নয়াকৃষি ও উবিনীগের প্রেস ব্রিফিংয়ে দাবী প্রাণ ও প্রকৃতি হত্যাকারীর অপরাধের বিচার জরুরী
“আমাদের পরিবেশ বিষাক্ত, আমাদের খাদ্য বিষাক্ত হয়ে গেছে। আমরা এই সব কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে একত্রে প্রতিবাদ করবো। প্রতিরোধ গড়ে তুলবো”, বলেন ‘মনসান্তো ট্রাইবুনাল: প্রাণ ও প্রকৃতি হত্যাকারীর অপরাধের বিচার জরুরী’ প্রেস ব্রিফিং এ উপস্থিত সদস্যবৃন্দ। নয়াকৃষি আন্দোলন ও উবিনীগ আয়োজিত এই প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয় ৪ মে,২০১৭ (বৃহস্পতিবার) সকাল ১০: ৩০ টায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের, তৃতীয় তলায়। এই প্রেস ব্রিফিং এ উপস্থিত ছিলেন, কৃষি বিজ্ঞানী, আইনজীবি, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিক্ষক ও বেসরকারী প্রতিনিধিবৃন্দ।সভাপতিত্ব করেন ডা. জাফরুল্লাহ্ চৌধুরী, ট্রাষ্টি, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র। মনসান্তো ট্রাইবুনাল সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা দেন ফরিদা আখতার, নির্বাহী পরিচালক, উবিনীগ। বহুজাতিক কম্পানির আগ্রাসন, বিশেষ করয়ে বাংলাদেশে মনসান্তোর কর্মাকান্ড নিয়ে বক্তব্য রাখেন দোলোয়ার জাহান, প্রাকৃতিক কৃষি, কৃষি বিজ্ঞানী ড. এম. এ. সোবহান, মানবাধিকার কর্মী ও আইনজীবি আদিলুর রহমান খান, প্রফেসর ডা. মোজাহেরুল হক, চেয়ারম্যন, পাবলিক হেলথ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. নূরজাহান সরকার, কৃষিবিদ ড. রেজাউল করিম, ইবনুল সাইদ রানা, সদস্য, স্বাস্থ্য আন্দোলন, এবং সায়েরা বেগম, নির্বাহী পরিচালক, সবুজের যাত্রা।
বহুজাতিক কম্পানি মনসান্তোর বিরুদ্ধে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ শুনানীর জন্যে মনসান্তো ট্রাইব্যুনাল অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৫ -১৬ অক্টোবর, ২০১৬ নেদারল্যান্ডের রাজধানী দ্যা হেগ (The Hague)-এ। পাঁচজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিচারকমন্ডলীর সামনে বিশ্বের ৫টি মহাদেশের ৩০ জন সাক্ষীসহ বিশেষজ্ঞরা তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরেন। নয়াকৃষি আন্দোলন ও উবিনীগের (উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা) পক্ষ থেকে সেই ট্রাইবুনালে বাংলাদেশে মনসান্তোর অপরাধের সাক্ষ্য দেয়া হয়েছিল। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মনসান্তোর প্রাণ বিধ্বংসী কুকর্মের অভিযোগ ট্রাইবুনালের বিচারকরা শুনেছেন। ট্রাইবুনালে মনসান্তো কম্পানিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং তাদের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগের আশ্বাসও ছিল, কিন্তু মনসান্তো আসেনি।
মনসান্তো ট্রাইবুনাল গণমানুষের ট্রাইবুনাল বা গণমানুষের আদালত।বহুজাতিক কম্পানির মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের হাত থেকে গণমানুষের প্রতিরক্ষার জন্য বিশ্বব্যাপী নৈতিক সচেতনতা ও জনসমর্থন তৈয়ার করাই ছিল এই অভূতপূর্ব ট্রাইবুনালের উদ্দেশ্য।
এই ট্রাইবুনালের মাধ্যমে সারা বিশ্বে মনসান্তোর উদ্ভাবিত বিকৃত বীজ বা জিএম ফসল এবং মনসান্তো কারিগরিতে তৈরি বীজের সঙ্গে ব্যবহার হওয়া মনসান্তোরই উৎপাদিত আগাছানাশক গ্লাইফোসেট বা রাউন্ড-আপ রেডী (RoundUp Ready) দ্বারা কিভাবে জনস্বাস্থ্য,পশু স্বাস্থ্য, মাটির স্বাস্থ্য,প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশের ক্ষতি ঘটানো হচ্ছে তার বিস্তর উদাহরণ,বর্ণনা ও সাক্ষ্য দেয়া হয়।বিশেষ করে জিএম সয়াবিন,জিএম কানোলা, জিএম ভুট্টা,বিটি কটন উৎপাদন করতে গিয়ে আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, ব্রাজিল, ভারত, বুরখিনাফাসোসহ বিভিন্ন দেশে কৃষক প্রাণ, প্রকৃতি,পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগতভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তার মর্মান্তিক বর্ণনা তুলে ধরা হয়। ট্রাইব্যুনালের সম্মানিত বিচারকরা দীর্ঘ ছয় মাস সাক্ষী ও বিশেষজ্ঞ মতামত পর্যালোচনা করে ১৮ এপ্রিল, ২০১৭ নেদারল্যান্ডের রাজধানী দ্যা হেগ-এ তাদের আইনী মতামত (legal Opinion) তুলে ধরেছেন।
বাংলাদেশে মনসান্তো বিকৃত বেগুন বা বিটি বেগুনের প্রবর্তনের মাধ্যমে তার আগ্রাসি কর্মকান্ড পরিচালনা করছে, তাই মনসান্তো ট্রাইবুনালের এই আইনী মতামত বাংলাদেশের প্রাণ, পরিবেশ ও প্রকৃতির সুরক্ষা এবং বিষাক্ত খাদ্য থেকে মুক্তির দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
মনসান্তো ট্রাইবুনালের মত দিয়েছে যে বহুজাতিক কোম্পানির এই ক্ষতিকর কাজসমূহকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা দরকার এবং তাদের আইনী জবাবদহিতা ও অপরাধের শাস্তির আওতায় আনা জরুরী।এতে শুধু ভোক্তাদের নয় একই সঙ্গে পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ-যারা বিষ-মুক্ত, পুষ্টিকর এবং বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদন করে -এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের সেই ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন সংস্কারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব তোলা এবং পেশ করা হোল।
মনসান্তো ট্রাইবুনালের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে বহুজাতিক কোম্পানির উৎপাদিত বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য যেমন- Round Up (Glyphosate) & Basta (Glufosinate), neonicotinoids, atrazine এবং অন্যান্য কীটনাশকের কারনে জীবন ও পরিবেশের অপুরণীয় ক্ষতি হচ্ছে;মাটি ও পানি নষ্ট হয়েছে,মৌমাছি হারিয়ে যাচ্ছে,অন্যদিকে ক্যান্সার,শ্বাস কষ্ট এবং বিশেষ করে বিকলাংগ শিশুর জন্ম হওয়ার ঘটনা বেড়ে গেছে,ইত্যাদি।
মনসান্তোর ট্রাইবুনালের এই আইনী মতামতের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক আইনী ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে মানবাধিকার এবং পরিবেশ রক্ষার অধিকারকে প্রাধান্য দেয়ার বিষয়টি নৈতিক দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে এবং তাকে আন্তর্জাতিক আইনের অন্তর্ভুক্ত করবার তাগাদা তৈরি করেছে। আন্তর্জাতিক আইনকে পরিবেশ সুরক্ষা (protection of the environment) এবং প্রকৃতি হত্যা (ecocide) বিষয়ে অবশ্যই সক্রিয় উদ্যোগ নিতে হবে।আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তা স্বীকৃতি পেলে এই কথা বলা যায় যে মনসান্তোর কার্যকলাপ ইকোসাইডের মতো অপরাধের আওতায় পড়ে। ফলে বাংলাদেশের কৃষক ও জনগণের দিক থেকে মানুষ, প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার জন্যে আইনী প্রতিকার পাওয়ার এক নতুন আন্তর্জাতিক দিক উন্মোচিত হোল।
এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে বক্তারা আমাদের দেশে ফসলের ক্ষেতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে আমাদের খাদ্য ব্যবস্থা বিষাক্ত হয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং প্রাকৃতিক কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিবেশ ও প্রাণ বৈচিত্র্য রক্ষার তাগিদ দেন। মনসান্তো কোম্পানির গ্লাইফোস্যাট (রাউন্ড আপ রেডি) চা বাগানে দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত ব্যবহার হচ্ছে। ওথচ এ বিষয়টি কেউ জানে না। বিটি বেগুন এবং অন্যান্য বিকৃত (জিএম) ফসল যেমন- আর বি গোল আলু, গোল্ডেন রাইস প্রবর্তনের প্রেক্ষিতেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
সভায় বিটি বেগুন নিয়ে মাঠ পর্যায়ে কৃসকের ক্ষেতে উৎপাদনের যে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে তার ফলাফল জনসমক্ষে প্রকাশের দাবী জানান হয়। মাঠ পর্যায়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে, বেগুনের কাংখিত ফলনও পাওয়া যায়নি। কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। তবে কোম্পানী সে সব তথ্য গোপন করার চেষ্টা করছে।পরিবেশ মন্ত্রণালয় বেগুন বাজারজাত করতে হলে লেবেল লাগানোর যে শর্ত দিয়েছিলেন তাদের অবশ্যই তা নিশ্চিত করতে হবে।