তামাক চাষে মাটি ক্ষয়


মাটি বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। গত ৩-৪ দশক থেকে মাটির উপর প্রচন্ড চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে। বিভিন্ন ফসলের আধুনিক জাত ও হাইব্রিড শস্য আবাদের ফলে মাটির উৎপাদিকা শক্তি নিঃশেষ করা হয়েছে। গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত এর উপর যুক্ত হয়েছে তামাক চাষ। তবে, বাংলাদেশে তামাক চাষের ফলে মাটি ক্ষয়ের সঠিক হিসাব খুঁজে পাওয়া যায় না। অন্যত্র প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায় তামাকের এক ফসলে একরে ৩০০০ পাউন্ড পাতা এবং ৩০০০ পাউন্ড কান্ড উৎপাদনে মাটি থেকে নাইট্রোজেন ১২৬, ফসফরাস ২৬, পটাশ ২৫৭, ক্যালসিয়াম ৭৫, ম্যাগনেশিয়াম ১৯, তামা ০.০৩, ম্যাঙ্গানিজ ০.৫৫ এবং জিঙ্ক ০.০৭ পাউন্ড তুলে নেয় ১।

তামাক বাংলাদেশে একটি বহিরাগত আগ্রাসি প্রজাতির উদ্ভিদ। গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে রবি মৌসুমে খাদ্য শস্যের জমিতে তামাক চাষ শুরু হয়। বৃটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানি প্রথমে তিস্তা অববাহিকায় তামাক চাষ প্রবর্তন করে। পরে পদ্মা অববাহিকায় কুষ্ঠিয়া অঞ্চলে এবং সাম্প্রতিক কালে পার্বত্য চট্রগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে মাতামহুরী অববাহিকায় সম্প্রসারিত হয়। সাম্প্রতিক কালে তামাক চাষ বেড়েই চলছে। ২০০১ সালে ৭৩,৮৭০ একর জমিতে তামাক চাষ হয়। ২০১১-২০১২ মৌসুমে ১,২৬,০০০ একর জমিতে তামাক চাষ সম্প্রসারিত হয় (বিবিএস ২০১২)।

তামাক একটি অর্থকরি ফসল। খাদ্য শস্যের জমি দখল করে তামাক চাষ করা হয়। খরিপ-২ মৌসুমের শেষ ভাগ, রবি মৌসুম পুরাপুরি এবং খরিপ-১ মৌসুমের প্রথম ভাগ দখল করে। ফলে নিবিড় ফসলের এলাকায় তিনটি ফসলের সময় জমি জবর দখল করে তামাকের একটি ফসল আবাদ হয়।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রধানত: তিন জাতের তামাক যেমন জাতি, মতিহারি এবং ভার্জিনিয়া আবাদ করা হয়। জাতি এবং মতিহারি প্রধানত: রংপুর এবং বান্দরবানে আবাদ করা হয়। ভার্জিনিয়া প্রধানত: কুষ্টিয়া, রংপুর, যশোর এবং মানিকগঞ্জে আবাদ করা হয়। সীমিত পরিমাণ জমিতে বার্লি জাতের তামাক আবাদ হয় ৩।

সাম্প্রতিক কালে তামাক চাষ যশোর, ঝিনাইদহ, নীলফামারী, লালমনিরহাট ও টাঙ্গাইলে সম্প্রসারিত হয়েছে। সময়ের সাথে তামাক চাষের স্থান পরিবর্তনের প্রধান কারণ হচ্ছে বেশি দিন তামাক চাষ করলে মাটির উর্বরতা শক্তি কমে যায় এবং তামাক পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে জ্বালানি কাঠের অভাব দেখা দেয়। এ অবস্থা মোকাবেলা করতে তামাক কোম্পনি প্রতিনিয়ত নতুন এলাকায় নতুন জমিতে তামাক চাষ সম্প্রসারণ করে চলছে।

উবিনীগের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে কৃষকরা প্রতি হেক্টর জমিতে ৫৭৫ কেজি ইউরিয়া এবং ৪৬৬ কেজি টিএসপি ব্যবহার করেন। তাছাড়া তামাকের এক ফসলে ১৬ বার বালাইনাশক স্প্রে করেন। তামাকের ক্ষেতে ৪৭ রকমের বালাইনাশক ব্যবহার করা হয় ২।

তামাক চাষের ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়। মাটি শক্ত হয়ে যায়। অন্য ফসল ভাল হয়না। যেমন ধান পাকার আগে গাছ শুকিয়ে যায়। স্থানীয় অন্য জাতের ফসল আবাদ না করার কারণে বীজ হারিয়ে যায়। কৃষকরা তামাক চাষের উপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। পার্বত্য চট্রগ্রাম অঞ্চলের কৃষকরা ব্যপক হারে তামাক চাষের উপর ঝুঁকে পড়েছেন। প্রায় ৯০% কৃষকরা তামাক চাষের উপর নির্ভশীল হয়ে পরেছেন ৪।

মাটি ক্ষয়, পানি দূষণ, বালাইনাশক দ্বারা পরিবেশ দূষণ সর্বোপরি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়ে তামাক চাষ সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। কুষ্টিয়া জেলা এক সময় খাদ্য উদ্বৃত্ত এলাকা ছিল, সেখানে শাক সবজি ডাল, আলু, পাট ইত্যাদি ফসল সরিয়ে দিয়ে তামাক চাষ করা হচ্ছে। এ ভাবে পার্বত্য চট্রগাম অঞ্চলেও ধান ও শাক সবজি চাষের স্থলে তামাক চাষ করা হচ্ছে৫। তামাক চাষে প্রচুর পরিমাণ বালাই নাশক ব্যবহার করা হয়। এ বালাই নাশক ভূ-উপরি ভাগের মাটি ও পানি সহ ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে যেমন জমা হয় তেমনিই সার্বিক পরিবেশ দূষণ ঘটায়। অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও বালাই নাশক ব্যবহারের ফলে মাটি সৃষ্টিকারী জীব অণুজীব মারা যায়। মাটি গঠনের চিরন্তন প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়।


তামাক ক্ষেত


পৃথিবী ব্যাপি আবাদী জমির ০.৩% তামাক চাষে ব্যবহার হয়। গণ সচেতনতার কারণে বিশ্বব্যাপি তামাক চাষের এলাকা কমছে। ১৯৯০ সালে ৪.৬ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে তামাক চাষ হয়েছিল। ২০১০ সালে তা কমে হয়েছে ৩.৯ মিলিয়ন হেক্টর। তামাক চাষ কমার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে যে তামাক চাষে মাটি নষ্ট হয়। অন্য ফসল আবাদের জন্য মাটি অনুপযোগী হয়। উচ্চহারে বালাই নাশক ব্যবহার হয়। প্রচুর পরিমান পানি খরচ হয়। তামাক পাতা প্রক্রিয়াজাত করতে বনাঞ্চল ধ্বংশ করা হয় ১

ইদানিংকালে উন্নত বিশ্বে তামাক উৎপাদন ও ব্যবহার কমছে। পক্ষান্তরে উন্নয়নশীল দেশে তামাক চাষ বাড়ছে। ১৯৭০ সালে বৈশ্বিক তামাক উৎপাদনের ২০% হতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। যা ২০০০ সালে কমে হয় ৮%। একই সময় ইউরোপিও ইউনিয়নের উৎপাদন ১৪% থেকে কমে হয়০৭%। জাপানের উৎপাদন কমেছে ৫০% (এফএও,২০০৩)। তামাক উৎপাদনের এই স্থান পরিবর্তন হলেও উন্নত বিশ্বের তামাক উৎপাদনকারী কোম্পানির মালিকদের আয়ের কোন কমতি হয়নি। যেমন ফিলিপ মরিচ যার হেডকোয়ার্টার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং বৃটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির আয় জমা হয় যুক্তরাজ্যে। উন্নয়নশীল বিশ্বে এসব কোম্পানির তৎপরতা বেড়েই চলছে। শুধু উৎপাদন নয় তামাকের ব্যবহারও বেড়েছে উন্নয়নশীল বিশ্বে। বিশ্বে ১.৩ বিলিয়ন তামাক সেবির ৮৪% বাস করে উন্নয়শীল দেশে (বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০০৪)।

বাংলাদেশের মত কৃষি প্রধান দেশের মাটি ক্ষয় রোধ করা অত্যন্ত জরুরী। জনগণের খাদ্য উৎপাদন তথা জনগণের বসবাসের উপযোগী মাটি ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে তামাকের মত আগ্রাসী প্রজাতির উদ্ভিদের সম্প্রসপ্রণ নিয়ন্ত্রণ এখন সময়ের দাবী।

তথ্য সূত্র:

1. Africa’s Farmers Weekly,26 October 2012

2. Farida Akhter.www. fair trade tobacco.org, tobacco to food crop production

3. Hossain, M.H, Rahman.2013. A Socio-economic analysis on tobacco cultivation in Kushtia district of Bangladesh, Social Science 2(3):128-134.

4. Motaleb, M.A.2011 Indian Journal of Traditional knowledge 10 (3):481-485

5. www.labor right.org/sites/tobacco

6. www.soil.nesu.edu/publications/soil facts/ag-439-16w.pdf


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।