চৈত্র সংক্রান্তি ও নারী
বাংলা সনের বছর শেষ হয় চৈত্র মাসের ৩০ তারিখে। এই দিনটাই চৈত্র সংক্রান্তি হিসেবে গ্রামের মানুষ পালন করে খুব নিষ্ঠার সাথে। কোন ঘটা করে নয়, কিন্তু তারা নিয়মটা ঠিকই মেনে চলেন। নিয়মটাও তেমন শক্ত কিছু নয়। সোজা কথা হচ্ছে এই দিনে তারা কমপক্ষে চৌদ্দ রকম শাক বাড়ীর আলানে-পালানে, ক্ষেতের জমি থেকে তুলে এনে রান্না করেন। কিছু শাক মিশ্র আকারে রান্না হয় আর কিছু শাক আলাদাভাবে রান্না, কিংবা ভর্তা বা ভাজি করে খেতে হয়। সাধারণভাবে এই শাকগুলো হচ্ছে হেলেঞ্চা, ঢেঁকি, সেঞ্চি্, নটে শাক (কোথাও ন্যাটাপ্যাটাও বলে), বথুয়া, তেলাকুচা, গিমা, দণ্ডকলস, নুনিয়া, কচু শাক, গুরগুরিয়া শাক, মরুক, ঢেঁকি শাক, নুনিয়া শাক, হাগড়া, আম খুইড়ে শাক, খুড়ে কাটা, থানকুনি পাতা, নুন খুরিয়া, কানাই, পাট, রসুন, পিপল, খাড়কোন, ইত্যাদি। আরো অনেক শাক রয়েছে। সাধারণত গ্রামের মেয়েরা জানে কোন শাক পুষ্টির দিক থেকে ভাল, কোনটা কি ওষুধি গুন আছে; কোনটা শুধু পাতা তুলতে হবে, কোনটার আগাটা কাটতে হবে। এই জ্ঞানের দীর্ঘ ইতিহাস আছে। কিন্তু এই জ্ঞান গাছপালা সম্পর্কে জ্ঞান ও কৃষিচর্চা থেকে আলাদা কিছু নয়। আধুনিক কালের পুষ্টি বিজ্ঞান পুষ্টিকে কৃষি ও উদ্ভিদের জ্ঞান থেকে আলাদা ব্যাপার বলে গণ্য করে বলে নারীর এই ঐতিহাসিক জ্ঞানের শক্তি সে কারণে আড়াল হয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে স্বীকৃতি ও চর্চার অভাবে তার ক্ষয়ও হয়েছে। আমাদের দাদীনানীদের পুষ্টিজ্ঞানের কোন অভাব ছিল না। কিন্তু আজকাল পুষ্টি সম্পর্কে আমাদের বিদেশীদের কাছ থেকে শিখতে হয়। কিন্তু যে সমাধান দেওয়া হয় সেটা আসলে ভুল ভাবে কৃষিচর্চার সংশোধন বলা যায়। আধুনিক কৃষির ফলে কৃষি ও খাদ্য ব্যবস্থার ক্ষয় পুষ্টির অভাবের প্রধান কারন।
এদিন কোন রকম মাছ বা মাংস রান্না হয় না, শুধু ডাল জাতীয় আমিষ থাকতে পারে। চৌদ্দ রকম শাকের মধ্যে অন্তত একটি দুটি তিতা স্বাদের, নোনতা, পানসা এবং টক স্বাদের থাকতেই হবে। টক স্বাদের শাক পাওয়া না গেলে কাঁচা আম তো আছেই, ডাল দিয়ে কাঁচা আম রান্না হয়। পানসা স্বাদের কিছু না থাকলে সজনা বা নাজনা সরিষা দিয়ে খেতে খুবই স্বাদ। আর কে না জানে সাজনা পুষ্টি ও ঔষুধু গুণ।
এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে চৈত্র সংক্রান্তি শুধুই শাক রান্নার মধ্যে সীমাবদ্ধ। নারীদের জ্ঞানের দৌড় বুঝি শুধু রান্না ঘর পর্যন্ত। একদিন রান্না করে খেলেই ফুরিয়ে গেল। চৌদ্দ শাক বা চৈত্রের শেষ দিনে নানা শাক রান্না নারীর জীবনে অনেক গভীর অর্থ বহন করে এবং সমাজের জন্যেও তার এই ভুমিকা খুব তাৎপর্যপুর্ণ।
গ্রামের নারীরা বাজার থেকে কিনে আনা আবাদী শাক রান্না করবেন না। যেমন পুঁই শাক, লাল শাক, পালং শাকের মতো বাণিজ্যিক ও আবাদী শাক দিয়ে চৈত্র সংক্রান্তি হবে না। তার মানে শুধু শাক রান্নার মধ্য দিয়ে চৈত্র সংক্রান্তি পালন হয় না। চৈত্র মাসের এই খর তাপে যে শাক মাঠে, রাস্তার ধারে, পুকুর পাড়ে, আবাদী জমিতে অনাবাদি হিসেবে বা সাথী ফসল হিসেবে পাওয়া যাবে শুধু সেই শাক তুলে রান্না করাই হচ্ছে চৈত্র সংক্রান্তির আয়োজন। তাই মনে করার কোন কারণ নেই যে একই রকমের শাক বাংলাদেশের সব জেলায়, বা গ্রামে একইভাবে পাওয়া যাবে। নির্দিষ্ট এলাকার ফসলের ধরণ, এলাকার আবহাওয়া, কৃষির অবস্থা অনেক কিছুই এর সাথে জড়িত। তা চৌদ্দ রকম শাক চৌদ্দ জায়গায় ভিন্ন হতেও পারে। একটি বিষয়ে কোন আপোষ নেই , সেটা হচ্ছে এই শাকগুলো অনাবাদী, এগুলো চাষ করা শাক নয়। এই শাকগুলোকে কুড়িয়ে পাওয়া শাক, বা কুড়ানো শাক বলা হয়। অর্থাৎ প্রকৃতিতে যা পাওয়া যায় তাই তারা নেবেন। প্রকৃতি রক্ষার প্রতি তাদের জবাবদিহিতার এটা একটা ধরণ।
শাকের সাথে গ্রামের নারীদের মধ্যে এক আর্থ-সামাজিক সম্পর্কের বন্ধনও তৈরি হয়। গৃহস্থ পরিবারের নারীদের পক্ষে মাঠে গিয়ে শাক তোলা সম্ভব নয়। তার সামাজিক অবস্থান তাকে এই কাজ থেকে বঞ্চিত করে। কিন্তু তাই বলে তিনি চৌদ্দ রকমের শাক দিয়ে চৈত্র সংক্রান্তি করবেন না এমন হতে পারে না। তাই মধ্যবিত্ত গৃহস্থ বাড়ির নারীরা তাদের বাড়ির কাছে্র গরিব পরিবারের নারীদের সাথে আবাদী ও অনাবাদী ফসলের বিনিময় করেন। গরিব নারী যখন অনাবাদী শাক কুড়িয়ে আনেন, তখন গৃহস্থ পরিবার তাকে বেগুন, তিতা করলা, চিচিংগা, বা মিষ্টি কুমড়া দিয়ে দেন। এই বিনিময় কোন টাকার অংকে হয় না, বা কে কতো দিল তার ওজন নিক্তিতে মাপা হয় না। কার কোনটা পছন্দ বা কার কোনটা দরকার সেই মাপজোকটাই প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে।
গ্রামের কৃষকদের আবাদী জমি থাকে, এবং তাদের আবাদী ফসল এই জমির পরিমানের ওপরই নির্ভরশীল। কিন্তু আবাদী জমিতে সাথী ফসল হিসেবে বথুয়া, দণ্ড কলস, জমির আইলে হেলেঞ্চা, হেঞ্চি, থানকুনি পাওয়া গেলে সেটা যে কোন নারী জমির মালিকের অনুমতি ছাড়াই তুলতে পারেন। এই শাক তো মালিক লাগায় নি, এটা নিজ থেকেই জন্মেছে। তাই এই শাক তোলার অধিকার গ্রামের অন্য সকল মানুষের আছে, বিশেষ করে নারীদের আছে। তবে যে নারী এই শাক তোলেন তারাও এটা মেনে চলেন যে আবাদী ফসলের কোন প্রকার ক্ষতি তারা করেন না। এমনকি অনাবাদী শাক তুলতে গিয়ে কখনো গাছ সহ উপড়ে ফেলেন না। শুধু যে অংশটুকু রান্নার জন্যে দরকার সে অংশটুকু তারা অতি যত্নের সাথে তোলেন। এবং সেটা তারা খুব ভালভাবেই করতে পারেন। তাদের হাতের মাপ, আঙ্গুলের ব্যবহার সব কিছুই তারা ছোট বেলা থেকে মায়ের সাথে শাক তুলতে তুলতেই শিখে ফেলেন। যে সাথী ফসল আবাদী ফসলের জন্যে বাড়তি হয়ে যায়, এবং আধুনিক কৃষির ভাষায় যাকে ‘আগাছা’ বলা হয়, সেগুলো তারা পুরোটাই তুলে ফেলেন। যেমন বথুয়া ও দণ্ডকলস। এগুলোর সুবিধা হচ্ছে এই গাছগুলো শুধু মানুষের জন্যে নয় গরু ছাগলের জন্যেও খুব ভাল খাদ্য। বথুয়া গরুর দুধ বাড়ায়। কাজেই প্রকৃতিতে যা আছে তা শুধু মানুষের জন্যে নয়, সব প্রাণীর জন্যে। এই দিকটি নারীর জন্যে তা খুবই গুরুত্বপুর্ণ।
দুঃখজনক হচ্ছে আধুনিক কৃষি এসে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করে এই মূল্যবান শাকগুলোকে ‘আগাছা’ নাম দিয়ে রাসায়নিক আগাছানাশক ব্যবহার করে ধ্বংস করে দিয়েছে। আগাছানাশক ব্যবহারের কারণে আবাদী ফসল ছাড়া বাকী সব সবুজ চারা, লতাপাতা মরে যায়। আবার আবাদী ফসলে পোকা লাগে বলে কীটনাশক ব্যবহার করলে জমির আইলে বা রাস্তার ধারে যদিও বা কোন শাক পাওয়া যায় নারীরা সেই শাক বিষাক্ত বলে তুলে ঘরে আনবেন না। গরুকেও খাওয়াবেন না। আবাদী ফসলে ফলনের কথা বলে কীটনাশক ব্যবহারের হিশাব পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা এবং পুরুষরাই তা করে থাকে। কিন্তু নারীরা দেখেন প্রানের বৈচিত্র; শুধু আবাদী এককাট্টা ফসলের পরিমান বাড়ালেই নারীরা সন্তুষ্ট নন, তারা চান আবাদী ও অনাবাদী ফসল ও শাক সব্জির ব্যবহার। সত্যি কথা বলতে কি গ্রামের গরিব নারীদের সারা বছরের মুল খা্দ্যের ৪০% আসে অনাবাদী উৎস থেকে। এমন কি মাছও তারা নদী, ডোবা, বা পুকুর থেকে তারা গোসল করতে গিয়েও সংগ্রহ করে আনেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আধুনিক কৃষি নারী ও গরিব বিরোধী কৃষি ব্যবস্থা। চৈত্র সংক্রান্তি এলে টের পাওয়া যায় শাক পাওয়া সহজ কিনা। যদি পাওয়া না যায়, এবং অনেক ক্ষেত্রেই সেটা ঘটে, তার অর্থ হচ্ছে প্রকৃতিতে বেশ বড় অ-ঘটন ঘটে গেছে। প্রাণ ও প্রাণের বৈচিত্র এই ক্ষেত্রে হুমকির সম্মুখিন। এই পরিস্থিতিতে নারী তার জ্ঞানের ব্যবহার করতে পারছে না।
চৈত্র সংক্রান্তি শাক খাওয়ার যে বৈচিত্র তা হঠাৎ করে বৈশাখে ইলিশ-পান্তার মতো করে কারো ‘মাথায়’ উদ্ভটভাবে আসা নেহায়েত হুজুগের বিষয় নয়। এর মাধ্যমে ইলিশের যে ক্ষতি তারা করছে তা ক্ষমার অযোগ্য। শাক তোলার ব্যাপার সারা বছরই হয়। যেমন বর্ষা কালের পানিতে ভাসা শাকগুলোর মজাই আলাদা, যেমন কলমি, শাপলা ইত্যাদী। কিন্তু চৈত্র মাসটা এমন এক কঠিন সময় যখন চৈতালী ফসল প্রায় উঠে গেছে, পাট ও আউশ ধান বোনার সময়। এই সময় কখনো বৃষ্টি হয়, তবে খরার ভাবটাই বেশী। নারী জানেন গরম বেশী হলে টক জাতীয় খাবার শরীরের জন্যে উপকারি। গিমা শাক সারা বছর পাওয়া যায় না। গিমা শাক রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে, কাজেই তারা বাচ্চাদের ছোট বেলা থেকে গল্প বলে বলে তিতা খাওয়াবার অভ্যাস তৈরি করেন। তবে গিমার তিতা আর তিতা করলার তিতা এক নাও হতে পারে এমন সুক্ষ্ম পার্থক্য একমাত্র নারীরাই বোঝেন।
চৈত্র সংক্রান্তি ভুলে গিয়ে পয়লা বৈশাখ দিয়ে নতুন বছর বরণ করার মধ্যে জ্ঞানের চর্চা নেই। আছে শুধু বাণিজ্য। বোঝা যায় শহরে আমরা যারা গড়ে উঠছি তারা কৃষি সম্পর্কে অজ্ঞ। বাঙালি সংস্কৃতির শক্তি উপলব্ধি করা এখন শহুরে মানুষগুলোর জন্য কঠিন। যাকে আমরা বাঙালি সংস্কৃতি বলি তার সঙ্গে আমাদের আদৌ কোন ঐতিহাসিক কোন সম্পর্ক আছে কিনা সন্দেহ। চৈত্র সংক্রান্তি পালনের মধ্য দিয়ে আসুন নারীর জ্ঞানের সাথে পরিচিত হই। প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার বড় বড় সেমিনারের চেয়ে সেটাতে বেশী উপকার হবে। তাই বলি, যুগ যুগ চলুক নারীর জ্ঞানের চর্চা।