জনস্বাস্থ্য রক্ষায় স্বাস্থ্য খাতে সঠিক বরাদ্দ জরুরি


বাজেটে অর্থ বরাদ্দ যেমন জরুরি, তেমনি অর্থ সংগ্রহের পদ্ধতির মাধ্যমেও জনস্বাস্থ্য রক্ষা সম্ভব। বাইরে থেকে কোনো প্রকার অর্থ সাহায্য ছাড়াই উচ্চহারে করারোপ করে তামাকের মতো ক্ষতিকর পণ্য যেমন— বিড়ি, সিগারেট, সাদাপাতা, জর্দা, গুল ইত্যাদি ক্রয়ক্ষমতার নাগালের বাইরে নিয়ে আসতে পারলে সেবনের হার কমবে, অতএব ক্ষতির প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে। কথাটি সরলীকরণ নয়, বরং বিভিন্ন দেশের গবেষণায় প্রমাণিত সত্য। এটা ঠিক, উচ্চকর বা নিম্নকর নির্ভর করে কোন পণ্যের ওপর তা আরোপ করা হয়েছে। বাজেটের পরে প্রতিক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ খাদ্যদ্রব্য, নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের দাম বাড়ল কি কমল, তা নিয়ে উদ্বেগ জানায়। কিন্তু এটা আমরা দেখি না যে, সাধারণ মানুষের ব্যবহারের তালিকায় যেসব ক্ষতিকর পণ্য আছে, যার ওপর উচ্চ করারোপ করলে তার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, তা নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করতে। তামাকদ্রব্য, মদ ও অন্যান্য ক্ষতিকর খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় উচ্চকরের আওতায় আনা যেতে পারে। আমি এখানে বোঝার সুবিধার জন্য ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস প্রকাশিত একটি তথ্যচিত্র থেকে কিছু উপাত্ত তুলে ধরছি। প্রথমেই বলতে হয়, মনে হয় বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বোকা ও দুর্ভাগা দেশ, যেখানে সস্তায় পেলে বিষ গিলতেও আপত্তি নেই। এবং বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে সিগারেট ও বিড়ির দাম বিশ্বের অন্য সব দেশের চেয়ে কম। সস্তা দামে ধোঁয়াযুক্ত ও ধোঁয়াবিহীন তামাকদ্রব্য সেবন করে সাময়িক আনন্দ পাওয়া যায় হয়তো, নায়ক নায়ক ভাব আনা যায়, কিন্তু যখন দেখি হূদরোগে আক্রান্ত মৃত্যুর ৩০ শতাংশ, ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর ৩৮ শতাংশ, ফুসফুসে যক্ষ্মার কারণে মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রজনিত মৃত্যুর ২৪ শতাংশের জন্য দায়ী ধূমপান তখন আনন্দ থাকার কথা নয়। শুধু যিনি ধূমপান করেন, তিনি একা নন, তার আশপাশে বিশেষ করে পরিবারের নারী ও শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হন। বাংলাদেশে প্রায় ৬৩ শতাংশ কর্মজীবী নারী ও পুরুষ কর্মক্ষেত্রে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন এবং তারাও একই ধরনের রোগে মারা যেতে পারেন। এছাড়া রয়েছে ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য (পানের সঙ্গে জর্দা, সাদাপাতা, গুল) ব্যবহারে মুখের ক্যান্সার, নারীদের ক্ষেত্রে প্রজনন স্বাস্থ্যের ক্ষতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তার গর্ভের শিশুও রেহাই পাচ্ছে না। অল্প ওজনের সন্তান প্রসব করা বা মৃত শিশুর জন্ম দিয়ে বহু নারী শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছেন। তবুও ভালো যে জর্দা-গুল সেবন ফ্যাশনের অংশ নয়, একটু কুটিল চরিত্রের লোক দেখাতে হলেই মুখভর্তি পান-জর্দার চিত্র ভেসে ওঠে। শীতকালীন খাদ্য ফসলের চাষের ভরা মৌসুমে তামাক পাতার চাষ করা হচ্ছে, বলা যায় সরাসরি নিকোটিন উত্পাদন করা হচ্ছে অতিমাত্রায় সার-বিষ ব্যবহার করে, মাটি ও পানি দূষিত করে। তামাক পাতার নিকোটিন ক্রমে পরিচর্যাকারীর হাত, পা, মুখ ও শরীরের ভেতর প্রবেশ করে জটিল রোগ সৃষ্টি করে। একইভাবে বিড়ি ও জর্দা-গুল উত্পাদনের কারখানাগুলোকে রোগ সৃষ্টির কারখানা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। কাজেই তামাকের কারণে স্বাস্থ্যের ক্ষতি, অর্থনৈতিক ক্ষতি সবই হচ্ছে। শুধু ধূমপানজনিত অসুস্থতার কারণে জাতীয় উত্পাদনশীলতায় আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা এবং জিডিপির ৩ শতাংশের বেশি। তাহলে এটা পরিষ্কার যে, তামাক সেবন বাংলাদেশের মানুষের সুস্থ থাকা এবং দেশের অগ্রগতির পথে বড় অন্তরায়।

তামাক বিরোধী নারী জোটের (তাবিনাজ) সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে গত কয়েক বছরে তামাক নিয়ন্ত্রণে যারা নিয়োজিত, তাদের সঙ্গে মিলে বাজেটে বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, সাদাপাতা, গুল ইত্যাদি দ্রব্যের ওপর উচ্চহারে করারোপের দাবি জানাচ্ছি। এতে একদিকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে, যা স্বাস্থ্য খাতে ও তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিতে ব্যবহার করা যাবে, অন্যদিকে মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষা পাবে। এ বাজেটে সুনির্দিষ্ট দাবি হচ্ছে— সিগারেটের ওপর করারোপের জন্য ব্যবহূত মূল্যস্তর প্রথা তুলে দিয়ে সব ধরনের সিগারেটে একই হারে বাড়াতে হবে, তাতে কম দামি সিগারেট বলে আলাদা কিছু যেন না থাকে। গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিতে হলে বিড়ি ও জর্দা-গুলের ওপর উচ্চহারে সুনির্দিষ্ট এক্সাইজ করারোপ করতে হবে। তামাক পাতা রফতানিতে উচ্চহারে রফতানি করারোপ করতে হবে। এটাকে চিংড়ি ও পোশাক শিল্পের মতো রফতানি পণ্য বানিয়ে বিশ্বের মানুষের রোগের কারণ সৃষ্টি করা যাবে না।


ছাপবার জন্য এখানে ক্লিক করুন



৫০০০ বর্ণের অধিক মন্তব্যে ব্যবহার করবেন না।