অল্পকথায় নয়াকৃষি
নয়াকৃষি বা প্রাণের চর্চা
নয়াকৃষি কৃষকদের আন্দোলন। চাষাবাদে কোন প্রকার বিষ, কীটনাশক এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক সার বা অন্য কোন পদার্থ ব্যবহার না করে এবং স্থানীয় প্রাণ ও পরিবেশের উপযোগী কৃষকের উদ্ভাবিত দেশীয় জাতের বীজ ব্যবহার দিয়ে একর প্রতি ফলন বৃদ্ধির পদ্ধতির নাম নয়া কৃষি। নয়াকৃষিতে ডিপ টিউবওয়েল দিয়ে সেচের জন্য মাটির তলা থেকে পানি তোলা হয় না, বরং বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও মাটির ওপরের পানি ব্যবহারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। নয়াকৃষিতে একাট্টা ফসল না করে মিশ্র ফসলের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। নয়াকৃষির কৃষকরা এই ধরণের দশটি নীতি অনুসরন ও চর্চা করেন।
সাধারণত যাকে 'অর্গানিক' বা জৈব কৃষি বলা হয় নয়াকৃষিকে সেই দিক থেকে 'অর্গানিক' বা জৈবকৃষি। কিন্তু তার বৈশিষ্ট্য আলাদা। এখানে প্রাকৃতিক উপায়ে জৈব কৃষির চর্চা ছাড়াও জীব-অণুজীব সমৃদ্ধ সুস্থ ও সবল মাটি তৈয়ারি এবং বিচিত্র ও বিভিন্ন প্রকার প্রাণ ও প্রাণের বৈচিত্র্যের ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ ভাবে জোর দেওয়া হয়। একারনে বলা হয় নয়াকৃষি আরও অগ্রসর ও উন্নত কৃষির চর্চা করে।
নয়াকৃষির চাষাবাদ মানে প্রাণ ও প্রকৃতির ক্ষতি হয় এমন কোন হানাদারি বা ক্ষতিকর কাজ সতর্কতার সঙ্গে পরিহার করা। চাষাবাদের অর্থ শুধু মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন নয়; বরং মানুষের খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে পশু, পাখি, কীটপতঙ্গসহ প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণের আহার জোগানো এবং তাদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। শুধু খাদ্য নয়, নয়াকৃষি মশলা, ওষুধ, জ্বালানি, ঘর ও আসবাবপত্র নির্মাণ সামগ্রী, সুতা – অর্থাৎ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের জন্য যা কিছু দরকার তার সবকিছুই উৎপন্ন করে। নয়াকৃষিকে অতএব এক কথায় প্রাণের চর্চা বা প্রাণের সুরক্ষা ও বিকাশের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা বলা যায়। এখানেই এই কৃষি অনন্য।
নয়াকৃষি আন্দোলন কৃষিকাজকে শুধু উৎপাদন ব্যবস্থা বা মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির উৎপাদন সম্পর্ক হিশাবে দেখেনা। শুধু উৎপাদন হিশাবে দেখলে প্রকৃতি শুধু কাঁচামাল সরবরাহকারী বা উৎপাদনের উপায় মাত্র হয়ে ওঠে। মনে হয় প্রকৃতি বুঝি মানুষের দখলদারি ও ভোগের জন্যই হাজির রয়েছে, মানুষের বোগের বাইরে বুঝি তার আর কোন মূল্য বা মহিমা নাই। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সপ্রাণ সম্পর্ক এই দখলী বৃত্তি ও ভোগবাদিতায় আড়াল হয়ে যায়। নয়াকৃষি আন্দোলন প্রকৃতির ওপর ভোগী মানুষের দখলদারি ও ভোগবৃত্তির বিরোধিতা করে এবং সহজ পথে প্রকৃতির সঙ্গে আনন্দময় সম্পর্ক চর্চা করে। এই দিক থেকে উৎপাদন ও জীবন যাপনের স্তরে নয়াকৃষি পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা ও ভোগী সমাজের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও বটে। যার সুডুর প্রসারী ভাবগত ও আত্মিক তাৎপর্য রয়েছে।
মানুষ যেমন প্রকৃতির অংশ, এবং প্রকৃতির সুরক্ষা ছাড়া নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারে না, তেমনি প্রকৃতি স্থির, নিশ্চল আর অপরিবর্তনীয় কিছু নয়। দুইয়ের সম্পর্কের মধ্য দিয়ে উভয়ে উভয়কেই বদলায়। মোটা দাগে এই বদলের দুই ধারা। প্রথম ধারা হচ্ছে সৃষ্টির বা বিকাশের ধারা। প্রকৃতির ওপর দখলদারি বা হানাদারি নয়, প্রকৃতির সপ্রাণ শক্তিকে উভয়ের ঐতিহাসিক রূপান্তরের মূলে রেখে উভয়েরই বিকশিত হয়ে ওঠা। যে প্রক্রিয়া ও শক্তির মধ্য দিয়ে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে সেই প্রক্রিয়া আশ্রয়ে ও শক্তির স্বভাব আত্মস্থ করে আরও বিকশিত হওয়া।
এর বিপরীত ধারা প্রাণ ও পরিবেশের দিক থেকে ধ্বংসাত্মক; রাসায়নিকে ও বিষে পরিবেশ বিষাক্ত করা এবং ক্ষতিকর প্রযুক্তি দিয়ে প্রকৃতির সর্বনাশ ঘটাবার ধারা। এতে প্রকৃতি যেমন ধ্বংস হয় তেমনি প্রজাতি হিশাবে মানুষ নিজেও পৃথিবীতে আদৌ টিকে থাকতে পারবে কিনা সেই গোড়ার জায়গাতেই সংশয় ও সন্দেহ দেখা দেয়। এই ধারা আধুনিক কৃষি, ‘সবুজ বিপ্লব’ ইত্যাদি নামে পরিচিত।
বলাবাহুল্য, নয়াকৃষি প্রথম ধারার অন্তর্ভূক্ত। এই ধারাকে শনাক্ত করা হয় প্রাণ ও পরিবেশ সম্মত কৃষি হিশাবে। কৃষি চর্চা এই ক্ষেত্রে শুধু প্রাণের রক্ষা ও বিকাশই শুধু নয়, একই সঙ্গে প্রাণের বৈচিত্র রক্ষাও বটে। এই কারনে নয়াকৃষিকে সাধারনত প্রাণবৈচিত্র ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা বলা হয়। প্রাণের বৈচিত্র উদযাপন নয়াকৃষির অন্তর্গত বৈশিষ্ট।