কৃষক প্রশিক্ষণ: নয়াকৃষি ফসলের বাজার বাড়ানো
নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের নিয়ে ২৮-২৯ ডিসেম্বর, ২০১৪ দুই দিন ব্যাপী “শস্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ” এর উপর এক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হলো টাঙ্গাইল জেলার বিষ্ণুপুর গ্রামে রিদয়পুর বিদ্যাঘরে। এই প্রশিক্ষণ আয়োজন করে উবিনীগ। ‘প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় সামাজিক ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য সংগঠনের সঙ্গে উবিনীগের যে উদ্যাগ তারই অধীনে এই আয়োজন। সার ও বিষমুক্ত নয়াকৃষির ফসল কিভাবে ভোক্তাদের কাছে পোঁছানো যায় তাই নিয়ে এই প্রশিক্ষণ। সঠিক পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে নয়াকৃষির কৃষকরা যেন আর্থিক ভাবে লাভবান হতে পারে প্রশিক্ষণের মূল বিষয় ছিল সেটাই।
কৃষক প্রশিক্ষণের একটি বড় অংশ ছিল “শস্য প্রবর্তনা”য় নয়াকৃষি কৃষকদের বাড়তি ফসল পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা। নয়াকৃষি কৃষকদের বাড়তি ফসল সচেতন ভোক্তাদের কাছে সুলভে পৌঁছে দেয় শস্য প্রবর্তনা। তাই নয়াকৃষির কৃষকেরা পরিকল্পনা করেন কিভাবে সবাই মিলে মৌসুম অনুযায়ী নয়াকৃষির উৎপাদিত ফসল শস্য প্রবর্তনায় নিয়মিত সরবরাহ করতে সক্ষম হবেন। আবাদি ফসলের পাশাপাশি অনাবাদি বা কুড়িয়ে পাওয়া শাকও শস্য প্রবর্তনায় সরবরাহ করা হবে। ঢাকার যারা নিয়মিত শস্য প্রবর্তনা থেকে সব্জি কিনছেন তাঁদের জন্য এটা খুবই সুখবর। অনাবাদি শাকের মধ্যে রয়েছে-হেলঞ্চা শাক, বথুয়া শাক, কলমি শাক, ঢেকি শাক, ডন্ড কলস শাক, থানকুনি ও অন্যান্য।
মোট ২৮ জন কৃষক এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে টাংগাইল জেলার ৪টি ইউনিয়ন (লাউহাটি, দেউলী, আটিয়া ও কাঞ্চনপুর) থেকে ৮টি গ্রামের ২৬ জন কৃষক এবং নাটোর জেলার চান্দাই ইউনিয়ন এর একটি গ্রাম থেকে দুই জন কৃষক এই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করেন। এদের মধ্যে নারী কৃষক ছিলেন ৬ জন।
দশটি নীতির আলোকে নয়াকৃষি আন্দেলনের কৃষকরা চাষাবাদ করেন। কৃষকদের প্রথম নীতি বিষ ব্যবহার বন্ধ করা। নয়াকৃষি কোন প্রকার বিষ ব্যবহার বিশ্বাস করে না। স্থানীয় বা দেশী বীজ ঘরে রাখা এবং মিশ্র ফসলের আবাদ করা নয়াকৃষির নীতি। তাই মিশ্র ফসল আবাদে “পোকামাকড়ের আক্রমন” হয় না এই আলোকেই প্রশিক্ষণ শুরু হয়।
প্রথমে কৃষকদের মাঝে একে অপরের সাথে পরিচিতি পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। একই সাথে জমির পরিমাণ অনুসারে নয়াকৃষি পদ্ধতিতে কি কি ফসল অংশগ্রহণকারী কৃষকেরা উৎপাদন করেন তার তালিকা তৈরী করা হয়। ফসলের তালিকা তৈরী করার আগে কৃষকদের তিনটি দলে ভাগ করা হয়।
১. নারী কৃষকদের দল।
২. ১-৩ বিঘা (৩৩ শতক এক বিঘা) আবাদি জমি, পুরুষ কৃষক দল।
৩. ৪-৬ বিঘা আবাদি জমি, পুরুষ কৃষক দল।
প্রথমে অংশগ্রহণকারি কৃষকেরা দলীয়ভাবে মৌসুম অনুসারে জমিতে যে ফসল আবাদ করে তার তালিকা তৈরী করেন। তালিকার মধ্যে ছিল ধান, সবজি, ডাল, তেল ও মসলা জাতীয় ফসল। তিনটি দলে দেশীয় ধানের নাম আসে মোট ২০টি। এর মধ্যে আমন ধান ছিল ১২ জাতের-১. লাল চামারা, ২. হিজল দিঘা, ৩. চামারা দিঘা, ৪. সাদা দিঘা, ৫. লাল ঢেপা, ৬. সাদা ঢেপা, ৭. পাটজাগ, ৮. ময়নাগিড়ি, ৯. ঝুল, ১০. লক্ষ্মিদিঘা, ১১. কার্তিকঝুল ও ১২. কালিজিরা।
আউশ ধানের মধ্যে ছিল-
১. ভাতুরী, ২. শাইটা, ৩. ভইরা, ৪. শঙ্খবটি, ৫. কালাবকরি, ৬. শনি, ও ৭. মইলকা।
সবজি ফসল আবাদের মধ্যে নারী দল ২২টি সবজির নাম দেয়। এই সবজিগুলো বাড়ির আলানে পালানে তারা লাগায়। যেমন, সীম, লাউ, বেগুন, পুঁই শাক, মিষ্টি কুমড়া, ঝিংগা, চাল কুমড়া, ধন্দুল, গাছ আলু, সাজনা। এ সব সবজি নিজেরা খায় এবং বিক্রি করে। দেখা গেছে, যে কৃষকদের আবাদি জমি ৪-৬ বিঘা তারাও সবজি ফসলের তালিকায় নাম দেয় ২২টি। পার্থক্য হলো-নারীরা এমন সবজি আবাদ করে যা চকে বা জমিতে লাগাতে হয় না। বাড়ির আলানে পালানে তারা লাগায়। কিন্তু পুরুষেরা সবজি আবাদ করে জমিতে। তাই পুরুষ কৃষকদের সবজি ফসলে রয়েছে আলু, ফুল কপি, বাধা কপি. সবরি কলা, পেঁপে ও লেবু জাতীয় ফসল।
ডাল ও দানাদার ফসলের মধ্যে কৃষকেরা আবাদ করে ১৭ ধরণের ফসল। এর মধ্যে ডাল, মাষকলাই, খেসারি ও মটর। তেল জাতীয় ৩ প্রকার- সরিষা, তিল ও কুসুম ফুল। মসলার মধ্যে ছিল- ধনিয়া, আদা, হলুদ, পেয়াজ, রশুন, রাঁধুনী, কালোজিরা ও মরিচ। এছাড়া ছিল গম, পায়রা ও কাউন। অর্থকরী ফসল হিসাবে ছিল পাট ও শন পাট।
এই সব ফসল অংশগ্রহণকারী কৃষকেরা সারা বছর খায় এবং নিজেদের পারিবারিক প্রয়োজনে বিক্রি করে থাকে। বছরের চাহিদা পুরণের পরে বীজ আকারেও কিছু ফসল তারা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। নয়াকৃষির কৃষকেরা সবসময় নিজের হাতে বীজ রাখেন।
নয়াকৃষি কৃষকদের “শস্য উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ” প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেন ফরিদা আখতার, নির্বাহী পরিচালক, উবিনীগ এবং রিদয়পুর বিদ্যাঘর, টাংগাইল-এর সমন্বক রবিউল ইসলাম । সহায়তা করেন শস্য প্রবর্তনার মো; মাইনুদ্দীন মোল্লা।