এনথ্রাক্স
রেজাউল হক || Sunday 19 September 2010 ||শাহজাদপুরে এনথ্রাক্সঃ একটি সরেজমিন প্রতিবেদন।
দৈনিক পত্রিকা পড়ে জানি সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুর ইউনিয়নের অধীনে চিথুলিয়া গ্রামে একটি গরু এনথ্রাক্সে অসুস্থ্ হয়েছে। গরুর মালিক মো: আ: ছালাম, পিতার নাম মৃ: দারেক মোল্লা। খবরে পড়ি, অসুস্থ্ গরু জবাই করে খাওয়ার পর বেশ কয়েক জন অসুস্থ্ হন।
অগাস্ট মাসের ২৭ তারিখে চিথুলিয়া গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। বানতিয়ার গ্রাম থেকে নৌকা, ভ্যান ও রিক্সা যোগে শাহজাদপুর বিসিক বাসষ্ট্যান্ড যাই। বাসষ্ট্যান্ড থেকে সিএনজি যোগে সরিষাকোল, সরিষাকোল থেকে জগন্নাথপুর বাজার ভ্যান, জগন্নাথপুর বাজার থেকে নৌকায় বনগ্রাম, বনগগ্রাম নৌকায় - চিথুলিয়া, চিথুলিয়া থেকে নৌকায় বাড়াবিল, বাড়াবিল রিক্সা বিসিক বাসষ্ট্যান্ড। তারপর রিক্সাম ভ্যান ও নৌকা যোগে জোস্নাপাতি বিদ্যাঘর ফিরে আসি। খবর নেওয়াও দুঃসাধ্য কাজ এটা বোঝাবার জন্য এতো বিস্তারিত বলছি।
জগন্নাথপুর বাজারে পৌঁছাই ১২:৩০ মিনিটে। এরপর বনগগ্রাম যাই বর্তমান ইউপি সদস্য মো: আক্তার হোসেন এর বাড়ীতে। তিনি জানান গরুটা ছিল মো: আ: ছালামের। মো: আক্তার হোসেনের কাছে প্রথম জানতে পারি, গরুটি স্থানীয় জাতের গরু নয়, গরুটি ছিল বিদেশী অস্ট্রেলিয়ার তথাকথিত উন্নত জাতের। আজ অবধি পত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়েছে সেখানে এই জাতের কথাটি সম্পূর্ণ চেপে যাওয়া হয়েছে। গরুকে, শুকনা খড়, গমের ছাল, খেশারীর ভুষি, সরিষার খৈল, তিলের খৈল, নালীগুড়, লবণ, এ্যাংকার ভূষি, ধানের কুড়া ইত্যাদি খাওয়ানো হোত। এনথ্রাক্সকে বাংলায় ‘তর্কা’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে। দেশী গরুতে তর্কা রোগ হয় এবং গরুও মারা যায়, কিন্তু গরু থেকে ভয়াবহ রূপ নিয়ে রোগ মানুষে ছড়িয়েছে এমন নজির আমার জানা নাই। তবে বিশেষজ্ঞ্রা ভাল বলতে পারবেন। বর্তমান ঐ এলাকায় এ্যানথ্রাক্স রোগ প্রতিরোধের জন্য গরুকে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে। শাহজাদপুর উপজেলার রতন কান্দি গ্রামের একজন পশু ডাক্তার ডা: দুলাল চন্দ্র বলেন, ভ্যাকসিনের বোতলে যা লেখা আছে তা হলো: ‘গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মহাখালী এ্যানথ্রাক্স রোগের প্রতিরোধক ভ্যাকসিন’।
মানুষের মধ্যে যাদের এ্যানথ্রাক্স রোগে অসুস্থ্য গরুর মাংস কাটাকাটি করার ফলে যারা অসুস্থ্য হন তাদের চিকিৎসার জন্য দেওয়া হচ্ছে সাইপ্রোফ্লক্সাসিন (ciprofloxacin 500mg)। শিশুর জন্য দেওয়া হচ্ছে স্কয়ার কম্পানির সাইপ্রোসিন (ciprocin) – তরল।
চিথুলিয়া গ্রামে মো: আ: ছালামের বাড়িতে গিয়ে তাকে গরুর কথা তারপর জিজ্ঞাসা তিনি বলেন, আমার গরুটি মোটা করার জন্য যোগাল দিতে থাকি। গরুটি এঁড়ে গরু ছিল। প্রথমে গরুটির জ্বর হয়। মিল্ক ভিটার পশু ডাক্তার মো: বাবুলকে জানানো হয় কিন্তু তিনি আসেন নাই। জ্বরের জন্য গায়ের পশম ২দিন খাড়া ছিল। শবেবরাতের দিন বেলা ৩টার দিকে গরুকে piravat (পাইরাভেট) টেবলেট ২টা এক সাথে খাওয়ানো হয়। খাওয়ানোর সাথে সাথে শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠে। তারপর দাড়াক দিয়ে শুয়ে পড়ে। ছালাম তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত গরুর মাথায় পানি দেয়। জ্বর ছিল ১০৬ (ডিগ্রি)। গরুটি তখন থেকে এদিক সেদিক মাথা ঠুকতে থাকে। গ্রামের এক ডাক্তার পরামশ দেন গরুটি জবাই করে কম দামে গ্রামে বিক্রি করে দিলে কিছু টাকা আসবে। তার কথা মতো গরুটি জবাই করা হয়। ৩ মন ২০ কেজি মাংস ১৪০.০০ (একশত চল্লিশ) টাকা দরে বিক্রি করা হয়। গোশতো বানানোর সময় হাড় কাটতে যেয়ে হাড়ের টুকরা যার যেখানে লেগেছে সেখানে ফোসকা পড়ে ঠোল পড়ে যায়। ঠোসা গলে ঘাঁ হয়। মো: আ: ছালামের ডান হাতের এক আঙ্গুলে এবং ছালামের ছোট ছেলের পায়ে ঘা বা ক্ষতের চিহ্ন দেখতে পাই। চিকিৎসা হিসাব আ: ছালাম সাইপ্রোফ্লক্সাসিন ৫০০ মিলিগ্রাম ও আ: ছালামের ছেলেকে স্কয়ার কম্পানির তরল সাপ্রোসিন খাওয়ানো হচ্ছে। এই রোগের লক্ষণ প্রথমে গরু ২/৩ ঘন্টা দম ধরে থাকে। তারপর শুয়ে পড়ে; ২/৩ বার হামবা, হামবা করে ডাক দেয়, মুখে ও মলদ্বার দিয়ে রক্ত বের হয়। কিছু ক্ষণের মধ্যে মারা যায়। এ্যানথ্রাক্স রোগের জীবানু বেঁচে থাকে ৫০ বছর পর্যন্ত।
মো: আ: ছালামের ঘটনার কয়েক দিন পর এওকই গ্রামের মো: সাহেব আলীর ১টি গরু মারা যায়। মারা যাওয়া গরুটি মাটিতে পুতে ফেলা হয়। তারপর ঢাকা থেকে লোকজন এসে পুতে রাখা গরু আবার তোলে। শুনেছি তাঁরা আহিসিডীডীয়ারবি বা ঢাকার কলেরা গবেষোণার থেকে এসেছেন। পরীক্ষার জন্য চামড়া, রক্ত, মাংস হাড়সহ কিছু নমুনা তারা নিয়ে যান। প্রচার করা হচ্ছে, সিরাজগঞ্জ জেলায় ১ লাখ গরুকে এ্যানথ্রাক্স বা তরকা রোগের ভ্যাকসিন দেওয়া হবে।
শাহজাদপুরে একই চিথুলিয়া গ্রামে ইব্রাহিম মোল্লার ছেলে শাহ আলীরও একটি গরু মারা যায়। গরু অসুস্থ্ হওয়ার পর গরুটি জনাই করা হয়, মাংস হয় ৪ মন ২০ কেজি। মাংস গ্রামে বিক্রি করা হয়। সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুর ইউনিয়নের যে গরুগুলো এনথ্রাক্স রোগে আক্রান্ত হয়েছে তার সবগুলোই বিদেশী, অস্ট্রেলিয়ার জাত। বর্তমান দেশী গরুর মধ্যে কোন এ্যানথ্রাক্স রোগ দেখা দেয়নি।
গ্রামের একজন উন্নয়ন কর্মী হিসাবে আমার মনে দুটো প্রশ্ন জেগেছে।
একঃ শাহজাদপুরকে বাংলাদেশের দুধের ভাণ্ডার বলা যায়। এখানে প্রায় প্রতি কৃষক বাড়িতেই ৪-৫ এমনকি অনেকের ১০-১২টা করে গরু আছে। এই এলাকার বিখ্যাত একটি জাত হচ্ছে পাবনা ব্রিড। প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের অন্য কোন এলাকায় না হয়ে পশুসম্পদ সমৃদ্ধ শাহজাদপুরে এনথ্রাক্স রোগের আবির্ভাব ঘটল কেন?
দুইঃ রোগটি ধরা পড়েছে অস্ট্রেলিয়ার গরুর জাতে। এ থেকে শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে দেশীয় গরুর জাতে এই রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী। কিন্তু গণমাধ্যম ও বিশেষজ্ঞরা এই দিকটির প্রতি দৃকপাত করছেন না কেন? এর ফলে দেশীয় পদ্ধতিতে গরু পালন যে পরিবেশ বান্ধব ও স্বাস্থ্য সম্মত সেই বিজ্ঞান দৃষ্টিকে আড়াল করে ফেলা হয়।
২৭ আগস্ট, ২০১০। জ্যোৎস্নাপাতি বিদ্যাঘর। শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ
রেজাউল হক নয়াকৃষি আন্দোলনের একজন কর্মী।