মিশ্র ফসলের আনন্দ
শীতকাল শাক-সব্জির উৎপাদনের মৌসুম। এই সময় ফসলের ক্ষেত দেখতে খুব রঙ্গিন লাগে। কারণ বেশিরভাগ পাতা সবুজ হলেও তেল, মসলা ও শাকের বৈচিত্র্য রং ছড়িয়ে দেয়। সরিষা থাকলে তো কথাই নেই। চারিদিকে হলুদের ছড়াছড়ি। চোখ ধাঁধানো হলুদ রং।
নয়াকৃষি এককাট্টা ফসল করে না, কয়েক রকমের ফসলের মিশ্রণ ঘটিয়ে চাষ করয়ে। তাই সরিষার হলুদের মধ্যেও অন্য রং দেখা যায়। মিশ্র ফসল এবং আন্ত-ফসল করা নয়াকৃষির ১০ নীতি একটি প্রধান নীতি। নয়াকৃষির দশ নীতি শুরু হয়েছে কীটনাশক ব্যবহার না করার অঙ্গীকার দিয়ে। কীটনাশক দেয়া বন্ধ করলে ফসলে পোকা দমন বা ব্যবস্থাপনা একটি সুন্দ্র উপায় হচ্ছে মিশ্র ফসল পদ্ধতিতে চাষ। ফসলের মিশ্রণ দিয়ে মাটির পুষ্টি রক্ষা, পোকা ব্যবস্থাপনা এবং ফলন বৃদ্ধি সবই সম্ভব হয়। কৃষকের আয়ও ভাল হয়, এবং ফসলের যে ঝুঁকি থাকে তাও সমাধান করা যায়। এক ফসলের ঝুঁকি অন্য ফসল দিয়ে ঠেকানো যায়। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, মিশ্র ফসলের জমিতে একাধিক অনাবাদী শাক বেড়ে ওঠে যা খেতে সুস্বাদু, পুষ্টিকর এবং বিক্রি করেও আয় করা যায়।
অনাবাদী শাক বা কুড়িয়ে পাওয়া শাক তোলায় সকলের অধিকার স্বীকৃত। যার জমি নয়, সেও এসে দুটো শাক তুলে নিতে পারে। সাধারণৎ গ্রামের গরিব নারী ও শিশুরা তাদের বাড়ীর কাছে মাঠ থেকে তুলতে পারেন। কেউ তাদের বাধা দেবে না।
এখানে মিশ্র ফসলের কয়েকটি মাঠের ছবি দেয়া হোলঃ
১। মূলা ও লাল শাকের মিশ্রণ
এই জমিতে মূলা ও লালশাক লাগানো হয়েছে।পৌষ মাসের শুরুতে লালশাক তোলা হয়।মূলা প্রথমে শাক হিসেবে তোলা হয় পরে সব্জি হিসেবে মাঘ মাসের শেষ পর্যন্ত মূলা উঠানো যায়। এই সময় লালশাক শেষ হয়ে গেলেও মূলা থাকে। এরই সাথে অনাবাদী শাক হেলেঞ্চা ও দন্ডকলস অনেক দেখা যায়।
মূলা এবং লাল শাক থেকে কৃষকরা খুব কম সময় অথাৎ দেড় মাসের মধ্যে আয় পেতে থাকে। মূলা যখন ছোট থাকে তখন শাক আকারে বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকে। কৃষকরা শাক আকারে তখন বাজারে বিক্রি করে।তারপর কয়েক দিন পরে বড় হলে সব্জী হিসাবে বাজারে বিক্রি হয়। ৩৩ শতাংশ (এক বিঘা) জমিতে মূলা শাক ও মূলা থেকে আয় ১৩ হাজার এবং লাল শাক থেকে ৪ হাজার মোট প্রায় ১৭ হাজার টাকা আয় পাওয়া যায়।
২. পেঁয়াজ, রসুন, ডাঁটা ও সরিষার মিশ্রণ
মসলা,তেল ও সব্জি ফসলের মিশ্রণ এই জমিতে হচ্ছে- পেঁয়াজ, রসুন, ডাঁটা ও সরিষা। চৈত্র মাসের শেষ থেকে পেঁয়াজ ও রসুন উঠানো শুরু হবে। ফাল্গুন মাসে মাঠ থেকে সরিষা ওঠে।শীত মৌসুমে সাধারনত ডাঁটা সব্জী আকারে ব্যবহার করা হয়।তবে মাঘ ফাল্গুনে ডাঁটা লাগালে কার্তিক মাসে বীজ হবে।
সাথে বেড়ে ওঠে বথুয়া শাক ও হেঞ্চি শাক।অনাবাদী শাক বথুয়া ও হেঞ্চি শাক শীত মৌসুমে প্রচুর পরিমানে হয়ে থাকে। জমির মালিক ছাড়াও গ্রামের যে কেউ এ গুলো সংগ্রহ করে খেতে পারে। জমির মালিক কিছু বলবে না।আবার গ্রামের অনেক গরীব মানুষ আছে যারা শীত মৌসুমে বথুয়া শাক ও হেঞ্চি শাক বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করে।আর এই শাকের চাহিদাও বেশ ভাল খেতে ও অনেক সুস্বাদু।
পেঁয়াজ,রসুন,ডাটা এবং সরিষা মিশ্র চাষে এক বিঘা জমি থেকে এক মৌসুমে পেঁয়াজ ৭ হাজার টাকা,রসুন ৪ হাজার টাকা,ডাঁটা ২ হাজার টাকা, সরিষা ২ হাজার টাকা আয় হয়।অনাবাদী ফসল থেকেও ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা আয় হতে পারে।এই জমিতে আয় হতে পারে ১৬২০০ টাকা।
৩। মিশ্র ফসল ও আশ-পাশের জমি
এই মিশ্র ফসলের জমিতে মূলা ও লালশাক আছে। পাশের জমিতে একক ফসল বিআর-২৯ ধান, মূলা,সীম আছে।মিশ্র ফসলের এই মাঠটি এককাট্টা ফসলের একঘেয়েমি ভেঙ্গে দিয়ে আরামদায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করছে। সাথে অনাবাদী কলমিশাক ও হেঞ্চি শাক দেখা যাচ্ছে।
শীতকালে রবি মৌসুমে মিশ্রভাবে লালশাক, মূলা চাষ করা হয়।পৌষ মাসের শুরুতে লালশাক তোলা হয়।লালশাক শেষ হয়ে গেলেও মাঘ মাসের শেষ পর্যন্ত মূলা উঠানো যায়।
এক মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে মুলা ও লাল শাক মিলে ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা আয় হতে পারে। কুড়িয়ে পাওয়া শাক বিক্রি হতে পারে ১০০০ থেকে ১২০০ টাকার পরিমান।
৪। মিশ্র ফসলের পাশে সীম ক্ষেত
মূলা ও লালশাকের মিশ্র ফসলের পাশের ক্ষেতে বড় সীম আছে। জমিতে বেড়ে উঠেছে অনাবাদী দন্ডকলস, হেঞ্চি ও বথুয়া।
লাল সাক ও মূলার ফসল লাগানোর এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে কুড়িয়ে পাওয়া শাক বথুয়া,দন্ডকলস তুলে শেষ করতে হবে। ফুল হয়ে গেলে এটা আর খাওযার উপযোগী থাকবে না। তেত্রিশ শতাংশ (এক বিঘা) জমিতে মূলা এবং লাল শাক থেকে ১৫ থেকে ১৭ হাজার টাকা আয় হয়। দন্ডকলস, হেঞ্চি, বথুয়া কুড়িয়ে পাওয়া শাক ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকার বিক্রি হতে পারে।
৫. বেগুন, ধনিয়া ও লালশাক
স্বল্প ও কিছুটা দীর্ঘ মেয়াদি ফসল বেগুন, ধনিয়া ও লালশাকের মিশ্রণ।লাল শাক পৌষ থেকে উঠে যায় আর বেগুন চৈত্র-বৈশাখ মাসে বেগুন সংগ্রহ করা হয়।সাথে জমিতে গড়ে ওঠা অনাবাদী শাক কাটানটে ও বথুয়া পৌষ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত সংগ্রহ করা যায়।
এক মৌসুমে এক বিঘা জমিতে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকার বেগুন সংগ্রহ করা যায়। লাল শাক ২ থেকে ৩ হাজার টাকার সংগ্রহ করা যায়। ধনিয়া এক বিঘা জমি থেকে ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার বিক্রি করা যায়। এবং ১ হাজার থেকে ১২০০ টাকার কুড়িয়ে পাওয়া শাক বিক্রি করা যায়।
৬. পাশাপাশি জমিতে নানা ফসলের মিশ্রণ
একই জমিতে নয়, পাশাপাশি জমিতে মূলা ও আলু চাষ করা হয়েছে। জমিতে বথুয়া, ও দন্ডকলস পাওয়া যাচ্ছে।পৌষ মাসের শুরু থেকে মাঘ মাসের শেষ পর্যন্ত মূলা তোলা যাবে। ফসল লাগানোর এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে কুড়িযে পাওয়া শাক বথুয়া,দন্ডকলস তুলে শেষ করতে হবে। এক বিঘা জমিতে (৩৩ শতাংশ) জমিতে আলু হবে ৮ থেকে ৯ হাজার টাকা এবং মূলা হবে ১১ হাজার টাকার পরিমান।
৭. দুইয়ের অধিক ফসলের মিশ্রণ
সব্জি ফসল গাজর, পাতাকপি ও টমেটো,মাসলা পেঁয়াজ ও রাই সরিষা এবং মাঝে গেঁদা ফুল। গন্ধ ও রঙয়ের দ্বারা পোকা তাড়াবার ব্যবস্থা। অনাবাদী শাক দন্ডকলস, কাটানটে ও বথুয়া গড়ে উঠেছে। পৌষ মাসের শুরুতে গাজর তোলা হয়।মাঘ মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত গাজর উঠানো হয়।ফসল লাগানোর এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে কুড়িযে পাওয়া শাক দন্ডকলস, কাটানটে, বথুয়া শাক তোলা যায়।পাতাকপি, টমেটো পৌষ মাস থেকে সংগ্রহ করা যাবে, রাই সরিষা ফাল্গুন মাসে সংগ্রহ করা যাবে, পেয়াজ চৈত্র মাস।
গাজর, টমেটো, রাইসরিষা, পাতাকপি ও পেঁয়াজ মিশ্রভাবে চাষাবাদে একবিঘা জমিতে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা আয় হয়।
৮. অর্থকরি ফসলের মিশ্রণ
আলু ও ভুট্টা অর্থকরি ফসল হিশেবে অনেকে এককাট্টা চাষ করেন। কিন্তু নয়াকৃষির কৃষক মিশ্র ফসল করেই লাভবান হচ্ছেন।পৌষ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত আলু সংগ্রহ করা যায়। চৈত্র শেষ থেকে বৈশাখ মাসের শেষ পর্যন্ত ভুট্রা উঠানো যায়।
সাথে দন্ডকলস ও বথুয়া গড়ে উঠেছে।অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র/বৈশাখ পর্যন্ত কুড়ানো শাক দন্ডকলস ও বথুয়া সংগ্রহ করা যায়।এক মৌসুমে,এক বিঘা জমিতে ভুট্টা প্রায় ৯ হাজার ও আলু থেকে আয় হবে প্রায় ১২ হাজার টাকা আয় হয়।
৯. নানাভাবে ফসলের মিশ্রণ
মিশ্র ফসল নানাভাবে সাজানো যায়। এখানে মূলা, আলু, পেঁয়াজ ও ধনিয়ার মিশ্র ফসল করা হয়েছে তবে পেঁয়াজ একটু জমির মাঝে লাইন করে দেয়া হয়েছে।পৌষ মাসের শুরু থেকে মাঘ মাসের শেষ পর্যন্ত মূলা তোলা যাবে। পৌষ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত আলু সংগ্রহ করা যায়।চৈত্র মাসের শেষ থেকে পেঁয়াজ উঠানো শুরু হবে।
অনাবাদী শাক হেঞ্চি ও বথুয়া এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে তুলে শেষ করতে হবে। বথুয়া ও হেঞ্চি শাক শীত মৌসুমে প্রচুর পরিমানে অনাবাদী হয়ে থাকে। জমির মালিক ছাড়াও গ্রামের যে কেউ এ গুলো সংগ্রহ করে খেতে পারে।এক বিঘা জমিতে মূলা ৫ হাজার টাকা, আলু ৮ হাজার টাকা, পেঁয়াজ ৩ হাজার ধনিয়া ২ হাজার টাকা সহ মোট প্রায় ১৮ হাজার টাকা আয় হবে।
১০. দীর্ঘ মেয়াদী ফসলের সাথে স্বল্প মেয়াদী ফসল
শসা দীর্ঘ মেয়াদী এবং জমির যথেষ্ট ব্যবস্থাপনার দরকার। বাঁশের জাংলা করার খরচও আছে। নয়াকৃষিঢ় কৃষক শসা গাছ বড় হবার আগেই জমিতে লাল শাক লাগিয়ে পৌষ মাস থেকেই আয় করে ফেলছেন। তখন রোদ পেতেও সমস্যা নেই। এরই মধ্যে হেঞ্চি, হেলেঞ্চা ও কাটানটে গড়ে উঠেছে। পৌষ/মাঘ মাস থেকে বৈশাখ/জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত কুড়ানো হেঞ্চি, হেলেঞ্চা,কাটানটে শাক সংগ্রহ করা যায়। আষাঢ় থেকে অগ্রাহায়ন মাস পর্যন্ত শসা সংগ্রহ করা হয়।
লাল শাক ৩ হাজার টাকা ও শসা এক বিঘা জমিতে ১৮ হাজার টাকা সহ মোট আয় হবে ২১ হাজার টাকা প্রায়।বাড়তি আয় প্রায় ১২০০ টাকা আসছে অনাবাদী শাক থেকে।
১১. একাধিক ফসলের ঘন মিশ্রণ
বরবটি, লালডাঁটা, টমেটো ও সরিষার মিশ্রণ। অল্প জমিতে একাধিক ফসল ঘন করয়ে লাগানো হয়েছে।পৌষ মাস থেকে ফাল্গুন মাসের শেষ পর্যন্ত বরবটি তোলা যায়। শীত মৌসুমে সাধারনত ডাঁটা সব্জী আকারে ব্যবহার করা হয়। তবে মাঘ ফাল্গুনে ডাঁটা লাগালে কার্তিক মাসে বীজ হবে। পৌষ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত টমেটো সংগ্রহ করা যায়। ফাগুুন মাসে মাঠ থেকে সরিষা ওঠে।
অনাবাদী শাক দন্ডকলস ও কাটানটে পৌষ/মাঘ থেকে বৈশাখ/জ্যৈষ্ঠ মাস সংগ্রহ করা যায়।
এক বিঘা জমিতে বরবটি ৪ হাজার টাকা, লালডাঁটা ২ হাজার টাকা,টমেটো ৫ হাজার টাকা, সরিষা ৪ হাজার টাকা মিশ্রভাবে চাষ করলে ১৫ হাজার টাকা আয় হয়।