বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় জনবল পরিস্থিতি


বাংদেশের সরকারী স্বাস্থ্য সেবার নানান ত্রুটি বিচ্যুতি থাকার পরেও স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী চিকিৎসক এবং চিকিৎসা কর্মীদের মান সম্পর্কে তেমন গুরুতর অভিযোগ কমই রয়েছে। তবু স্বাস্থ্য সেবার মান র্নিধারণে জনবল একটি অন্যতম মানবও হিশাবে স্বীকৃত। সেদিক থেকে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানকারী সংকটাপন্ন ৫৮টি দেশের যে তালিকা রয়েছে বাংলাদেশ সেখানে অন্যতম হিশাবে ওই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। (ফরিদা আখতার, ২০১৩)

আমাদের দেশে এ নিয়ে কমবেশী লেখালেখিও হয়েছে। গবেষণা হয়েছে। আই সি ডি ডি আর , বি এবং ব্র্যাক এর গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে, আমাদের দেশে প্রতি ১০,০০০ মানুষের জন্য ৫.৪ জন চিকিৎসক এবং ২.১জন নার্স  রয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা চিকিৎসকদের এই অতি অপ্রতুলতার চিত্র মাথায় রেখে চিকিৎসা জনবলের হিসাব করতে নিয়ে দাই এবং নার্সদেরও সংযুক্ত করেছে। যেখানে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিশেবে প্রতি হাজার মানুষের জন্য ০.৫৮ জন চিকিৎসক, দাই ও নার্স রয়েছে বলে দাবী করেছে। অত্যন্ত হতাশাজনক এ চিত্রের মধ্যে একটু আশার সঞ্চার হতো যদি এ সংখ্যা অন্তত ২.৫ জন হতো।

দেশের স্বাস্থ্যসেবার জনবল এখন একটি বড় সংকট। দেশের  প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর বিভিন্ন পেশার কর্মরত মানুষদের সাথে মতামত বিনিময়ে সংকটের এ চিত্রটি অত্যন্ত প্রকট হিসাবে ফুটে উঠেছে। এদের মধ্যে সর্বাষেক্ষা বেশী ভুক্তভোগী নারী, শিশু, আদিবাসী এবং চরাঞ্চলে বসবাসরয়ত বিশাল জনগোষ্ঠী। তাদের দুদর্শা অত্যন্ত প্রকটভাবে দৃশ্যমান। এই বিশাল জনগোষ্ঠী স্বাস্থ্য সেবায় জনবল সংকটের কারণে মারাত্মকভাবে ক্ষতি ও ভোগান্তি এবং এমন কি মৃত্যু মুখে পতিত হন।

বিষয়টি সম্পর্কে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ও সচেতন। তাদের পরিবেশিত তথ্যে দেখা যায় যে, ২০১১ সাল নাগাদ দেশে ৫০,০৬৩ জন চিকিৎসক ছিলেন। তবে এদের মধ্যে ১০,০০০ এর মতো বিভিন্ন কারণে দেশের বাহিরে অবস্থান করছেন। দেশের চিকিৎসকদের মধ্যে সরকারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় অর্থাৎ স্বাস্থ্য ও অধিকার কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে মাত্র ৩৮ ভাগ সম্পৃক্ত। বাকীরা বেসরকারী খাতসহ অন্যত্র অবস্থান করছেন। ফলে, স্বাস্থ্য জনবলের সংকট শুধু সংখ্যার দিক থেকেই অত্যান্ত প্রকট হয়ে ওঠে।

বিষয়টিকে অন্য মাত্রায় বিবেচনা করলে এ সংকট আরত্ত তীব্র হবে। এর মধ্যে রয়েছে স্বাস্থ্য সেবার চিকিৎসকদের বন্টন নীতি। কেননা এই অল্প সংখ্যক চিকিৎসকদের মধ্যে নানাধরণের দক্ষতা, বিশেষজ্ঞতা এবং অভিজ্ঞতা রয়েছে। ফলে জন স্বাস্থ্যের প্রয়োজনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে তাদের বন্টন নীতিমালায় সমন্বয় একদমই কম মাত্রায় ঘটে থাকে। একই সঙ্গে যতোটুকু  আছে তা অনেক ক্ষেত্রেই জনসাধারণের নাগালের বাইরে। অর্থাৎ কোন বিশেষ ধরণের অসুস্থতা নিয়ে যথাযথ একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে অসুস্থ্য জনের অনেক ক্ষেত্রেই পৌঁছা সম্ভব হয়ে উঠেনা। এ নিয়ে সাধারণ চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মধ্যে পারস্পরিক অভিযোগ এবং দেনদরবারও হয়ে থাকে।

সমস্যাটা আরও ননীভূত হয় যখন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ নীতিমালায় একদমই বিবেচনাহীন কিছু নীতির প্রাধান্য চোখে পড়ে। অর্থাৎ স্বাস্থ্য বরাদ্দ যখন একদমই ভৌগলিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর আওতায় হয়ে থাকে। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী সকল উপজেলার জন্য অভিন্ন নীতিতে স্বাস্থ্য বরাদ্দ এবং জনবলের বন্টন হয়ে থাকে। ফলে ৫ থেকে ৬ লক্ষ জনসংখ্যা অধ্যুায়িক উপজেলার জন্য যতোটা বরাদ্দ, অভিন্ন বরাদ্দ আছে মাত্র ৫০ হাজার জনসাধারণ অধ্যুাষিত একটি উপজেলার জন্য।

স্বাস্থ্যজনবলের এ সংকটময় চিত্র অনেক দেশে থাকলেও অন্য দেশগুলোতে তা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাটিয়ে উঠার সক্রিয় পদক্ষেপ আছে। ইতিমধ্যে কোন কোন দেশ এ সংকট কাটিয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, সারা দুনিয়ায় মোট ৫ কোটি ৫৮ লক্ষ চিকিৎসক সক্রিয়। তথাপি বিশ্বের আরত্ত ৪২ লক্ষ চিকিৎসকের প্রয়োজন রয়েছে। অন্যান্য দেশগুলো এ প্রয়োজন মেটানোর কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা নেই। কেননা দেশে ২০১৩ সালে মাত্র ৫৩.০০০ রেজিষ্টার্ড চিকিৎসক রয়েছে। অথচ দরকার ১১০.০০০ চিকিৎসক। একই সঙ্গে নার্স রয়েছেন মাত্র ৩০.০০০ অথচ দরকার ২৪০.০০০ জন।

দেশে বর্তমানে প্রতিবছর সরকারী এবং বেসরকারী চিকিৎসা মাহাবিদ্যালয়গুলো থেকে মাত্র ৬০০০ জন চিকিৎসক পাশ করে স্বাস্থ্য জনবলে যুক্ত হচ্ছেন। এক্ষেত্রে ১১০.০০০ জন চিকিৎসক হতে আরও ১০ বছর সময় দরকার। কিন্তু ওই সময়ের প্রয়োজনীয়তা হবে ভিন্ন রকম।

স্বাস্থ্য সেবার যে বিয়ষটি অত্যন্ত জরুরী তাহলো স্বাস্থ্যসেবা শুধুমাত্র চিকিৎসকরা চালাতে পারেন না। এবং তা চলেও না। একটি গতিশীল স্বাস্থ্য সেবা খাত পরিচালনার জন্য একটা টিম দরকার। এখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থেকে পরিচ্ছন্ন ও নিারাপত্তা কর্মীসহ ২০ থেকে ২৫ জনের একটি টীম অত্যাবশ্যক। ফলে স্বাস্থ্য জনবল তৈরীতে শুধু চিকিৎসক বড় কথা নয় এখানে নার্স, প্যারামেডিক, থেকে শুরু করে পরিছন্ন কর্মী, গাড়ী চালক এবং নিরাপত্তা কর্মীও গড়ে তোলা অত্যাবশ্যক।  


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।