তামাক ব্যবহার ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ জরুরী
ফরিদা আখতার || Monday 20 October 2014 ||তামাক খুব বাজে জিনিষ যা উৎপাদন থেকে ব্যবহার সকল পর্যায়ে মানুষের ক্ষতি করে। যারা নিয়মিত ধুমপান করে তাদের শরীরে যে সব রোগ বাঁধে এমন কি অকাল মৃত্যু হয়, সে ব্যাপারে আমরা অনেকেই মর্মাহত হই, পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কেউ বাঁচতে পারে না। যে ধুমপান করে সে তো নিজেও মরে অন্যকেও মেরে যায়। তার আশে পাশে যারা থাকে তারাও ধোঁয়ায় আক্রান্ত হয়ে সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়, কিন্তু কেউ বুঝতে পারে না, কারণ সে তো ধুমপায়ী নয়। এই ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে রয়েছে বেশীর ভাগ নারী ও শিশু। স্বামী, ভাই, বাবার ধোঁয়ায় তাদের মৃত্যু ঘটতে পারে, কিংবা হতে পারেন রোগগ্রস্থ। এসব জানা কথা। দেশে ধুমপানের বিরুদ্ধে আইন রয়েছে, শাস্তি ও জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু তাও থামছে না, কারণ যারা এই মরণ পণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে বিপুল অংকের মুনাফা গুনছে তাদের তৎপরতা থামছে না। তারা তরুনদের পিছে লেগেই রয়েছে এবং সরকারকে এ বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকার জন্যে উৎসাহ যোগাচ্ছে। যতো ইচ্ছা মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। আইন অমান্য করে তরুনদের উদ্ধুদ্ধ করছে সিগারেট পানের জন্য।
গত ২১ সেপ্টেম্বর, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন ভংগ করে বংগবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বেনসন সিগারেটের প্রচারণা বৃদ্ধির করার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের টার্গেট করে এক জাক-জমকপুর্ণ কনসার্টের আয়োজন করেছিল। যদিও তারা বিষয়টি কিছুটা গোপন রাখতে চেয়েছিল কিন্তু তামাক বিরোধী সচেতন গণমাধ্যম ও বাংলাদেশ তামাক বিরোধী জোট (বাটা), তামাক বিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) ও অন্যান্য সংগঠনের প্রতিবাদের মুখে তা স্থগিত করতে বাধ্য হয়। তামাকের প্রচারণার এই কাজ সম্পুর্ণভাবে আইনের লংঘন। এর জন্য সংশ্লিষ্ট যারা এই কনসার্ট আয়োজনে সহায়তা করেছেন তাদের উপরও দায় বর্তায়।
বিশ্ব ব্যাপী তামাক নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ জোরদার করা হচ্ছে। অক্টোবর মাসের ১৩ – ১৮, ২০১৪ তারিখে মস্কোতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল ( FCTC) এর স্বাক্ষরকারি দেশ সমুহের ষষ্ট সভা (COP6) । তবে এই গুরুত্বপুর্ণ সভা নিয়ে বাংলাদেশে খবর খুব একটা দেখা যায়নি। এই সভার আগেই বাংলাদেশে বৃহত্তম তামাক কোম্পানির এই ধরণের আইন ভংগকারি কার্যক্রম কোন মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। বোঝা যাচ্ছে তারা তোয়াক্কা করে না। বাংলাদেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল ( FCTC) এর প্রথম কয়েকটি স্বাক্ষরকারি দেশ হিশেবে ২০০৫ সালে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন প্রনয়ন করেছিল। এই আইনের দুর্বল দিক চিহ্নিত করে ২০১৩ সালে সংশোধিত আইন হয়েছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ তামাক নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে মোটামুটি চেষ্টা করছে, যদিও এই ক্ষেত্রে তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠন এবং তামাক বিরোধী সাংবাদিকদের ভুমিকা উল্লেখ করা অবশ্যই দরকার। কপ৬ সভায় উত্থাপিত সকল বিষয় নিয়ে এই লেখায় আলোচনা সম্ভব নয়। তবে বিশেষ কয়েকটি দিক এখানে তুলে ধরতে চাই। কপ৬ সভায় প্রকাশিত দৈনিক বুলেটিন থেকে তথ্য নিয়ে লিখছি।
কপ৬ সভায় তামাক ও নারী নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন এলায়েন্স (FCA) প্রকাশিত নারীদের আর উপেক্ষা করা যাবে না (Women cannot be Left Behind) পলিসি ব্রিফিংয়ে বলা হয় FCTC Article 4.2 (d) অনুযায়ি জেন্ডার এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন প্রস্তুত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখানে এই ধারাটি তুলে ধরছিঃ
FCTC Article 4.2 (d): Strong political commitment is necessary to develop and support, at the national, regional and international levels, comprehensive multisectoral measures and coordinated responses, taking into consideration … the need to take measures to address gender-specific risks when developing tobacco control strategies.
আগামি কপ৭ -এ বিশেষজ্ঞ প্রতিবেদন নারীদের তামা্কমুক্ত করার জন্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারণে সহায়ক হবে এবং এই কাজে নারীদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা যাবে। উল্লেখ্য বাংলাদেশে ইতিমধ্যে তামাক বিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) বেশ সক্রিয় ভুমিকা নিয়েছে এবং তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য তামাকের সংজ্ঞায় অন্তরর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে জোরালো ভুমিকা রেখেছে, এবং এখনো তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের জন্য সচেষ্ট রয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে নারীদের সংগঠন বা জোট বাংলাদেশে আর নেই, অন্যান্য দেশেও খুব কম। বুলগেরিয়ায় Association Women Against Tobacco-Bulgaria নামক একটি সংগঠন আছে। তামাক কম্পানিগুলো নারীদের সহজ টার্গেট হিশেবে চিহ্নিত করেছে।ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য যেমন জর্দা-গুল ইত্যাদি ছাড়াও ধুমপানের দিকে নারীদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চলছে, কারণ এতে কোম্পানির বাজার সম্প্রসারিত হবে। পৃথিবীতে বছরে ১৫ লক্ষ নারী (১.৫ মিলিয়্ন) তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে মৃত্যু বরণ করছেন। আশংকা করা হচ্ছে যদি নারীদের রক্ষার জন্যে নির্দিষ্টভাবে কোন নীতি গ্রহন করা না হয়, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্য এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ লক্ষ (২.৫ মিলিয়ন)। এর মধ্যে ৭৫% ঘটবে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে। অথচ তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শক্তিশালি হলে এই সব মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য।
গত মে মাসে প্রকাশিত বিডিনিউজ২৪.কম-একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোতে ধূমপানের ওপর কড়াকড়ি বাড়ার কারণে তামাকজাত পণ্য প্রস্তুত কোম্পানিগুলো ভারত ও চীনের ভোক্তাদের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে।এখানে জনসংখ্যা বেশী, কাজেই বাজারও বড়। জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (জেএএমএ) নামের একটি স্বাস্থ্য সাময়িকীর খবরে বলা হয়,ভারতে গত ৩০ বছরে পুরুষ ধুমপায়ীর হার ৩৩.৮ শতাংশ থেকে কমে ২৩ শতাংশ হয়েছে। একই সময়ে নারী ধূমপায়ীদের হার তিন শতাংশ থেকে বেড়ে তিন দশমিক দুই শতাংশ হয়েছে।
তামাক কোম্পানি নারীদের আকৃষ্ট করার জন্য সিগারেটের প্যাকেটে আকর্শনীয় ছবি দেয়; FCTC এর ১১ ধারা অনুযায়ী নারীদের জন্য প্যাকেজিং কেমন হচ্ছে তা দেখার বিশেষ উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। অন্যদিকে FCTC ১৪ ধারা অনুযায়ি আগে নারীদের মাধ্যে ধুমপান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি শুধু গর্ভধারণ সময়কালে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু নারীদের মধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণের পরিধি আরও বাড়াতে হবে এবং সকল বয়সের নারীদের, বিশেষ করে কিশোরী ও তরুণীদের সম্পৃক্ত করার প্রস্তাব দেয়া হয়।
উৎপাদনের ক্ষেত্রে কপ৬ সভায় তামাক চাষের নেতিবাচক দিক তুলে ধরা হয়েছে। এবারের সভায় তামাক চাষের ক্ষতি এবং এর থেকে বেরিয়ে আসার পথ অনুসন্ধানমুলক গবেষণা প্রকাশ করা হয়েছে। কপ৬ সভার তৃতীয় দিনে (১৫ অক্টোবর, ২০১৪) প্রকাশিত বুলেটিনে একটি নতুন গবেষণা বইয়ের উন্মোচন উপলক্ষ্যে বলা হয়, এই পর্যন্ত তামাক ব্যবহার বন্ধের জন্য বেশী মনোযোগ দেয়া হয়েছে, কিন্তু সরবরাহের দিক নিয়ন্ত্রণ উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তামাক চাষীদের আন্তর্জাতিক সংগঠন (International Tobacco Growers Association, ITGA) প্রচার মাধ্যমে তাদের বক্তব্য এমনভাবে প্রকাশ করে যেন FCTC বাস্তবায়ন না করা হয়। তারা দাবী করে এর ফলে চাষীদের ক্ষতি হবে, তারা দরিদ্র হয়ে পড়বে। কিন্তু মালাওয়ি, বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের গবেষণায় দেখা গেছে তামাক চাষীদের দারিদ্রের কারণ সিগারেট কোম্পানি এবং তামাক পাতা কেনার কোম্পানি, অন্য কেউ নয়। তামাক চাষের বিক্রি পণ্য হচ্ছে তামাক পাতা, এবং তামাক পাতা বিক্রির ক্ষেত্রে কোম্পানির শোষণমুলক নীতি চাষীদের কখনোই লাভের মুখ দেখতে দেয় না। তাদের মুনাফার লোভ দেখানো হয়, কিন্তু সত্যিকারের লাভ তাদের হয় না। শুধু তাই নয়, তামাক উৎপাদনে শিশু শ্রমের ব্যবহার অত্যন্ত বেশী। মালাওয়িতে প্রায় ৭৮,০০০ শিশু এই কাজে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্ট্মেন্ট অব লেবারের হিশাবে পৃথিবীর প্রায় ১৫টি দেশে তামাক উৎপাদনে শিশু শ্রম ব্যবহার হচ্ছে। এটা দারিদ্রের লক্ষণ। বাংলাদেশে উবিনীগের গবেষণায় দেখা গেছে তামাক চাষে পারিবারিক শ্রম হিশেবে শিশুদের ব্যাবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে তামাক পাতা মাঠ থেকে ঘরে এনে চুল্লিতে তোলার সময় শিশুদের ব্যবহার হয়। শিশুদের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিতে হয়, এই সময় তাদের কোন পরীক্ষা থাকলে সেই পরীক্ষাও দিতে পারে না। FCTC এর ১৭ এবং ১৮ ধারা অনুযায়ী তামাক চাষ থেকে বিকল্প ফসল উৎপাদনে সহায়তা করার কথা রয়েছে, অথচ এই ব্যাপারে এখনো সরকারের কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে উবিনীগের গবেষণায় সফলতার সাথে খাদ্য উৎপাদনে ফিরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা দেখানো হয়েছে। কপ৬ এ উন্মোচিত আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা (IDRC) প্রকাশিত গ্রন্থে বাংলাদেশ, কেনিয়া ও ব্রাজিলের বিকল্প ফসল উৎপাদনের সাফল্য তুলে ধরা হয়েছে। তামাক চাষকে লাভজনক ও অর্থকরি ফসল হিশেবে এতোদিন তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু আসলে তা সঠিক নয়।
বাংলাদেশে তামাক চাষের অনেক ক্ষতির মধ্যে তিনটি বিশেষ ক্ষতি নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। এক. তামাক চাষের কারণে খাদ্য ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়, দুই. তামাক চাষে বিপুল পরিমাণ কীটনাশক ব্যবহার হয়, এবং তামাক পাতা পোড়ানোর জন্যে বিপুল সংখ্যক গাছ কাটা হয়, যা পরিবেশের জন্যে হুমকি সৃষ্টি করছে, এবং তিন. তামাক চাষের কারণে নারী, পুরুষ ও শিশুদের স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। প্রথম দুটি কারণ ইতিমধ্যে স্বীকৃত হলেও স্বাস্থ্য ক্ষতির দিক থেকে তামাক চাষকে দেখা হয় নি, অথচ তামাক ব্যাবহারের চেয়ে স্বাস্থ্যের দিক থেকে তামাক চাষ কোন অংশে কম নয়। উবিনীগের একটি গবেষণায় দেখা গেছে তামাক চাষী পরিবারের প্রায় সকলেই নানা রোগে ভুগছেন। বিশেষ করে শ্বাসকষ্ট, হাত-পা, সারা শরীর ব্যাথা, পেটের নানা ধরণের রোগ, চর্ম রোগ এবং বিশেষ করে নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের মারাত্মক ক্ষতি করছে। ওজন কম বাচ্চা হওয়া, সময়ের আগে প্রসব হওয়া, এমন কি মরা বাচ্চার জন্মদানের ঘটনা তামাক চাষী পরিবারে ঘটছে। এই বিষয়গুলো স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মীদেরও নজরে এসেছে।কাজেই বিষয়টী একদিকে কৃষি ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়কে দেখতে হবে অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও সক্রিয় ভুমিকা রাখতে হবে।
কাজেই তামাক চাষ বন্ধের উদ্যোগ নেয়া খুবই জরুরী হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী তামাক চাষের নিয়ন্ত্রণে বিকল্প ফসল উৎপাদনের নীতিমালা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আশা করি সরকার এই বিষয়ে দ্রুত উদ্যোগ নেবেন।