ডারবান জলবায়ু সম্মেলন
ফরিদা আখতার || Thursday 01 December 2011 ||পরিবেশ সম্মত কৃষি এনে দেবে কোটি মানুষের খাদ্যের নিশ্চয়তা
জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলন কপ-১৭ ডারবানে শুরু হয়েছে ২৮ নভেম্বর, শেষ হবে ডিসেম্বর ৯ তারিখে। বাংলাদেশে এই উপলক্ষে আর কিছু না হোক পরিবেশ মন্ত্রী ডা. হাছান মাহমুদের পদোন্নতি ঘটেছে। আগে তিনি গেছেন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে, এবার যাচ্ছেন পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে। যদিও এর ফলে ডারবানে বাংলাদেশের কদর কতখানি বাড়বে বা হিশাব নিকাশে কি বদল ঘটবে তা বলা মুশকিল। আমাদের চিন্তা এই মুহুর্তে সার্বিকভাবে জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের মতো ঝুঁকিতে রয়েছে এমন দেশ গুলোর ভবিষ্যত কি হবে? ধনী দেশগুলো আসলেই তাদের দায়িত্ব পালন করবে কি?
কিওটো প্রটোকল ১৯৯৭ সালে শুরু হয়েছে, মেয়াদ শেষ হচ্ছে ২০১২ সালে। এই চুক্তির প্রধান দিক ছিল জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে হলে কার্বন নির্গমনের হার কমাতে হবে, বিশেষ করে ধনী দেশগুলো যারা কার্বন নির্গমনের জন্য প্রধানতঃ দায়ী তাঁরা শতকরা ৪০ ভাগ কমাবে। এটাই ছিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবী। কিন্তু ধনী দেশ তাদের দিক্ থেকে সাড়া দিতে চাইছে না। এর আগে কানকুন এবং কোপেনহেগেন সম্মেলন ভেস্তে গেছে, তাদের কিছুই এসে যায় না। ডারবানে এসেও কোন আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছে না, উলটো কানাডা বলে দিয়েছে তারা এসব বাধ্যবাধকতায় থাকতে চায় না। রাশিয়া ও জাপান আগেই এই কাজ করে ফেলেছে, আর ইওরোপিয়ান ইউনিয়ন শর্ত দিয়েছে যে যদি যুক্ত রাষ্ট্র, চীন ও ভারত কার্বন নির্গমন না কমায় তাহলে তারাও করবে না। এ যেন ছোট বাচ্চাদের খেলা। যেখানে সারা বিশ্বের মানুষের জীবন- মরণের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে সেখানে তারা একে অপরের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজ দায়িত্ব পালন করছে না। তাই ডারবানের সম্মেলনের শুরুতেই হতাশার সুর শোনা যাচ্ছে। ভেস্তে যাবার সব লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
কিয়োটো প্রটোকলের অঙ্গীকারের প্রথম দফার মেয়াদ ২০১২ সালে শেষ হলে দ্বিতীয় পর্বে অঙ্গীকার (Second commitment period (SCP) ) করার যে প্রস্তাব এড-হক ওয়ার্কিং গ্রুপ করেছে তা ডারবান সম্মেলনে সব সংশ্লিষ্ট পার্টি একমত হবে কিনা তা এখন বড় অক্ষরের ‘যদি’ হয়ে আছে। উল্লেখ্য উন্নয়নশীল দেশগুলো ২০১৩ থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়কালে ধনী দেশগুলো যেন ১৯৯০ সালের তুলনায় ৪০% কমিয়ে আনে তার দাবী করে আসছে। একদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর দাবী হচ্ছে কিয়োটো প্রটোকলের দ্বিতীয় দফা অঙ্গীকারে যাওয়া, অন্যদিকে ধনী দেশগুলো চাইছে কিওটো চুক্তি বাদ দিয়ে নতুন চুক্তি করা যার অধীনে যুক্তরাষ্ট্র এবং চারটি উদীয়মান উন্নয়নশীল দেশ ব্রাজিল, চীন, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা (যাদের BASIC দেশ বলা হয়) অন্তর্ভুক্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্র তার মনমতো না হলে কোন চুক্তি এতোদিন মানে নি, এখনো মানবে না সাফ বলে দিয়েছে। উন্নয়নশীল দেশ সমুহের প্রতিনিধিরা মনে করছেন এই নতুন চুক্তির কথা বলে ধনী দেশগুলো তাদের দায়িত্ব এড়াতে চাইছে এবং কিয়োটো চুক্তির মতো শক্ত আইনী বাধ্য-বাধকতা থেকে বেরিয়ে দুর্বল চুক্তি করতে বলছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো বা জি-৭৭ এবং চীনের পক্ষ থেকে আহবান জানানো হয়েছে যে ডারবান যেন কিয়োটো প্রটোকলের কবরস্তান না হয়ে দ্বিতীয় অঙ্গীকারের জন্মস্থান হতে পারে। অর্থাৎ প্রশ্ন উঠেছে ডারবানের যে ফলাফল হতে যাচ্ছে তা কি পৃথিবীর ১% মানুষের বিলাসের জন্য নাকি ৯৯% মানুষকে রক্ষার জন্য হবে?
জলবায়ু সম্মেলনে কি পেয়েছি আর কি বা পেলাম- এর হিশাব নিকাশ সম্মেলন শেষ হলে অনেক হবে, আমি সে সব নিয়ে এই অল্প পরিসরে লিখতে পারছি না। কিন্তু যা নিয়ে আমি শংকিত তা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাদ্য সংকটের যে সম্ভাবনা রয়েছে তার সমাধান নিয়ে নতুন ব্যবসা শুরু হচ্ছে এবং তার শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো। আমাদের জন্য কৃষি সংখ্যাগরিষ্ট কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার মাধ্যম। উন্নয়নশীল দেশের কৃষিতে যুক্ত রয়েছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। সারা বিশ্বে এদের সংখ্যা প্রায় ৫০ কোটি পরিবার এবং প্রায় ১৫০ কোটি (১.৫ বিলিয়ন) মানুষ পরিবার মাত্র ২ হেক্টর জমির ওপর নির্ভর করে চলছেন। ক্ষুদ্র কৃষকরা বিশ্বের মোট কৃষি খামারের ৮৫%। এই তথ্য দিয়েছেন ২০০৮ সালে Special Rapporteur on the right to food অলিভার দি সুটার [UN General Assembly (A/HRC/9/23)] । কাজেই জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলে ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থের কথা না ভেবে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তা আত্মঘাতি হবে। কারণ দেখা যাচ্ছে খাদ্য সংকটের সমাধান হিসেবে রাসায়নিক ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল মডেলের কৃষি উৎপাদনের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে যা নিজেই গ্রীণ হাউজ গ্যাস নির্গমনের (GHG) কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বহু তথ্য ইতিমধ্যে সংগৃহিত হয়েছে যেমন Vandermeer, J., G. Smith, I. Perfecto এবং E. Quintero (২০০৯) তাঁদের Effects of industrial agriculture on global warming and the potential of small-scale agroecological techniques to reverse those effects গবেষণায় দেখিয়েছেন জীবাশ্ম জ্বালানি-নির্ভর কৃষি উপকরণ, রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং তথাকথিত ‘নতুন’ উদ্ভাবিত ফসল দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই তো হয়ই নি, বরং পরিবেশের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা বলছেন বর্তমানে প্রচলিত কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তনই জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকী ঠেকাতে পারবে।
বাংলাদেশে বছরে বছরে বন্যা, খরা, শীতের কুয়াশা ইত্যাদী অবস্থার পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো দেখা যাচ্ছে গত কয়েক বছরে। এর সাথে কৃষি ফসলেরও ক্ষয়-ক্ষতি আমরা লক্ষ করেছি। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে আবহাওয়া পরিবর্তনের বিষয়টি হিশাব-নিকাশের মধ্যে থাকছে না। কি হবে কিছুই ঠিক নাই। আমাদের দেশের কৃষকরা এই জ্ঞান রাখেন যে আবহাওয়া পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে কি ফসল বুনতে হয়। আমাদের সরকার বিদেশী অর্থে পরিচালিত কর্মসুচীর ওপর নির্ভরশীল। তাই তারা বিদেশী প্রযুক্তি-নির্ভর সমাধান আমাদের দিচ্ছেন। এই পর্যন্ত যে সব গবেষনা হয়েছে তার মধ্যে এগিকালচারাল সেক্টর প্রোগ্রাম সাপোর্ট (ASPS-II) এর প্রতিবেদনে দেখাচ্ছে যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ধানের মধ্যে আউশ ধানের ক্ষতি সবচেয়ে বেশী হবে। কিন্তু এর কারণ শুধুই জলবায়ু পরিবর্তন নয়, আউশ ধান আবাদ কমে যাওয়ার পেছনে তামাক চাষ, ফুল চাষ, বোরো ধানের বেশী আবাদ ইত্যাদীও জড়িত, সেই কথাগুলো উচ্চারিত হয় না।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ক্ষতিপুরণের দাবী নিয়ে ডারবানে সোচ্চার হয়ে ভিক্ষার হাত বাড়িয়ে দিলেও ভাগে খুব বেশী জুটবে না। অথচ আমাদের হাতে যে সমাধান আছে তার দিকেই মনোযোগ দিতে পারি আনায়াসে। আমি সেই বিষয়েই কিছু কথা বলতে চাই। জীবন-জীবিকার দিক থেকে সমাধানের পথ খোঁজাই বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশের জন্য সবচেয়ে সমীচিন পদক্ষেপ হবে। এবং তা হতে হবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী ও পরিবেশ সম্মত কৃষির প্রচলন। এই প্রস্তাব ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে International Assessment of Agricultural Knowledge, Science and Technology for Development (IAASTD, 2009) উত্থাপন করেছে। তারা মাটির স্বাস্থ্য রক্ষা, প্রাণবৈচিত্র রক্ষা এবং কৃষকের জ্ঞান নির্ভর কৃষি ব্যবস্থা প্রণয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার ওপর ফসলের উৎপাদনশীলতার সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ট। রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়েছে, তাই উৎপাদনশীলতাও কমতে শুরু করেছে। পরিবেশ সম্মত কৃষি মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধিতেও সাহায্য করবে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে ৩০ বছর ধরে প্রচলিত কৃষি এবং অর্গানিক কৃষির তুলনামুলক গবেষণায় দেখা গেছে ভুট্টার ফলন অর্গানিক পদ্ধতিতে ৩১ গুন বেশী হয়েছে, ইথিওপিয়াতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার না করে কম্পোস্ট ব্যবহার করা জমিতে সমান কিংবা দিগুন ফসল হয়েছে (সুত্রঃ Edwards, S., Arefayne Asmelash, Hailu Araya and Tewolde Berhan Gebre Egziabher (2009). The impact of compost use on crop yields in Tigray, Ethiopia] বাংলাদেশেও নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা বিভিন্ন জেলায় কোন প্রকার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে মাটির স্বাস্থ্য রক্ষায় ভাল ফল পাচ্ছেন এবং ফসলের উৎপাদনও বৃদ্ধি করছেন।
এককাট্টা ফসল না করে ফসল, গাছ-পালা ইত্যাদীর বৈচিত্র্য বাড়িয়ে আবহাওয়ার তারতম্যের কারণে ক্ষতি অনেক লাঘব করা সম্ভব। গাছ-পালার সাথে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী পালনের কাজ করে এই বৈচিত্র্য আরও বেশী সমৃদ্ধ হয়। সত্যি কথা বলতে কি এই সব কাজে গ্রামের সাধারণ নারী যে ভুমিকা পালন করতে পারেন, তা বড় বড় প্যান্ট-শার্ট পরা বিজ্ঞানীর পক্ষে করা সম্ভব নয়। নারী এখানে অনেক বড় বিজ্ঞানীর কাজ করছেন এবং আরও করতে পারেন, যদি তাকে সেই সহায়তা দেয়া হয়। প্রাণবৈচিত্র্য সনদ (CBD 2009) এর গবেষণায় দেখা গেছে রোয়ান্ডায় নারীরা ৬০০ জাতের সীম উৎপাদন করেন, এবং পেরুতে নারীরা ৬০ জাতের মানিওক বা কাসাবা উৎপাদন করেন। এই বৈচিত্র্য খাদ্য ঘাটতি কমাবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা রাখে। বাংলাদেশের কৃষক নারীরা হাজার হাজার জাতের ধানের পাশাপাশি প্রায় ২৩ জাতের বেগুন, ১৬ জাতের মরিচ, ৪ জাতের লাউসহ আরও নানা ধরণের খাদ্য ফসল ঘরের আনাচে কানাচে উৎপাদন করে পরিবারে খাদ্য যোগান দিচ্ছেন। তার খবর সরকারী পরিসংখ্যানে না থাকলেও পাঠক গ্রামে গঞ্জে ঘুরে দেখলেই টের পাবেন।
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে খাদ্য সংকট সৃষ্ট হলেও তার সমাধান কৃষকদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে আমরা অনেক লাভবান হতে পারতাম। অথচ এখন খাদ্য উৎপাদনের ওপর দখল নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানী। তারা ফসলের বৈচিত্র্য চায় না, তারা মাত্র দু-একটি ফসল উৎপাদন করে বাজার দখলে রাখতে চায়। এরা রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং কোম্পানী উৎপাদিত বীজের বাজার বিশেষ হাইব্রিড ও জিএমও বীজের বাজার সৃষ্টি করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাদের ওপর নির্ভর শীল করে দিতে চায়। কোটি কোটি কৃষক পরিবার চেয়ে থাকবে মাত্র চারটি বহুজাতিক কোম্পানীর ওপর!! এটা কোন মতেই কাম্য নয়।
কাজেই জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খায় এমন কৃষি আমাদের চর্চায় আনতে হবে, কৃষকের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা আমাদের সম্পদ। আমাদের মাটি নষ্ট হলেও এখনও ঠিক করার সময় আছে। আমাদের ফসলের বৈচিত্র্য রক্ষার সুযোগও এখনও অনেক রয়েছে। কোম্পানী নির্ভর নয়, কৃষক নির্ভর পরিবেশ সম্মত কৃষি ব্যবস্থাকে সহায়তা দিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা ও বেঁচে থাকার উপায় সৃষ্টি করা হবে। সেই দিকেই সরকার মনোযোগ দেবেন আশা করি।