ধানই কৃষকের প্রাণ
ফরিদা আখতার || Friday 14 April 2017 ||বলা হয়, বাংলাদেশে কৃষি কী তার পরিচয় ধান উৎপাদনের মধ্যে। কিন্তু কথাটা একাট্টা ধানের আবাদ যেমন নয়, তেমনি স্রেফ ধান চাষও নয়। কারন ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে সরকারী হিসাবেই বাংলাদেশে ধানের জাতর সংখ্যা প্রায় পনেরো হাজারেরও বেশি ছিল। তাদের মৌসুম, চাষের সময় পানির পরিমান, ফটো পিরিয়ড বা দিনের আলো ব্যাবহারের সময়কাল এক রকম ছিল না। প্রাণের বৈচিত্র্যের চর্চা হাজার হাজার জাতের ধান আবাদের মধ্যেই ধরা পড়ত।
স্রেফ ধান চাষ নয় কেন? কারণ জমিতে কখন কি ধান বুনছি তার সঙ্গে জমির ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন জড়িত। ধানচাষ কেন্দ্রিক একটি বাস্তুসংস্থান পদ্ধতি বা ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছিল। সেই সবের কিছুই আধুনিক চাষাবাদের ফলে আর নাই। এখন দেশে কোন বছর কত ধান উৎপাদন হচ্ছে তা দিয়ে কৃষির সার্বিক ভাল মন্দ বিচার হয়। কিন্তু ধানের জাত কতোটা হারিয়েছি, ধান চাষ করতে গিয়ে ডাল, তেলবীজ ও অন্যান্য ফসল কতো হারিয়েছি তার কোন খবর নাই। গবাদিপশু মাছ জলজ প্রাণি কীটপতঙ্গ পাখিপাখালি কী পরিমান ধ্বংস করা হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান সরকারি খাতায় নাই। সবাই জানেন কৃষি মানে শুধু ধান উৎপাদন নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে শাক-সব্জি, ডাল, তেল, মসলা, মাছ, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল-ভেড়া সহ আনেক কিছু। সবকিছু ছাপিয়ে ধানের উৎপাদনেই মনোযোগ দেয়া হচ্ছে সরকারি ভাবে এবং খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান মাপকাঠি হিসেবে দেখা হচ্ছে। বর্তমানে দেশের ৭৫% আবাদী জমি (১ কোটি হেক্ট্রর জমি) এবং ৮০% সেচকৃত জমিতে ধানের উৎপাদনেই ব্যবহার হচ্ছে। দেশে বছরে ৩.৫ কোটি টন আউশ, আমন এবং বোরো ধান উৎপাদন করছে। এর মধ্যে বোরো ধান সবচেয়ে বেশি প্রায় ২ কোটি টন, আমন ১.৩ কোটি টন এবং আউশ মাত্র ২৩ লক্ষ টন।
ধান্য থেকে ধান এবং এখান থেকে ‘ধন’। এটা কৃষিজাত তৃণ হলেও আপনা-আপ্নি অযত্নে জন্মায় এমন তৃণকেই ধান্য নামে উল্লেখ করা হয়। এমনই আর একটি তৃণ হচ্ছে দুর্বা ঘাস। সেদিক থেকে ধান একটি শস্য দায়িনী ঘাস। ধানের আরেক নাম শাইল বা শালি। বাংলাদেশ-আসাম অঞ্চল থেকে শুরু করে পাঞ্জাব পর্যন্ত শালি ধান বলতে হেমন্তের ধান বা আমন ধান বোঝায়। ইংরেজীতে ধানকে Paddy বা Rice বলা হয় । ধান গণের বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে Oryza । তা থেকেই ফরাসী ভাষায় ‘রিজ’ এবং ইংরেজীতে রাইস হয়ে যায়। রাইজা থেকে অনেকগুলো উপজাতের সৃষ্টি হয়, তার মধ্যে রয়েছে ওরাইজা সেটাইভা (Oryza Sativa) এবং ওরাইজা গ্লাবেরিমা (Oryza glaberimma)। এশিয়াতে ধানের যে উপজাত প্রধানত উৎপাদন হয় তা Oryza Sativa এবং ওরাইজা গ্লাবেরিমা আফ্রিকা মহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ধান এশিয়া্র দেশগুলোতেই প্রধানত হয় এবং এই মহাদেশের কোটি কোটি মানুষের সকাল-দুপুর-রাতের প্রধান খাবার। যাকে বলে তিনবেলার খাবার। ভাত না হলে বাঙালির খাওয়া সম্পূর্ণ হয় না।
বাংলায় উৎপাদনের বিভিন্ন পর্বে ধানের নাম বদলায়। মাঠের ধান মাড়াই করে, ঢেঁকি কিংবা ধানের মিলে ছাটাই করলেই চাল হয়ে যায়, আর তা রান্না করলেই ভাত। যারা ধান উৎপাদন করেন না, তাদের কাছে ধানের তেমন কোন গুরুত্ব নেই। মাঠের ধান বন্যায় ভেসে গেলে আহাজারি করে কৃষক, সে সময় শহরের মানুষ কোন খোঁজ নেয় না, কৃষক ধানের দাম মন প্রতি ৭০০ টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও ৪৫০ টাকা না পেলেও কেউ সহানুভুতি জানাতে এগিয়ে আসে না। কিন্তু চালের দাম বাজারে প্রতি কেজি ৩৬ থেকে ৩৮ হলেই শহরের সকল শ্রেণীর মানুষ চিৎকার শুরু করে, সরকারের সমালোচনা হয়। তাই সরকারও কৃষকের যখন ক্ষতি হয় তখন তত বেশি দায়িত্ব নেয় না। তারা চেষ্টা করে শহরের মানুষের পাতে যেন ভাতটা ঠিকমতো থাকে তার ব্যবস্থা করতে। তাই চালের দাম বাড়তে দেয়া হয় না। এভাবে শহরের মানুষদের রক্ষা করতে গিয়ে আমরা কৃষকদের মেরেছি। গ্রামের গ্রাম অভাবে বিরান হয়ে গিয়েছে।
বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও ধানের বৈচিত্র্য দেখলে অবাক হতে হয়। এই ছোট দেশেই কয়েক হাজার জাতের ধান উৎপাদন করা হয়। ১৯৩০ সালের অবিভক্ত বাংলায় ভৌগলিক পরিবেশ অঞ্চল ভেদে পনের হাজার জাতের ধান চাষাবাদ করা হোত বলে বিভিন্ন জরিপে জানা যায়। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে, আধুনিক কালে ধানের স্থানীয় জাতের ওপর গুরুত্ব না দিয়ে উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রীডের প্রবর্তনের কারণে অনেক জাত অবহেলায় হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইনস্টিটিউট (ব্রি) এর জিন ব্যাংকে কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা স্থানীয় জাতের ধানের সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ৫০০০। ব্রি বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে ৭২টি উচ্চ ফলনশীল জাত বা আধুনিক জাত এবং ৪টি হাইব্রিড ধান উদ্ভাবন করেছে। কিন্তু পুরানা জাতগুলো তাদের রক্ষা করবার কথা। করেছেন কিনা তারাই ভালো বলতে পারবেন।
আগে প্রধান দুটি ধানের মৌসুম ছিল, আউশ ও আমন, কিন্তু এখন সেটা হয়েছে আমন ও বোরো ধান। ক্রমে আউশের আবাদ কমে গেছে। ১৯৮৩-৮৪ সালে মোট আবাদী জমির ২৩.৬% অংশে আউশ ধান চাষ হোত, সেটা ২০০৮ সালে হয়েছে মাত্র ৮.৩৫%, আমন ধানও আগের তুলনায় কমছে, ১৯৮৩-৮৪ সালে ছিল ৩৬.৮% জমিতে, ২০০৮ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০.৭৫% জমিতে। অন্যদিকে ১৯৮৩-৮৪ সালে বোরো ধান ছিল মাত্র ৯.৬% জমিতে, ২০০৮ সালে হয়েছে ৩৩.১৪% জমিতে। বৈশাখ থেকে শ্রাবণ মাসে বৃষ্টি নির্ভর, উঁচু ও মাঝারি জমিতে আউশ ধানে্র চাষে সেচের দরকার হয় না। এক সময় ছিল যখন আউশ ধান কৃষকের বাৎসরিক ফসল পরিকল্পনায় খুব গুরুত্ব পেতো। কিন্তু বোরো ধানের প্রতি বেশি মনোযোগ দেয়ার কারণে এবং অন্যান্য ফসল, বিশেষ করে তামাক চাষের কারণে আউশ ধানের বপন করার সময় মাঠ খালি পাওয়া যায় না। কারণ এই সময়ে বোরো ধান মাঠে থাকে, তামাক পাতা তোলা হলেও গাছটি জমিতে থেকে যায়। আউশ ধানের অনেক স্থানীয় জাত আছে যা বিভিন্ন এলাকার কৃষকের কাছে খুব জনপ্রিয়, এবং খেতে খুব স্বাদ। এর মধ্যে অনেক জাত চাষ না করার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কয়েকটি জাত কৃষকরা ধরে রেখেছেন এবং চাষ করছেন। এর মধ্যে রয়েছে কালাবকরী, ভাতুরী, শংখপটি, কালামানিক, ষাইটা, ভয়রা ইত্যাদি। কৃষকের কাছে আউশ ধানের জাত সম্পর্কে জানতে চাইলে বন্যাপ্রবন অঞ্চলে তারা অন্তত ৮১ জাতের, বরেন্দ্র অঞ্চলে ৫৬, হাওর অঞ্চলে ২৭, এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ২৯ আউশ ধানের জাতের নাম বলতে পারে। সরকার এখন আউশ ধান চাষাবাদে বিশেষ প্রণোদনা দিচ্ছেন কারণ বোরো ধান সেচ নির্ভর হওয়ায় এবং মাটির তলার পানি ক্রমে নীচে নেমে যাওয়ায় বোরো ধান চাষ করা্র ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে ২০০৮ সালে মাটির তলার পানি ৬৪ ফুট নীচে ছিল, পাঁচ বছরয়ে তা ৯৭ ফুট নীচে নেমে গেছে।
চামারা দিঘা
আমন ধান নীচু জমিতে চাষ করা হয় এবং প্রচুর পানির দরকার হয়, বর্ষা কালের পানি আমন ধানের জন্যে খুব দরকার। এই ধান সারা বছরের ধান উৎপাদনের জন্যে খুব গুরুত্বপুর্ণ। বন্যা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমন ধানের ক্ষতি হলে কৃষক এবং দেশের ক্ষতি হয়। আমন ধানের মধ্যে অনেক জাত আছে, সাধারণ ভাতের ধান থেকে শুরু করে পোলাও - পায়েশের চিকন ও সুগন্ধি ধানও চাষ করা হয়। যেমন কাটারীভোগ, কালিজিরা, চিনিগুড়া, বাঁশফুল ইত্যাদী। কৃষকের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায় বোনা আমন ধানের জাতের সংখ্যা বন্যাপ্রবন অঞ্চলে ১৬৪ এবং রোপা আমনের সংখ্যা ১২৮টি, বরেন্দ্র অঞ্চলে বোনা আমন ৫৪, রোপা আমন ১১২, হাওর অঞ্চলে বোনা আমন ৪৬ এবং রোপা আমন ৬৬ এবং উপকূলীয় অঞ্চলে ১০১টি।
কালিজিরা
বোরো ধান সব এলাকার ধান নয়। যেসব জমিতে সারা বছর পানি জমে থাকে এবং অন্য রবি ফসল যেমন সব্জি, ডাল, সরিষা ইত্যাদি করা যায় না সেসব জমিতেই বোরো ধান চাষ হোত। তাই বোরো ধানের এলাকা আগে কম ছিল, শুধু হাওর-বাওর এলাকা এবং নীচু অঞ্চলেই চাষ হোত, গভীর নলকূপ বসিয়ে সেচের মাধ্যমে চাষের প্রয়োজন ছিল না। বর্তমানে বোরো ধান সব এলাকায় করতে গিয়ে গভীর নলকূপ বসিয়ে সেচের মাধ্যমে চাষ করা হয়। সেচকৃত ধান চাষের জমির ৮৮% বোরো ধানের জন্যে করা হয়। তার অর্থ হচ্ছে বোরো ধান না করলে গভীর নলকুপের ব্যবহার এতো বেশি হোত না। আমরা জানি মাটির তলার পানি তুলে সেচের এই ব্যবস্থায় পানিতে আর্সেনিকসহ ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান আমাদের খাদ্যে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যের জন্যে ঝুঁকিপুর্ণ করে তুলছে। বোরো ধান শুকনো মৌসুম বা শীতকালে হয়। কাজেই এই ধানের চাষ বৃষ্টি নির্ভর হওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই সেচের ব্যবস্থার মাধ্যমেই বোরো ধান চাষের ব্যাপকতা বাড়ানো হয়েছে। বলাবাহুল্য, আধুনিক বা উচ্চ ফলনশীল জাতের বোরো ধান চাষেই সেচের প্রয়োজন হয়। ১৯৮২-৮৩ সালে সেচের জন্যে মাটির তলার পানি্র ব্যবহার ছিল ৪১%, কিন্তু ২০০১-২ সালে এসে টা হয়েছে ৭৫%, শুধুমাত্র বোরো ধান চাষের বৃদ্ধির কারণে। বাজারে বেশি চলছে এমন উচ্চ ফলনশীল বোরো ধান হচ্ছে বিআর ১, বিআর৩, বিআর১৪, বিআর২৮, বিআর২৯। অথচ বোরো ধানের স্থানীয় জাতও আছে যা এখনো খুব জন প্রিয়। যেমন খৈয়াবোরো, টেপাবোরো, বোয়ালীবোরো, মুখকালালী। বোরো ধান বন্যা প্রবন অঞ্চলে ৩৪, বরেন্দ্র অঞ্চলে ২৪ এবং হাওর অঞ্চলে ২৩ জাতের নাম কৃষকের কাছ থেকে পাওয়া গেছে।
হরিংগা দিঘা
আধুনিক কৃষি বা সবুজ বিপ্লব নামে রাসায়নিক সার, কীটনাশক, সেচসহ যান্ত্রিক কৃষির মাধ্যমে অধিক খাদ্য ফলানোর যে ফর্মূলা দেয়া হয়েছিল তা এসেছিল ধানেরই মাধ্যমে। এই সময় প্রথম উচ্চ ফলনশীল ধানের প্রবর্তন করা হয়। আমাদের দেশে হাজার জাতের ধানের বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও নতুন ‘প্রবর্তিত’ ধান এসেছিল আন্তর্জাতিক ধান গবেষনা ইন্সটিটিউট থেকে ফোর্ড এবং রকেফেলার ফাউন্ডেশানের সহযোগিতায়, নাম ছিল আই আর-৮। বামুন জাতের এই ধানকে মিরাকল রাইসও বলা হোত – আলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন। বেশি ফলনের কৌশল ছিল খড়ের অংশ কমিয়ে দিয়ে শুধু শস্য বা দানা উৎপাদন বাড়াতে হবে। অথচ ধানের খড়ও খাদ্যেরই অংশ। গোখাদ্য হিশেবে খড় খুব গুরুত্বপুর্ণ। গরু না থাকলে দুধ ও মাংস মিলবে না, সে দিক বিবেচনা করা হয়নি। ফলে পরবর্তীকালে কৃষকের বাড়ীতে গরুর সংখ্যা কমে গেল এবং গরু পালতে হলে বাইরে থেকে খাবার কিনতে হল। দেশীয় গরুও শেষ হয়ে গেল। খাদ্য হিসেবে মাংস ও দুধ সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে গেল। আধুনিক কৃষির প্রবর্তনের জন্যে দেশে কয়েকটি জিন ব্যাংক তৈরি করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ধান গবেষনা ইন্সটিটিউট বা ব্রি ১৯৭০ প্রতিষ্ঠিত হয়, এবং উচ্চ ফলনশীল এবং হাইব্রিড জাতের ধানের জাত তৈরি করে কৃষকের মাধ্যমে চাষ করানো হচ্ছে। ব্রি’র আধুনিক জাতের ধান বর্তমানে ধান চাষের ৮০% জমিতে হচ্ছে, মোট ধানের ৯১% উৎপাদন কর্রছে। কিন্তু এই আধুনিক জাতের ধান উৎপাদনে ব্যাপকপরিমান রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করার কারণে ধানের ক্ষেতে যে মাছ পাওয়া যেত সেসব দেশীয় কৈ, শিং, মাগুড়সহ অসংখ্য মাছ হারিয়ে যাচ্ছে।
আধুনিক কৃষিতে উচ্চ ফলনশীলের জাত প্রবর্তন করা হয়েছে এই বলে যে দেশের জনসংখ্যা বেশি, তাদের খাওয়াতে হলে বেশি করে চাল লাগবে। এই যুক্তির সাথে মেলানো হোল দেশীয় জাতের ধানের ফলন বেশি নয়, তাই উচ্চ ফলনশীল (উফশী) এবং হাইব্রিড জাত লাগবে। কিন্তু এই কথা মোটেও ঠিক নয়। দেশীয় জাতের মধ্যে বেশি ফলনের জাত অনেক আছে, যা উফশীর চেয়ে কম নয়। এবং এই ধানের সাথে খড়ের পরিমানও অনেক বেশি যা গোখাদ্য হিশেবে কৃষক ব্যবহার করতে পারে। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। আমন ধানের মধ্যে কালোভোগ ধানের ফলন প্রতি হেক্টরে ৭.৬ টন এবং খড় ১৩ টন। অন্যদিকে আশাইল্লেম্বুরু ৬টন হলেও খড় ১৮টন। কৃষক শুধু মানুষের খাদ্যের হিশাব করে না, তারা তাদের বাড়িতে পালিত পশুপাখির খাদ্যেরও হিশাব করে। অন্যদিকে, আধুনিক জাতের ধান গুলো যেগুলো নম্বর দিয়ে চেনানো হয় (বিআর ২৮, বিআর ২৯ ইত্যাদী) রাসায়নিক সার, কীটনাশক এবং সেচ নির্ভর হওয়ায় এর খরচ অনেক বেশি। আধুনিক জাতকে তাই শুধু উচ্চ ফলনশীল (High Yielding variety) না বলে উচ্চ উপকরণশীল (High Input Variety) বললে ভুল বলা হবে না। ধানের উৎপাদনে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও গভীর নল কূপের পানি ব্যবহারের ক্ষতিগুলো এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে এবং নিত্য নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব বিশেষ করে অ-সংক্রামক রোগ (হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনীর বিকল হওয়া ইত্যাদি) বেড়ে যাওয়া জনমনে উৎকন্ঠা বাড়িয়ে তুলছে। খাদ্য ঘাটতি মেটাতে গিয়ে মানুষের শরীরে বিষ ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। এখন আবার জেনেটিকালী মডিফাইড ধানের (জিএম) প্রবর্তনের চিন্তাভাবনা চলছে, ব্রিতে বহুজাতিক কোম্পানির সাথে গবেষণাও হচ্ছে। উফশী ও হাইব্রিডের ক্ষতির পরে আরও পরনির্ভরশীল প্রযুক্তির দিকে ছুটছে। বর্তমানে জিএম ধানের মধ্যে গোল্ডেন রাইস (ভিটামিন এ ধান) প্রবর্তনের প্রক্রিয়া চলছে। বিআর ২৯ ধানের মধ্যে ভূট্টার জিন ঢুকিয়ে হলুদ ধান করে ভিটামিন এ সমৃদ্ধ ধান হবে বলে কোম্পানি দাবী করছে। এই ধান দীর্ঘদিন ফিলিপাইন ও অন্যান্য দেশে খুব সফল হতে পারেনি, এবং পরিবেশবাদীরা এর বিরূপ প্রভাব নিয়ে সতর্ক করছেন। তবুও এই ধান বাংলাদেশে প্রবর্তনের অপেক্ষায় আছে। অথচ ভিটামিন এ সমৃদ্ধ শাক-সব্জি, ফল আমাদের প্রচুর রয়েছে। সেসব ব্যবহার না করে বহুজাতিক কোম্পানি সিনজেন্তার পেটেন্ট করা ধানের প্রবর্তন করে আমরা কি করতে চাইছি?
ধান আমাদের অনেক বড় সম্পদ, কিন্তু ধানের প্রতি নীতিনির্ধারকরা প্রচুর অবহেলা এবং অবজ্ঞা করেছেন। আধুনিক ল্যাবরেটরীতে তৈরি ধানের প্রতি মনোযোগ দিয়েছেন, স্থানীয় জাতকে ফেলে রেখেছেন এক পাশে। সরকারের আউশের প্রণোদনাকে স্বাগত জানাই, একই সাথে আমাদের দেশের স্থানীয় জাতের ধান রক্ষা করা এবং বহুজাতিক কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল না হওয়ার আহবান জানাই। আমাদের বিজ্ঞানীরা নিজেরা দেশের প্রয়োজন বিবেচনা করে আমাদের দেশের ভৌগলিক ও পরিবেশ অনুযায়ি স্থানীয় জাতের ধানের গবেষনা ও চাষ বাড়ানোর উদ্যোগ নেবেন, এই আশা করছি।
এই লেখাটি দৈনিক বণিক বার্তা-য় ১৪ এপ্রিল ২০১৭, প্রকাশিত হয়: ধানই কৃষকের প্রাণ
১২ এপ্রিল ২০১৭। শ্যামলী।