বীজ সম্পদ ব্যবস্থাপনা
কৃষষের শক্তির প্রধান উৎসই হচ্ছে বীজ। বর্তমানে সরকারী বীজ ব্যবস্থাপনার কারণে হাইব্রিড ও উফশী বীজের দৌরাত্বে প্রকৃত ভালোবীজ কৃষকের নাগালের বাইরে চলে যেতে শুরু করেছে বেশ আগে থেকেই। বাংলাদেশের বীজ ব্যবস্থাপনার বেহাল অবস্থায় বিশেষ করে ক্ষুদ্র কৃষকরা খুবই বিপদের পড়ে গেলেন। এ রকম অবস্থায় খোদ কৃষকের জীবন-জীবিকা রক্ষার জন্য নগদ টাকা-পয়সা খরচ না করে নিজেদের শ্রম, জ্ঞান ও স্থানীয় পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়ানোর কৃষি, নয়াকৃষি আন্দোলনের নামে প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষির যাত্রা শুরু হয় ১৯৯০ এর শুরুতে। এই প্রাণবৈচিত্র্য নির্ভর কৃষির নেতৃত্বে রয়েছেন ক্ষুদ্র কৃষক ও নারী কৃষকরা। তাঁরাই শুরু থেকে স্থানীয় বীজ রক্ষার জন্য কাজ শুরু করেন। এই ক্ষুদ্র কৃষক ও নারী কৃষকরাই হলেন নয়াকৃষি আন্দোলনের চালিকা শক্তি। নয়াকৃষির কৃষকরা দেশের স্থানীয় ফসলের বীজ নিরাপত্তার লক্ষ্যে সামাজিক বীজ সম্পদশালা বা কেন্দ্র গড়ে তোলেন।
ফসলের বীজ সংগ্রহ, উৎপাদন, বিনিময় ও সম্প্রসারণের কাজগুলো নয়াকৃষির কৃষকরা একেবারে নিজস্ব পদ্ধতিতে দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষন, গবেষণা এবং বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বাছাই করে একটি সমন্বিত বীজ সংরক্ষণের কৌশল/প্রযুক্তি উদ্ভাবন করার মধ্য দিয়েই নয়াকৃষির কৃষকরা বাংলাদেশের অঞ্চল ভিত্তিতে বীজ সম্পদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। ফসলের বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি অবলম্বন করে নয়াকৃষির কৃষকরা নিজেদের চাহিদা পূরণ করে অন্য কৃষকদের সঙ্গে বিনিময়ের মাধ্যমে সম্প্রসারণ করছেন।
কৃষকের ফসল উৎপাদনের মূল উপকরণ হচ্ছে বীজ। গুণগত মান সম্পন্ন বীজের অভাবে কৃষকরা নিরাপদ পুষ্টিমান সম্মত কাঙ্খিত উৎপাদন করতে পারছে না। দেশে নিরাপদ পুষ্টিমান সম্মত বীজের যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে। তবে নয়াকৃষির কৃষকরা পুষ্টিমান সম্মত যে বীজ ব্যবহার করেন সিংহ ভাগ জোগান দেন নারী কৃষকরা।
মাটির, কাঁচ, বাঁশ এবং গ্যাটাপার্চের পাত্রে বীজ সংরক্ষণ করে রাখার পদ্ধতিতে কোনো রকম রাসায়নিক পদার্থ বা রাসায়নিক কীটনাশক ছাড়াই বীজ সংরক্ষণ করা হয়। ফসলের বীজ সংগ্রহ থেকে শুরু করে সংরক্ষণ পর্যন্ত সব কাজই করেন নারী কৃষকরা।
বীজ সম্পদশালা বা কেন্দ্র সরাসরি নয়াকৃষির কৃষকরাই পরিচালনা করেন। নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের বীজ সংরক্ষণ কেন্দ্রের নাম ‘সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র। ইংরেজিতে বলা হয় Community Seed Wealth Center (CSW)। ১৯৯৮ সালে দেশব্যাপী প্রচন্ড বন্যার ফলে কৃষকরা মারাত্মক ভাবে বীজ সমস্যায় পড়লে নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা সামাজিক বীজ সম্পদশালা বা বীজ সম্পদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক, সামাজিক, ও রাজনৈতিক গুরুত্বের দিক বিবেচনায় রেখে স্থানীয় জাতের বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, পুনরুৎপাদন, অধিক ফলনশীল জাত বাছাই এবং স্থানীয় জাতের বীজের বিস্তার ঘটানো এবং একই সাথে বীজের সঙ্গে জড়িত লোকায়ত সামাজিক জ্ঞান ও সংস্কৃতির তথ্য সংগ্রহ ও চর্চা। এই চর্চার মধ্য দিয়ে কৃষির বিকাশ ঘটানোই উদ্দেশ্য। নয়াকৃষি আন্দোলনের অধীনে কৃষি ব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অঞ্চল অনুসারে তিনটি সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র রয়েছে। বন্যা বা বন্যবিধৌত সমতল এলাকার সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রটি রয়েছে রিদয়পুর বিদ্যাঘর, টাঙ্গাইল; খরা প্রবণ এলাক জন্য সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র রয়েছে আরশিনগর বিদ্যাঘর, ঈশ্বরদী, পাবনা এবং উপকূলীয় ও পাহাড়ী এলাকার জন্য সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র রয়েছে পদ্মাবতী বিদ্যাঘর, চকরিয়া, কক্সবাজারে।
প্রতিটি সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রের আওতায় রয়েছে কয়েকটি করে বীজ আখড়া। বীজ আখড়া ইংরেজিতে Seed Hut নামে পরিচিত। বর্তমানে রিদয়পুর বিদ্যাঘরের আওতায় ৭টি বীজ আখড়া, আরশীনগর বিদ্যাঘরের আওতায় ৩টি বীজ আখড়া, পদ্মাবতী বিদ্যাঘরের আওতায় ৩টি বীজ আখড়া এবং আখড়াবাড়ি কেন্দ্রের আওতায় ১টি বীজ আখড়া সক্রিয় রয়েছে।
নয়াকৃষি আন্দোলনের বীজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালিত হয় তিনটি ধাপে। প্রথম ধাপে কৃষক পরিবার, দ্বিতীয় ধাপে বীজ আখড়া এবং তৃতীয় ধাপে সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্র। বীজ আখড়ার অবস্থান নয়াকৃষির কৃষকদের গ্রামে। নয়াকৃষির কৃষকদের সংগৃহীত বীজের একটি অংশ কৃষক নিজ সংগ্রহে রাখবেন, একটি অংশ গ্রামে অবস্থিত বীজ আখড়ায় সংরক্ষণ করা হয় এবং আর একটি অংশ সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রে সংরক্ষণ করা হয়। নয়াকৃষি আন্দোলনের সার্বিক বীজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম পরিচালনা করেন নয়াকৃষি বীজ সংঘের সদস্যগণ। ইংরেজিতে বীজ সংঘকে Nayakrishi Seed Network (NSN) বলা হয়। প্রতিটি সামাজিক বীজ সম্পদ কেন্দ্রের আওতায় আলাদা আলাদা ভাবে নয়াকৃষি বীজ নেটওয়ার্কের সদস্য রয়েছেন। আবার প্রতিটি বীজ আখড়া পরিচালনা করেন আলাদা আলাদা নয়াকৃষি বীজ আখড়া পরিচালনা কমিটি।
সারা দেশে ১৯টি জেলা, ৭৩টি উপজেলা, ১৬৬টি ইউনিয়ন এবং ৬৭৭টি গ্রামে সরাসরি নয়াকৃষি বীজ সংঘের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। দিনে দিনে নতুন নতুন এলাকায় নয়াকৃষি এবং নয়াকৃষি বীজ সংঘের কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমানে দেশে মান সম্মত বীজের যথেষ্ঠ চাহিদা থাকায় নয়াকৃষির কৃষকরা নিজেদের চাহিদা পূরণ কওে ফসলের বীজ উৎপাদন বিক্রি করার নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করছেন।
নয়াকৃষি আন্দোলনের তিনটি সামাজিক বীজ সম্পদশালায় আলাদা আলাদা ভাবে বিভিন্ন ফসল এবং অ-ফসলের স্থানীয় জাতের বীজ সংগ্রহে রয়েছে।
১। রিদয়পুর সামাজিক বীজ সম্পদশালায়-(১) ধান ১৭৫২ জাতের; এরমধ্যে আমন ধান-১৭৩৭টি, আউশ ধান-১১টি এবং বোরো ধান-৫টি, (২) ফল জাতীয় সবজি- ১০৩টি, (৩) শাক-৫, (৪) ডাল-৬টি, (৫) তৈলবীজ-৭টি, (৬) অন্যান্য দানাদার শস্য-৫টি, (৭) মসল্লা-১৪টি, (৮) ফল প্রাণসম্পদ-২০টি, (৯) ফুল-১০টি, (১০) ওষুধি-১০টি, (১১) কাঠ-৯টি, (১২) পাট-২টি।
২। আরশিনগর সামাজিক বীজ সম্পদশালায়-(১) ধান ৭৬৭ জাতের; এরমধ্যে আমন ধান-৭২৪টি, আউশ ধান-২৯টি এবং বোরো ধান-১৪টি, (২) ফল জাতীয় সবজি- ২০টি, (৩) শাক-৫, (৪) ডাল-১০টি, (৫) তৈলবীজ-৬টি, (৬) অন্যান্য দানাদার শস্য-৮টি, (৭) মসল্লা-১৫টি, (৮) ফল প্রাণসম্পদ-৪০টি, (৯) ফুল-১৯টি, (১০) ওষুধি-২৫টি, (১১) কাঠ-২২টি, (১২) পাট-২টি।
৩। পদ্মাবতী সামাজিক বীজ সম্পদশালায়-(১) ধান ৫২৯ জাত; এরমধ্যে আমন ধান-৪৯১টি, আউশ ধান-২৬টি এবং বোরো ধান-১২টি, (২) ফল সবজি- ৯০টি, (৩) শাক-৯, (৪) ডাল-৫টি, (৫) তৈলবীজ-৪টি, (৬) মসল্লা-৫টি, (৭) ফল প্রাণসম্পদ-২২টি, (৮) ফুল-৮টি, (৯) ওষুধি-১০টি, (১০) কাঠ-১৩টি,।
নয়াকৃষি আন্দোলনের বীজ সম্পদশালার বীজ সম্পদ সংগ্রহের অবস্থা
ক্রম | ফসলের নাম | ফসলের জাত এবং প্রজাতি সংখ্যা | ||
রিদয়পুর বিদ্যাঘর | পদ্মাবতী বিদ্যাঘর | আরশিনগর বিদ্যাঘর | ||
১ | ধান মোট | ১৭৫২ | ৫২৯ | ৭৬৭ |
১.ক | আমন ধান | ১৭৩৬ | ৪৯১ | ৭২৪ |
১.খ | আউশ ধান | ১১ | ২৬ | ২৯ |
১.গ | বোরো ধান | ৫ | ১২ | ১৪ |
২. | ফল সবজী | ১০৩ | ৯০ | ২০ |
৩. | পাতা সবজী | ৫ | ৯ | ৫ |
৪. | ডাল শস্য | ৬ | ৫ | ১০ |
৫. | তৈল বীজ | ৭ | ৪ | ৬ |
৬. | অন্যান্য দানাদার শস্য | ৫ | ০ | ৮ |
৭. | মসলা | ১৪ | ৫ | ১৫ |
৮. | ফল |
(প্রজাতি) ২০ | (প্রজাতি) ২২ | (প্রজাতি) ৪০ |
৯. | ফুল |
(প্রজাতি) ১০ |
(প্রজাতি) ৮ | (প্রজাতি) ১৯ |
১০. | ওষুধি গাছপালা | ১০ | ১০ | ২৫ |
১১. | কাঠ | ৯ | ১৩ | ২২ |
১২. | পাট | ২ | ০ | ২ |
মোট | ১৯৪৩ | ৬৯৫ | ৯৪৭ |