তামাক কম্পানি ফিলিপ মরিস উরুগুয়ের কাছে মামলায় হেরে গেছে
মাত্র প্রায় ৩৫ লক্ষ জনসংখ্যার দেশ উরুগুয়ে। দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশটি নানা কারণে বিশ্বে পরিচিত। বিশেষ করে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কয়েক রাউন্ড আলোচনা এখানেই হয়েছে। এখন দেশটি বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে কারণ তারা বিশ্বের বৃহত্তম তামাক কম্পানি ফিলিপ মরিস ইন্টারন্যাশনালকে মামলায় হারিয়ে দিয়েছে। ফিলিপ মরিস মামলা করেছিল যে উরুগুয়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সুইজারল্যান্ড ও উরুগুয়ের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি ভংগ করেছে। সুইজারল্যান্ডে ফিলিপ মরিস কম্পানি হিশেবে নিবন্ধিত। মামলাটি করা হয়েছিল বিশ্ব ব্যাংকের বিনিয়োগ সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের আরবিট্রেশান পেনেলের কাছে।
ফিলিপ মরিস উরুগুয়ের সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা এবং তার কম্পানির ব্রান্ড নাম ব্যবহারে নিষধাজ্ঞার বিরোধিতা করেছে। উরুগুয়ে সরকারের তামাক বিরোধি আইনের অধিনে সিগারেটের প্যাকেটে উভয় দিকে শতকরা ৮০% ছবিযুক্ত স্বাস্থ্য সতর্কবার্তা থাকতে হবে এবং প্লেইন প্যাকেজিং-য়ের নিয়মানুযায়ি তার বিশেষ ব্রান্ড যেমন Marlboro Red অথবা Marlboro Gold দেয়া যাবে না। এই কারণে ফিলিপ মরিস উরুগুয়ের বাজার থেকে ১২টি ব্রান্ডের সিগারেট তুলে নেয়।
ফিলিপ মরিস অভি্যোগ করেছে যে উরুগুয়ের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কারণে তার বুদ্ধিবৃত্তিক মেধাসত্ব অধিকার (intellectual property rights) ক্ষুন্ন হয়েছে এবং তার ব্যবসার ক্ষতি হয়েছে। উল্লেখ্য ফিলিপ মরিসের ১৮০ দেশে ব্যবসা আছে এবং তার বার্ষিক আয় ৮০ বিলিয়ন ডলার, যা উরুগুয়ের বার্ষিক আয়ের চেয়েও বেশি ; উরুগুয়ের বার্ষিক আয় ৫০ বিলিয়ন ডলার।
মামলার শুনানীর পর ৮ই জুলাই উরুগুয়ে সরকারের পক্ষে রায় দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, বিরোধ নিস্পত্তি প্যানেল ফিলিপ মরিসকে উরুগুয়ের মামলার খরচও দেয়ার আদেশ দেয়। ফিলিপ মরিসের দেয়া যুক্তিগুলো গ্রহণযোগ্য হয়নি। তামাক নিয়ন্ত্রনের জন্যে তামাক কম্পানির বিরুদ্ধ্বে এই রায় শুধু উরুগুয়ের জন্যে নয়, বিশ্বের অন্যান্য সকল দেশের তামাক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্যে ঐতিহাসিক তাৎপর্য বহন করে । এই প্রসঙ্গে সেই দেশের রাষ্ট্রপতি তাবারে ভাজকুয়েজ President Tabaré Vázquez, যিনি নিজে একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ, জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেন, “ মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য রক্ষার মতো মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে কোন প্রকার বাণিজ্যক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়া গ্রহণযোগ্য হতে পারে না” ।
উরুগুয়ের এই জয় সারা বিশ্বে তামাক নিয়ন্ত্রনের সাথে যুক্ত ব্যাক্তি ও সংগঠনের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক সংগঠন ক্যাম্পেইন ফর টব্যাকো ফ্রি কিডস [Campaign for Tobacco-Free Kids] এর প্রেসিডেন্ট ম্যাথিউ মায়ার্স বলেন এই রায় আন্তর্জাতিকভাবে তাৎপর্যপুর্ণ কারণ এই রায়ের মাধ্যমে শুধু উরুগুয়ে নয়, সব দেশেরই জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষে তামাক ব্যবহার কমানোর জন্যে কার্যকর ব্যাবস্থা গ্রহণের সার্বভৌম অধিকার স্বীকৃতি পেল। রায় ফিলিপ মরিসকে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনকে অগ্রাহ্য করার আন্তর্জাতিক চুক্তিকে ব্যবহারের মতো ঘৃন্য প্রচেষ্টার নিন্দা জানিয়েছে।
মাইকেল ব্লুমবার্গ, যিনি নিউ ইয়র্ক সিটির তিন বার মেয়ার ছিলেন এবং ব্লুমবার্গ ফিলানথ্রফির প্রতিষ্ঠাতা, এই রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘ এই রায় উরুগুয়ের জনগণের জয় এবং এর মাধ্যমে প্রমান হচ্ছে সারা বিশ্বে তামাক কম্পানির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো সম্ভব এবং জয়ি হওয়াও সম্ভব। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষা নিশ্চিত করা এবং আমরা এই কাজে তামাক কম্পানি বাধা দিলে তা দূর করার কাজে সাহায্য করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কোন দেশেরই তামাক কম্পানির হুমকিতে পিছিয়ে আসা উচিত নয়। এই রায় আরও অনেক দেশকে মানুষের জীবন বাঁচাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করবে’।
বাংলাদেশে তামাক বিরোধী নারী জোট (তাবিনাজ) উরুগুয়ে সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছে এবং তামাক নিয়ন্ত্রণের জন্যে সকল প্রকার বাধা অতিক্রম করে জনগণের স্বাস্থ্য রক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে বাংলাদেশের সরকারকে আহবান জানাচ্ছে। আমরা দেখেছি সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবানী দেয়ার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কম্পানি কিভাবে হস্তক্ষেপ করেছে এবং করারোপের ক্ষেত্রেও তারা বাধার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে তামাক নিয়ন্ত্রণে তাদের অঙ্গীকার ঘোষনা করেছেন। আমরা আশা করছি উরুগুয়ের মতো বাংলাদেশও তামাক নিয়ন্ত্রণে এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারবে।