‘নিরাপদ খাদ্য সমাবেশ, ২০১৬’ অনুষ্ঠিত হলো টাঙ্গাইলের নান্দুরিয়া গ্রামে
টাঙ্গাইলের নান্দুরিয়া নয়াকৃষি কৃষকদের একটি গ্রাম। ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ নান্দুরিয়া গ্রামে।‘নিরাপদ খাদ্য সমাবেশ, ২০১৬’ অনুষ্ঠিত হলো। পুরা দেলদুয়ার উপজেলাকে নিরাপদ খাদ্য উপজেলা হিসাবে গড়ে তোলের উদ্যাগের অংশ হিশাবে এই সম্মেলন হোল। অন্যান্য গ্রামেও নিরাপদ খাদ্য সমাবেশ নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের উদ্যাগে নিরাপদ খাদ্য সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
কোন প্রপকার কীটনাশক ও রাসায়নিক সার, ছাড়া, দেশীয় বীজে উৎপাদিত বিভিন্ন ফসল কেনারও ব্যবস্থা ছিল সমাবেশে। , যেমন- ধান, ডাল, শাক, সবজি, কুড়িয়ে পাওয়া শাক এবং স্থানীয় বীজ । নয়াকৃষির কৃষকেরা তাদের নিরাপদ খাদ্য সম্ভার নিয়ে দলে দলে এই সমাবেশে অংশগ্রহণ করে।
সকাল থেকেই নান্দুরিয়া গ্রামের আশপাশের ১০টি গ্রাম থেকে (মৌসাকাঁঠালিয়া, কান্দাপাড়া, জাংগালিয়া, নাল্লাপাড়া, গজিয়াবাড়ি, গড়াসিন, হিঙ্গানগর, বাবুপুর, মামুদপুর ও গোয়ারিয়া) কৃষক সহ লোকজন নান্দুরিয়া দাই ঘরে আসতে থাকে। জনগণের মধ্যে আনন্দের আমেজ ছড়িয়ে পরে। গ্রামের গণ্যমান্য জনপ্রতিনিধি, মাতব্বর, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষক, গৃহিণী, সকল নারী-পুরুষ এই সমাবেশে যোগ দেয়। নান্দুরিয়া দাইঘরের সামনে অনুষ্ঠিত হয় এই সমাবেশ। সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলে এই সমাবেশ।
গতবছর ডিসেম্বর, ২০১৫ সালে টাঙ্গাইল দেলদুয়ার উপজেলাকে ‘নিরাপদ খাদ্য উপজেলা’ হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়। দেলদুয়ার উপজেলা পরিষদ, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য নেটওয়ার্ক, উবিনীগ, নয়াকৃষি আন্দোলন এবং বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা যৌথভাবে এই ঘোষণা দেয়। খাদ্য উৎপাদনকারী ও ভোক্তার মধ্যে সচেতনতা বাড়াবার জন্যই নান্দুরিয়া গ্রামে এই সমাবেশ।
সমাবেশে নয়াকৃষির কৃষকেরা দলে দলে তাদের উৎপাদিত ফসল নিয়ে খুব সকালে উপস্থিত হয়। তারপরে শুরু হয় স্টল সাজানো। সমাবেশে প্রদর্শনীর জন্য স্টল ছিল। ধানের স্টলে ছিল ৫৪ জাতের দেশী ধান। দুটো চাষ মৌসুমে ধান ছিল। আমন এবং আউশ। আউশ ধানের মধ্যে ছিল ১. খাড়া জামড়ি, ২. কালা মানিক ও ৩. সাইটা। আউশ ধান হারিয়ে যাচ্ছে তাই নয়াকৃষি আন্দোলন এই জাতগুলোর প্রতি বিশেষ ভাবে মনোযোগী।
আমন ধান ছিল-১. নাক কাটি, ২. মতি চিকন, ৩. কালি চিকন, ৪. ঝুনা, ৫. কাত্তাই, ৬. ফুল দিঘা, ৭. বাইরাজ, ৮. পালাকা, ৯. বক তুলসি, ১০. চিনি ধান প্রভৃতি। এ সবই ছিল ভাতের ধান।
পোলাউ বা বিরিয়ানী খাওয়ার ধান ছিল ভিন্ন যেমন- ১. তুলসী মালা, ২. চিনিগুড়ি, ৩. কালিজিরা এবং ৪. বেগুন বিচি।
সবজির স্টলে ছিল মৌসুম ভিত্তিক সবজি। যেমন- কাঁচা কলা, আউশি ডাঁটা, টমেটো। সীম ছিল ৩ জাতের, পঁটি সীম, বাইমা সীম এবং পাইকা সীম। বেগুন ছিল ৩ জাতের, শৈইলা বেগুন, তবলা বেগুন ও নালী বেগুন। আরও ছিল মূলা, বাঁধা কপি এবং গাজর।
কুড়িয়ে পাওয়া শাকের স্টলে এই মৌসুমে যা পাওয়া যায়, যেমন-কচুর শাক, নুনিয়ার শাক, ইলিচা, খুইড়াকাচা, ন্যাটাপ্যাটা, ভুলখুইড়া, ডন্ড কলস, থানকুনি, সজনে শাক ও আমরুল শাক। এই শাকগুলি নয়াকৃষি কৃষক এবং গ্রামের মহিলারাই তাদের বাড়ির আসে-পাশে থেকে সংগ্রহ করেছেন।
ফলের স্টল: এই মৌসুমে যা পাওয়া যায়- দুই জাতের কলা, সবরি কলা এবং মদনা কলা। নোনা ফল, বেল, জাম্বুরা, চালতা, বড়ই, কামরাঙ্গা।
বীজ স্টল: বিভিন্ন ধরনের দেশীয় সবজি বীজ ছিল এই স্টলে। যেমন- মিষ্টি কুমড়া, লাউ, ডাঁটা, টমেটো, পুঁই শাক, মূলা, পেঁপে, পালং শাক। সীম তিন জাতের- পুঁটি, বাইমা ও পাইকা। বেগুন তিন জাতের-তবলা, নলী ও শৈলা। ডালের মধ্যে ছিল - মাষকালাই, খেসারী ও মুগ ডাল। আরও ছিল সরিষা। অনেকেই তাদের পছন্দ মত সবজি বীজ কিনেছে নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় লাগাবে বলে।
প্রদর্শনীর মাঝেই চলছিল আলোচনা সভা। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন নান্দুরিয়া গ্রামের মাতব্বর জনাব সোহরাব খান। বক্তব্য রাখেন নয়াকৃষির কৃষক রূপসী বেগম, আক্কাচ আলী, জিন্নাত আলী এবং কৃষক মাঈনুদ্দীন। বক্তব্য রাখেন নান্দুরিয়া গ্রামের চাকুরীজীবি সানোয়ার হোসেন এবং নান্দুরিয়া দাইঘরের দাইমা খাদিজা বেগম।
সরাসরি ফসল উৎপাদনের সাথে জড়িত আমরা কৃষকেরা। আমরা শাক-সবজি, ধান, দানা শস্য উৎপাদন করি। আমরা এগুলো উৎপাদন করি কোন রকম রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ছাড়া। দেশীয় বীজে। আমরা স্থানীয় জাতের ফসল আবাদ করি। এতে রাসায়নিক সার লাগে না, কীটনাশকও লাগে না। উৎপাদন খরচ কম। ফসল খেতে স্বাদ আছে। অসুখ কম। ডাক্তারের কাছে ঘন ঘন যেতে হয় না, বলেন কৃষক বক্তারা। দাইমা খাদিজা বেগম বলেন, নিরাপদ খাদ্যে পুষ্টি বেশী। আর এই পুষ্টিকর খাদ্য খেলে গর্ভবতী নারীদের গর্ভকা্লীন ঝুঁকি কম দেখা দেয়।
বক্তব্য শেষে নিরাপদ খাদ্য সমাবেশ থেকে একটি র্যালী নান্দুরিয়া গ্রাম প্রদক্ষিণ করে পাশের গ্রাম গড়াসিনে শেষ হয়। এই র্যালীতে প্রায় ২০০ জন গ্রামের মানুষ অংশগ্রহণ করে।