তামাকের আগ্রাসন দেশের জনস্বাস্থ্যকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে


বিগত কয়েক বছরের অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধি পেলেও তামাকজাত দ্রব্যের দাম সে অনুসারে বৃদ্ধি পায়নি বরং কমেছে। সস্তায় তামাকজাত দ্রব্য প্রাপ্তির কারণে মানুষের মধ্যে তামাক ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তামাক ব্যবহারের প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে প্রতিবছর বাংলাদেশে ৩০ বছরের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৫৭ হাজার জন মৃত্যুবরণ করছে এবং প্রতি বছর ১২ লক্ষ মানুষ তামাক ব্যবহারজনিত প্রধান ৮টি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। রোগীর চিকিৎসা, অকালমৃত্য, পঙ্গুত্বের কারণে বছরে দেশের অর্থনীতিতে ১১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।

“ধূমপান স্বাস্ব্যের জন্য ক্ষতিকর তা প্রত্যক্ষ হোক কিংবা পরোক্ষ ধূমপান। ধূমপানের কারণে এ পৃথিবীতে অনেক মানুষ সবার অজান্তে অকালেই ঝরে যাচ্ছে। ধূমপানের ফলে সৃষ্ট তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদী সমস্যাগুলো জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। তামাকে যে নিকোটিন থাকে তা ভয়ানক আসক্তির সৃষ্টি করে। গবেষণায় দেখা গেছে সিগারেটের ধোঁয়ায় যে নিকোটিন থাকে তা হিরোইন অপেক্ষা শক্তিশালী।

ধূমপানের সময় শ্বাসের সঙ্গে টেনে নেয়া নিকোটিন অতিদ্রুত (সাত সেকেন্ডের মধ্যেই) মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়। যার প্রভাবে মস্তিষ্কের সুক্ষ রক্তনালী সংকোচনের ফলে অক্সিজেনের সরবরাহে আঘাত ঘটে ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়। সেইসাথে বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস রক্তে অনুপ্রবেশের ফলে মারাত্বক পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। বুকে ব্যথা সহ হৃদপিন্ডের রক্তনালী রোগ (clogged arteries) ও ফুসফুসের ক্ষতি হয়। সিগারেটের মধ্যে নিহিত রাসায়নিক উপাদান ও বিষাক্ত গ্যাসের কারণে ব্রঙ্কিয়াল এজমা, এম্ফাইসেমা, ব্রোঙ্কাইটস, হৃদরোগ, উচ্চ-রক্তচাপ, হার্ট এটাক, স্ট্রোক এবং ক্যান্সার হয়।

ধূমপানের ফলে ডিসলিপিডেমিয়া হতে পারে অর্থাৎ রক্তে চর্বির মাত্রার হ্রাস বৃদ্ধি ঘটতে পারে ও ক্ষতিকারক লিপিডের পরিমাণ বৃদ্ধিতে নিকোটিনের ভূমিকা থাকতে পারে। প্রকৃতপক্ষে অধূমপায়ীদের তুলনায় ধূমপায়ীরা দুই থেকে তিন গুণ বেশী স্ট্রোক ও হার্ট এটাকে ভোগে। গবেষণার আলোকে জানা গেছে যে, এল.ডি.এল-কোলেষ্টেরল (low-density lipoprotein cholesterol -LDLc) এথেরোস্কে¬রোটিক প্লাকের সূত্রপাত ঘটায়, আর ধূমপান উক্ত প্লাকের অগ্রসরণের সাথে সংশ্লিষ্ট বেশী এবং ধূমপানের সংশ্লিষ্টতা ইকোজিন-প্লাক তৈরীতে। প্লাকের সূত্রপাত ঘটাতে ও তা ছিন্ন হওয়ার ব্যাপারে এল.ডি.এল-সি মুখ্য ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে ধূমপানের কারণে এই প্লাক আরও শক্ত ও আঁশযুক্ত হয়।

ধূমপান জনিত ক্যান্সারে যারা মৃত্যুবরণ করে তাদের মধ্যে ২২% ফুসফুসের ক্যান্সার রোগী এবং যারা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তাদের চারজনের মধ্যে একজন লোক ফুসফুসের ক্যান্সার রোগী এবং যারা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় তাদের চারজনের মধ্যে একজন লোক ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে থাকে। মহিলাদের ক্ষেত্রে একনাগারে ৪০ বছর ধূমপান করলে স্তন ক্যান্সারের সম্ভাবনা ৬০% বেড়ে যায় এবং এই ধূমপানের পরিমাণ প্রতিদিন এক প্যাকেট বা তার বেশী হলে এই ঝুঁকি ৮৩% বৃদ্ধি পায়। মুখ ও গলার ক্যান্সারে আক্রান্তদের ৯০% লোকই তামাক গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে থাকে। এছাড়াও লিভার, প্যানক্রিয়াস, পাকস্থলি, মূত্রথলি, কিডনী ও সারভাইকাল ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা বেশী ।

সম্প্রতি গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, ধূমপানের কারণে ডিএনএ অনুক্রমের পরিবর্তন ঘটতে পারে। এর ফলে একজন পিতা যিনি ধূমপান করেন তার সন্তানেরা (inherit genetic damage) ‘জিন’ বা বংশগতি সম্বন্ধনীয় ক্ষতিকর উত্তরাধীকারী হতে পারে। বিজ্ঞানী ও গবেষক ('Carole Yauk, Ph.D' - lead author of the study and research scientist in the Mutagenesis Section of Health Canada's Environmental and Occupational Toxicology Division.) এর মতে একজন ধূমপায়ী মাতার কারণে ভ্রুনের ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু একজন ধূমপায়ী পিতা তার স্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের অনেক আগেই সম্ভাব্যরূপে আগত সন্তান সন্ততির ক্ষতি হতে পারে। তাই যারা ভাবে সন্তান জন্মাবার পরে ধূমপান ছেড়ে দিবে তাদের ভাবনা ঠিক না। মূল প্রবাহের তামাকের ধোঁয়ায় (Mainstream tobacco smoke - MTS) প্রায় ৪০০০ রাসায়নিক উপাদান থাকে, যেগুলোর বেশীরভাগই (genotoxic) বংশানুগতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক উপাদান ‘জীন’-এর জন্য বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে। যারা সরাসরি তামাকের ধোঁয়ার সংস্পর্শে এসেছে তাদের কারণে তাদেরই ভবিষ্যৎ বংশধরেরা (যারা কখনই তামাকের সংস্পর্শে আসেনি) বংশগতি সম্বন্ধীয় রোগের বাহক হিসাবে জন্ম নিতে পারে। সুতরাং এখনই সাবধান না হলে (genetic disease) বংশগঝত সম্বন্ধীয় রোগ আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা যে দিন দিন বৃদ্ধি পাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ধূমপানের কারণে স্বাদ ও গন্ধ নেয়ার ক্ষমতা হৃাস পায়। সম্প্রতি এক পর্যবেক্ষনে দেখা গেছে যুবক বয়সেই ধূমপায়ীদেরকে বৃদ্ধের মত দেখায় এবং যে যত বেশী বেশী ধূমপান করে তার মুখের চামড়া তত তাড়াতাড়ি ও ততোবেশী কুঁচকে যায়। ধূমপান করলে আঙ্গুল, দাঁত ও ঠোট বিবর্ণ হয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাস, চুল ও কাপড়ে দুর্গন্ধ হয়।

তামাক ব্যবহার দারিদ্র জনগোষ্টির উপর প্রভাব ফেলছে। গবেষণায় দেখা যায়, আমাদের দেশে তামাকের পিছনে ব্যয়কৃত অর্থের ৬৯% খাদ্যের পিছনে ব্যয় করা হলে ৫০% শিশুকে অপুষ্টি থেকে বাচাঁনো সম্ভব। এছাড়া তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধি তামাক ব্যবহার হ্রাস করে এবং তামাক কোম্পানির নতুন ধূমপায়ী (বিশেষ করে যুবক ও দারিদ্র জনগোষ্ঠীকে) তৈরিকে বাধাগ্রস্থ করে। তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির মাধ্যমে আদায়কৃত অতিরিক্ত রাজস্ব সরকার প্রয়োজনে দরিদ্র লোকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ব্যয় করতে পারে। প্রায়শই কোম্পানিগুলো অনেক টাকা রাজস্ব দেয় বলে নিজেদের জাহির করতে চায়। তামাক কোম্পানিগুলোর কর বৃদ্ধি হলে রাজস্ব এবং কর্মসংস্থান হ্রাস পাবে বলে কর বৃদ্ধির বিরোধীতা করে থাকে। গবেষণায় দেখা যায়, কর বৃদ্ধি হলে তামাক ব্যবহার হ্রাস পেলেও দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে তামাক নিয়ন্ত্রণ হলে ১৮.৭% চাকুরি বৃদ্ধি পাবে। অপর গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিবছর বিড়ির পেছনে প্রায় ২৯১২ কোটি টাকা খরচ হয়, যা দিয়ে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে। এ গবেষণা অনুযায়ী বিড়ির বার্ষিক খরচ দিয়ে ৪৮৫ কোটি ডিম অথবা ২৯ কোটি ১ কেজি ওজনের মুরগী, অথবা ২৯ লক্ষ গরু অথবা ১৪ লক্ষ টন চাল কিনা সম্ভব। তামাকজাত দ্রব্যের উপর কর বৃদ্ধির মাধ্যমে আদায়কৃত অতিরিক্ত রাজস্ব সরকারের প্রয়োজনে দরিদ্র লোকদের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য ব্যয় করতে পারে। তামাকের উপর কর বৃদ্ধির ফলে সরকার তিনভাবে লাভবান হবে, প্রথমত রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পাবে, দ্বিতীয়ত জনস্বাস্থ্য উন্নয়ন হবে, তৃতীয়ত তামাক হতে আদায়কৃত রাজস্ব তামাক শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থানে ব্যয় করা সম্ভব হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার, কোম্পানিগুলো মূলত সংগৃহীত ভ্যাট রাজস্ব খাতে জমা দেয়, ভ্যাট পুরোটা জনগণের টাকা। কিছু অর্থ রাজস্ব খাতে দিয়ে, সরকারের উপর রোগ ও অসুস্থতার বোঝা চাপিয়ে অনেক অনেক টাকা লাভ হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে তামাক কোম্পানী।

মানুষের স্বাস্থ্য অপেক্ষা অর্থ কখনই মুখ্য হতে পারে না। তামাক কোম্পানিগুলো শুধুমাত্র তাদের মুনাফা লাভের আশায় দেশের জনস্বাস্থ্য, পরিবশ এবং অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিবে তা আমরা কখনই মেনে নেব না। সরকার প্রশাসন তামাক নিয়ন্ত্রণ সংগঠন, গণমাধ্যমকর্মীদের পারষ্পরিক সহযোগীতা ও পদক্ষেপ কোম্পানির অশুভ উদ্দেশ্য প্রতিহত করে জনগণের স্বাস্থ্যকে রক্ষা করবে এ আমাদের বিশ্বাস।

ইবনুল সাঈদ রানা, চেয়ারম্যান, নিরাপদ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন
nirapadfoundation@gmail.com

তথ্যসূত্র -

  1. lead author of the study and research scientist in the Mutagenesis Section of Health Canada's Environmental and Occupational Toxicology Division.
  2. http://www.bata.net.bd
  3. http://www.ubinig.org


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।