নয়াকৃষি আন্দোলন
নয়াকৃষি এক কথায় প্রাণের চর্চা -- অর্থাৎ প্রাণের সুরক্ষা, বিবর্তন ও বিকাশের সামগ্রিক ও সপ্রাণ ব্যবস্থাপনার চর্চা। এর লক্ষ্য আনন্দময় জীবনযাপন। জীবনকে তার সারবত্তাসহ অনুভব, উপলব্ধি ও উপভোগ। কর্মে, জ্ঞানে, জীবনযাপনে প্রাণের স্বাদ পুরাপুরি গ্রহণ করতে চায় নয়াকৃষি। নিরন্তর আনন্দ তার লক্ষ্য।। জগত কেবলি ভোগের বস্তু নয়, ওপর আধিপত্য, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যক্তিগত মালিকানা সম্পর্কের পরিবর্তে সকলে মিলে অন্তরঙ্গ ও আনন্দময় সম্পর্কের স্ফুর্তি ঘটানোই নয়াকৃষির কাজ।
নয়াকৃষি কৃষকদের আন্দোলন। বিষ কোম্পানির প্ররোচনায় কৃষিতে বিষ ব্যবহারের যে ভয়ংকর অভ্যাস গড়ে উঠেছে নয়াকৃষি তা অবিলম্বে বন্ধ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয়। পরিবেশ, প্রাণ ও প্রাণবৈচিত্রের কোন ক্ষতি না করে চাষাবাদ কিভাবে করা যায় কৃষকদের সেই চেষ্টা থেকে নয়াকৃষি আন্দোলনের জন্ম। যারা শুধু কৃষির ফলনে আগ্রহী তঁরা জেনে খুশি হবেন যে নয়াকৃষি চাষাবাদে কোন প্রকার রাসায়নিক সার ও বিষ বা কীটনাশক ব্যবহার ছাড়া পরিবেশ অনুযায়ী দেশীয় জাতের বীজ থেকে একর প্রতি ফলন বৃদ্ধির পদ্ধতির নাম নয়াকৃষি। নয়াকৃষিতে ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে সেচের জন্য মাটির তলা থেকে পানি তোলা হয় না, বরং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও মাটির ওপরের পানি ব্যবহারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নয়াকৃষিতে একাট্টা ফসল না করে মিশ্র ফসলের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। নয়াকৃষির কৃষকরা এই ধরণের দশটি নীতি বা নিয়ম অনুসরন ও চর্চা করেন।
নয়াকৃষি খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করবার আন্দোলন। কিন্তু নয়াকৃষি শুধু মানুষের জন্য খাদ্য নিশ্চিত করে সন্তুষ্ট নয়, একই সঙ্গে সকল প্রাণ ও প্রাণীর খাদ্য নিশ্চিত করবার আন্দোলন। প্রাণের রক্ষা, বিবর্তন ও বিকাশের মধ্য দিয়েই সমৃদ্ধি, শান্তি ও আনন্দ লাভ সম্ভব -- নয়াকৃষির কৃষকরা তা বিশ্বাস করে।
নয়াকৃষি চাষাবাদ পদ্ধতির মানে প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন কোন হানাদারি বা ক্ষতিকর কাজ সতর্কতার সঙ্গে পরিহার করা। চাষাবাদের অর্থ শুধু মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন নয়; বরং মানুষের খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে পশু, পাখি, কীটপতঙ্গসহ প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণের আহার জোগানো এবং তাদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। শুধু খাদ্য নয়, নয়াকৃষি মশলা, ঔষধ, জ্বালানি, ঘর ও আসবাবপত্র নির্মাণ সামগ্রী, ঔষধ, সুতা – অর্থাৎ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জন্য যা কিছু দরকার তার সবকিছুই উৎপন্ন করে।
নয়াকৃষি তার ভাবগত দিকের চর্চার জন্য নবপ্রাণ আন্দোলনের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে কাজ করে। বাংলার ভাবান্দোলনের ধারার অভ্যন্তর থেকেই নয়াকৃষির উৎপত্তি ও বিকাশ।
মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির আনন্দময় সম্পর্ক নির্মাণ, আনন্দময় চাষাবাদ
নয়াকৃষি ধারণার উদয়ের ইতিহাস
বানভাসি বাংলাদেশে ১৯৮৮ সালের বন্যায় একদিকে তাঁতী আর অন্যদিকে কৃষকদের দুর্দশা লাঘবের চেষ্টা চলছিল টাঙ্গাইলে উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণার (উবিনীগ) উদ্যোগে। সেই সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে প্রাণ ও প্রকৃতির সুরক্ষা ও বিকাশের তাগিদে ১৯৯০-এর দিকে নয়াকৃষি ধারণার উদয়।
প্রকৃতি ও প্রাণের সুরক্ষা ও বিকাশের তাগিদে নয়াকৃষি একান্তই কৃষকদের গবেষণার ফল, জ্ঞান-বিজ্ঞানের জগতে বাংলাদেশের কৃষকদের নিজস্ব অবদান।
নয়াকৃষি আন্দোলনের ভাব ও প্রাথমিক চর্চা গড়ে উঠেছিল উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)-এর অনুপ্রেরণায়। কৃষকের দৈনন্দিন লড়াই সংগ্রামের ভেতর থেকেই ভাব, ভাষা ও কাজের প্রক্রিয়া গড়ে গঠে। অতএব উবিনীগ শুরু থেকেই কৃষকদের নেতৃত্বে কৃষকদের মধ্যে কাজ শুরু করে। ফলে শুরু থেকেই স্বাধীনভাবে কৃষকদের নিজেদের লড়াই-সংগ্রাম হিসাবে নয়াকৃষি আন্দোলন গড়ে উঠতে থাকে। ক্রমে ক্রমে নিজস্ব ভাব, সংগঠন ও কাজের নতুন পদ্ধতি হিশাবে নয়াকৃষি দেশে বিদেশে পরিচিত হয়ে ওঠে।
প্রথমে কাজ শুরু হয় টাঙ্গাইল জেলায়। নয়াকৃষি আন্দোলন এখন টাঙ্গাইল ছাড়িয়ে আরো জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
হাজার বছর ঘরে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলিয়ে যাঁরা আমাদের আহার জুগিয়েছেন তাঁদের প্রতিদিনের অভিজ্ঞতার ওপর গড়ে উঠেছে কৃষিসভ্যতা। শহরকেন্দ্রিক আধুনিক সভ্যতার দাবি হচ্ছে কৃষি, কৃষক ও কৃষিসভ্যতার ধ্বংসই নাকি প্রগতি ও অগ্রগতির পূর্বশর্ত! এই নষ্টচিন্তা দিয়ে দুনিয়ার খাদ্যব্যবস্থা অল্প কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি কুক্ষিগত করেছে, প্রকৃতি ও মানুষ আজ পরিণত হয়েছে এগ্রোবিজনেসের গোলামে
কৃষকই ভাবুক, কৃষকই কর্ম্যােদগী, কৃষকই নেতা
নয়াকৃষি আন্দোলনের নেতা, ভাবুক আর উদ্যোগী স্বয়ং কৃষকরাই। কৃষকদের চেয়ে স্কুল কলেজে তুলনামূলক ভাবে বেশীদিন পড়েছেন এমন দুই একজন মানুষ সবসময়ই কৃষকদের সঙ্গে ছিলেন, এখনও আছেন। কিন্তু তাঁরা ফুটুর ফাটুর শিক্ষার গরিমা নিয়ে মাঠে নামেন নি, বরং গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে কাজ করতে আর কাজ শিখতে গিয়েছিলেন।
নয়াকৃষি আন্দোলন স্বাক্ষর ও নিরক্ষর উভয় সংস্কৃতির মানুষকেই বদলে দেয়। এই স্বাক্ষর/নিরক্ষরের কৃত্রিম বিভাজন ভাঙার কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও আবিষ্কার ত্বরান্বিত হয়। নয়াকৃষি মনে করে কাজ ছাড়া জ্ঞান নাই, জ্ঞান ছাড়া কাজ নেই। সার্টিফিকেটওয়ালা স্কুল-কলেজ পাশ দেওয়া ‘শিক্ষা’ পেলেই তাকে শিক্ষা বলে না, আমরা কি শিখেছি তা একমাত্র কাজের মাধ্যমেই ধরা পড়ে। হাতেনাতে কৃষি কাজ এবং কাজের মধ্য দিয়ে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চাই সত্যিকারের জ্ঞানচর্চা। এই জ্ঞানের সঙ্গে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে সার্টিফিকেট পাওয়ার তুলনা চলে না। সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের লড়াই-সংগ্রামে গড়ে ওঠার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাধনার মধ্যে শুরু থেকেই এই দুইয়ের মিলন ঘটাবার জন্য কাজ করে যাচ্ছে নয়াকৃষি আন্দোলন।
বুদ্ধি কি আর আলস্যে হয়?
পরিশ্রমেই জ্ঞানের উদয়।
দুর্যোগ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা ও নয়াকৃষি
অষ্টআশি সালে দুর্যোগ মোকাবিলার অভিজ্ঞতা টাঙ্গাইলে অনেকগুলো গ্রামে তাঁতী, কৃষক ও অন্যান্য পেশার মানুষগুলোকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা নিয়ে ভাবাভাবি সমাধানের উদ্যোগ নিতে শুরু করেন গ্রামবাসীরাই। এই চর্চার মধ্যে ব্যক্তির অভিজ্ঞতা সমষ্টির জ্ঞান হিশাবে দানা বাঁধে। নিজের জীবনে খেটে খাওয়া মানুষ সবসময়ই কিছু না কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেই থাকে। কাজের মানুষ যখন নিজেদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার মর্যাদা বুঝতে শিখল তখন তা এক অভূতপূর্ব শক্তি হয়ে হাজির হোল তাদের কাছে।
অষ্টআশির (১৯৮৮) ঘোর বন্যা নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে কৃষকদের ফেলে দেয়। বৃষ্টি, নদীব্যবস্থা ও পলিমাটির পরিবহন ও কৃষির সম্পর্ক যেন নতুন করে কৃষক আবিষ্কার করলেন। প্রকৃতির প্রথম পাঠ নিলেন তারা। বন্যার বিপদের দিক যেমন আছে, তেমনি আছে সম্ভাবনা। প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক হবে পারস্পরিক। নিয়ন্ত্রণ নয়, প্রকৃতির সজ্ঞান ব্যবস্থাপনাই হবে মাটি, পানি ও প্রাণসম্পদে সমৃদ্ধ সবুজ বাংলাদেশে উন্নত জনপদ ও সভ্যতা গড়ে তোলার পথ।
কৃষক যখন তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি পায় ও জ্ঞানচর্চায় আন্তরিক উৎসাহ পেতে থাকে তখন তার মধ্যে আবিষ্কারের তাগিদও তীব্র হয়। হাজার বছর ধরে কৃষকের আবিষ্কারেই কৃষিব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছে। নয়াকৃষি উৎসাহ পেয়ে কৃষিব্যবস্থাকে আরো উন্নত ও বিকশিত করে তুলছে কৃষক।
সরাসরি প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন, সম্পর্ক যাপন এবং নানান অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে জানার বিপরীতে বইয়ের মাধ্যমে জানার পার্থক্য খুব সহজেই কৃষক বুঝলেন, কারণ বন্যার সময় বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে বিদেশী সাহায্যের নামে কোটি কোটি ডলার খরচ হচ্ছিল বন্যা ‘নিয়ন্ত্রণ’-র জন্য। বানের পানি আটকে দেবার মহা পরিকল্পনা চলছিল তখন। ইন্দ্রিয়নির্ভর প্রত্যক্ষ জ্ঞানের শক্তির সঙ্গে ‘শিক্ষিতা’ বা সাক্ষর জগতের পুস্তকি বিদ্যার গুণগত পার্থক্য বুঝতে কৃষকের সময় লাগল না। শিক্ষিত শ্রেণীর অহংকারী মূর্খতা, অজ্ঞানতা ও অযোগ্যতার বিপদ কৃষক সমাজ নিজ চোখেই দেখল ও করতে শিখল।
কৃষক তার অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা নিরীক্ষা থেকেই বোঝেন যে বন্যা মাত্রই মন্দ ব্যাপার নয়, বনভাসি বাংলাদেশ মাত্রই দুর্যোগ নয়। নদী পলি নিয়ে আসে দুরদূরান্তের পাহাড় পর্বত হিমালয় থেকে। দুকুল বানের জলে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে যেতে, পলি ফেলতে ফেলতে বঙ্গোপসাগরের দিকে ছোটে, মাঝে মধ্যে চিক চিক বালিও। পলিতে উর্বর হয়ে ওঠে জমি। মাঝে মধ্যে বালি সর্বনাশও বয়ে আনে, কিন্তু মোট ফল কৃষি ও কৃষকের অনুকূলে। নদী, পানির প্রবাহ চক্র, পলির উর্বরতা, আবহাওয়া আর ভূগোলের ভিন্নতা এলাকা ভেদে বিশেষ ধরণের শস্যের সুবিধা তৈরি করছে বৈচিত্র্যময়ী প্রকৃতি নিজেই। প্রকৃতির এই কায়কারবার আরো কী করে বোঝা যায়, কাজে লাগানো যায় সেই দিকে কৃষকরা মাথা খাটাতে শুরু করলেন। পলি ধরে রাখা এবং উর্বর জমিকে আরো উর্বর করবার পথ খুঁজতে নামলেন তাঁরা। নানান ধরণের বৈচিত্র্যময় ফসলের যে-সংবাদ কৃষকদের মৌসুমের চক্রাবর্তের মধ্য দিয়ে কৃষককে প্রকৃতি জানায় তাকে আরো জানা ও নতুন ধরণের আবাদের কথা ভাবতে শুরু করলেন তাঁরা। এই ভাবেই কৃষকের দৈনন্দিন জীবনের লড়াই-সংগ্রামের অবিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠল নয়াকৃষির বিজ্ঞান।
জ্ঞানের বীজ সবার মধ্যে
বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের বিরুদ্ধে একটি কায়েমী প্রচারণা জারী আছে; কৃষক বা সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষ জানে না কী করে খাদ্য উৎপাদন করতে হয়, বন্যা থেকে রক্ষা করতে হয়, প্রকৃতির শক্তি আহরণ করতে হয় - জানে কেবল শোষক ও শাসক শ্রেণীর শিক্ষায় ‘শিক্ষিত’ বিশেষজ্ঞ গোষ্ঠি - যাদের অধিকাংশই কোম্পানির স্বার্থের কাজ করে; কৃষি বা কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন বা অধিক খাদ্য ফলানো মানে শুধুমাত্র ‘আধুনিক’ জ্ঞান ও টেকনলজির প্রয়োগ ও বিস্তার ইত্যাদি। এই কায়েমী চিন্তার আসল উদ্দেশ্য জ্ঞানজগতের নতুন দিগন্ত ও আবিষ্কারে কৃষককে অংশীদার করা নয়, কৃষককে নিছকই ভোক্তা বা সার, বিষ, বীজ, পাম্প ইত্যাদির ক্রেতায় পরিণত করা। বিদেশী সংস্থার টাকায় কিম্বা বহুজাতিক কোম্পানির অর্থে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করবেন আর কৃষক ও গ্রামীণ সমাজ হবে তাদের বাজার। গ্রামীণ সমাজের ওপর শহরের আধিপত্য, শোষণ ও শাসন টিকিয়ে রাখাই এই কায়েমী প্রচারণার উদ্দেশ্য। শহরের এই শাসক ও শোষক শ্রেণীর মাধ্যমে ধনী দেশ এবং তাদের সার কীটনাশক পাম্প বীজ ইত্যাদির কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে কৃষিপ্রধান বাংলাদেশকে চিরতরে পঙ্গু বা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
আমাদের খাদ্যব্যবস্থায় নানান আবাদি বা অনাবাদি লতাপাতার ভূমিকা এবং কৃষিব্যবস্থায় একই সঙ্গে আবাদি ও অনাবাদি ফসলের ফলন বাড়ানো নিয়ে নিয়মিত আলোচনা করে নয়াকৃষি। নয়াকৃষি মনে করে না যে ফলন বাড়ানোর অর্থ অনাবাদি খাদ্যের উৎস ধ্বংস করে শুধু আবাদি ফসল করা। আবাদি ও অনাবাদি উভয় ভাবেই অনাবাদি শাকসবজি, মাছ ও জলজ সম্পদ এবং ঘরেবাইরে গজিয়ে ওঠা ফলমূলের ফলন বাড়িয়ে প্রকৃতির উৎপাদনশীলতা বিপুল বাড়ায় নয়াকৃষি।
কৃষকরা বুঝলেন এই কায়েমী ও শোষক ও শাসক শ্রেণীর চিন্তাচেতনার বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাড়া কৃষকের মুক্তির কোন পথ নাই। বর্তমান সময়ে যারা মানুষ ও মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞানের উদয় ও বিকাশ নিয়ে গবেষণা করছেন, জ্ঞান-প্রক্রিয়া সম্পর্কে যাঁরা সত্যি সত্যিই বিশেষজ্ঞ - তাঁরা এখন আর ‘শিক্ষা’/‘অশিক্ষা’-র ভুয়া বিভাজন মানেন না। বরং মানুষের ইন্দ্রিয় অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি ও জ্ঞানের বিকাশ নিশ্চিত করার জন্য প্রকৃতির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রচনার গুরুত্বের ওপরই আজকার তাঁরা প্রচ- জোর দিচ্ছেন। কেউ ‘শিক্ষিত’ হলেই নিরক্ষরের চেয়ে বেশী জানে, এই ধারণা নিছকই শিক্ষার অহমিকা নয়, প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর বাংলাদেশের কৃষিব্যবস্থাকে বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফার অধীনস্থ করার চাতুরি মাত্র।
অসাধ্য সাধন
নয়াকৃষির শুরুটাই ছিল অসাধ্য সাধনের ব্রত নিয়ে। শুরুতে যেসব কৃষক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের অদ্ভুত জীব মনে করেছিল অনেকেই। কিন্তু তাঁরাই পথ দেখিয়েছেলেন, তাঁদের পরীক্ষা গবেষণার ফলাফলের অভিজ্ঞতার ওপর নয়াকৃষি দাঁড়িয়েছে।
কৃষি নিয়ে কৃষকদের সামষ্টিক ও খঁটিনাটি অভিজ্ঞতাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে কম পক্ষে পাঁচ ছয় বছর ব্যয় হয়েছে। তারপরই শুরু হয়েছে সফলতার আলোকে নয়াকৃষির বিস্তারের কাজ। অতি অল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার কৃষক পরিবার নিজেদের জীবন ও জীবিকার তাগিদে এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছেন। একই সঙ্গে প্রথাগত কৃষক আন্দোলনের চরিত্র অতিক্রম করে নয়াকৃষি আন্দোলনের চরিত্রকে আরো অগ্রসর চিন্তার ধারক ও বাহকে পরিণত করেছেন তাঁরা; স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। কৃষকের অথনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গে প্রাণ ও পরিবেশ রক্ষা ও বিকাশের সংগ্রাম যুক্ত হয়ে এই আন্দোলনের চরিত্রে নতুন মাত্রা যেমন যোগ হয়েছে একই সঙ্গে নতুন ও উন্নত উৎপাদন সম্পর্ক চর্চা করে এই আন্দোলন আমাদের ভবিষ্যতের বাস্তব সম্ভাবনাকে এখনই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। প্রমাণ করছে প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর উন্নত কৃষিব্যবস্থা কায়েম করার মধ্য দিয়ে অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধশালী, অগ্রসর ও সুখী দেশে পরিণত করতে পারি।
মিশ্রফসল বা জমিতে নানা ধরণের ফসল এক সঙ্গে চাষ - অর্থাৎ অল্প জমি থেকে অধিক ফলন বাড়ানোর জন্য গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নয়াকৃষি।
নয়াকৃষি কি ?
নয়াকৃষি মনে করে এই বিশ্বজগত বা প্রকৃতি আনন্দময়। ভাবে, সংকল্পে ও কাজে এই আনন্দকে নিরিখে রেখে সৃষ্টি, সৃষ্টির শর্ত ও সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার সুরক্ষা ও বিকাশই ধর্ম। আনন্দ আনন্দই - নিরানন্দ বা অসুখী অবস্থার বিপরীত কোন ধারণা নয়। তবে মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সকল প্রকার হানাদারি সম্পর্কের বিনাশ বা বিলয় ছাড়া আনন্দের আবির্ভাব অসম্ভব। অতএব ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কাজেকর্মে আচার ব্যবহারে বিশ্বাসে সংস্কৃতিকে সকল প্রকার হানাদারির বিরুদ্ধে ব্যক্তি পর্যায়ে, পরিবারে, সমাজে ও সর্বত্র লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। আনন্দের শর্ত তৈরীর জন্যই সকল প্রকার হানাদারি সম্পর্কের অবসান চায় নয়াকৃষি।
আনন্দের নিরিখে কৃষিকাজে সমৃদ্ধি ও উন্নতির জন্য দশটি কৃষিনীতির ব্যবহারিক প্রয়োগ করে নয়াকৃষি। সেই প্রয়োগ থেকে অবিজ্ঞতা অর্জন, নতুন শিক্ষালাভ, গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং আবিষ্কারের দৈনন্দিন চর্চায় নয়াকৃষি বিকশিত হয়ে চলেছে।
হানাদারি হচ্ছে চিন্তায় ও কাজে অপর মানুষ ও প্রকৃতির ওপর নিজের জবরদস্তি, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা বা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অভ্যাস বা খাসিলত। হানাদার হানাদারির অভ্যাসকে মানুষের স্বভাব গণ্য করে এবং মানুষ মাত্রই সম্পত্তির দখলদার ও সম্পত্তির মালিক হতে চায় এই দাবি নিজের হানাদারি ও বলপ্রয়োগকে ন্যায্য ও বৈধ প্রমাণের চেষ্টে করে। মালিকানা ব্যবস্থাকেই চিরায়ত সত্য গণ্য করে বলেই হানাদারি সংস্কৃতি আজ যুদ্ধ, বিগ্রহ ও ধ্বংসের ভয়াবহ ঐতিহাসিক পরিণতি লাভ করেছে। যেদিন থেকে কিছু মানুষ প্রকৃতিকে নিজের দখলে নিয়ে দাবি করতে শুরু করেছে এই সম্পত্তি তার একার, এই দখল হয়ে যাওয়া প্রকৃতি আর কেউ ব্যবহার করতে পারবে না, একই যুক্তিতে শক্তিতে দুর্বল মানুষদের নিজের দখলে নিয়ে তাদের ‘দাস’ বানিয়ে নিজেকে তার মনিব বা প্রভু ঘোষণা করেছে। হানাদারি সভ্যতার উৎপত্তি কারণ এই দখলদারিতে, যাকে ব্যক্তিগত মালিকানা বলে আমরা এখন বৈধ বা স্বাভাবিক ব্যাপার বলে গণ্য করি। জাতিভেদ, গোত্রভেদ, রক্ত ও বর্ণ ভেদ, শ্রেণী ভেদ, নারীপুরুষ ভেদসহ মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভাজনের গোড়ায় এই হানাদারি সম্পর্ক। তথাকথিত ‘আধুনিক’ সভ্যতার মূলেও আছে হানাদারি, রক্তপাত, যুদ্ধবিগ্রহ - মানুষ ও প্রকৃতির ওপর দখলদারি, মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা - পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা যার অনিবার্য পরিণতি। পুরানা আমলে যা ছিল দাস ব্যবস্থা, বর্ণাশ্রম, জাতপাতের বিভাজন, আশরাফ আতরাফের বিভাগ - আধুনিক কালে তাই হয়েছে উপনিবেশ, পুঁজিবাদ ও সাম্র্জ্যবাদ। হানাদারিই তথাকথিত ‘সভ্য’ যুগের খাসিলত বৈশিষ্ট্য ও চরিত্র লক্ষণ। তথাকথিত ‘আধুনিক সভ্যতা’-র এই হানাদারি চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যেরই পরিণতি বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ, ধ্বংস ও অবলীলায় হত্যাকা-। হানাদারির ঐতিহাসিক পরিণতি এই রক্তাক্তসভ্যতার চূড়ান্ত পতন না হলে দুনিযায় শান্তি প্রতিষ্ঠা অসম্ভব।
হানাদারির বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের অর্থ হানাদারির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য সম্যক অনুধাবন এবং সজ্ঞানে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। পাশাপাশি হানাদারির যে বৈষয়িক ভিত্তি - অর্থাৎ যে ধরণের অর্থনীতি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি এখন জারী রয়েছে তার বিপরীতে নতুন ধরণের সম্পর্ক এখনই এই মুহূর্তেই নিজের জীবনে, পাড়া-প্রতিবেশীর মধ্যে, গ্রামে ইউনিয়নে সমাজে চর্চা শুরু করা। একদিন সবকিছু দৈবযোগে আকস্মিক রাজনৈতিক বৈপ্লবিক কায়দায় সকল সম্পর্কে আমূল বদল ঘটবে নয়াকৃষি তা মনে করে না। বরং আমাদের এই মুহুর্ত থেকেই হানাদারির বিরুদ্ধে যেমন ঘরে-বাইরে লড়তে হবে, একই সঙ্গে নিজেদের রপ্ত করা হানাদারি অভ্যাসের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম চালাতে হবে। ঐতিহাসিক কারণে এই হানাদারি চরিত্র আমাদের মধ্যেও বসবাস করে, তথাকথিত ‘আধুনিক’ সভ্যতার কুফলে হানাদারির চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য আমরা প্রতিদিনই জ্ঞানে অজ্ঞানে রপ্ত করি। অতএব শক্র বাইরে শুধু নয়, শক্র আমাদের মনেও।
শামুক, শ্যাওলা, ঘাস, পানি, বৃষ্টি, মাটি এবং তার সঙ্গে হাজারো প্রাণের সঙ্গে চাষাবাদের সম্পর্ক - এই ধরণের গূঢ়, জটিল অথচ অপূর্ব সুন্দর প্রাণের সম্পর্ক জানা ও বোঝার সাধনা করে নয়াকৃষি - ফলে প্রাণবৈচিত্র্যভিত্তিক উন্নত উৎপাদন সম্পর্কের বিকাশ ঘটে।
অন্যদিকে হানাদারির বিরুদ্ধে মানুষের সংগ্রাম নতুন নয়, মানুষ নিজের মুক্তির জন্য শোষণ নির্যাতন অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে বহু বছর ধরে লড়াই সংগ্রাম করছে। নয়াকৃষি সেই ঐতিহাসিক সংগ্রামেরই ধারাবাহিকতা মাত্র।
অতীতের লড়াইগুলোতে মনের অন্দরমহলের লড়াইকে আমরা উপেক্ষা করেছি। অতএব শক্রই শুধু খারাপ আর আমরা যেহেতু শোষিত ও নির্যাতিত অতএব আমরা ভাল - এই বিভাজনের ভিত্তিতে লড়াই সংগ্রাম করা হয়েছে। সেই লড়াইয়ে সাময়িক বিজয়ের পর বিজিতদের মধ্য থেকেই হানাদারি অভ্যাস আবার প্রত্যাবর্তন করেছে। দ্বিতীয়ত যা ভাল, সুন্দর ও আনন্দময় তার ধারণা বা তত্ত্ব দেওয়া হয়েছে অশুভ, খারাপ বা শয়তানের বিপরীত ধারণা দিয়ে। অসুন্দরের মানদ- দিয়ে সুন্দরের কল্পনা করা হয়েছে। আনন্দকে নিজ গুণেই আনন্দ হিশাবে, শুভ বা ভালকে আপন স্বভাবগুণে শুভ বা ভাল বলে কল্পনা, চিন্তা বা ধারণা করবার শক্তি মানুষ হারিয়ে ফেলেছে।
মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে তার বাইরের জগত বা প্রকৃতির আনন্দময় সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য সৃষ্টি, সৃষ্টির শর্ত ও সৃষ্টির প্রক্রিয়ার সুরক্ষা ও বিকাশের নীতিতে অটল থাকা নয়াকৃষির অতি প্রাথমিক কিন্তু প্রধান প্রতিজ্ঞা।
নয়াকৃষি আনন্দকে আনন্দ হিশাবেই কল্পনা করতে চায়, জানতে চায় এবং মানুষের সংকল্পে, জীবনযাপনের চর্চায় তার সম্ভাব্য রূপ প্রদর্শন করতে চায়। আনন্দের বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আনন্দময় সমাজ গড়তে চায়।
কাজের সুবিধার জন্য পাঁচ ধরণের কর্মযোগের মধ্য দিয়ে নয়াকৃষি হানাদারি চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য বর্জন করে বিশ্বমানব হওয়ার চর্চা করে। এই কর্মযোগগুলো হচ্ছে - (১) সংরক্ষণ বা রক্ষা (২) সৃজন বা সৃষ্টি (৩) পালন ও প্রতিপালন (৪) বিকাশ, ও (৫) উন্নতি। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই পাঁচ কর্মযোগের প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। এই আদর্শে যাঁরা মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ, শোষণ ও নির্যাতনের সম্পর্ক উচ্ছেদের জন্য সংগ্রাম করে নয়াকৃষি তাঁদের সঙ্গে মৈত্রীর বন্দন দৃঢ় করে। নযাকৃষি মনে করে এই মৈত্রীর চর্চাই নতুন ধরণের শ্রেণী চেতনা কিম্বা গোষ্ঠ ভাবের উদয় ঘটাবে, অনুৎপাদক ও পরজীবী শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম তীব্র করবে, সকল প্রকার মহাজনগিরি, সুদখোরি, শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সামাজিক ও রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করবে এবং দুনিয়াব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ অর্থাৎ পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে দেশে দেশে মানুষের লড়াই-সংগ্রামকে এক সূত্রে গাঁথবার শর্ত তৈরি করবে। এর ফলে জাতপাত, শ্রেণীভেদ ও নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক হানাদারিরও অবসান ঘটবে।
কর্মযোগের এই নিরিখ মানুষ ও প্রকৃতির অভিন্ন বিকাশ নিশ্চিত করবার শর্ত। হানাদারির ইতিহাস পেছনে ফেলে মানুষের সত্যিকারের ইতিহাস শুরু করার এই প্রতিজ্ঞা ও কর্মযোগের নিরিখই নয়াকৃষির কেন্দ্রীয় চালিকা শক্তি।
নয়াকৃষির দুই পায়ে হাঁটার নীতি
একদিকে তাঁতীদের নেতৃত্বে গ্রামীণ শিল্পের বিকাশ আর অন্যদিকে কৃষকদের চাষাবাদ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা - দুই পায়ে গ্রামীণ অর্থনীতি পুনর্গঠনের এই পথই কৃষি ও শিল্পকে পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর দাঁড় করানোর সঠিক পথ, বাংলাদেশকে অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত সমৃদ্ধশালী করবার এই কৌশল চর্চা করে নয়াকৃষি।
সূক্ষ্ম জ্ঞান যার ঐক্য মুখ্য
সাধকেরই উপলক্ষ্য
অপরূপ তারই বৃক্ষ
দেখলে জীবের জ্ঞান থাকে না ॥
(ফকির লালন শাহ)
নয়াকৃষি নিছক কোন কারিগরী বিদ্যা বা কৃৎকৌশল প্রবর্তনের নামে ভূয়া ও মিথ্যা জাদুকরির প্রতিশ্রুতি নয়। অথচ নয়াকৃষি অতি অগ্রসর চিন্তা ও ভাব এবং জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র ও উৎপাদন শক্তি বিকাশের উপায়। ঐক্য, গোষ্ঠভাব ও শক্তির সাধক নয়াকৃষি, তার সাধনা মানুষের জীবনে আনন্দ, সমৃদ্ধি ও বৈষয়িক উন্নতি। এই প্রজ্ঞা, জ্ঞান বা বিজ্ঞান চর্চার জন্য প্রকৃতিকে শুধু খ- খ- ভাবে বুঝলে চলবে না, বুঝতে হবে অখ-, অভিন্ন বা সামগ্রিক ভাবে। এমনকি শুধু ‘প্রকৃতি’ রূপে চিনলেও চলবে না। প্রকৃতিকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবেও বুঝতে হবে। প্রকৃতি - অর্থাৎ জমি, পানি, তেল-গ্যাস কয়লাসহ খনিজ সম্পদ বন, গাছপালা, পশুপাখি জীব-অণুজীব ইত্যাদি মুনাফাখোরদের মুনাফা কামানোর উপায় কিম্বা কাঁচামাল মাত্র এখন হানাদারি ও দখলদারির ক্ষেত্র, দুনিয়াব্যাপী হানাহানি, যুদ্ধ, হিংসা ও হত্যার কারণ। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী পুঁজিতান্ত্রিক যে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা তাকেই আমরা স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক বলেই মনে করি। সকল দিক থেকেই প্রকৃতির এই বন্দী দুর্দশা জানতে, বুঝতে ও ব্যাখ্যা করতে হবে। একই সঙ্গে প্রকৃতির ঐতিহাসিক বিকাশ সম্পন্ন করবার জন্য লড়াইয়ের নীতি ও কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। প্রকৃতিকে দখলদারি, হানাদারি ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করে মানুষসহ সকল প্রাণ, প্রাণীকুলের বিকাশ অর্থাৎ সৃষ্টির অসীম সম্ভাবনার বিবর্তন নিশ্চিত করাই নয়াকৃষির চর্চা ও রাজনীতি। সজ্ঞান ও সচেতন মানুষের পক্ষেই কেবল এই ভাবের বাস্তবাযন সম্ভব।
মানুষ এই অর্থেই সৃষ্টির সেরা যে তার পক্ষেই এই ভাব চর্চা সম্ভব। আনন্দের কল্পনা, সংকল্প ও তা বাস্তবায়নের চর্চা করে মানুষ। হাতির শরীর মানুষের চেয়ে বড়ো ঈগল খুব দূর আকাশে উড়তে সক্ষম-মহাসমুদ্রের বিশাল ও অপূর্ব সুন্দর তিমি গভীর পানিতে বিচরণ করে - কিন্তু তাদের মধ্যে কোন কর্তাসত্তা নেই, তারা প্রকৃতি মাত্র। কিন্তু মানুষ প্রকৃতিমাত্র নয়, মানুষের মধ্যে নতুন কর্তাসত্তা আবির্ভারের স্বভাব আছে যে কারণে প্রাকৃতিক ইতিহাস ছাড়াও মানুষের নিজের একটা আলাদা ইতিহাস আছে, যা প্রকৃতির অপরাপর সত্তার মধ্যে আমরা দেখি না। মানুষ যা ছিল, বা যা আছে সেটাই তাঁর চরিত্র বা মনুষত্ব নয়, বরং যা সে এখনো হয় নি, কিন্তু সে হয়ে উঠতে পারে বা একদিন সে হয়ে উঠবে- সেই সুন্দর বা আনন্দের কল্পনা ও সংকল্পের মধ্যে সবসময় নতুন মানুষের আবির্ভাবের আওয়াজ শুনি আমরা। এই সম্ভাবনার ধারণা বা কল্পনা ছাড়া বিপ্লব কথাটার কোন মানে হয় না, যদিও বিপ্লব বলতে আমরা নতুন কিছু সৃষ্টি বুঝি। নয়াকৃষি মানুষের মধ্যে এই সৃষ্টিবান কর্তাসার উদ্বোধন ও বিকাশের শিক্ষা দেয়।
নয়াকৃষি বিজ্ঞান চর্চা করে, কিন্তু বিজ্ঞানের পূজা করে না।
অতএব কৃৎকৌশলের দিক থেকে নয়াকৃষি মান্ধাতার আমলের কৃষি, কিম্বা তথাকথিত ‘প্রাকৃতিক’ কৃষি বা চিরায়ত কৃষিও নয়। নয়াকৃষি সবসময়ই নতুন সবসময়ই, নিত্য নতুন প্রক্রিয়ার মধ্যে যা কিছুই সৃজন, সংরক্ষণ, পালন, বিকাশ ও উন্নতির পক্ষে নয়াকৃষি তাকে জানতে, নিজের করে নিতে, ধারণা করতে ও কাজে খাটাতে আগ্রই। বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের অভূতপূর্ব অগ্রগতির ফলে প্রাণ ও প্রাণের প্রক্রিয়া রক্ষা ও বিকাশের ক্ষমতা বেড়েছে মানুষের বহুগুণ। অতএব নয়াকৃষি অবশ্যই নিত্য নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার উৎসাহী ও আগ্রহী। কিন্তু যে ‘বিজ্ঞান’ দখলদারি, হানাদারি, ধ্বংস, যুদ্ধ, হত্যা ও সন্ত্রাসের সমার্থক, নয়াকৃষি তার সঙ্গে আপোষ করে না। প্রাণপণ লড়ে।
মানুষের ভাব, প্রজ্ঞা, বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের চর্চা যুগে যুগে কালে কালে বদলায়। উৎপাদন শক্তির বদল মানে খোদ প্রকৃতিরই রূপান্তর। কিন্তু এই বদল নয়াকৃষির ভাবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা তার বিচার হবে সংরক্ষণ, সৃজন, প্রতিপালন, বিকাশ ও উন্নতির মানদ- দিয়ে। বিবর্তন বা বিকাশ মানে প্রকৃতিকে তার ঐক্যে ও বৈচিত্র্যে একই সঙ্গে অনুধাবন, চর্চা ও বিকাশ - প্রকৃতির ধ্বংস বা বিনাশ নয়। প্রকৃতি একসময় নিজেই নিজে বিবর্তিত হয়েছে এবং মানুষ প্রকৃতিরই অংশ হয়ে বিকশিত হয়েছে। এখন মানুষকেই নিজের ও প্রকৃতির বিকাশ নিশ্চিত করতে হবে। ‘উৎপাদন শক্তির বিকাশ’ বলতে আমরা কী বুঝি সেই সম্পর্কে সুস্পষ্ট ও পরিচ্ছন্ন ধারণ না থাকলে মানুষের পক্ষে এই কর্তব্য পালন অসম্ভব। সেই কারণে বিজ্ঞার মাত্রই ভাল, বা সব টেকনোলজিই মানুষের অগ্রগতির সহায়ক নয়াকৃষি তা মনে করে না। এই ধরণের একতরফা মূল্যায়ন ধ্বংসাত্মক। ঠিক তেমনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘বিপ্লব’ ঘটলেই নয়াকৃষি তাকে ‘প্রগতি’ বা মানুষ ও প্রকৃতির এগিয়ে যাওয়া বলে গণ্য করে না। পৃথিবীতে প্রাণ ও প্রাণের প্রক্রিয়াই আজ ধ্বংসের সম্মুখিন।
কৃষকের যে জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে হাজার বছরের কৃষিসভ্যতা গড়ে উঠেছে তাকে উৎসবে আনন্দে উদযাপন করে নয়াকৃষি। ছবিতে ২০০৪ সালে নয়াকৃষির একজন কৃষককে দেখা যাচ্ছে যাঁদের জ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান: নারী দিবসে নারী কৃষকদের যখন উদযাপনের অনুষ্ঠান
নয়াকৃষি অতীতমুখী নয়, ঐতিহ্যবাদীও নয়, কিন্তু একটি জনগোষ্ঠিকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে সেই জনগোষ্ঠির ঐতিহাসিক জ্ঞানের জমিনটা রক্ষা দরকার, যার অবহেলায় অতীতে বহু সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।
মানুষ যদি এগিয়েই গিয়ে থাকে তাহলে যুদ্ধ, হত্যা, ধ্বংস ও হানাহানি কেন ? কেন মারণাস্ত্র উৎপাদনই বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রে নিজের স্থান করে নিতে সক্ষম হোল ?
অর্থশাস্ত্র মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ককে সাধারণ ভাবে ‘উৎপাদন সম্পর্ক’ বলে থাকে। কিন্তু নয়াকৃষি সব উৎপাদন সম্পর্ককে ‘আনন্দ’ বলে গণ্য করে না। যে উৎপাদন সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে মানুষের বর্ণ, জাত, শ্রেণী ও নারীপুরুষ ভেদ বহাল রাখে - শোষণ, হিংসা, হানাদারি, দখলদারি ও যুদ্ধবিগ্রহই যে উৎপাদন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ভিত্তি - নয়াকৃষি সেই উৎপাদন সম্পর্কের উৎখাত বা রূপান্তর ঘটাবার জন্য লড়াই করে। যে উৎপাদন সম্পর্ক আনন্দের, ইহলোকে আনন্দময় জীবনযাপনের শর্ত, সেই সম্পর্ক রচনা ও জীইয়ে রাখা ও প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই - সংগ্রাম করে নয়াকৃষি।
বিজ্ঞান ও টেকনলজি বিকাশের নামে দুনিয়ার অল্প কিছু বহুজাতিক কোম্পানি আজ খোদ সৃষ্টিজগতকেই ধ্বংস করতে উদ্যত। দুনিয়া ধ্বংস হোক, তবুও তাদের মুনাফা কামানো চাই। কোম্পনির মুনাফার রক্ষা করতে গিয়ে জগতে খোদ প্রাণের ভিত্তিটাই আজ মহা বিপদের সম্মুখিন।
বিজ্ঞান ও টেকনলজি যখন ‘মুনাফা’ কামানোর উপায় ছাড়া অধিক কিছু নয়, এমনকি ধ্বংসাত্মক, তখন মুনাফাবাজদের কবল থেকে জ্ঞানবিজ্ঞানকে মুক্ত করাই নয়াকৃষির এখনকার প্রধান কাজ। যদি ‘বিজ্ঞান’ বা ‘টেকনলজি’ খোদ সৃষ্টিকেই ধ্বংস করে, সৃষ্টির প্রক্রিয়াকে বিনষ্ট করে, মানুষকে যন্ত্রের অধীন বা গোলামে পরিণত করে তাকে ‘বিজ্ঞান’ নয়, অজ্ঞানতা বলাই সঙ্গত। এই যুগে বিজ্ঞানবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ের অংশ।
নয়াকৃষিই আমাদের ভবিষ্যৎ
নয়াকৃষি আন্দোলন মানুষসহ গাছ-পালা, লতা গুল্ম, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ - প্রতিটি প্রাণীর প্রতি ভালবাসা ও মায়া মমতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। নয়াকৃষি জীবন ও জগতের প্রতি আনন্দময় দৃষ্টিভঙ্গী। আনন্দময় জীবনযাপন। নয়াকৃষিই মানুষের ভবিষ্যৎ।
নয়াকৃষির অতি অগ্রসর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বুঝতে যাঁরা অক্ষম তাঁরা অনেকেই একে পুরানা জমানার কৃষি মনে করেন। পুরানা জমানার কৃষি কিন্তু আধুনিক কৃষির মতো ধ্বংসাত্মক নয়। তবে পুরানা জমানার কৃষি বলতে তাঁরা বোঝান নিম্ন মানের প্রযুক্তি এবং ল্যাবরেটরি মার্কা বিজ্ঞানের অনুপস্থিতি। তাদের ধারণা রাসায়নিক সার-বিষ, সেচের যন্ত্র এবং ল্যাবরেটরীতে উৎপাদিত এবং কোম্পানীর বাজারজাত বীজ ব্যবহার করলেই তাকে উন্নত প্রযুক্তি বলে মানতে হবে। বিষে ও পরিবেশ বিপর্যয়ে সবদিক ধ্বংস হলেও। নয়াকৃষির বিজ্ঞান ল্যাবরেটরি মার্কা খ-িত বিজ্ঞান নয়, সামগ্রিক বিজ্ঞান।
মানুষের জ্ঞান, বুদ্ধি ও অন্যান্য মানবিক বৃত্তির বিরুদ্ধে যে সকল প্রাচীন ও আধুনিক কুসংস্কার কাজ করে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নয়াকৃষি। প্রাচীন কুসংস্কার যেমন, ঠিক তেমনি দেশীবিদেশী ব্যবসা ও বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফাবাজি ও লুটতরাজকে বিজ্ঞান বলে চালানো এই কালের কুসংস্কার। এই সকল ভুয়া দাবি ও চাতুরির বিরুদ্ধে নয়াকৃষি সংগ্রাম করে।
বিজ্ঞানের বিপুল অগ্রগতির পরে ধ্বংসাত্মক কৃষির পথ পরিত্যাগ করা এখন সহজ, অথচ আধুনিক কৃষি তার হানাদারি ও মুনাফাখোর চরিত্রের কারণে মুনাফাবাজ কোম্পানির হাতিয়ার মাত্র, বিজ্ঞানকে প্রাণের রক্ষা ও বিকাশের কাজে ব্যবহার আধুনিক কৃষি জানে না, বরং আরো ধ্বংসাত্মক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রবর্তন করার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। অতএব তথাকথিত আধুনিক কৃষিই আসলে পুরাতন ও পশ্চাতপদ কৃষি। সার ও বিষ ছাড়া ফসল উৎপাদন করা যায় এবং অতি সহজেই অধিক ফলন ফলানো সম্ভব সেই বিজ্ঞানের খবর আধুনিকদের কানে পৌঁছায় নাই। কিম্বা পৌঁছালেও কীটনাশক, সার ও পাম্প কোম্পানির স্বার্থে তারা সেটা বলেন না।
মানুষসহ অন্য যে কোন প্রাণ বা প্রাণীর জন্যে ক্ষতিকর পদ্ধতি বাদ দেওয়া, পদার্থ বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নতুন আবিষ্কার ও অভিজ্ঞতা কৃষি কাজে ব্যবহার, প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা ও বিকাশ এবং কৃষকের জ্ঞানের ভিত্তি, ক্ষমতা এবং সাংগঠনিক শক্তি বিকশিত করে তোলাই নয়াকৃষির মোদ্দা কথা।
কৃষকের সাফল্য
কোন বইপত্রের তত্ত্ব নিয়ে কিম্বা কারো কারিগরি পরিকল্পনা মাফিক নয়াকৃষি গড়ে ওঠে নি। সর্বনাশের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই কৃষককে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়েছে। নয়াকৃষি আন্দোলনের প্রথম কাজ ছিল কৃষকের অসহায় অবস্থা থেকে মুক্ত করার জন্যে মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তি তৈরি করা। সংকটের সমাধান যে কৃষকের হাতের কাছেই আছে সেই দিকটা তুলে ধরাই ছিল শুরুর কাজ।
প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থার চর্চা করে নয়াকৃষি। যেমন, যেটুকু জমি কৃষকের আছে তাতেই নগদ কোন টাকা খরচ না করে বিভিন্ন জাত ও প্রজাতির মিশ্রণ করে কি করে অধিক ফসল ফলানো যায় তার প্রাথমিক পদ্ধতি আবিষ্কার ছিল প্রথম সাফল্য।
নয়াকৃষি আন্দোলন এমন এক সময়ে শুরু হয়েছে যখন আধুনিক কৃষির নামে রাসায়নিক সার-বিষ ব্যবহারই ফসল ফলানোর একমাত্র পথ বলে প্রতিষ্ঠিত। সেচের জন্যে শ্যালো এবং ডিপ টিউবওয়েল ব্যবহার করে মাটির নীচের পানি তোলা হয়েছে ওপরে। ষাট দশক থেকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত আধুনিক কৃষির নামে রাসায়নিক সার, বিষ, উচ্চ ফলনশীল বীজ এবং সেচের পানি ব্যবহার করে দেশের অধিকাংশ আবাদি জমিতে চাষ হচ্ছে। সার ও বিষ ব্যবহারের ভয়াবহ বা সেচের পানি তোলার ফলে ভূগর্ভের পানির ভয়াবহ সমস্যা কৃষকরা অনেক আগেই টের পেয়েছিলেন। আর্সেনিকের বিষে বিশাল জনগোষ্ঠি এখন আক্রান্ত। ওদিকে গরিব কৃষকরা চাইলেও আর নগদ টাকা দিয়ে সার-কীটনাশক কিনতে পারছেন না। এখন শুরু হয়েছে কৃষকের বীজ ব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য বিদেশী বীজ কোম্পানির কাছ থেকে হাইব্রিড বীজের আমদানি, বিকৃত বীজ বা জিএমও প্রবর্তনের পাঁয়তারা। ভয়ানক প্রতিকূল পরিস্থতির মধ্যে নয়াকৃষির কৃষক সংগঠিত হচ্ছেন।
নয়াকৃষি প্রাণের জটিলতার রহস্য যতো বুঝতে শিখছে ততোই কৃষিচর্চার ধরনেও বিপুল পরিবর্তন ও বিকাশ ঘটছে। সত্যিকারের বিজ্ঞানের সঙ্গে গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার সম্পর্কও হয়ে উঠছে গভীর ও দূরদর্শী।
একদিকে কৃষি ও কৃষিব্যবস্থা রক্ষার লড়াই, অন্যদিকে কৃষকের নিজের জ্ঞান বুদ্ধি খাটিয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা। কি করে আরো উন্নত পদ্ধতিতে ফসল ফলানো যায়, ফলন বাড়ানো যায় তার প্রক্রিয়া। স্থানীয় জাত নিয়ে নানান ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মিশ্র ফসলের বিপুল ফলন বৃদ্ধির সাফল্য এবং সর্বোপরি পোকামাকড়, কীট-পতঙ্গ অপকার করা দূরে থাকুক, কৃষকের উপকারী প্রাণ সম্পদে পরিণত হওয়ায় বিপুল উৎসাহে নয়াকৃষি বেড়ে ওঠে। এখন নয়াকৃষি মাছ, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন, ফলমূল চাষ, মশলা চাষ, ওষুধি গাছ সংরক্ষণ প্রভৃতির মধ্য দিয়ে কৃষি পরিবারের দ্রুত আর্থিক ও বৈষয়িক সমৃদ্ধি আনয়নের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এগিয়ে গিয়েছে। নয়াকৃষি নিজের শক্তি ও আত্মবিশ্বাসের ওপর এখন শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারো সাধ্য নেই তাকে এখন কেউ টলায়।
কীটনাশক বন্ধ করার জন্যে কৃষকদের মধ্যে প্রথম থেকেই ঐক্যমত ছিল। বিশেষত মহিলারা নিজেদের ও শিশুদের স্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের কথাটা প্রথম থেকেই বলছিলেন এবং তাঁরা কীটনাশক অবিলম্বে বন্ধ করার কথা তুলেছেন। কীটনাশক বন্ধ করার জন্য প্রথমদিকে যেসব কৃষক নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রধানত ছিলেন ক্ষুদ্র চাষী এবং মহিলারা। প্রথম অবস্থায় যোগদানের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকরা দলে সংগঠিত হয়ে সবুজ সার তৈরি ও কম্পোষ্ট তৈরি করা এবং এর ব্যবহার নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে শুরু করলেন। তাঁরা কম্পোষ্ট তৈরি করতে লাগলেন কচুরিপানা দিয়ে এবং এ থেকে জৈব সার তৈরি সহজ হবার কারণে ধীরে ধীরে কম্পোষ্ট কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। বর্ষাকালে এই কচুরিপানা প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। স্বাস্থ্য সম্পর্কে বিশেষ আত্মোপলব্ধির কারণেই ফসল উৎপাদন বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার থেকে তাঁরা নিজেদের মুক্ত করতে পারলেন। এটা ছিল নয়াকৃষি আন্দোলনের অগ্রযাত্রার একটা বাধা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার প্রথম অথচ গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কারণ দীর্ঘ ত্রিশ চল্লিশ বছরের আধুনিক কৃষির প্রচার এবং সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতার পর নতুন কোন ধারণা আছে কি না এই কথা বোঝা তাঁদের পক্ষে খুব কঠিন ছিল। কিন্তু কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং সেই সাথে আত্মবিশ্বাস জন্মানোর কারণে তাঁরা নয়াকৃষি পদ্ধতির চাষ করাকে একটি আন্দোলনের রূপ দিলেন। এবং তাঁরা খাদ্য উৎপাদনের জন্য নয়াকৃষির সাধারণ কিছু নীতিও ঠিক করে নিলেন। কৃষকদের বিভিন্ন সভায় এবং তাঁদের নিজস্ব কাজের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নয়াকৃষির নীতিগুলো কবিতার ছন্দ আকারে গড়ে উঠতে থাকে।
পিঠে বিষের টাংকি হাতে ফিচির ফিচির বিষ মারা পাইপ নিয়ে কি মানুষের জন্ম হয়েছে? মানুষ কি পৃথিবীতে কেমিকেল সারের বস্তা মাথায় আদিতে পয়দা হয়েছিল? যদি না হয় তাহলে বিষে আর কেমিকালে দুনিয়া বিষাক্ত কেন? করছে কারা? বিষের ছোবল থেকে মুক্তির পথ কি? শুধু রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বিচারে শক্রমিত্র নির্ধারণ যথেষ্ট নয় - প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ ধ্বংসে বিশ্বব্যাপী উন্মাদনার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছাড়া মানুষের মুক্তি নাই।
প্রথম অবস্থায় কৃষকের পক্ষ থেকে উদ্যোগ ছিল রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের বিকল্প সন্ধান। প্রথমে তাঁরা জৈব সার এবং জৈব কীটনাশকের ব্যবহারও করেছেন। পরে দেখা গেলো আসলে শুধু রাসায়নিক নয়, কীটনাশক জৈব হলেও ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে না। জৈব কীটনাশকও প্রাণের ক্ষতি করে, প্রাণ হত্যা করে। কৃষকরা নিজেরাই পদ্ধতি খুঁজে পেলেন। আসলে পোকা দমন বলে কিছু নেই, মূল কথা হচ্ছে কি করে ফসলের সাথে কীটপতঙ্গের ব্যবস্থাপনা একীভূত করা যায়। একক ফসল না করলে তো অনেক পোকাই আসে না। মিশ্র ফসলের ক্ষেত্রে এক ফসলে যা অপকারী, অন্য ফসলে তা উপকারী। তাহলে ফসলে পোকা লাগা কথাটার তো কোন মানে হয় না। তাছাড়া পাখি এবং অন্যান্য প্রাণী থাকলে তারাই নিজেদের আহার হিশেবে পোকা খেয়ে ফেলে। এভাবে নয়াকৃষির কৃষকদের মধ্যে এই ধারণা জন্ম নেয় যে তাঁরা কোন অবস্থাতেই প্রাণ হত্যাকারীর ভূমিকা নেবেন না। এই সিদ্ধান্তের যে নৈতিক আনন্দ তার তুলনা চলে না। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, অতএব তাকেই সকল প্রাণ সংরক্ষণ, রক্ষা ও বিকাশের দায়িত্ব নিতে হবে, এই উপলব্ধি নয়াকৃষির কৃষকের জীবন বদলে দেয়। তার শ্রেষ্ঠত্বের অর্থ দাঁড়ায় সৃষ্টি রক্ষা ও বিকাশের নৈতিক দায়িত্ব গ্রহণে।
নয়াকৃষির অর্থ শুধু শস্য ফলানো নয়, মাছ ও জলজ প্রাণের রক্ষা ও বিকাশও বটে। আধুনিক কৃষিতে বিষ ও সার ব্যবহারের কারণে বাংলাদেশের মাছ সম্পদ আজ ভয়াবহ বিপদের সম্মুখিন। কী করে আমরা আমাদের মিষ্টি পানি, মাছ ও অন্যান্য জলজ সম্পদ রক্ষা করতে পারি তার জন্য কৃষক ও জেলে মিলে গবেষণা করে নয়াকৃষি।
আধুনিক কৃষি ফলনের হিশাব প্রতারণামূলক
কেউ নয়াকৃষি করবেন বলে যদি সিদ্ধান্ত নেন তাহলে তাঁর প্রথম পরীক্ষা তিনি কীটনাশক ব্যবহার বন্ধ করেছেন কি না। এভাবে নয়াকৃষিতে প্রথম নীতি হিশেবে স্থান পেলো কীটনাশক ব্যবহার বন্ধের বিষয়টি। এরপর সার বীজ, মাটির তলার পানি ইত্যাদি ব্যবহারের প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি করে নীতি ঠিক হয়ে গেলো।
আধুনিক কৃষি আসার পর প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কৃষকের নিজস্ব জ্ঞান অস্বীকার ও বিলুপ্ত করে বিদেশ থেকে আনা প্রযুক্তির ওপর কৃষককে নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছে। এর ফলাফল হিশেবে আমরা দেখেছি পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। কৃষকের জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে এবং কৃষক পরনির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এই অবস্থার বিপরীতে নয়াকৃষির কৃষকরা নিজেদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা থেকে শেখা কৃষি কাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি করে নীতি প্রণয়ন করে নয়াকৃষির দশ নীতি এখন কৃষকের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার কৃষকরা একত্রিত হচ্ছেন, সংঘবদ্ধ হচ্ছেন।
কৃষক তাঁদের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন আধুনিক কৃষির ফলনের হিশাব প্রতারণামূলক। প্রথম দিকে ফলন বেশী হয়, তাও শুধু ইরি ধানের, যে ফলন রাসায়নিক সার, বিষ, ভূ-গর্ভের পানির ব্যবহার ছাড়া পাওয়া অসম্ভব। হাজার হাজার স্থানীয় জাতের বৈচিত্র্যকে অল্প কয়েকটি উফশি জাতে নামিয়ে আনে আধুনিক কৃষি। অচিরেই এককাট্টা ধানের অভিজ্ঞতা তিক্ত হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে মাছ মরে, পশু-পাখি কমে, স্বাস্থ্য নষ্ট হয় এবং কৃষক ধুঁকতে থাকে অভাবে, অসুখে, মহামারিতে। এখন কৃষক আর্সেনিকের বিষে মরছে। গরিব আরো গরিব, ঘরহারা জমিহারা হয়ে বৌ ছেলে মেয়ে নিয়ে পথে বসে। একসময় গ্রামের কৃষকটিই শহরে ছেলেমেয়ে নিয়ে হাত পাতছে পেটের ক্ষুধায়। বাঁচার জন্য অনেক কৃষক অন্য পেশায় চলে যায়। অন্যরা কষ্ট করে ফসল উৎপাদন করে চলে, কারণ এছাড়া বেঁচে থাকার অন্য কোন পথ নাই বলে।
আনন্দময় ভাব
মানুষ মাত্রই চেতনাসম্পন্ন প্রকৃতি বা সজ্ঞান প্রকৃতি, অতএব মানুষের বিকাশ প্রকৃতিরই বিকাশ। সেই বিকাশ প্রকৃতির আনন্দময় বিকাশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই কেবল সম্পন্ন করা যেতে পারে, কোন বিরোধাত্মক বা ধ্বংসাত্মক পথে নয়। সে কারণে বিশ্বচরাচরের আনন্দময় যে রূপ বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যে এক ও অভিন্ন ভাব হয়ে বিরাজ করে, সেই ভাবেরই চর্চা করে নয়াকৃষি।
আমরা যখন নিজের দিকে আর বাইরের দিকে তাকাই তখন আমরা নিজেকে আর নিজের বাইরের জগতকে আলাদা আলাদা করে দেখি। আলাদা করেই ভাবি। এই দেখা বা অবস্থান হচ্ছে প্রতিটি মানুষেরই প্রাথমিক ভেদরেখা। এই ভেদবুদ্ধি না থাকলে আমরা নিজেদের যেমন জানতে পারতাম না, ঠিক তেমনি প্রকৃতিকেও জানতাম না। এই দিক থেকে মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক আসলে কি, কী ধরণের সম্পর্ক বিরোধাত্মক বা ধ্বংসাত্মক আর কী ধরণের সম্পর্ক আনন্দময় সেই প্রশ্নও আমরা তুলতে পারতাম না। মানুষের জীবনের লক্ষ্যও সম্ভবত এই প্রশ্ন তোলা এবং তার মীমাংসার মধ্য দিয়ে মানুষ ও প্রকৃতির আনন্দময় সম্পর্ক রচনার নীতি ও কৌশলগুলো আবিষ্কার করা, জানা ও তা চর্চা করা। এই আকাঙ্খা থেকেই মানুষ বিপ্লবের কথা বলে, সমাজ রূপান্তর বা বদলের সংকল্প প্রকাশ করে, ইহলোকে ইনসাফ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে শরিক হয়। এই আনন্দময় সম্পর্ক রচনার ভিত্তি মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি নয়, বরং মানুষ ও প্রকৃতি যে আসলে এক ও অভিন্ন এই উপলব্ধিকে তীব্র ও শক্তিশালী করা। এই উপলব্ধি মানুষের মধ্যে যতোই তীব্র হয় ততোই সৃষ্টি, সুরক্ষা ও প্রতিপালনের ভাব মানুষের প্রধান ভাবে পরিণত হয়। কারণ এই ভাব আনন্দময়।
শুধু মাঠে ফসল ফলিয়েই নয়াকৃষি সন্তুষ্ট নয়, ফসল প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রেও পুষ্টি ও খাদ্যগুণ বজায় রাখার জন্যে পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়।
সর্বত্র একই ভাব - আবাদে প্রবাদে দশনীতি
ভিন্ন স্থান কাল পাত্রে ভিন্ন পদ্ধতি ভিন্ন রীতি
নয়াকৃষির ভাব একটাই। আনন্দ। তবে চর্চার দরকারে দশ নীতি। কিন্তু নীতি মানে ‘মডেল’ নয়। নয়াকৃষির কোন ‘মডেল’ নাই। প্রতিটি নয়াকৃষি কৃষক পরিবারই ভিন্ন, নয়াকৃষি মানেই দেশকালপাত্র ভেদে বৈচিত্র্য, পদ্ধতির বিভিন্নতা। অথচ নয়াকৃষির ভাব এক ও অভিন্ন - সেটা হোল, আনন্দ। প্রকৃতি ও সমাজের সকলের সঙ্গে আনন্দময় সম্পর্ক রচনা। এর অর্থ শুধু পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্য ভিত্তিক উৎপাদন পদ্ধতি প্রবর্তন নয়, একই সঙ্গে জাত, বর্ণ বা শ্রেণীর বিলোপ ঘটানো এবং নারী-পুরুষের সম্পর্কের মধ্যে যে অসাম্য ও তার মোচন। মানুষের সঙ্গে মানুষের সকল প্রকার শোষণমূলক ও বিরোধাত্মক সম্পর্কেরও অবসান না ঘটানো গেলে ‘আনন্দ’ কথাটির কোন অর্থ নাই।
নয়াকৃষির কৃষক ভাই ও বোনেরা ছন্দের মাধ্যমে, গানে গানে এবং কবিতায় যতোভাবে সম্ভব তাঁদের কথা আর দশজন কৃষকের কাছে পৌঁছে দিতে চান। সব কৃষক ছাপার অক্ষরে পড়তে পারবেন না বলে তাঁরা কথা এবং গানের মাধ্যমকেই বেশী প্রাধান্য দিয়েছেন। কৃষকরা নতুন নতুন গবেষণা এবং কাজ করে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে, নতুন এলাকার কৃষকরা নয়াকৃষি আন্দোলনে যুক্ত হবার জন্যে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দশনীতিরও পরিবর্তন, রূপান্তর বা বিবর্তন ঘটেছে।
বীজেই প্রকৃতি, বীজেই সৃষ্টি। সৃষ্টির মূলেই বীজ। বীজ একদিকে প্রকৃতির পুনরুৎপাদনের উপায়, বীজ ছাড়া চাষাবাদ চলে না। অন্যদিকে বীজ নিজেই নিজের প্রক্রিয়ার ফল, অর্থাৎ বীজেই আবার ফসল। অতএব বীজ বা প্রাণকোষের মর্ম না বুঝলে নয়াকৃষির চাষাবাদ অসম্ভব।
কখনোই বা কোন অবস্থাতেই বীজ, প্রাণকোষ বা কোন প্রকার প্রাণ সম্পদ কৃষকের ঘর থেকে বা এলাকার সঞ্চয় থেকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। অতএব গ্রাম পর্যায়ে সকলে মিলে বীজ বা প্রাণ সম্পদ সংরক্ষণের উদ্যোগ কৃষকের বাঁচা-মরার লড়াই গণ্য করে গড়ে তুলতে হবে। সকল প্রাণসম্পদ কৃষকের ঘরে কিম্বা মাঠে কৃষকেরই নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। সেই লক্ষ্যে কৃষক পরিবারকে বীজ সংরক্ষণ ও পুনরুৎপাদনের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু হিশাবে গড়ে তুলতে হবে। এই লক্ষ্য সামনে রেখে গ্রাম পর্যায়ে সকলে মিলে অতএব অবিলম্বে বীজ, প্রাণকোষ বা প্রাণসম্পদ সংরক্ষণের বীজাগার বা নয়াকৃষির বীজসুন্দর গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় বীজাগার বা জীনব্যাংককে কৃষকেরই স্বার্থ রক্ষার জন্যই কাজ করতে হবে।
কৃষকের বীজ চুরি করার জন্য বহুজাতিক কোম্পানি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার বাণিজ্যচুক্তিসহ আরো বহু কায়দায় প্রাণের ওপর পেটেন্টে বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পত্তির অধিকার কায়েম করতে চায় - সারাদুনিয়ার কৃষকদের সঙ্গে নয়াকৃষি বীজডাকাতদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।
প্রাণ এবং প্রাণীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, সম্পর্ক ও আচরণের মধ্য দিয়েই নয়াকৃষির কৃষক হওয়ার চর্চা নির্ভর করে, শুধু ফসল ফলানো নয়। ভোগবাদী আধুনিক মানুষ সব কিছুকেই নিজের ভোগের বস্তু হিশাবে দেখে, অতএব পশু-পাখিকে তারা মানুষের খাদ্যই শুধু ভাবে। তাদের মাংস, ডিম বা দুধ ছাড়া তারা ভাবতে পারে না। প্রতিটি প্রাণ বা প্রাণীর নিজস্ব সত্তা আছে, তাদের জীবনের নিজস্ব মূল্য আছে - শুধু মানুষের খাদ্য হওয়ার জন্য তাদের সৃষ্টি হয় নি। অতএব অপ্রয়োজনে বা নেহায়েতই ভোগের লিপ্সা মেটানোর জন্য তাদেরকে কসাইয়ের কারখানায় জবাই হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে থাকা প্রাণী হিসাবে গণ্য করার মন-মানসিকতা নয়াকৃষি বিরোধিতা করে।
নয়াকৃষি আন্দোলন অবশ্যই চাষীর বাড়ি ছাড়াও সকলের খাদ্যের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা অর্জন করতে বদ্ধ পরিকর, কিন্তু এই বাড়িগুলো নিছক ডিম বা মাংস উৎপাদনের কারখানা নয়, বরং প্রাণের আশ্রয় হিশাবে গড়ে তোলে নয়াকৃষি।
জিএমও ও হাইব্রিড শস্য
বাংলাদেশের কৃষি এবং কৃষকের জীবিকা বহুজাতিক কোম্পানির ল্যাবরেটরীতে উদ্ভাবিত বীজ প্রবর্তনের মুখে আজ হুমকির পড়েছে। এদেশের প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষি এতোদিন তথাকথিত উচ্চফলনশীল ও হাইব্রিড বীজ এবং তার সাথে ব্যবহার করা রাসায়নিক সার, কীটনাশক, সেচ ব্যবস্থার কারণে মারাত্মক সমস্যার মধ্যে আছে। সেচ ও সার নির্ভর হওয়ার কারণে এখন বোরো ধান চাষ করা যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় কৃষিতে এখন আরো নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসা হচ্ছে যা পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য এবং মানুষ ও প্রাণীকুলের জন্য মারাত্মক হুমকি। বহুজাতিক কোম্পানি এখন বিশ্বখাদ্য ব্যবস্থা নিজের কুক্ষিগত করবার জন্য টেকনোলজিকে অস্ত্র হিশাবে ব্যবহার করছে।
বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাংলাদেশেও জিএমও বা বিকৃত বীজ প্রবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে।
জেনেটিক্যাল মডিফাইড অরগানিজম (জিএমও) বা বিকৃত প্রাণ ও বীজের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ হচ্ছে কারণ এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইওরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশের ও মানুষের স্বাস্থ্যের, জিএমও কারিগরি দিক থেকে অনৈতিকভাবে এক প্রাণীর জিন অন্য প্রাণিতে প্রতিস্থাপন করছে এবং প্রাণের প্রক্রিয়াকে মুনাফাখোর কোম্পানির লাভালাভের প্রতিযোগিতায় নামিয়ে এনেছে।
বাংলাদেশে জিএমও প্রবর্তক কোম্পানিগুলো খুব সক্রিয়ভাবে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে এবং তারা এখানে সরকারের সহযোগিতায় এই বীজ প্রচলন করতে চাইছে। এ পর্যন্ত জিএমও ফসলের কারণে কোনো দেশেরই কৃষকের উপকার হয় নি, উপকার যা হয়েছে তা হচ্ছে গুটিকয় বহুজাতিক কোম্পানির। জিএম ফসলের সুফলের চেয়ে কুফল অনেক বেশি তা ভুক্তভোগী দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যাচ্ছে।
জিএমও ফসলের প্রবর্তন কৃষকের ঘরে রাখা বীজের ক্ষতি করবে এবং কৃষককে বহুজাতিক কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল করে তুলবে। জিএমও বীজ আগাছানাশক ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের ওপর নির্ভরশীল এবং এক প্রাণীর জিন অন্য প্রাণীতে ঢুকিয়ে মানুষের সামাজিক সংস্কৃতিক মূল্যবোধের ওপরও আঘাত হানছে।
গুটিকয় কোম্পানীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে এদেশের শতকরা ৭০ ভাগ জনগণ, যারা কৃষক, তাদের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা আমরা কোন মতেই সমর্থন করতে পারি না। নয়াকৃষির কৃষকরা এর বিরোধিতা করে।
শস্য প্রবর্তনা
নয়াকৃষি কৃষকদের বাড়তি ফসল সচেতন ভোক্তাদের কাছে সুলভে পৌঁছিয়ে দেয় শস্য প্রবর্তনা। নয়াকৃষি আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও এই ফসল তাদের সদস্যদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। নয়াকৃষি আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও এই ফসল তাদের সদস্যদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে। বিদ্যাঘরগুলোতে শস্য সংগ্রহ ও মজুদের সুব্যবস্থা আছে। শস্য প্রবর্তনায় নিয়োজিত কর্মীরা নয়াকৃষি এলাকাগুলোতে গিয়ে নয়াকৃষি কৃষকের উৎপাদিত ফসলগুলোর মান পরীক্ষা ও ক্রয় করে নয়াকৃষি বিদ্যাঘরে নিয়ে আসেন। এখানে ফসলগুলো প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকা শস্য প্রবর্তনায় সরবরাহ করা হয়।
পুষ্টিকর, সুস্বাদু এবং সর্বোপরী নিরাপদ খাদ্যের জন্য শস্য প্রবর্তনা দেশে বিদেশে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। সার-কীটনাশকযুক্ত খাদ্যের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সাধারণভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে তাই নয়াকৃষি পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসলের চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছে। বিশেষ করে চাল, গম, সরিষার তেল, মুড়ি, ডাল, শাক-সবজির মসলা ইত্যাদি।
শস্য প্রবর্তনা থেকে খাদ্য কেনা মানে বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্য ও পরিবেশসম্মত কৃষিকে উৎসাহিত করা এবং নয়াকৃষি আন্দোলনে সহায়ক ভূমিকা পালন করা। এই ক্ষেত্রে নয়াকৃষি আন্দোলন শস্য প্রবর্তনার মাধ্যমে শহরে বিপুল শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতা ও ভালবাসা অর্জন করে চলেছে।
আধি
নয়াকৃষি আন্দোলনে ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকের সংখ্যাই বেশী। কিন্তু যাঁদের মোটেও কোন জমি নেই, তাঁরা নয়াকৃষির দৃঢ় সমর্থক। এর কারণ নয়াকৃষি গ্রামে অনাবাদী বা কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্যের নিশ্চয়তা বেশী এবং নয়াকৃষি কর্মসূচীতে তাঁদের অর্ন্তভুক্ত হবারও পথ আছে।
গ্রামে ভূমিহীন পরিবার যেমন আছে তেমনি আছে মহিলা প্রধান পরিবার যেখানে কোন পুরুষ উপার্জনকারী নেই। নিজেই আয় উপার্জন করে সংসারের খরচ চালান। ভূমিহীন পরিবারে পুরুষরা অকৃষি কাজে যুক্ত থাকেন, সেখানেও মহিলাদের ওপর সংসারের একটা বড় দায়িত্ব থাকে। এই ধরণের পরিবারকে সাধারণত কোন ঋণও দেয়া হয় না। কিন্তু নয়াকৃষিতে এঁরা সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন।
গ্রামে আগে থেকে বর্গা পদ্ধতিতে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগী পালনের নিয়ম ছিল, এখনও অনেক ক্ষেত্রে আছে। আধি মানে আধা বা অর্ধেক। কেউ কেউ বলে আধাআধি, বিশেষ করে ভাগের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে আধি শব্দটি কৃষি ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত। যেমন, কোন কোন এলাকায় জমি বর্গা নিয়ে চাষ করাকে আধি বলে। আধি কথাটা এখন পর্যন্ত গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক পরিবারগুলোতে ব্যবহার হয়। মোট কথা আধি মানে অর্ধেক। এই পদ্ধতিতে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগী মহিলাদের পালন করার জন্যে দেয়া হয়। তাঁরা নিজ খরচে গরু-ছাগল পালন করেন এবং পালনের সময়ে পাওয়া গোবর ইত্যাদি ব্যবহার করেন। বাছুর জন্মালে বাছুরটি রেখে মা-গরু বা মা-ছাগল একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর ফেরত নেওয়া হয়। যা আবার ঐ গ্রামেরই অন্য কোন মহিলা প্রধান পরিবারকে দেয়া হয়। অসুখ-বিসুখ হলে বিক্রি করে দিয়ে নতুন গরু বা ছাগল কেনা হয়। গাভীন না হলেও নয়াকৃষি বদলিয়ে দেয়।
আধি পদ্ধতির মাধ্যমে পাওয়া গরু ছাগল পালনের জন্য ঐ গ্রামের কৃষকদের জমির ঘাস ও খড় সংগ্রহ করে মহিলারা গরু-ছাগল পালন করতে সক্ষম হচ্ছেন। অন্য দিকে ঐ সমস্ত আধি গ্রহীতাদের কাছ থেকে গরুর গোবর নিচ্ছেন কৃষকরা। কৃষি কাজে গরু দিয়ে হালের কাজে সহযোগিতা করছেন। এর ফলে আধি গ্রহীতাদের সঙ্গে কৃষকদের একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে যা প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষির জন্য জরুরী। গ্রামে গরু, ছাগলের জাত ও সংখ্যা বাড়ছে এবং গরু, ছাগল বৃদ্ধির কারণে সঠিকভাবে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং ফসলের বৈচিত্র্য বেড়েছে। বিশেষ করে গো-খাদ্যের উপযোগী ফসলের চাষ বাড়ছে।
আধি গরুর মাধ্যমে গ্রামের নয়াকৃষি পদ্ধতিতে চাষের গুনগত পরির্বতন হয়েছে।
নয়াকৃষির কৃষক ও আধি গ্রহীতাদের মঝে কাচা ঘাস ও গোবরের বিনিময়ের মাধ্যমে সম্প্রীতি গড়ে উঠেছে। মহিলারা গরু, ছাগলের দুধ বিক্রি করে বাচ্চাদের পড়াশুনার খরচ জুগিয়েছে।
প্রতি বাছুর বড় হওয়ার পর ঐ গরু থেকে পুনরায় বাছুর হয়েছে। ঐ বাছুর বিক্রি করে অনেকে জমি বন্ধক রেখেছেন এবং মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন।
নয়াকৃষি আন্দোলনের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায়, যেমন- টাংগাইল, পাবনা, কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন গ্রামে আধি গ্রহীতা রয়েছে।
নয়াকৃষি বিদ্যাঘর
নয়াকৃষি বিদ্যাঘর বিভিন্ন এলাকায় নয়াকৃষি কর্মকা-ের প্রাণকেন্দ্র। জ্ঞানচর্চার ঘর। এই বিদ্যাঘর কৃষক এবং সমাজের সকল পেশার জনগণের মধ্যে সেতু বন্ধন তৈরী করে।
বাংলাদেশের ভূÑপ্রাকৃতিক অবস্থান অনুসারে সারা দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ পূর্ব থেকে পশ্চিম নয়াকৃষির কার্যক্রম বিস্তৃত। বাংলাদেশের টাঙ্গাইল, কক্সবাজার, পাবনা, কুষ্টিয়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, শেরপুর এবং নোয়াখালী জেলায় বিদ্যাঘরের মাধ্যমে নয়াকৃষি আন্দোলনের কার্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে।
বিদ্যাঘরগুলোতে নিয়মিত পড়াশোনা, সভা আয়োজন, মাঠে সুনিদিষ্ট কৃষি গবেষণার কাজ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ইত্যাদির প্রয়োজনীয় সুবিধা রয়েছে। বিদ্যাঘরগুলোতে উবিনীগের কর্মীগণ নিজেদের জ্ঞান অর্জনের জন্য কৃষি কাজ চর্চা করে থাকেন এবং নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের বিভিন্ন কৃষি কাজের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অর্জিত সাফল্যের ফলাফল নথিভুক্ত করা হয়ে থাকে। ইহা ছাড়াও বিদ্যাঘরগুলোর সঙ্গে জাতীয় কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, এনজিও এবং অন্যান্য সরকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজের সম্পর্ক বজায় রাখা হয়।
নয়াকৃষি বিদ্যাঘরে দেশীয় জাতের প্রায় আড়াই হাজার ধানের বিভিন্ন দিক নিয়ে নিয়মিত গবেষণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলে।
মানুষের রূপ নিয়ে সজ্ঞান প্রকৃতি মানুষেরই কর্মে তার সঠিক স্বীকৃতি সৃজন, সুরক্ষা, প্রতিপালনের ভাব বিকাশ ঘটানো প্রতি ব্যক্তির স্বভাব। এই উন্নতির কোন পরাজয় নাই সেই চির বিজয়ের ডাক দিয়ে যাই
দেশের বিভিন্ন এলাকায় নয়াকৃষি বিদ্যাঘর।