খাদ্যাভ্যাসে বৈচিত্র্য ও পুষ্টি নিশ্চিত করণে সুষম খাদ্যের রান্না এবং খাদ্য প্রদর্শনী


এবার ১৪২৩ বাংলা সালে গৌর পূর্ণিমা ছিল ২৭ ফাল্গুন (১১ মার্চ ২০১৭)। ফকির লালন শাহের বিখ্যাত গৌর পূর্ণিমার সাধুসঙ্গের তারিখও এই দিনে। কুষ্টিয়া ছেঁউড়িয়ায় এই দিন উপলক্ষ্যে উৎসব চলে, নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে দিনগুলো কাটে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ও ব্যস্ততায়।

একই সময়ে নয়াকৃষি আন্দোলন কৃষকদের নিয়ে একটি ব্যাতিক্রমী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। কৃষকদের দিক থেকে উদ্দেশ্য ছিল যাঁরা ছেঁউড়িয়ার উৎসবে যোগ দিতে এসেছেন তাদের খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কে নতুন ভাবে ভাবনার জন্য খোরাক যোগানো। আমাদের খাদ্য ব্যবস্থাকে সামগ্রিক ভাবে বোঝার জন্য নয়াকৃষি চাষাবাদ ও খাদ্যবতবস্থার চর্চা কিভাবে আমাদের খাদ্যাভাসে বৈচিত্র্য আনে এবং জরুরি পুষ্টি নিশ্চিত করে সেটা হাতেনাতে দেখাবার জন্য নয়াকৃষি কৃষকদের সুষম খাদ্যের রান্না এবং খাদ্য প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। নয়াকৃষির কৃষকদের রান্না ও খাদ্য প্রদর্শনী এলাকায় এ ধরণের প্রথম অনুষ্ঠান এবং তা ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করে। সাপ্তাহিক ছুটি থাকার কারণে এলাকার কৃষক, নারী-পুরুষ, চাকুরী জীবি মানুষ, শিল্পী, গবেষক, শিক্ষক ছাত্র-ছাত্রীসহ সমাজের সকল শ্রেণী পেশার প্রায় ৩৫০ জন মানুষ অনুষ্ঠানটি উপভোগ করেন। রান্না এবং খাদ্য প্রদর্শনী অনুষ্ঠানে নয়াকৃষি আন্দোলনের নয় জন নারী কৃষক অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন রোকেয়া বেগম।

লালন সাঁইজীর গান “অনায়াসে দেখতে পাবি কোন খানে সাঁইর বারামখানা” গানটি দিয়ে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করা হয়। নবপ্রাণ আন্দোলনের সঙ্গে নবপ্রাণ আখড়াবাড়িতে এই অনুষ্ঠানটি আয়োজনের বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। ‘শরীর’ বা ‘দেহ’ সম্পর্কে আমাদের বিচিত্র, আজগবি ও নানাবিধ মিস্টেরিয়াস ধারনা আছে। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে তথাকথিত বাউলতত্ত্ব ও দেহবাদের নামে অবাস্তব অনুমান, নানান গুহ্যসাধনা ও বিকৃত চর্চা। যার সঙ্গে ফকির লালন শাহের কোন সম্পর্ক নাই। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য দীর্ঘ সংগ্রাম জরুরী। কিন্তু শুরুতেই দরকার ‘শরীর’ বা ‘দেহ’ সম্পর্কে সকল প্রকার সংকীর্ণ ধারণা কাটিয়ে ওঠা। বিশেষত আমাদের নিজ নিজ শরীর বা দেহের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক বোঝা। আমাদের সাধকরা ভাণ্ড এবং ব্রহ্মাণ্ডের সম্বন্ধ – অর্থাৎ আমাদের দেহের সঙ্গে দেহের বাইরের জগত বা প্রকৃতির সম্বন্ধ নিয়ে নানান দিক থেকে ভেবেছেন। বাংলার ভাবচর্চায় তার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। এই বোঝাবুঝির জায়গা বা মানুষ ও প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচারের দিক থেকে খাদ্যব্যবস্থার বিচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্ষেত্র। কারণ খাদ্য গ্রহণ এবং খাদ্য থেকে পুষ্টি গ্রহণের মধ্য দিয়েই আমরা প্রকৃতির সঙ্গে সুনির্দিষ্ট সম্বন্ধ স্থাপন করি। নবপ্রাণ আন্দোলনের পাশাপাশি নয়াকৃষি আন্দোলন এই গুরুত্বপূর্ণ দিকটি সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। ফলে গৌর পূর্ণিমা উপলক্ষে কিভাবে খাদ্যদ্রব্য বাছাই এবং মৌসুমের শাকশব্জি আমরা রান্নার মধ্য দিয়ে দেহের পুষ্টির উপযোগী করি তা হাতেকলমে দেখানো ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আপাতদৃষ্টিতে তা খুবই সহজ ও অনাড়ম্বর হলেও এই অনুষ্ঠানটি ছিল গভীর এবং বাংলার সাধনার জগতের সঙ্গে গভীর ভাবে সম্পৃক্ত। বিশেষত যদি আমরা বুঝি যে সাধকদের সেবাব্যবস্থা বা তাঁদের খাদ্য গ্রহণের বাছবিচার এবং শরীরের ‘সেবা’ নিশ্চিত করবার জন্য খাদ্যগ্রহণ পদ্ধতি তাঁদের সাধনার খুবই নির্ধারক দিক।

অংশগ্রহণকারী কৃষক ও গবেষকদের কথা

পুষ্টির জন্য নয়াকৃষি আন্দোলন কুড়িয়ে পাওয়া শাকের ওপর বিশেষ ভাবে জোর দেয়। এবারও অনুষ্ঠানে আবাদি শাকশব্জির পাশাপাশি কুড়িয়ে পাওয়া শাকের ওপর বিশেষ ভাবে মনোযোগ দেওয়া হয়েছে। বৈচিত্র্যপূর্ণ কাঁচা শাকশব্জি, খাদ্যদ্রব্য ও মশলার মিশ্রণ এবং কি ভাবে রান্না করা হলে খাদ্যে পুষ্টিমান বজায় থাকবে সেটা নিশ্চিত করবার জন্য কিভাবে রান্না করতে হবে প্রদর্শনীতে সেই দিকটি বিশেষ ভাবে তুলে ধরা হয়। এখানে অংশগ্রহণকারী কৃষকদের কিছু অবিজ্ঞতার কতা ত্তুলে ধরা হোল।

সাফিয়া বেগম, গোপালপুর: আমরা বাজারে যেসব শাক পাতা পেয়ে থাকি সেসব শাক পাতা সার বিষ দিয়ে উৎপাদন করা হয়ে থাকে। বাজারের ঐ সব শাকা পাতা খেলে শরীরের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশী হবে। সে কারণে আমরা বাড়ির আনাচে কানাচে এবং পতিত জমিতে জন্মানো কুড়িয়ে পাওয়া শাক সংরহ ও রান্নাকে স্বাস্থ্যের দিক থেকে খুবই গুরুত্ব দিয়ে থাকি। সেজন্য গর্ভবতী মায়েদের শরীরের প্রয়োজনে দিক বিবেচনা করে বিভিন্ন ধরণের কুড়িয়ে পাওয়া শাক-সবজি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি।

আবার রাতকানা রোগে যারা আক্রান্ত তাদের হলুদ রংয়ের সবজি খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকি। হলুদ সবজি শরীরের জন্য খুবই পুষ্টিকর। চালের আবরণে ভিটামিন ও খনিজ থাকে। সে কারণে আমরা মেশিনে ছাঁটা চালের পরিবর্তে ঢেকিতে ছাঁটা চালের ভাত খাবার জন্য বিশেষ ভাবে পরামর্শ দিয়ে থাকি। সার বিষ সব সময় ক্ষতিকর। আবাদি ফসলে সার-বিষ ব্যবহারের কারণে কুড়িয়ে প্ওায়া শাক কমে গেছে। সার-বিষের কারনে খাদ্য আর নিরাপদ থাকে না। স্বাস্থ্য সম্মত নিরাপদ খাদ্য পেতে হলে অবশ্যই সার-বিষ বাদ দিয়ে ফসলের চাষাবাদ করতে হবে।

মনোয়ারা বেগম, আরপাড়া: নিরাপদ খাদ্যের দিক থেকে বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষাবাদ খুবাই গুরুত্বপূর্ণ। বাড়ীর আঙ্গিনায় এসব সবজির চাষ মহিলারা নিজেদের উদ্যোগে করে থাকেন। বাড়ির আনাচে কানাচে ৩টি বেগুন, ৪টি মরিচ, দুটি টমেটো, জায়গা থাকলে জালেঙ্গা করে অথবা ঘরের চালায় লাউ, মিষ্টিকুড়া, চালকুমড়া, সীম ধুন্দল ইত্যাদি লাগিয়ে থাকেন। যাদের সামর্থ আছে, তারা বাড়িতে হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল লালন-পালন করেন, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা ও গরুর গোবর দিয়ে কম্পোষ্ট সার বানিয়ে তারা সেসব দিয়ে সবজির চাষ করে থাকেন। এসব শাক-সবজিতে কোনো রকম সার-বিষ না থাকায় স্বাস্থ্যের দিক থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ। এ সব সবজি মা-বোনরা নিজেদের পরিবারে খেয়ে থাকেন, প্রতিবেশীদের দেন, অতিরিক্ত হলে বাজারে বিক্রি করে আয় করেন। সে আয়ের টাকা পরিবারের অন্যান্য প্রয়োজন মেটায়। আমি সবাইকে অনুরোধ করবো আপনার বাড়ির মা-বোনদের উৎসাহ দেবেন তারা বাড়ির আনাচে-কানাচে যতটুকু জমি পায় ফেলে যেন না রাখে, সেখানে কিছু না কিছু যেন লাগায়, অবশ্যই উপকৃত হবেন।

মুক্তা বেগম, নন্দলালপুর: আমি একজন দাই’মা। বাড়ি নন্দলালপুর। আমি দাইমা হবার কারণে গ্রামে বিভিন্ন গর্ভবতী মেয়েদের পরামর্শ দিয়ে থাকি। সকল গর্ভবতী মায়েদের বাড়ী যাই। তাদের খোঁজ-খবর করি। গর্ভবতী মায়েদের প্রথম পর্যায়ে বমি বমি ভাব হলে তাদেরকে কোনো ওষুধ খেতে বলি না। আমি তাদের মৌসুমে পাওয়া যায় ফলমুল খেতে বলি। এক চিমটি লবন দিয়ে পেয়ারা বা কামরাঙ্গা খেলে বমি বমি ভাব চয়ে যায়। শরীরে রক্তহীনতা দেখলে কালো কচু শাক, কাঁচাকলা খেতে বলি। কালো কচুশাক ও কলায় শুধু আয়রনই নয়, প্রচুর ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম রয়েছে, যা গর্ভবতী মায়েদের জন্য খুবই প্রয়োজন। এভাবে গর্ভবতী মায়েদের বিভিন্ন পর্যায়ে, পর্যায় অনুসারে পুষ্টিকর খাদ্যের পরামর্শ দেই। আমি এমন কোনো পুষ্টিকর খাবারের পরামর্শ দেই না যা সে নিজের ঘরের আশপাশ বা গ্রাম থেকে সংগ্রহ করে খেতে পারবে না। তার হাতের কাছে যা আছে তার মধ্য থেকেই পুষ্টিকর খাবারের পরমর্শ প্রদান করি। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়েদের উঠাবসা-চলাফেরা-কাজকর্ম ঘুমানোসহ সব বিষয়েই পরামর্শ দিয়ে থাকি। এমনকি রান্না পদ্ধতিও বলে দেই যাতে রান্না করা খাদ্যে থেকে যথাযথ পুষ্টি সে পায়।

আমিনুল ইসলাম গাইন, দৌলতপুরঃ আমরা কৃষক যখন চাষাবাদ করি তখন যাচাই-বাছাই করি না। কিন্তু যাচাই-বাছাই করতে হবে। আমরা সব কিছুতে বেশী লাভ খুঁজে থাকি এটা সঠিক চিন্তা নয়। উদাহরণ হিসেবে বলছি। এখন সরকারী ভাবে বিটি বেগুন চাষ করার কথা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সে বেগুনে কোনো পোকা লাগবে না। এখন এ বেগুন যদি চাষ করা হয় তাহলে বিষ-বেগুন চাষ করা হবে। বিষাক্ত। এই বিটি বেগুন খেলে শরীরের উপকারের তুলনায় ক্ষতি হবে। সে কারণে কৃষক ভাই বোনদের বলছি, আপনার একটু বাছ-বিচার করে ফসল চাষাবাদ করবেন। অর্থাৎ আমি বলছি আপনারা রাসায়নিক সার-বিষ বাদ দিয়ে স্থানীয় জাতের ফসলের চাষাবাদ করবেন। প্রয়োজনে কম্পোষ্ট সার ব্যবহার করবেন। সার-বিষ ছাড়া চাষাবাদ করা যায়। তার প্রমাণ নয়াকৃষির কৃষক। তারা নয়াকৃষি পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে আর্থিক ভাবে লাভবানও হচ্ছেন। আগেকার দিনে দেখেছি, কারো রক্ত স্বল্পতা হলে তাকে ভাতের ফেন খাওয়ানো হোত। তাতেই তার রক্ত স্বল্পতা রোগ ভালো হয়ে যেতো। কিন্তু এখন সেই ধান কোথায় পাবেন? এখন শুধু ইরি বা ব্রি ধান। সে ধান রাসায়নিক সার-বিষ ছাড়া হয় না। নয়াকৃষি একক ফসলে বিশ্বাস করে না। আপনারা মিশ্র ফসলের চাষাবাদ করবেন। এতে লাভ বেশী অপরদিকে ফসল পোকা-মাকড় বা রোগে আক্রান্ত হবে না। দেশী ধানের চাষ করবেন স্থানীয় জাতের সবজির চাষাবাদ করবেন। নিজের চাষাবাদের শস্য বীজ নিজের হাতে রাখবেন। দেখবেন আপনারাই নিরাপদ পুষ্টি সমৃদ্ধ ফসল উৎপাদন করছেন। মনে রাখবেন নিরাপদ পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য খেতে হলে নিরাপদ শস্য উৎপাদন করতে হবে, তবেই নিরাপদ পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য পাবেন নচেৎ সম্ভব নয়।

রোকেয়া বেগম, হাবাসপুর: আমার বাড়িতে নয়াকৃষি আন্দোলনের একটি বীজঘর আছে। এই বীজ ঘরে ধানের মধ্যে আউশ, আমন এবং বোরো মৌসুমের স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ করা হয়েছে। গম, ভূট্টা, সরিষা, রাই, তিল, তিশি, মশুর, মুগ, খেসারী, মাষকলাই, অড়হর, ছোলা, মটর, বরবটি, মিষ্টিকুমরা, চালকুমরা, লাউ, শসা, পুঁইশাক, লালশাক, মূলা, পাট, আলু, রসুন পেয়াজ, ধনিয়া মৌরি, বেগুন, উচ্ছে, করলা, ঢেঁড়স, ডাটা, তিল, কাউনসহ অন্যান্য ফসল, ফল-মূল, ফুলসহ স্থানীয় জাতের বীজ রয়েছে। আমাদের কিছু জমি আছে, সে জমিতে সকল স্থানীয় জাতের ফসল কম্পোষ্ট সার এবং গরুর লাঙ্গল দিয়ে চাষাবাদ করে থাকি। এই বীজঘর থেকে গ্রামের অন্যান্য কৃষক পরিবার এবং অন্যান্য মানুষ বীজ নিয়ে যান, আবাদ করেন, ফসল উঠলে যে পরিমাণ বীজ নিয়ে গিয়েছিলেন, তারা নিয়মানুযায়ী দ্বিগুণ বীজ ফেরৎ দেন। কেউ বীজ নিতে এলে তাকে বীজ আদান-প্রদানের নিয়মের কথা বলে থাকি। আরো বলি আপনারা সার বিষ দিয়ে চাষাবাদ করবেন না। আমি নিজে বাড়ীর আনাচে কানাচে সবজির আবাদ করি। সে সব সবজির মধ্যে রয়েছে লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, শসা, বিভিন্ন জাতের সীম। সীম শসা জালেঙ্গা করে করি আর লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া ঘরের চালে তুলে দেই। আমার বাড়ীর সীমানার মধ্যে সবরি কলার বড় ঝাড় রয়েছে। আমার সবরি কলার স্বাদ খুবই ভালো। কলা বাড়ীর পরিবার পরিজন নিয়ে খাই এবং বিক্রি করি। বাড়ী থেকেই আমার কলা, অন্যান্য ফসল বাজার মূল্যের চেয়ে বেশী দামে বিক্রি হয়ে যায়। কেননা, সবাই জানে আমরা রাসায়নিক সার বিষ দিয়ে কোনো আবাদ করি না। আমি সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি, আপনারা যে যতটুকু আবাদ করেন বা বাড়ীর আঙ্গিনায় লাগান বীজ নিজের হাতে রাখবেন। বীজ কৃষকের শক্তি, নিজের চাষের বীজ নিজের হাতে না থাকলে কখনই পুষ্টিকর ফসল পাবেন না। আর মাটি সার-বিষ দিয়ে মেরে ফেলবেন না। এদুটো জিনিস ঠিক থাকলে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য শস্য অবশ্যই পাবেন। পরিবাবেরর সকলের স্বাস্থ্যও ভালো থাকবে।

ছালেহা খাতুন, জিয়ারখি: আমার বাড়ী জিয়ারখি। আমি একজন নয়াকৃষির কৃষক। নয়াকৃষির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে শস্য বৈচিত্র্য। আমাদের শরীর যেমন বিভিন্ন বৈচিত্রপূর্ণ উপাদান দিয়ে তৈরি, আমাদের শরীরের সকল বৈচিত্রপূর্ণ উপাদানই শস্য বৈচিত্র্যের মাধ্যমেই পাওয়া যাবে। শুধুমাত্র এক ফসলের মধ্যে পাওয়া যাবে না। শরীর সুস্থ্য রাখতে হলে অবশ্যই নিরাপদ খাদ্যশস্য নিশ্চিত করতে হবে। আবার নিরাপদ খাদ্য পেতে হলে রাসায়নিক সার বিষ মুক্ত হতে হবে। কম্পোষ্ট এবং অন্যান্য জৈব উপাদান দিয়ে চাষাবাদ করতে হবে। যদি কম্পোষ্ট বা অন্যান্য জৈবসার দিয়ে শুধু এক ফসলের আবাদ করেন তাহলে শরীরের যথাযথ পুষ্টি পূরণ হবে না। আর সে জন্য দরকার আমাদের খাদ্যশস্য আবাদের ক্ষেত্রে্ প্রাণবৈচিত্র। সে দিক থেকে নয়াকৃষির চাষাবাদ পদ্ধতির মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মিশ্র ফসলের চাষাবাদ। মিশ্র ফসলের চাষাবাদ করা হলে শস্যের বৈচিত্র রক্ষা হবে একই সঙ্গে বিভিন্ন পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ফসল পাওয়া সম্ভব হবে। খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পুষ্টি সহজেই পূরণ করা যাবে। বৈচিত্রপূর্ণ ফসল চাষাবাদে সার-বিষ মুক্ত জমিতে কুড়িয়ে পাওয়া শাক-সবজিও বেশী পরিমাণে জন্মে। নিরাপদ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্যের জন্য প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর চাষাবাদের বিকল্প কিছুই নাই বলেই আমার বিশ্বাস।

ড. এম. এ সোবহান, উবিনীগ: আমরা খাদ্য কেন খাই? খাদ্য আমাদের ক্ষুধা মেটায় এবং শরীরে শক্তি যোগায়। আর সে কারণেই আমরা চলাফেরা করি, বিভিন্ন কাজ-কর্ম করতে পারি। আমরা যেসব খাদ্য খাই সে সব খাদ্যে প্রধানত ৭ প্রকার খাদ্য পুষ্টি রয়েছে। যেমন আমিষ, শ্বেতসার, স্নেহ, আঁশ, খনিজ উপাদান, ভিটামিন এবং পানি। সব ধরণের খাদ্যে পুষ্টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। খাদ্যের পুষ্টির হিসাব নিকাশ না করে খাওয়ার কারণে আমাদের শরীরে নানা রকম সমস্যা হচ্ছে। আমাদের দেশের একটি প্রতিষ্ঠান ‘বারডেম’ থেকে গবেষণার মাধ্যমে হিসাব করে দেখানো হয়েছে একজন মানুষের দেহের পুষ্টি প্রয়োজন মেটানোর জন্য খাদ্য নির্বাচন ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় মনে রাখতে হবে। মোট আহার যোগ্য মোট খাদ্যের ৪ ভাগের ১ ভাগ দানাদার খাদ্য, শাক-সবজি ১ ভাগ, ফলমূল ১ ভাগ প্রাণিজ উৎসের খাদ্য ১ ভাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশের নাগরিকদের উপযোগি খাদ্য তালিকা: খাদ্যের মোট পরিমাণ ১২৮০ গ্রাম,এবং ২৪৩০ ক্যালোরি (বারডেম)। এরমধ্যে দানা শস্য -৪০০ গ্রাম, গোলআলু -১০০ গ্রাম, প্রনীজ উৎসের খাদ্য ২৬০ গ্রাম, ফল-১০০ গ্রাম, শ্ক-সবজি-৩০০ গ্রাম, ভজ্য তেল-৩০০ গ্রাম, চিনি/গুড়-২০ গ্রাম, মসলা-২০ গ্রাম।

কিন্তু আমরা খাদ্য পুষ্টির এ হিসাব নিকাশ না করে খাবার কারণে শরীরে পুষ্টির ঘাটতি থেকে যায়। ফলে আমরা নানা ধরণের রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকি।

আমাদের খাদ্যের মধ্যে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য হচ্ছে ‘লবন’। লবন কম পরিমাণে খাওয়া প্রয়োজন। লবণ একটি মারাত্মক বিষ। আমাদের দেশের মানুষ লবন বেশী খেয়ে থাকেন। লবণ বেশী খেলে রক্ত উচ্চ চাপ বেড়ে ষ্ট্রোক আক্রান্ত হোন। দেশের মানুষের শরীরের আইওডিন ঘাটতি পূরণের জন্য লবনের সঙ্গে আওডিন মিশ্রিত করে বাজারে বিক্রয় করা হয়ে থাকে। আমরা বেশীর ভাগ মানুষই জানিনা আইওডিন উদায়ী অর্থাৎ উড়ে যায়। লবন রাখার পাত্রের মুখ খোলা রাখলে অথবা রান্না করার সময় ঢাকনা না দিয়ে রান্না করা হলে আইওডিন আপনা থেকেই উড়ে যায়। এ বিষয়টি খেয়াল রাখা দরকার। আমরা শাক পাতা এবং বিভিন্ন সবজি বেশী সিদ্ধ করে পানিটা ফেলে দিই। ফলে রান্না করা যে, শাক-সবজি খেয়ে থাকি তাতে কোনো পুষ্টি থাকে না, এর কারণে আমরা শাক-সবজি ঠিকই খাই কিন্তু শরীরের কোনো কাজে লাগে না। আমরা এখন মেশিনে ছাঁটা চাল বেশী পছন্দ করি। বেশী পানি দিয়ে সিদ্ধ করে ভাতের মাঢ় ফেলে দেই। চালে কমপক্ষে ১৮ধরণের পুষ্টি উপাদান রয়েছে ভাতের মাঢ় ফেলে দেবার কারণে যেটুকু পুষ্টি অবশিষ্ট ছিলো তখন তাও আর থাকে না, থাকে একমাত্র শ্বেতসার। চাউলের গায়ের সঙ্গে একটি আস্তরণ লেগে থাকে। চালের গায়ের ঐ আবরণে সকল পুষ্টি উপাদান থাকে। আমরা যখন মেশিনে ধান ভানাই তখন চালের গায়ের সঙ্গে লেগে থাকা ঐ আবরণটি উঠে যায়, তার সাথে সাথে চালের সকল পুষ্টি উপাদানগুলোও চলে যায়। আবার বেশী পানি দিয়ে ঐ চাল রান্না করে যখন ভাতের মাঢ় ফেলে দেই তখন ভাতে আর কোনো পুষ্টি থাকে না। ফলে আমরা ভাত খাই ঠিকই, কিন্তু শরীরের কাজে লাগে না।

রান্না প্রদর্শনী

নয়াকৃষির কৃষক ৯ জন বোন ৫টি চুলায় নয় রকমের রান্না তৈরি করেন। তারা প্রত্যেকে এক একটি রান্না করা খাদ্য তৈরি করেন। প্রথমে তারা কি কি কাঁচা খাদ্য দিয়ে কি কি খাদ্য রান্না করবেন সেটা নির্ধারণ করেন এবং কাঁচা খাদ্য রান্না করার প্রস্তুতি গ্রহণ করার পর রান্নার কাজ করেন। প্রতিটি রান্না করা খাদ্যের রেসিপি এবং এসব রান্না করা খাদ্য খেলে মানব শরীরের কি কি উপকারে আসবে সে সম্পর্কে কৃষক বোনেরা যা বলেছেন-এখানে তা উল্লেখ করা হোল।


রান্না তৈরি আগে কোটা কাটা খাদ্য প্রদর্শনী
রান্না তৈরি হচ্ছেখাদ্য প্রদর্শনীঅংশ গ্রহণকারীনায়াকৃষির কৃষকখাদ্য প্রদর্শনীরওশন ফকির


মুগ ডালের সঙ্গে সাজনে ডাটা: সরিষার তৈল, স্বাদ মতো লবন, হলুদ এবং পাঁচফোড়ন দিয়ে তরকারী রান্না করা হয়েছে। মুগ ডালে প্রচুর আমিষ, ক্যালসিয়াম, আয়রণ, এবং ভিটামিন রয়েছে, এবং সাজনা ডাটায় প্রচুর ক্যালসিয়াম আয়রন এবং অন্যান্য ভিটামিন রয়েছে। শরীর দূর্বলতায়, রক্ত স্বল্পতা এবং হাত-পায়ের গিরা ব্যথায় বেশ উপকারী। এটি রান্না করেছেন-সালেহা খাতুন, গ্রাম: জিয়ারখি

ছোলার ডাল: খোসা ছিলা ছোলার ডালের সঙ্গে সরিষা তেল, স্বাদ মতো লবন ও হলুদ: ছোলার ডালে প্রচুর আমিষ, আঁশ, আয়রন এবং অন্যান্য ভিটামিন রয়েছে। এটি একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর খাদ্য। শরীরে শক্তি যোগাতে ক্ষয়পূরণে যথেষ্ঠ আবদান রাখে। এটি রান্না করেছেন: সাফিয়া খাতুন গোপলপুরঃ

কলার মোচার ভর্তা: কলার মোচা সিদ্ধ সঙ্গে আদা, জিরা, পাঁচফোড়ন, স্বাদ মতো লবন, কাঁচামরিচ ও সরিষা তেল দিয়ে রান্না করা হয়েছে। কলার মোচায় প্রচুর আয়রণ রয়েছে। এছাড়া আদা এব জিরায় প্রচুর ওষুধি গুণাগুন রয়েছে। কলার মোচায় একদিকে রক্ত পরিষ্কার করবে, আদা ঠান্ডা লাগা এবং ব্যাথা নাশকের কাজ করে। জিরা শরীরের মেদ কমায় এবং স্ট্রোক থেকে রক্ষা করে। রান্না করেছেন রোকেয়া বেগম, হাবাসপুর।

বথুয়া শাক: বথুয়া শাক, সঙ্গে স্বাদ মতো লবন, কাঁচামরিচ ও সরিষা তেল: বথুয়া শাকে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন সি রয়েছে যথেষ্ঠ পরিমাণেএছাড়া আমিষ ও অন্যান্য ভিটামিন অল্প পরিমাণে রয়েছে। শরীরের বিষ ব্যাথায় বথুয়া শাক উপকারী, এছাড়া শরীরের ক্যালসিয়াম জনিত রোগ ব্যাধিতেও বেশ উপকার করে। রান্না করেছেন, রুবিয়া বেগম, বেলগাছী।

মিশ্র সবজি রান্না (কাঁচাকলা+মিষ্টিকুমড়া+লাউ+পেঁপে): কাঁচাকলা, মিষ্টিকুমড়া, লাউ এবং পেঁপে এই চারটি সবজির সঙ্গে স্বাদ মতো লবন, হলুদ, কাঁচামরিচ বাটা, আদা থেতলানো এবং পরিমাণ মতো সরিষার তেল দিয়ে একটি সবজি তরকারী রান্না করা হয়। এ চারটি সবজি কি কারণে একসঙ্গে রান্না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, জিজ্ঞাসা করা হলে এ তরকারী রান্নাকারী বলেন, চারটি সবজিতেই রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ উপাদান। বিশেষ করে পেঁপেতে রয়েছে ভিটামিনের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে খনিজ উপাদান। পেঁপেতে আরও রয়েছে খাদ্য হজমকারক উপাদান। এই চারটি সবজির মিশ্রিত তরকারী মানব শরীরে সকল ধরণের পুষ্টি এবং খনিজ উপাদানের ক্ষয় পূরণ করবে। এটি একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর সবার জন্য গ্রহণ উপযোগী একটি খাদ্য। এটি রান্না করেন রোকেয়া বেগম, গ্রাম হাবাসপুর।

কচুর শাকের ভর্তা: কালো কচুর পাতা সঙ্গে কাঁচামরিচ, স্বাদ মতো লবন এবং পরিমাণ মতো সরিষার তেল দিয়ে সিদ্ধ করে খাদ্য তৈরি করা হয়। কালো কচু শাক পাতায় প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং আয়রন রয়েছে। কচুশাক একদিকে রক্তহীনতা দূর করবে এবং শরীরের ক্যালসিয়ামের ক্ষয় পূরণ করবে। কচু শাকের ক্যালসিয়াম শরীরের গিরার ব্যাথা দূর করবে। এটি রান্না করেছেন-মনোয়ারা বেগম, গ্রাম চর গোপালপুর।

কলমী শাক: কলমী শাকের সাথে কাঁচামরিচ, স্বাদ মতো লবন এবং পরিমাণ মতো সরিষার তেল দিয়ে রান্না করা হয়। কলমী শাক এমন একটি শাক যে শাকে রয়েছে, আমিষ উপাদান, প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খনিজ উপাদান। কলমী শাক শরীরের পুষ্টিহীনতা দূর করে এবং গর্ভবতী মায়েদের স্তনে দুধ বৃদ্ধি করে।

ডুমুরের সবজি: কাঁচা ডুমুর খণ্ড খণ্ড করে কেটে তার সঙ্গে পরিমাণ মতো সরিষার তেল, কাঁচামরিচ এবং স্বাদ মতো লবন দিয়ে একটি সবজি রান্না করা হয়। ডুমুর একটি ওষুধি সবজি। ডুমুর ঘন ঘন প্রস্রাব, ধাতু সমস্যা এবং বহুমূত্র রোগে বেশ উপকারী এবং প্রতিষেধক। এটি রান্না করেছেন মুক্তা বেগম, গ্রাম: নন্দলালপুর।

লাউ শাকের সবজি: লাউ পাতার সঙ্গে কাঁচামরিচ, স্বাদ মতো লবন এবং পরিমাণ মতো সরিষার তেল দিয়ে রান্না করা হয়। লাউ পাতা খনিজ উপাদান এবং ভিটামিন সি সমৃদ্ধ। শরীর কষে ঠান্ডা লাগা অসুস্থতায় বেশ উপকারী খাদ্য।

 দলীয় আলোচনা

গুরুপ আলোচনাগুরুপ আলোচনা

অংশগ্রহণকারী কৃষকগণ দুটি দলে ভাগ হয়ে তাঁদের কিছু সংকট নিয়ে আলোচনা করেন আলোচনা করেন দলীয় আলোচনার প্রশ্ন ছিলো। তাঁরা দুটো বিষয় নিয়ে আলচনা করেনঃ ১. এলাকা থেকে কি কি শস্য হারিয়ে গেছে? এবং ২. বর্তমানে কি কি শস্য আছে?

প্রথম দলে অংশগ্রহণকারীগণ হচ্ছেনঃ সালেহা বেগম, গ্রাম: জিয়ারখি, মনোয়ারা বেগম, গ্রাম আড়পাড়া, সাফিয়া বেগম, গোপালপুর, মুক্তা বেগম, নন্দলালপুর, এবং কমেলা বেগম, হাবাসপুর। তাঁরা এই তথ্যগুলো জানিয়েছেন।

১. এলাকা থেকে কিকি শস্য হারিয়ে গেছে?

  • ধানের মধ্যে: জবাহুল, ঝিংগাশাইল, কাশিরাজ, হলদেজটা, শীরকোমর, ভালোভোগ, জবাকুসুম, কলামোচা, দিঘাহিদে, হাজরা,কাঁচরূপা, ময়নামতি, জামাইআদুরী, জামাইবাবু, কাজলাদীঘা, বেগুনবিচি

২. বর্তমানে আছে

  • ধানের মধ্যেঃ কালাবকরী, হিদে, হিজলদীঘা, রূপা, ইরিশাইল, কালোজিরা, বাদশাভোগ, বার্মা, কাজল লতা, কাজলদীঘা, লক্ষীজটা
  • ডালের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া নেই: মশুর, ছোলা, খেসারী, মটর, অড়হর, মাসকালাই, কালিকালাই, সোনামুগ এ সব ডাল পূর্বে ছিলো বর্তমানেও আছে।
  •  তৈল ফসলের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া কিছু নেই: সরিষা, রাই, তিল, কুসুমফুল, তিশি, ভেন্নার তেল সবই বর্তমানে আছে।
  • লাউ: তবলা লাউ, বেল লাউ, কালো লাউ, সাদা লাউ। লাউয়ের মধ্যে সব জাতই আছে।
  • মিষ্টি কুমড়া: তরমুজকুমড়া, ধামাকুমড়া,মাইঠা কুমড়া, কোদালী কুমড়া। মিষ্টিকুমড়ার মধ্যেও হারানো কোনো জাত নেই।
  • চালকুমড়া: ক্ষেত চালকুমড়া এবং জাংলা চালকুমড়া। চালকুমড়ার মধ্যেও হারানো জাত নেই।
  • করলা: করলা, উচ্ছে। হারানো কোনো জাত নেই।
  • পটল: মাঠ পটল (সাদা), জাংলা (কালো)। পটলেরও কোনো জাত হারায় নাই।
  • আলু, শিলবিলাতী, সূর্যমুখী, মৌআলু (সাদা ও লাল), অঅলুর কোনো জাত হারায় নাই।
  •  ঝিংগা: মাঠ ঝিংগা, জাংলা ঝিংগা। ঝিংগার কোনো জাত হারায় নাই।
  • ঢেঁড়স: ৮ শির ঝিংগা, ৪ শির ঝিংগা, গোলাপী ঢেঁড়স। ঢেঁড়সের কোনো জাত হারায় নাই।
  • ধুন্দল: তিত পোল্লা, মাই পোল্লা। ধুন্দলের কোনো জাত হারায় নাই।
  • দেশী সীম: ঘী-কাঞ্চন, কাষিয়া সীম, মটরী সীম, বাগনন্দে সীম, ভুলেকাঞ্চন, হাতীকান, জামাইকুলি। সীমের মধ্যে শুধু ‘জামাইকুলি’ সীম; সীম হারিয়েছে।
  • বেগুন: সইলা বেগুন, ঢেপা বেগুন, শিংবেগুন, ডিম বেগুন, কাঁটাবেগুন। বেগুনের মধ্যে কাঁচাবেগুন ও শিং বেগুনের জাত হারিয়েছে।
  • ডাটা: আমনে ডাটা, বাঁশডাটা, কাটুয়াডাটা,। ডাটার কোনো জাত হারায় নাই।
  • কচু: মুখি কচু, সোলাকচু, ওলকচু, মানকচু, দস্তাকচু, আদুরেকচু। কচুর কোনো জাত হারায় নাই।
  • মরিচ: আকাশী মরিচ, কামরাঙ্গা মরিচ, কার্তিকা মরিচ, রাইনে মরিচ, আইনে মরিচ, ঝুমকা মরিচ। মরিচের মধ্যে ঝুমকা মরিচ হারিয়ে গেছে।

দ্বিতীয় দলের অংশগ্রহণকারীগণ হচ্ছেনঃ রুবিয়া বেগম, বেলগাছী, মনোয়ারা বেগম, চর গোপালপুর, আলেয়া বেগম, রোকেয়া বেগম, হাবাসপুর, আলেয়া বেগম, বেলগাছী

১. এলাকা থেকে কিকি শস্য হারিয়ে গেছে?

ধানের মধ্যে: আমন: মালভোগ, বাঁশীরাজ, কলামোচা, ভোজনকলি, জবাহুল, বেগুনবীচি, বেতো, কেশলাল, ঝিংগাশাইল, সুরকিমালা, কাদাচাপ, আউশ: খেড়ো ধান, কাটকুয়া ধান, লক্ষীজটা, কালো নড়ই, লাল নড়ই ধানের জাত হারিয়ে গেছে।

বর্তমানে আছে: ধানের মধ্যেঃ আমন: বেতো, তেইশ শাইল, ঝিংগাশাইল, সুরকি মালা, কাদাচাপা, আউশ: খেড়ো ধান, কাইকুয়া, জবাহুল, লক্ষ্মীজটা, কালো নড়ই, লাল নড়ই ধানের জাত রয়েছে।

২. বর্তমানে কি কি শস্য আছে?

শাক সবজি বর্তমানে আছে: আলু, পুঁইশাক, ঝিংগা, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, উচ্ছে, করলা, বরবটি, ধুন্দল, চিচিংগা, বেগুন, সীম, টমেটো, পটল, ডাটা, ঢেঁড়স, লাল শাক, মাইটা আলু, কচু, সোলাকচু, মুখিকচু, ওলকচু, মানকচু, দাস্তাকচু

মসলা: ধনিয়া, মরিচ, হলুদ, কালিজিরা, মেথী, পিয়াজ, রসুন,

ডাল শস্য: মুগকলাই, মশুর কলাই, খেসারী কালাই, কালিকলাই, মাষকালাই, অড়হর, ছোলা, মটর,

তৈল শস্যঃ তিল, সরিষা, রাই, তিশি, গোজা, সূর্যমুখী, চিনাবাদাম ভেন্না।

খাদ্য দ্রব্যের পুষ্টিপিরামিড প্রদর্শনী

পুষ্টি পিরামিড


নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের সুষম খাদ্যের রান্না এবং খাদ্য প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী কৃষক বোনেরা পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের মানদন্ড বুঝানোর জন্য কাঁচা খাদ্য পিরামিড উপস্থাপন করেন। পিরামিড আকৃতির ৫টি তাক বিশিষ্ট্য একটি কাঠের সেলফ। এক একটি তাকে এক একটি শ্রেণীর খাদ্য সাজিয়ে রাখা হয়েছিলো। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে খাদ্য গ্রহনের নীতির ভিত্তিতে পিরামিডেও খাদ্যের শ্রেণী ভাগ দেখানো হয়েছে। এই পিরামিড আকৃতির সেলফটি নীচের দিক থেকে উপরের দিকে পর্যায়ক্রমে সরু আকৃতির গঠন। এই খাদ্য পিরামিডে নীচের তাক থেকে শুরু করে সর্ব উপরে যে ভাবে খাদ্যদ্রব্য সাজানো হয়েছে, সেটা এখানে তুলে ধরা হোল:

১. সর্ব নীচের তাক: গমের আটা, চাউল (আউশ ধানের), দীঘা চালের মুড়ি, বাদশাভোগ চাল: খাদ্য শ্রেণী অনুসারে এ ধাপে রয়েছে সবই শ্বেতসার জাতীয় খাদ্য।ঃ

২. তার উপরের তাক: পাতাকপি, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, সাজনে ডাটা, কচুশাক কলমীশাক, বেগুন, পটল, কলার মোচা, সীম, কাঁচাপেপে, আলু ও কাঁচাকালা: এখানে রয়েছে, সবজি প্রোটিন ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাদ্য। কৃষক বোনরা জানালেন এ তাকে প্রাণিজ প্রোটিনও থাকবে। কিন্তু সংগ্রহে না থাকার কারণে দেয়া হয় নাই।

৩. তার উপরের তাক: পাকা কলা, বরই, নারিকেল। এ ধাপে রয়েছে ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ খাদ্য। বোনেরা জানালেন এ ধাপে শুধু ফল থাকবে, ভিটামিন ও খনিজ ক্ষয় পূরণের জন্য।

৪. তার উপরের তাক: দুধ, মশুর ডাল, মটর ডাল, ছোলার ডাল। প্রধানত সবই প্রোটিন ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাদ্য।

৫. সর্ব উপরের তাক: সরিয়ার তৈল, তেজপাতা ও লবন। এ ধাপে রয়েছে তেল ও মসলা জাতীয় খাদ্য। যা বাংলাদেশের রান্না পদ্ধতি অনুসারে রান্নার সহায়ক হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তৈলতে রয়েছে শক্তি খ্যালোরি, এবং মসলায় রয়েছে খনিজ ও ওষুধি গুণাগুণ।

খাদ্য শস্য বীজ এবং কৃড়িয়ে পাওয়া শাক প্রদর্শনী

নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের সুষম খাদ্যের রান্না এবং খাদ্য প্রদর্শনীতে রাসায়নিক সার ও বিষ মুক্ত নিরাপদ খাদ্য শস্যের বীজ ও কুড়িয়ে পাওয়া শাক প্রদর্শন করানো হয় যা দর্শনার্থীগণ উপভোগ করেন।

এখানে ১৯৫ জাতের ধান প্রদর্শন করা হয়। এর মধ্যে আমন ধান ছিলো ১৭৪ জাতের, আউশ ধান ছিলো: ৯ জাতের এবং বোরো ধান ছিলো: ১২ জাতের। সবজি ফসল: ২৭ প্রজাতি, মসলা ফসল:৭ প্রজাতির, ডাল শস্য: ৯ প্রজাতির, তৈল শস্য: ৭ প্রজাতির এছাড়া ১০ রকমের কুড়িয়ে পাওয়া শাক প্রদর্শন করানো হয়।

অংশগ্রহণকারী কৃষকদের পরিচয়:

ক্রমিক
নাম গ্রাম
আলেয়া বেগম বেলগাছী
রুবিয়া বেগম বেলগাছী
মনোয়ারা বেগম আরপাড়া
মুক্তা বেগম নন্দলালপুর
সাফিয়া বেগম গোপালপুর
মনোয়ারা বেগম চর গোপালপুর
রোকেয়া বেগম হাবাসপুর
কমেলা খাতুন হাবাসপুর
ছালেহা খাতুন হাবাসপুর

খাদ্যের পুষ্টি গুণাগুণ এবং নিরাপত্তা বিবেচনায় রেখে খাদ্য রান্না করা গুরুত্বপূর্ণ। নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা জাতসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ‘নিরাপদ খাদ্য’ কর্মসূচি নিশ্চিত করবার কাজে ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িত। আমাদের সাধারণ ধারণা খাদ্য খেই কাজ হয়। খাদ্য নিরাপদ কিনা এবং তার পুষ্টিগুণ কতোটুকু সেইসব জানার দরকার নাই –এই অনুমান ঠিক না। এই অনুমান ভাঞবার জন্য নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের নিরাপদ ও সুষম খাদ্যের রান্না এবং খাদ্য প্রদর্শনী খুবই শিক্ষণীয় ছিল। অংশগ্রহণকারী কৃষক বোনদের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের উপস্থাপনা দেখে সহজেই বোঝা যায় যে তারা আর আগের পর্যায়ে নাই। খাদ্য নির্বাচন এবং খাদ্য রান্না করার বিষয়ে তারা বেশ সচেতন হতে পেরেছেন। প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদনে দক্ষতা বৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কৃষক পরিবার এতে বেশ উপকৃত হয়েছেন। একই সাথে তাদের মাধ্যমে গ্রামের অন্যান্য পরিবারগুলো কিছুটা হলেও উপকৃত হবেন। যদি সম্ভব হয় তাহলে প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্য উৎপাদনে দক্ষতা বাড়াবার জন্য প্রশিক্ষণ আরো সম্প্রসারণ করা হলে ব্যাপক ফল লাভ করা যাবে।

আয়োজনেঃ উবিনীগ ও নয়াকৃষি আন্দোলন; স্থানঃ আখড়াবাড়ি বিদ্যাঘর, কুষ্টিয়া তারিখঃ ১১ মার্চ, ২০১৭।

প্রতিবেদক:
গোলাম রাব্বী বাদল
গবেষণা বিভাগ, নয়াকৃষি আন্দোলন, উবিনীগ, ঢাকা কার্যালয়।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।