাষ্ট্র হাইব্রিড সিড কোম্পানি লিমিটেড (মাহিকো) বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ে।
কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানি গবেষণা শেষ করে তার ফলাফলের অপেক্ষা না করেই চুক্তির মাধ্যমে বেগুনের মেধাস্বত্ব বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তি হিসেবে কোম্পানির ব্যক্তিগত মালিকানা নিয়ে ফেলেছে। ২০০৫ সালের ১৪ মার্চ বারি, মার্কিন বহুজাতিক বীজ কোম্পানি মনসান্টোর পক্ষে ভারতীয় কোম্পানি মাহিকো ও সাতগুরু ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় সাব-লাইসেন্স চুক্তি অনুসারে জিনগত পরিবর্তন ঘটিয়ে উত্পাদিত বিটি বেগুনের মেধাস্বত্ব মনসান্টো ও মাহিকো কোম্পানির হাতে চলে গেছে। চুক্তিটির আর্টিকেল ১.১৯ ধারায় বলা হয়েছে, বিটি বেগুন বীজের মেধাস্বত্ব মনসান্টো-মাহিকো কোম্পানির। আর্টিকেল ১.৬ ধারায় বলা হয়েছে, বিটি বেগুনের বীজ কোম্পানির কাছ থেকে কিনে নিতে হবে। এ চুক্তির আর্টিকেল ৯.২(গ) অনুসারে বিটি বেগুন বীজের বাণিজ্যিক ও মেধাস্বত্ব অধিকার মনসান্টো-মাহিকো কোম্পানির। বিটি বেগুন বীজ ও প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ও মেধাস্বত্ব অধিকারের সংরক্ষণ লঙ্ঘিত হলে কোম্পানি এ চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে। চুক্তির ১.১৯ ও ১.৬ ধারা অনুসারে বাংলাদেশের নিজস্ব জাতের ৯টি বেগুন, যেগুলোয় বিটি জিন সংযুক্ত করা হয়েছে, সেগুলোর মালিকানা বহুজাতিক কোম্পানির হাতে চলে যাবে। আর্টিকেল ৯.২(গ)-এ বলা হয়েছে, বিটি বেগুন বীজের ও প্রযুক্তির বাণিজ্যিক এবং মেধাস্বত্ব অধিকারের সংরক্ষণ লঙ্ঘিত হলে কোম্পানি এ চুক্তি বাতিলের অধিকার রাখে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে বিটি জিন প্রয়োগ করা নয়টি জাত হলো— উত্তরা, কাজলা, নয়নতারা, সিংনাথ, চেগা, ইসলামপুরী, দোহাজারী ও আইএসডি ০০৬।
একদিকে মেধাস্বত্ব দিয়ে দেয়া, অন্যদিকে দেশের প্রাণবৈচিত্র্য ও বেগুনের মতো খাদ্যফসল ভোগের পর মানবদেহে এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে যে উত্কণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রতি তোয়াক্কা না করেই কৃষি মন্ত্রণালয় এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আরো ১০০ জন কৃষকের মাধ্যমে আগামী মৌসুমে এটি চাষের কথা ঘোষণা করেছে। কিসের ভিত্তিতে এ ঘোষণা করা হলো, তার কোনো ভালো জবাব নেই।
কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে—
এক. সাতটি শর্ত দিয়ে অনুমোদন দিয়েছে পরিবেশ মন্ত্রণালয়, সেই অনুমোদনের শর্ত লঙ্ঘন হওয়ার পরও কী করে এ বেগুন আরো চাষের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়? বিটি বেগুন একটি জিএম ফসল, যা উন্মুক্ত চাষের জন্য প্রবর্তনের ঝুঁকি যে বিশাল ও মারাত্মক হতে পারে, সেটা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারক মহলে সুপ্রতিষ্ঠিত। এক্ষেত্রে সাবধানী হওয়ার (Pre-cautionary Principle) যে ন্যূনতম আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি ও বিধিবিধান আছে, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। যদিও অনুমোদনের সময় দেয়া শর্ত ৩ অনুযায়ী, যেসব স্থানে সীমিত চাষাবাদ করা হবে তার বায়োসেফটি মেজার্স (Biosafety measures) মনিটরিংসহ তত্সংশ্লিষ্ট অধিক্ষেত্রের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের স্থানীয় কর্মকর্তা, বিএআরআই গবেষণা কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট বৈজ্ঞানিক, পরিবেশ অধিদফতরের জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মকর্তার সমন্বয়ে ফিল্ড বায়োসেফটি কমিটি গঠনের প্রস্তাবনা বিএআরআই কর্তৃক এনসিবি বরাবর প্রেরণ করতে হবে। এ ধরনের কোনো কমিটি গঠনের কথা জানা যায়নি। শুধু কৃষি কর্মকর্তা সেখানে সবকিছু দেখভাল করেছেন। বিটি বেগুনের চাষের বিষয়টি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের এবং বিভাগীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। এভাবে আন্তর্জাতিক নীতিমালা অগ্রাহ্য করে কি বাংলাদেশ জিএম ফসল উত্পাদনকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার গৌরব (!) অর্জন করতে চাইছে?
বাংলাদেশে এমন দায়িত্বহীন কাজের নেতিবাচক ফলাফল এ দেশের সীমানার মধ্যে থাকবে না, এর প্রতিক্রিয়া প্রতিবেশী ভারতেও পড়বে। কারণ জিএম ফসল আদি উত্পত্তিস্থলের দেশে প্রবর্তন করলে এর প্রতিক্রিয়া সে অঞ্চলের স্থানীয় জাতের দূষণ ঘটাতে পারে। ভারতও সেই আদি উত্পত্তিস্থলের অংশ। এবং ভারতে বিটি বেগুন চাষের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি আছে। কিন্তু কোম্পানি বাংলাদেশে জিএম বেগুন চাষ করে ভারতেও পাচার করতে চায়। ভারতে বাংলাদেশের এ ঘটনাকে The curse of Bt Brinjal হিসেবে চিহ্নিত করেছে ডেক্কান হেরাল্ড পত্রিকা (আগস্ট ১১, ২০১৪)। http://www.deccanherald.com/content/424824/
curse-bt-brinjal.html
দুই. বাংলাদেশে গবেষণা দিয়ে প্রমাণ করা যাচ্ছে না যে বিটি বেগুন উন্মুক্ত চাষের জন্য নিরাপদ এবং কৃষকদের জন্য সুফল বয়ে আনবে। ২০১৩ সালে তড়িঘড়ি করে বিটি বেগুনের অনুমোদন দেয়া হয়। অথচ সব দিক বিবেচনা করে অনুমোদন দেয়ার কথা। ছাড়পত্রের জন্য বারি গত ১৪ জুলাই কৃষকপর্যায়ে চাষ করার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। কৃষি মন্ত্রণালয় ৭ অক্টোবর সভা করে ২০ অক্টোবর পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে পাঠায় মতামত দেয়ার জন্য। সে সময় পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের ন্যাশনাল কমিটি অন বায়োসেফটি (এনসিবি)-কে মাত্র তিনদিন সময় দেয়া হয়। এর পর ২০১৩-এর ৩০ অক্টোবর অনুমোদন মেলে। এতে বোঝা যাচ্ছে, এ অনুমোদনের ক্ষেত্রে ন্যূনতম নীতি মেনে চলা হয়নি। এটা অনেকটা যেন আদিষ্ট হয়ে অনুমোদন দেয়ার মতো। তাই পরিবেশ মন্ত্রণালয় শর্ত দিয়ে নিজেদের গা বাঁচানোর চেষ্টা করেছে এবং শর্ত মেনে চলা হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে গরজ করেনি। এখানে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা কোনোখানেই দেখা যাচ্ছে না।
তিন. জিএম ফসল চাষের বিষয়টি ‘বৈজ্ঞানিক’ বা প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক থেকে দেখা যায়। সেদিক থেকে এর ফলাফল সফল কি ব্যর্থ, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। চারা লাগানোর পর থেকে বেগুন ধরা পর্যন্ত বিভিন্নভাবে পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, বাংলাদেশে বিটি বেগুনের চাষ সফল হয়নি। সরকার ২০ জন বাছাই করা কৃষককে চারা দিয়ে বারির পর্যবেক্ষণে চাষ করালেও মাত্র দু-একজন ছাড়া সবাই ফসল উত্পাদনে ব্যর্থ হয়েছে এবং গাছে পোকা লেগেছে। বিটি বেগুন বিরোধী মোর্চা এবং আরো কয়েকটি সংগঠন গত ৩১ আগস্ট কৃষকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বিটি বেগুন চাষের ব্যর্থতার কথা বলেন। জিএম বেগুন চাষের ব্যর্থতা সম্পর্কে বারি অবগত থাকলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, উল্টো তারা সত্য তথ্য তুলে ধরার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে অপপ্রচার চালান। পরে ৭ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলন করে তারা নিজেদের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল মিলনায়তনে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে দেশের পাঁচ জেলার ১৯ চাষীকে বারি নিয়ে আসে। এ সংবাদ সম্মেলনে চাষীদের বিটি বেগুনের পক্ষে সাফাই গাওয়ার কথা থাকলেও একপর্যায়ে তারা প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। সাংবাদিকদের একের পর এক প্রশ্নের জবাবে তারা প্রকৃত সত্য প্রকাশ করে দেন। এ সময় বারির মহাপরিচালক ড. মো. রফিকুল ইসলাম মণ্ডলকে বারবার বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়। http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/২০১৪/০৯/০৮/১২৬১১৭
পাঁচ জেলার যে ২০ জন চাষী বিটি বেগুন চাষ করেছিলেন, তাদের ১৩ জনের ক্ষেতের প্রায় সব গাছ মারা গেছে। বাকিদের মধ্যে পাঁচজনের ক্ষেতের কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। ভালো ফলন হয়েছে দুজনের ক্ষেতে। তবে সার্বিকভাবে কেউ লাভবান হননি। যেসব কৃষকের ক্ষেতের সব গাছ মারা গেছে, তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এক মৌসুমে বিঘাপ্রতি এক থেকে সোয়া লাখ টাকার আয় থেকেও বঞ্চিত হয়েছেন তারা। http://www.bonikbarta.com/2014-09-08/news/details/13191.html
কৃষকপর্যায়ে চাষ যে সম্পূর্ণ সফল হয়নি, তা বারি নিজেদের দেয়া বিজ্ঞাপনেও স্বীকার করেছে। ৩ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন পত্রিকায় দেয়া ‘বিটি বেগুন-সংক্রান্ত প্রকাশিত সংবাদ সম্পর্কে বিএআরআই এর বক্তব্য’ শিরোনামে দেয়া বিজ্ঞাপনের ৪ নং বক্তব্যে তারা বলেছেন, ‘...তবে ২/১ জন কৃষক চাষাবাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা সঠিকভাবে অনুসরণ না করায় বিটি বেগুন চাষে সফল হতে পারেননি।’ [স্মারক নং, বারি/পি আর/৭/২৪৯২ তারিখ ০২-০৯-২০১৪]
কৃষকদের এমন মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা বর্ণনার পরও উপস্থিত কোনো বিজ্ঞানী সেখানে তাদের ফসল কেন হলো না, তার কোনো উত্তর দিতে পারেননি। বরং অনেকটা গোয়ার্তুমি করেই বারির মহাপরিচালক ড. রফিকুল ইসলাম মণ্ডল বলেন, ‘দু-চারজন চাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ঠিকই, তবে আমাদের অন্যান্য জমিতে ভালো ফলন হয়েছে। আগামীবার আরো ১০০ জন চাষীকে চারা দেয়া হবে।’ http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2014/09/08/126117
আবারো ১০০ জন চাষীকে আগামী মৌসুমে চারা দেয়ার খবর প্রায় সব পত্রিকায় এসেছে। অর্থাত্ ফল যাই হোক, তাদের কাজ অব্যাহত থাকবেই। এটা কি জেদ করার বিষয়?
চার. অনুমোদনের অন্যতম শর্ত ‘লেবেল লাগিয়ে বিক্রি করা’র নিয়ম মানা হয়নি, এবং সেটা সম্ভব নয় বলে বারি মহাপরিচালক আগেই জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ৩ সেপ্টেম্বর দেয়া বারির বিজ্ঞাপনের ৫ নং বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘বিভিন্ন জেলায় বাজারে বিটি বেগুন যথোপযুক্ত লেভেলসহকারে বিক্রি করা হয়েছে।’ এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। এটা ডাহা মিথ্যা। বারি মহাপরিচালক এর আগে পত্রপত্রিকায় সাক্ষাত্কারে বলেছেন, লেবেল লাগানো কোনোমতেই সম্ভব নয়। বিটি বেগুনে লেবেলিং করা হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে রফিকুল ইসলাম মণ্ডল বলেছেন, ‘It is totally impossible to label the brinjals before going to market here in Bangladesh. We wrote this observation to the government that it would be difficult to distinguish the varieties with labels in markets.’ Interview BARI DG_New Age_The Outspoken Daily.htm (মার্চ ১৪, ২০১৪)
বাজারে বিক্রির অর্থ হচ্ছে এ বেগুন মানুষ খাচ্ছে। জিএম ফসলের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে বিটি বেগুনের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা বিজ্ঞানীরা এরই মধ্যে তুলেছেন। তাই এ বেগুন স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কিনা, বাজারে বিক্রির আগে গবেষণা করতে হতো। কিন্তু তেমন কোনো গবেষণাই হয়নি। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে বারি মহাপরিচালক বলেছেন, ‘We could not carry out any test regarding human health hazards of Bt brinjal in Bangladesh due to the absence of necessary laboratories,’ http://www.dhakatribune.com/agriculture/2014/sep/08/bari-admits-no-health-tests-done-bt-brinjal
মহাপরিচালক পরিষ্কার বলেছেন, স্বাস্থ্য নিরাপত্তার গবেষণা বাংলাদেশে হয়নি, কারণ এ রকম কোনো ল্যাবরেটরি সুবিধা বাংলাদেশে নেই। অথচ বিটি বেগুনের অনুমোদনের বিরুদ্ধে করা রিট মামলায় বাদীপক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়েছিল। অন্যদিকে বারি স্বাস্থ্য নিরাপত্তার কোনো প্রতিবেদন হাজির করেনি। এখন তারা নিজেরাই স্বীকার করছেন যে, এ গবেষণা করেননি। তাহলে মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতি হলে সে দায়দায়িত্ব কে নেবে?
যারা বিটি বেগুনের বিরুদ্ধে সতর্কতামূলক তথ্য প্রকাশ, বিশেষ করে এর পরিবেশ ও স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও আজগুবি অপবাদ দেয়া হচ্ছে। তার একটি অন্যতম হলো, বিটি বেগুনের বিরোধিতাকারীরা নাকি কীটনাশক কোম্পানির কাছ থেকে অর্থ নিয়ে এ কাজ করছেন! যদিও এ কথার সপক্ষে আজ পর্যন্ত নির্দিষ্ট প্রমাণ যেমন— কোন কোম্পানি, কত টাকা, কবে এবং কাকে দিয়েছে, তারা দিতে পারেননি। যারা বিটি বেগুনের বিরোধিতা করছেন, তাদের বিরুদ্ধে তারা মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন। ঢালাও মন্তব্য করে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করাই তাদের উদ্দেশ্য। যারা বিটি বেগুনের বিরোধিতা করছেন, তাদের প্রায় সবাই কীটনাশকমুক্ত এবং প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষার জন্য কাজ করছেন। তারা কীটনাশক ব্যবহার বন্ধের জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছেন। বিকল্প হিসেবে সমন্বিত কীট ব্যবস্থাপনার (IPM) পক্ষে কাজ করছেন। নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার জন্য প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপপ্রচার পুরনো কৌশল। বারি সেই কৌশল নিয়েছে।
শেষে বলি, বিটি বেগুন স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কিনা, সেটা আদৌ পরীক্ষা করা হয়নি। পরীক্ষা না করেই জিএম খাদ্য আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে চাষাবাদ ও খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছে (বিজ্ঞাপনের ৭ নং বক্তব্য)— এমন তথ্য দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে যে, বিটি বেগুনে কোনো সমস্যা নেই। এটা সত্য যে, বহুজাতিক কোম্পানি ধনী দেশেই এর চাষাবাদ ও ব্যবহার শুরু করেছে, কিন্তু এখন ইউরোপের বাজারে লেবেল ছাড়া জিএম খাদ্য রফতানি করা যায় না। জিএম খাদ্য নিরাপদ প্রমাণ হয়নি। ভারতের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী পুষ্প ভারগাভা বলেছেন, জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ৯০ শতাংশ দেশ লেবেল ছাড়া জিএম খাদ্য নিজ দেশে আমদানি করছে না। আর লেবেল দিলে জিএম খাদ্য ভোক্তারা কেনে না। যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে জিএম সয়া ও ভুট্টা গত ১৫ বছর মানুষ খাচ্ছে, সেখানে পাকস্থলীর নানা অসুবিধা ধরা পড়েছে, যার সঙ্গে জিএম খাদ্যের যোগসূত্র আছে বলে ধরা যায়। জিএম ফসল নিরাপদ কিনা, এমন গবেষণার কোনো নির্দেশনা ঠিক হয়নি, কিন্তু যখনই জিএম ফসলের স্বাস্থ্যঝুঁকি পরীক্ষা করা হয়েছে, তখনই এর সঙ্গে ক্যান্সারের সম্পর্ক পাওয়া গেছে। http://www.hindustantimes.com/
comment/analysis/us-is-trying-to-control-our-food-production/article1-1249456.aspx
বাংলাদেশের জনগণকে জিএম ফসলের গিনিপিগ বানানোর চেষ্টা প্রতিরোধ করা দরকার। অনুমোদনের শর্ত ভঙ্গ করা হয়েছে, অতএব বিটি বেগুনের অনুমোদন বাতিল করা হোক। এ ব্যাপারে প্রাণ, পরিবেশ, খাদ্য ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন সব নাগরিককে সোচ্চার হতে হবে।
বাংলাদেশকে জিএমমুক্ত ঘোষণা করা হোক।