নয়াকৃষি চাষাবাদে কৃষকরা খুশী
পত্রিকার ভাষায় বোরো ধানের এবার বাম্পার ফলন হয়েছে। বিঘা প্রতি গড়ে ফলন ১৮ মণ। উফশী ও হাইব্রিড বোরো ধানের এবার ভাল ফলন নিয়েও অসন্তোষের আগুনে পড়ছে সাধারন কৃষক। কারণ ধানের উৎপাদন খরচের তুলনায় ধানের দাম অনেক কম। বিভিন্ন জায়গায় খোজ নিয়ে দেখা গেছে শুকনো প্রতি মণ ধান বাজারে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সরকার ধানের দাম নির্ধারন করে দিয়েছে মন ৯২০ টাকা। আপাতদৃষ্টিতে দামটা খুবই ভালো। কিন্তু এই দাম নির্ধারনের রাজনৈতিক দিক হলো কোথাও এই দামে সরকার কিংবা মিলার কেউ ধান কিনছে না। সরকার এক সময় ওই দামে ধান কিনবে বটে কিন্তু সেটা কেনা হবে মিলারদের কাছ থেকে। এখন তাই আড়তদাররা ছোট ছোট মধস্বত্বভোগীদের বাজারে নিয়োগ দিয়েছে। তারা আস্তে আস্তে অল্পদামে ধান কিনতে থাকবে। তবে অনেক কৃষকই ঋণ নিয়ে আবাদ করেছে। চলতি মৌসুমে কম দাম্ইে তাদের ধান না বেচলেই নয়। কৃষকদের হিসাব অনুযায়ী প্রতি মণ ধাণের উৎপাদন খরচ হয়েছে প্রায় ৭০০ টাকা। তার মানে বিনিয়োগ ও আয়ের হিসাবে ধান আবাদে লোকসান দিচ্ছে কৃষক। আধুনিক কৃষি অনুশীলনরত ধান আবাদের এই নেতিবাচক বাস্তবতা এদেশের প্রায় সকল কৃষকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
তবে নয়াকৃষি অনুশীলনরত কৃষকদের বাস্তবতা খুবই ইতিবাচক। কৃষ্ণপুর, নয়াকৃষি অধ্যুষিত একটি গ্রাম। প্রায় এক দশকের বেশী সময় ধরে প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা অথ্যাৎ নয়াকৃষি পদ্বতি অনুশীলনে চাষাবাদ করে আসছে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের কৃষক। খলিসাডাংগা নদীর তীর ঘেষে কৃষ্ণপুর গ্রামের অবস্থান। গ্রামের চাষাবাদ ব্যবস্থা নিয়ে কথা হলো কৃষক নাসিমা, আফিয়া, শুকচান, জয়নাল ও ছফুরা বেগমসহ ১৯ জন কৃষকের সাথে। নয়াকৃষি চাষাবাদ ব্যবস্থায় তাদের মাঝে বিরাজমান সুখ ও সমৃদ্বির বিষয়টি আলোচনার মাঝেই ফুটে উঠছিল। কৃষকরা জানালেন, নয়াকৃষি অনুশীলনে স্থানীয় জাতের ফসলের আধিক্য ও বৈচিত্রতা অনেক বেশী।
কৃষ্ণপুর গ্রামে স্থানীয় জাতের আউশ ধানের আবাদের মধ্যে প্রধানত রয়েছে: কালাবকরী, কালামানিক, শংকপটি, ভ্ইরা, মুলকেআউশ, ষাইটা, ভাতুরী, যশোরী। আমন ধানের চাষাবাদের মধ্যে প্রধানত রয়েছে: হিদা, দলাদীঘা, ভইলটা, জামরুল, কার্তিকশাইল, পাটজাগ, ময়নাগিরি, দিঘা, ঢেপা, পাতিশাইল ইত্যাদি। বোরো আবাদের মধ্যে প্রধানত রয়েছে: ষাইটা বোরো, টোপা বোরো, জাগলি বোরো, বি আর ২৯ ও বি আর ২৮। মৌসুম অনুযায়ী ডাটা, লালশাক, পালংশাক, পুঁইশাক, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, করল্লা, ছিচিংগা, ধুন্দল, ঝিংগা, ঢেড়স, বেগুন, টমেটোসহ প্রধানত স্থানীয় জাতের শাকসব্জির চাষ হয়। তৈল জাতীয় ফসলের মধ্যে প্রধানত চাষ হয় সরিষা, রাই, তিল ও তিষি। মুগ, মুসুরী, খেসারী ও মাসকলাই ডালজাতীয় ফসল হিসেবে নিয়মিত চাষ হয়। মসল্লার আবাদের মধ্যে প্রধানত রয়েছে: পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, কালিজিরা, মেথী, আদা, মরিচ ও হলুদ। আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, বেল, জামরুল, কদবেলসহ স্থানীয় জাতের নানা রকম ফসলের বৈচিত্র্য বিদ্যমান। শান্তি, কাটাশুড়, তেলাকুচা, কলমি, হেলেন্চা, ঢেকিশাক, সেন্চি,ডোলকলমিসহ ৩৯ জাতের কুড়িয়ে পাওয়া শাকের সমারোহ বিশেষ করে গরীব ও প্রান্তিক পরিবাররের খাদ্য নিরাপদতা ও খাদ্য নিরাপত্তায় গুরত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
খলিসাডাংগা নদীর সাথে গ্রামের আবাদী জমির মিতালির কারণে গ্রামটি স্থানীয় মাছের বৈচিত্র্যতায় অনেক সমৃদ্ব। স্থানীয় জাতের মাছের মধে প্রধানত রয়েছে: পুটি, টেংরা, মসি, ফাতাসি, গুছি, ব্ইাম, টাকি, শৈল, বোয়াল, গজার, ভেদা, দাড়কি, খৈলসা, চান্দা, বুতুম, ডানকিনি ইত্যাদি। চাষের মাছের মধ্যে প্রধানত রয়েছে: নলা, কাতল, রুই, মৃগেল, গ্রাসকাপ, সিলভার কাপ, ব্রীগেট, তেলাপিয়া, কারপু, চিতল, পাংগাস ইত্যাদি। গ্রামবাসীরা আষাঢ় থেকে ফাল্গুন বছরে প্রায় নয় মাস উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ ধরে নিজেরা খায় এবং গরীর পরিবারগুলোর একটি অংশ বাজারে বিক্রি করে পরিবারের অন্যান্য চাহিদা পূরণ করে।
গ্রামের অর্থকরী ফসলগুলোর মধ্যে প্রধানত রয়েছে: পাট, রসুন, পেঁয়াজ, মুগ, মুসুর, খেসারী, কালিজিরা ও ধনিয়া। বি আর ২৮ ও বি আর ২৯ ধান খলিসাডাংগা নদীর ধারে কিছুটা জমিতে উৎপাদন হয়; তবে এর পুরাটাই কৃষকরা বিক্রি করে দেন। স্থানীয় জাতের আউশ, আমন ও বোরো ধান নিজেদের খাওয়ার জন্য রাখেন।
নয়াকৃষি নির্ভর স্থানীয় জাতের ফসলের বৈচিত্র্যতা সমৃদ্ব কৃষ্ণপুর গ্রামরে চাষিরা শস্যাবর্তন পদ্বতি অনুসরন করে মিশ্র ও আন্তফসল চাষাবাদের মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশ বান্ধব চাষাবাদে উতপাদনশীলতায় ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছে।
কৃষ্ণপুর গ্রামের মাঠ ঘুরে দেখা দেখা গেল বিস্তৃীর্ণ প্রায় পুরো মাঠে সেচনির্ভর বোরো ধানের কোন আবাদ নাই। চৈত্রের শেষে মাঠে বুনা হয়েছে স্থানীয় বিভিন্ন জাতের পাট। অংকুরোদগম হয়ে পাটের চারাগাছগুলো সবুজ শ্যামলরুপে পুরো মাঠে ছড়িয়ে গেছে। কৃষকদের অভিজ্ঞতায় আষাঢ় মাসের প্রথম দিকে পাট ৬/৭ হাত লম্বা হয়ে যাবে। তখন পাটের ভিতর কালাবকরী ও অন্যান্য আউশ ধানের বীজ বপন করা হবে। পাটের ফসলের অভ্যন্তরে যথেষ্ট আদ্রতা থাকার কারণে ধান দ্রুত অংকুরোদগম হয়ে বড় হতে থাকবে। ধান বুনার ১৫/২০ দিন পর পাট কেটে ফেলা হবে। পাট কাটার পর উন্মুক্ত পরিবেশে ধান দ্রৃুত বাড়তে থাকবে। ধানের জমিতে প্রয়োজন অনুসারে আগাছা পরিষ্কার ও নিড়ানি দেওয়া হরে বলে কৃষকরা জানান।
ধান কাটা হবে কার্তিক মাসের প্রথম সপ্তাহে। ধান কাটার পর একই জমিতে কৃষকদের রসুন লাগানোর পরিকল্পনা রয়েছে। প্রায় তিন হাত ধান গাছের দুই হাত কাটা হবে এবং এক হাত নাড়া আকারে জমিতে রেখে দেওয়া হবে। ধান কাটার পর নাড়া এক হাত আলাদা করে কেটে রাখা হবে। জমি তখন একটু কাদাযুক্ত থাকবে। কাদাযুক্ত হাল্কা নরম মাটিতে রসুন এক কোয়া করে বুনে দেওয়া হবে। প্রয়োজন অনুসারে মাঝে মধ্যে নিড়ানী দেওয়া হবে। রসুন তোলা মৌসুমে শস্যাবর্তন পদ্বতিতে একই জমিতে গম বা ডালের আবাদ করা হবে।
কৃষকদের প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ী প্রতি হেক্টর জমিতে পাট চাষে (জমি চাষ, বীজ, নিড়ানী, জৈব সার, শ্রমিক)মোট খরচ হয় ৩৫,২৪৭ টাকা। মোট পাট উৎপাদন হয় ৬৭ মণ যার বাজারমূল্য পাটখড়িসহ ১,২৪,০০০ টাকা। প্রতি হেক্টর জমি থেকে কৃষকের লাভ হয় ৮৮,৫৭৩ টাকা।
পাটের সাথে মিশ্র আউশ ধান চাষে প্রতি হেক্টর জমিতে কৃষকের মোট খরচ(জমি চাষ, বীজ, নিড়ানী, জৈব সার, শ্রমিক) হয় ৩৫২৪৭ টাকা। মোট ধান উৎপাদন হয় ৬০ মণ যার বাজারমূল্য খড়সহ ৫১,০০০ টাকা। প্রতি হেক্টর জমি থেকে কৃষকের লাভ হয় ৩৫,৯৩৫ টাকা।
আউশ ধানের সাথে রসুন চাষে প্রতি হেক্টর জমিতে কৃষকের মোট খরচ(জমি চাষ, বীজ, নিড়ানী, জৈব সার, শ্রমিক) খরচ হয় ১,৭০,২০০ টাকা। মোট রসুন উতপাদন হয় ২২০ মণ যার বাজারমূল্য ৪,৪০,০০০ টাকা। প্রতি হেক্টর জমি থেকে কৃষকের রসুন চাষে লাভ হয় ২,৬৯,৮০০ টাকা।
কৃষ্ণপুর গ্রামসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় নয়াকৃষি কৃষকদের অভিজ্ঞতায় প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর নয়াকৃষি ব্যবস্থা অনুশীলন প্রাকৃতিক, পরিবেশসম্মত, উতপাদনশীলতায় সমৃদ্ব ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। ফলে প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষি ব্যবস্থার বিস্তার দেশের কৃষি ও কৃষকের সমৃদ্বির ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।