খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন যথেষ্ট নয়, খাদ্য নিরাপদ করতে হবে
বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে এগিয়েছে এটা সুখের খবর। দেশের অগ্রগতির যে কোন মানদন্ডে তা স্বীকৃত। কৃষি ফসল হিসেবে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিনগুন । এখন ধান উৎপাদন হচ্ছে ৩ কোটি৭৬ লক্ষ টন। শাক-সব্জি উৎপাদনের হিসাব ও অনেক বড়। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ২০১৩ সালের হিসাব অনুযায়ি শাক-সব্জি উৎপাদন ১৩০ লক্ষ, আলু ৮৬ লক্ষ, ডাল ৮ লক্ষ ও তেল বীজ ৯ লক্ষ মেট্রিক টন উৎপাদিত হচ্ছে। হড়টেক্স ফাউন্ডেশানের তথ্য মতে প্রায় ১০০ রকমের সব্জি বিদেশে রপ্তানি করা হয়। সত্তুর রকমের মৌসুমি ফল উৎপাদিত হয়। খাদ্যের তালিকায় আরও আছে মাছ, যা প্রাণী উৎস থেকে পাওয়া ৫৮% আমিষের উৎস। নদী, খাল, বিল হাওর-বাওর থেকজে মাছ আসে ৮৫%, আর ১৫% মাছ বিশেষভাবে চাষ করা হয়। কিন্তু সেই চাষ করা মাছই বাজারে বেশী স্থান পায়। প্রায় ৩০০ প্রজাতির মাছ এবং ২০ প্রজাতির চিংড়ি। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ১৩ প্রজাতির চাষ করার জন্যে বিদেশী মাছ। মাংস উৎপাদন বলতে প্রধানত মুরগির মাংস উৎপাদন করা হয় ১৫০০ মেট্রিক টন। মাছের তুলনায় মাংসের ব্যবহার সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রয়োজনের তুলনায় কম হলেও মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মাঝে অনেক বেশী । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতি সংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা অনুযায়ী গড়ে জনপ্রতি বছরের মাংস খাওয়া হয় ১৫.২৩ কেজি অথচ তার খাওয়ার প্রয়োজন ৪৩.৮ কেজি, অর্থাৎ প্রায় তিনগুন কম খাওয়া হচ্ছে। http://old.thefinancialexpress-bd.com/2014/07/10/44271
খাদ্যের তালিকায় যে ফল আছে তার মধ্যে সারা বছর আমদানী করা ফল যেমন খাওয়া হয়, তার চেয়ে বেশী হয় মৌসুমে বিশেষ করে আম, আনারস, তরমুজ, কাঠাল, লিচু, কলা, পেয়ারা, পেপে, বড়ুই ইত্যাদী। দেশে নয়টি ফল ৭৯% ফল চাষের এলাকায় এবং ৪৮টি ক্ষুদ্র মৌসুমি ফল ২১% ফল চাষের এলাকায় উৎপাদিত হয়। এসব দিক বিবেচনা করলে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহের দিক থেকে সমস্যা তেমন নেই।
উৎপাদনে সন্তোষজনক অবস্থা থাকলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে খাদ্য আমরা খাচ্ছি তার কতটুকু নিরাপদ। এ নিয়ে ভোক্তদের মধ্যেই উদ্বেগ উৎকন্ঠা বেড়েছে। মানুষ প্রধানত খায় ক্ষুধা মেটানোর জন্যে, অর্থাৎ বেঁচে থাকার জন্যে। এবং তা ছাড়াও শখের খাদ্যও অনেক আছে। গরিব, ধনি, মধ্যবিত্ত যার যার সামর্থ অনুযায়ি শখের খাদ্য নিজে তৈরি করয়ে খান কিংবা বাজার থেকে কেনা হয়। সে হিসাবে খাদ্যের তালিকা অনেক বড় হতে পারে। প্রতিদিনের খাবার এবং বিশেষ অনুষ্ঠানের খাবারও ভিন্ন হয়। এই সবই মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ঘটছে। কিন্তু সুস্থ্য থাকার সাথে খাদ্যের সম্পর্ক অনেক গভীর। পেট ভরার জন্যে খাওয়া আর শরীরে শক্তি যোগাবার জন্যে খাওয়া ভিন্ন ব্যাপার। দুঃখজনক হচ্ছে, পেট ভরার জন্যে খেয়ে শরীরের ক্ষতি হতে পারে এমন খাদ্যও আছে। সেই খাদ্য আর খাদ্য থাকে না যদি তা শরীরের শক্তির যোগান না দিয়ে ক্ষতির কারণ হয়।
অভিধানে খাদ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে ভোজ্যদ্রব্য, খাবার। ভোজনযোগ্য। খাদ্য একই সাথে অ-খাদ্য হতে পারে। অ-খাদ্য যা খাওয়ার অযোগ্য। আমরা কোন খাবার পছন্দ না হলে বলি অ-খাদ্য। কোন খাদ্য খাওয়ার অযোগ্য হলে সে খাদ্য শরীরের চাহিদা মেটাতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। এবং উলটো শরীরে এমন কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে যা রোগের কারণ হয়ে যায়, কিংবা মৃত্যুও ঘটাতে পারে। রোগ তত্ত্বের মধ্যে নতুন করে যুক্ত হয়েছে খাদ্য বাহিত রোগ, যাকে ইংরেজীতে বলা হচ্ছে ফুড বোর্ণ ডিজিজ। খাদ্য গ্রহণের পর কেউ রোগে আক্রান্ত হলে ফুড পয়েজনিং হওয়ার ঘটনায় বমি, পায়খানা হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, এমনকি মৃত্যু হতে পারে। অর্থাৎ খাদ্য বিষাক্ত হয়ে সংক্রমণিত হওয়ার কারণে, কিংবা প্যাথজেনিক ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস, খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যার ব্যবহার, ঠিক মতো রান্না না হওয়া, কিংবা খাদ্য রাখার মধ্যে মধ্যে কোন সমস্যা হলে এই রোগ হতে পারে। এই রোগ খুব তাড়াতাড়ি প্রতিক্রিয়া দেখা যায় এবং রোগীর অবস্থাও দ্রুত অবনতি ঘটে।
নিরাপদ খাদ্যের ধারণা শুধুমাত্র খাদ্য বাহিত রোগের মধ্যে সীমাবদ্ধ্ব নয়, এই ধারণা আরও ব্যাপক হয়েছে। কারণ খাদ্য নিরাপদ না হলে শুধুমাত্র তাৎক্ষণিক অসুস্থতা সৃষ্টি করে না, বরং আরও দীর্ঘ মেয়াদী রোগের সৃষ্টি করে, যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অ-সংক্রামক রোগ বা ইংরেজিতে বলা হয় নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ (এনসিডি) , যেমণ ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনী সমস্যা, ক্যান্সার ইত্যাদী । খাদ্য উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাত করণ, মজুদ রাখা, আকর্ষণীয় করা সহ নানা ভাবে নিরাপদ না হলে যে কোন মানুষ মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। বর্তমান সময়ে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মৃত্যুর ৬১% কারণ এই অ-সংক্রামক রোগ। অথচ এই রোগ প্রতিরোধযোগ্য। এই রোগ জীবনযপনের ধরণ, তামাক সেবন এবং খাদ্যের অভাসের ধরণের সাথে সরাসরি যুক্ত।
তাই অবাক হবার কিছু নেই যে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়টি জনস্বাস্থ্য বিভাগের একটি গুরুত্বপুর্ণ কাজ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। খাদ্যের কারণে অসুস্থতা বাড়ছে। সেটা উৎপাদন পর্যায় থেকে শুরু করে, পরিবহন, বাজারে রাখা, ঘরে নিয়ে রাখা, রান্না করা এবং খাদ্য গ্রহণের যে কোন পর্যায়ে খাদ্য অ-নিরাপদ হয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ রোগের কারণ হয়ে যেতে পারে।
দেশের সংবিধানে ১৫ অনুচ্ছেদে খাদ্য মৌলিক প্রয়োজনের অংশ হিসেবে স্বীকৃত, এবং ১৮ অনুচ্ছেদে পুষ্টির এবং জনস্বাস্থ্য উন্নতির কথা রয়েছে। কাজেই মানুষের খাদ্যের যোগান দেয়া যেমন গুরুত্বপুর্ণ তেমনি পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্য রক্ষাও সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত অধিকার।
দুঃখজনক হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে সংবিধানের একটি অনুচ্ছেদ রক্ষা করতে গিয়ে এমন উৎপাদন ব্যবস্থায় খাদ্য উৎপাদন করা হয়েছে যার ফলে পুষ্টিও জনস্বাস্থ্য উভয়েই ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। সবুজ বিপ্লব একসময়ের ইতিবাচক হলেও এখন সবুজ বিপ্লবের অর্থ রাসায়নিক-সার কীটনাশক ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি। খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আমরা ডুগডুগি বাজিয়েছি, কিন্তু খাদ্য নিরাপদ করার ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করলাম কিন্তু নিরাপদ হোল না তাহলে সেই উৎপাদনের পরিসংখ্যান আমাদের কতখানি কাজে লাগে? ব্রিটিশ আমলের আইন The Pure Food Ordinance 1959 দিয়ে দীর্ঘদিন খাদ্যে ভেজাল বের করার চেষ্টা হয়েছে। এই আইনে কিছু সংশোধন ২০০৫ সালে হয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে খাদ্যকে নিরাপদ করার মতো কোন ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। ভাল খবর হচ্ছে ২০১৩ সালে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধ্বতিতে যথাযথ অনুশীলনের মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, আমদানি, প্রক্রিয়াকরণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন ও বিক্রয় সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরাপদ খাদ্য আইন , ২০১৩ জাতীয় সংসদে পাশ করা হয়। এই আইনে খাদ্য বলতে ‘চর্ব্য, চূষ্য, লেহ্য (যেমন খাদ্যশস্য, ডাল, মৎস, মাংস, দুগ্ধ, ডিম, ভোজ্য-তৈল, ফল-মূল, শাক-সব্জি,ইত্যাদি), বা পেয় (যেমন সাধারণ পানি, বায়ুবাহিত পানি, অঙ্গরায়িত পানি, এনার্জি ড্রিংক, ইত্যাদী) সহ সকল প্রকার প্রক্রায়জাত, আংশিক-প্রক্রিয়াজাত বা অ-প্রক্রিয়াজাত আহার্য উৎপাদন এবং খাদ্য, প্রক্রিয়াকরণ বা প্রস্তুতকরণে ব্যবহৃত উপকরণে বা কাঁচামাল যাহা মানবদেহের জন্যে উপকারী আহার্য হিসাবে জীবন ধারণ, পুষ্টি সাধন বা স্বাস্থ্য রক্ষা করিতে ব্যবহৃত হইয়া থাকে ’। আইনে খাদ্যের সংজ্ঞা দেয়া হলেও আলাদাভাবে এবং সংক্ষেপে ‘নিরাপদ খাদ্য’ ও সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নিরাপদ খাদ্য অর্থ প্রত্যাশিত ব্যবহার ও উপযোগিতা অনুযায়ী মানুষের জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্য সম্মত আহার্য্য । যারা খাদ্য উৎপাদন করেন তাদের আসলে নিরাপদ খাদ্যই উৎপাদন ও বাজারজাত করতে হবে। যদি তা না করা হয় তাহলে তা আইনানু্যায়ী অপরাধ বলে গণ্য হবে। কাজেই খাদ্য উৎপাদন করাই যথেষ্ট নয়, খাদ্যকে নিরাপদ করতে হবে।
আইনে খাদ্য নিরাপদ না হওয়ার বা ভেজাল খাদ্য কি তাও ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে আছে ১. খাদ্যে স্বাদ-গন্ধযুক্ত, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ বা আকর্ষণীয় করতে গিয়ে মানব স্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর কোন উপাদান মেশানো, ২. রঞ্জিতকরণ, আবরণ প্রদান, আকার পরিবর্তন করতে গিয়ে মূল খাদ্য দ্রব্যের ক্ষতিসাধন হলে এবং পুষ্টিমান কমে গেলে এবং ৩. স্বাভাবিক উপাদানকে সম্পুর্ণ বা আংশিকভাবে অপসারণ করয়ে ভিন্ন কোন উপাদান মিশিয়ে পরিমাণ বাড়ানো বা আকর্ষণীয় করতে গিয়ে ক্রেতার আর্থিক ক্ষতি বা স্বাস্থ্যের ক্ষতি সাধন করা।
মৌলিক চাহিদার যোগান হিসেবে যে খাবার তা না দিয়ে খাদ্য যখন ব্যবসার পণ্য হয়ে যাচ্ছে, তখনই ভেজালের এই নানা ধরণের কাজগুলো হচ্ছে। এবং খাদ্য অ-নিরাপদ হয়ে উঠছে। খাদ্যের অনেক ধরণ বেড়েছে, খাদ্যের দোকান বেড়েছে, নানান খাদ্যে মানুষের আগ্রহও বেড়েছে। বিনোদনের একটি অংশ হিসেবে খাদ্য এখন গুরুত্বেপুর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন কি বইমেলায়ও খাদ্যের স্টল থাকে এবং সেখানে ভিড় জমে। বই কেনা হোক বা না হোক, ফুচকা, চটপটি ইত্যাদী একটু খাওয়া চাই। যে কোন সভা সেমিনার, সম্মেলনের প্রধান আয়োজনের অন্যতম হচ্ছে খাদ্যের আয়োজন। রাস্তায় খাদ্য বিক্রি হয়, স্ট্রিট ফুড নামে তা জনপ্রিয়। খাদ্যের ব্যসায়িক চাহিদা বেড়েছে। এবং এই ব্যবসারই অংশ হিসেবে যুক্ত হয়েছে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় খাদ্যে নানা ধরণের ভেজাল মিশ্রণ। শুধু দাম বাড়াবার জন্যে, বা আকর্ষণীয় করে বেশী মূল্য রাখার জন্যেই খাদ্যকে অ-নিরাপদ করে দেয়। এটা অপরাধ নয়তো কি? আমাদের সভ্যতা এমন পর্যায়ে এসেছে যে এখন ‘বিশুদ্ধ্ খাদ্য আদালত’ স্থাপন করতে হয় এবং খাদ্য উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীরা আইন অনুযায়ী কাজ না করলে তাদের জন্যে বিভিন্ন মেয়াদের শাস্তি ও অর্থ দন্ডের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
খাদ্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং পবিত্র জিনিস। সাংস্কৃতিকভাবেও খাদ্য শুধু ভক্ষণ করার বিষয় নয়, এর সাথে মানুষে মানুষের সম্পর্ক, ভালবাসা, শ্রদ্ধা, সব কিছুই অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত।
তাই খাদ্যকে পরিসংখানের মাধ্যমে নিরাপত্তার কথা বলে আনন্দ পাওয়ার কিছু নেই যদি না তা মানুষ সুস্থ থাকতে সহায়তা করে, তার শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিতে পারে। তাই কৃষকের মাঠ, জেলের মাছ ধরা, গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন যেমন নিরাপদ করতে হবে একইভাবে শহরের চাকচিক্যময় খাবারের চেয়ে নির্ভেজাল খাবার দিতে হবে। ব্যবসা হোক ক্ষতি নাই, কিন্তু এখানে খাদ্যকে আর দশরকম ব্যবসার পণ্যের সাথে মেলানো যাবে না। নিরাপদ খাদ্য নিয়ে সচেতন হলেই ক্রেতাদের আতংক বাড়ে, তাহলে খাবো কি!
তবুও এই কথাই বলতে হবে আমরা নিরাপদ খাদ্য চাই।