গ্রামীণ নারীদের মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দাইমাদের ভূমিকা শীর্ষক আলোচনা সভা


গ্রামীণ নারীদের মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য এখনও সবার আগে যার ভূমিকা সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ তিনি হলেন গ্রামের দাই মা। ধাত্রী বা দাইকেই বলা হয় দাইমা। গ্রামে এমন কোন মহিলাকে খুঁজে পেতে কষ্ট হবে যিনি মা হয়েছেন অথচ দাইমা'র সহযোগিতা পান নি। প্রসূতি মায়ের নিদানকালে ত্রানকর্ত্রী হিসাবে কাজ করেন দাইমা। মায়ের অকৃত্রিম স্নেহ তারা নিঃস্বার্থভাবে উজাড় করে দেন। এমনকি সন্তান ধারণ থেকে সন্তান প্রসব হওয়া পর্যন্ত প্রসূতি মায়ের খোঁজ রাখেন তারা। প্রয়োজনে নানা পরামর্শ দেন।

দাইমা'রা তাদের কাজের বিনিময়ে কোন পারিশ্রমিক দাবি করেন না। বরং সেবার আর্দশ নিয়ে তারা মানুষের উপকার করে থাকেন। কর্তব্যের তাগিদেই এ কাজ করেন। অধিকাংশ সময় প্রসূতি মায়ের পরিবার থেকে খুশি হয়ে যেটুকু উপহার দেওয়া হয় তাই খুশি মনে গ্রহণ করেন। গ্রামীণ নারীদের মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সমাজে দাইমারা অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে 'উবিনীগ ও নারীগ্রন্থ প্রবর্তনার আয়োজনে আজ ২৯ জানুয়ারি ২০২৫ সকাল সাড়ে দশটায় ঢাকা রির্পোটার্স ইউনিটিতে "গ্রামীণ নারীদের মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও দাইমাদের ভূমিকা" শীর্ষক একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নূরজাহান বেগম, মাননীয় স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সভার সভাপ্রধান ছিলেন সম্মানিত স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. সামিনা চৌধুরী। ছিলেন নারী স্বাস্থ্য নিয়ে কর্মরত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং বিভিন্ন নারী সংগঠন।

সভায় বাংলাদেশের চারটি জেলা থেকে দাইমায়েরা অংশগ্রহণ করেন- টাংগাইল, পাবনা, কুষ্টিয়া ও নাটোর থেকে দাইমা মমতা বেগম, সুফিয়া বেগম ও সালেহা বেগম। ঈশ্বরদী, পাবনা থেকে দাইমা চায়না বেগম ও মমতাজ বেগম। দেলদুয়ার, টাঙ্গাইল থেকে দাইমা খাদিজা বেগম, রেহেনা বেগম ও হাজেরা বেগম। নাটোর থেকে দাইমা সুরাইয়া খাতুন। গ্রামীণ নারীদের মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য গ্রামে তারা যে কাজ করেন, তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।

দাইমায়েরা কি ভাবে গর্ভবতী নারী ও প্রসুতি মায়েদের সেবা দেন, গর্ভবতী নারীদের কি ধরণের জটিলতা দেখেন, সরকারী হাসপাতালে যাওয়া এবং গর্ভবতী মায়েদের পুষ্টির জন্য কি পরামর্শ দেন এ বিষয়গুলো দাইমায়েরা সরাসরি স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, নূরজাহান বেগম এর কাছে তুলে ধরেন।


প্রধান অতিথির বক্তব্য: নূরজাহান বেগম, উপদেষ্টা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম দাইমাদের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, এখনও গ্রামে নারীদের স্বাস্থ্য ও প্রসবকালিন সময়ে নারীদের পাশে দাইমায়েরাই বিশেষ ভূমিকা রাখছে। দেশের গ্রামে প্রায় ৭০ ভাগ সন্তানের জন্ম বাড়িতে দাইমার হাতে। সরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং হাসপাতালে সন্তানের জন্মের হার কম। সরকারি হাসপাতালে বেলা ১টার পর ডাক্তার না থাকার কারণেও গ্রামের নারীরা ডেলিভারি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শুধু সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রেই নয়, ইউনিয়ন এবং উপজেলা হাসপাতালগুলোতেও নারী স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয় সকল সেবা থাকে না। জেলা হাসপাতালে দেখা যায় অপারেশনের জন্য এনেসথেশিয়ার ডাক্তার সময় মতো পাওয়া যায় না।

মাতৃস্বাস্থ্যের দিক বিবেচনা করলে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুব ভাল না। দেশে মাতৃস্বাস্থ্যের সুষ্ঠু সেবার জন্য যে কাজগুলির দরকার বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থা তার ধারে-কাছেও নাই। হাসপাতালে যে পরিমাণ ডাক্তার থাকার কথা সেই পরিমাণ ডাক্তারের অভার রয়েছে। বিভিন্ন কারণে তারা দেশের বাইরে অবস্থান করেন। আমি বিভিন্ন হাসপাতালগুলো পরিদর্শন করে দেখেছি-মাতৃস্বাস্থ্য সুরক্ষায় জন্য যে মান রক্ষা করা দরকার আমাদের হাসপাতালগুলোতে সেই মান নাই। যেখানে ৫০ জন মায়ের বেড রয়েছে, সেখানে ১০০ মাকে রাখা হয়েছে। এক বেডে ৩ জন শিশুকে রাখা হয়েছে।

এই অর্ন্তবর্তীকালিন সরকারের কাছে এমন কোনো মেকানিজম নাই, জাদুরবলে তা পরিবর্তন করে দিতে পারে। সমস্যা সমাধানের হাতিয়ার আমার হাতে নাই। কারণ আমি চাইলেই ডাক্তার নিয়োগ দিতে পারবো না। বিশেষ করে দাইমাদের হাতে গ্রামের নারীরা যারা সন্তান প্রসব করছে।

একসময় দাইমায়েরা বাঁশের চাঁচ, পুরনো ব্লেড দিয়ে নবজাতকের নাড়ি কাটতেন। এই সমস্যা নিরসনের জন্য তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম দাইমাদের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, এখনও গ্রামে দাইমায়েরা বিশেষ ভূমিকা রাখছে। তিনি কয়েকটি সুপারিশের উপর গুরুত্ব দেন। যাতে পরবর্তী সরকার এই সমস্যাগুলো সমাধানের চেষ্টা করবেন।

সুপারিশ:

১. দাইমাদের প্রশিক্ষণের জন্য কি কি প্রয়োজন সরকারিভাবে তা দেখা।
২. মাতৃস্বাস্থ্য’র কাজে দাইমাদের কাজে লাগানো যেতে পারে।
৩. দাইমাদের কথা নিবিরভাবে শোনার জন্য কর্মশালার আয়োজন করা।
৪. রোগ প্রতিরোধের দিকে বেশী মনোযোগী হতে হবে এবং
৫. তামাককে না বলতে হবে।

সভাপ্রধানের বক্তব্য: প্রফেসর ডা. সামিনা চৌধুরী, স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ

প্রফেসর ডা. সামিনা চৌধুরী বক্তব্যে বলেন, দাইমায়েরা গ্রামে নারীদের পাশে থাকে তাই প্রয়োজনে তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দাইমাদের কাজের প্রচার করতে হবে। তিনি প্রসবকালীন ৫টি ঝুঁকি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

এছাড়াও বক্তব্য দেন, নারীপক্ষের প্রকল্প পরিচালক সামিয়া আফরীন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. মাহাজেবীন চৌধুরী। বারডেমের পুষ্টিবিদ আখতারুন নাহার আলো। কবি ও লেখক রোকেয়া ইসলাম, জাগো নারী ফাউন্ডেশনের মুশতারী বেগম। সৈয়দা অনন্যা রহমান, প্রকল্প প্রধান ডাব্লুউবিবি ট্রাষ্ট। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মিডওয়াইভ তামান্না দিলরুবা। ফারহানা জামান লিজা, প্রকল্প সমন্বক, টিসিআরসি। কুষ্টিয়া সদরের জিয়ারখী গ্রামের দাইমা সালেহা বেগম, গোপারপুর গ্রামের দাইমা সুফিয়া বেগম। নাটোরের দাইমা সুরাইয়া খাতুন। পাবনা ঈশ্বরদীর দাইমা মমতাজ বেগম। টাঙ্গাইল দেলদুয়ারের দাইমা রেহেনা বেগম, দাইমা হাজেরা বেগম ও দাইমা খাদিজা বেগম।

দাই সংগঠকের পক্ষ থেকে বক্তব্য দেন কুষ্টিয়ার ডলি ভদ্র, টাংগাইলের সংগঠক ফাহিমা খাতুন লিজা ও পাবনা ঈশ্বরদী সংগঠক আজমিরা খাতুন প্রমুখ।

সভাটি সঞ্চালনা করেন উবিনীগের পরিচালক সীমা দাস সীমু।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।