যে ‘কাল’ সদাই ‘বর্তমান’, যা ‘শেষ’ তাই ‘আরম্ভ’, চৈত্র সংক্রান্তি ১৪২৫ sdf
নয়াকৃষি আন্দোলন, নবপ্রাণ আন্দোলন, বীজ বিস্তার ফাউনডেশান, উবিনীগ || Saturday 06 April 2019 ||
৩০ চৈত্র ১৪২৫ (১৩ এপ্রিল ২০১৯) আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ। আসুন সবাই মিলে এবার চৈত্র সংক্রান্তি পালন করি। আমাদের আয়োজন ঢাকায় এবং টাঙ্গাইলে। ঢাকায় নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা, আড্ডা এবং শস্য প্রবর্তনার আয়োজনে থাকছে সকাল থেকে ছাতু, চিড়া, দই, মুড়ি, খই, তিল ও নারিকেলের নাড়ু ইত্যাদি এবং নানান ধরণের শরবত। দুপুরের খাবারে চৌদ্দ রকমের শাক, ডাল, সবজি ও লাল ও সাদা চালের ভাত। এই দিন কোন মাছ-মাংস রান্না হবে না।
টাঙ্গাইলে নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকরা তাদের গ্রাম থেকে শাক কুড়িয়ে আনবেন এবং রিদয়পুর বিদ্যাঘরে সব্জি, ডাল ইত্যাদি নানা রকম রান্না করবেন। তার পাশাপাশি তারা গ্রামে প্রাণ বৈচিত্র্য ব্যবস্থাপনা ও নিরাপদ খাদ্য নিয়ে আলোচনা করবেন। নবপ্রাণ আন্দোলনের শিল্পীরা দেশের বিভিন্ন সাধকদের গান, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, লালন সাঁইয়ের গান পরিবেশন করবেন। সাথে থাকবে নয়াকৃষি আন্দোলনের কৃষকদের গান।
যোগাযোগ: ঢাকা, শস্য প্রবর্তনা । ৬/৮ স্যার সৈয়দ রোড, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭। মোবাইল: ০১৭১২৩৬৫২৬৬, ০১৯১১৯৮৬২২৯। টাঙ্গাইল: রিদয়পুর বিদ্যাঘর।। গ্রাম: বিষ্ণুপুর, ইউনিয়ন: পাথরাইল, থানা: দেলদুয়ার, জেলা: টাংগাইল। মোবাইল: ০১৭৩০০৫৭৭১৭।
চৈত্র সংক্রান্তি সম্পর্কে জানুন
চৈত্রের শেষ দিন চৈত্র সংক্রান্তি। বৈশাখকে আমরা বছর শুরুর মাস গুনি। তাই চৈত্র সংক্রান্তি বা চৈত্রের শেষ দিন অতিক্রান্ত হলে ১৪২৫ বাংলা বছরের সমাপ্তি ঘটবে।
কিন্তু চৈত্র সংক্রান্তি পালনের বিষয়টি বছর শেষ ঘোষণার জন্য নয়, কিম্বা পরদিন নতুন বছর শুরু হচ্ছে বলে ‘নববর্ষের’ প্রস্তুতিও নয়। দিনটি পালন হবে মানুষের শরীর ও প্রকৃতির মধ্যে সম্বন্ধ রচনার যে চর্চা এই নদিমাতৃক সবুজ বদ্বীপে বহু দীর্ঘকাল ব্যাপী জারি আছে তাকে চিনবার ও জানবার জন্য। মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির প্রাণবন্ত ও স্বতঃস্ফূর্ত সম্বন্ধ রচনার যে চর্চা বাংলার কৃষক সমাজ হাজার বছর ধরে করে এসেছেন, সেই দিকে সকলের নজর ও মনোযোগ ফেরানোই আমাদের ইচ্ছা। আমাদের দেহ বা জীবাবস্থার সঙ্গে গ্রহনক্ষত্র, গাছপালা, জীবঅণুজীবসহ সকল প্রাণ এবং অপ্রাণের সম্বন্ধ রয়েছে। এই সম্বন্ধ যেন আমরা একালে নতুন করে বুঝি, আমাদের পূর্বসূরীদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে গর্ব করতে পারি, তার জন্যই চৈত্রসংক্রান্তি উদযাপন। চৈত্রের মহাবিষুব সংক্রান্তি পালনের পেছনে যে জ্ঞানকলা, বিজ্ঞানবুদ্ধি, প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি – বিশেষত কৃষিকাজের মধ্য দিয়ে প্রাণ ও প্রকৃতির পুনরুৎপাদন ও বিকাশের অতি আবশ্যিক কর্তব্য পালনের রীতি – কোন অবস্থাতেই আমরা যেন তা ভুলে না যাই।
ঋতুর যে ভাব বা ধারণা কৃষি সংস্কৃতিতে প্রবল সেখানে সময় কখনই শেষ হয়ে যায় না, কিম্বা আবার নতুন শুরুও হয় না, একই ঋতু বারবার ফিরে আসে। চিত্রা নক্ষত্রের রাশি চক্র অতিক্রম করে যাবার সময়টা চৈত্রের সংক্রান্তি, কিন্তু নভোমণ্ডলে নিজের কক্ষ পরিভ্রমণ শেষে সেই একই চিত্রা ফিরে আসবে আবার আগামি চৈত্রে। নতুন নক্ষত্র নয়, পুরানা নক্ষত্রই ফিরবে। চক্রাবর্তে প্রত্যাবর্তনের এই ধারণা সংক্রান্তিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, এর সম্পর্ক গ্রহ নক্ষত্রের সঙ্গে, মূলত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গেই। বিপরীতে নতুন বছরের ধারণা ঘড়ি ও ক্যালেন্ডার থেকে উৎপন্ন। আমরা ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে গ্রহ নক্ষত্রের কথা ভুলে গিয়েছি। চাঁদ-সুর্য দেখে দিন-রাত বোঝার চর্চাও বিলীন হয়ে গিয়েছে। সময় বলতে আমরা সরলরেখা বুঝি, বৃত্ত কিম্বা প্রত্যাবর্তনের ধারণা আমরা হারিয়ে ফেলেছি।
চৈত্র সংক্রান্তি হচ্ছে প্রকৃতি ও গ্রহ নক্ষত্রের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ ঝালিয়ে নেবার দিন। আমরা জীব হিসাবে বিশ্বপ্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নই এটা উপলব্ধি করা, জানা এবং সেই উপলব্ধিকে চরিতার্থ করবার জন্যই নানান আচার, উৎসব ও উদযাপন। খাদ্য ব্যবস্থা তার অন্যতম দিক। চৈত্র সংক্রান্তির দিনে বিশেষ বিশেষ খাবার পরিকল্পিত ভাবে খাওয়া নিয়ম। এই দিন প্রাণীজ আমিষ নিষিদ্ধ। তাছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চর্চা রয়েছে: আবাদি ফসল আমরা তো সারা বছরই খাই, চৈত্র সংক্রান্তিতে তাই অনাবাদি শাকশব্জি খাওয়াই রীতি; অর্থাৎ চাষের শাকশব্জি না, বরং কুড়িয়ে এনে চৌদ্দ রকমের শাক এবং চৈতালি মৌসুমের সবজি, পাতা, মুড়া ইত্যাদি খেয়ে চৈত্র সংক্রান্তি পালন করতে হবে।
গ্রামের কৃষকের স্মৃতি ও জ্ঞানচর্চার দিবস হিশেবে সবারই প্রায় অলক্ষ্যে দিনটি পালিত হয়ে যায়। চৈত্র সংক্রান্তির মহিমা এখানেই। এখনও গ্রামের মানুষ তার জ্ঞান অনুযায়ী যা পাবার কথা ছিল তা খুঁজে না পেলে আফসোস করেন। আমাদের বাপ-দাদার সময়ে যা দেখেছি, কিম্বা মায়েরা যে সব শাক শব্জি দিয়ে চৈত্র সংক্রান্তি করতেন, তা এখন নাই। রাস্তাঘাট হয়েছে, বড় বড় দালান কোঠা হয়েছে, তাই অনাবাদী শাক শব্জি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এসব আছে কি নেই সেটা জেনে আমাদের কেমন সতর্ক হতে হবে সেটা নির্ধারণের জন্য হলেও চৈত্র সংক্রান্তি পালন খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলার কৃষক নারী চৈত্র সংক্রান্তিতে ঘরের পাশে আলান পালান মাঠের আনাচে কানাচে শাক কুড়াতে বেরোয়। নিয়ম আছে তাকে চৌদ্দ রকম শাক কুড়াতে হবে। আবাদী নয় কিন্তু, অনাবাদী; অর্থাৎ রাস্তার ধারে, ক্ষেতের আইলে, চকে আপনজালা শাক তুলতে হবে। অর্থাৎ যে শাক লতাপাতা কেউ আবাদ করেনি, আপনা থেকেই গজিয়েছে -- নিজে থেকে হয়ে ওঠা শাক। এই মৌসুমে যা টিকে থাকে। এই শাক তোলার অধিকার কৃষক নারীর থাকে। তার দেখার বিষয় হচ্ছে যেই শাক তাঁরা খুঁজছেন সেই শাক গ্রামে আছে কিনা। ধনি পরিবারের নারীরা নিজে শাক তুলতে বের না হলেও তার আশে পাশে যারা গরিব নারী আছে্ন তাঁদের মাধ্যমে শাক তুলিয়ে আনেন। মনে রাখতে হবে বলা হয় ‘শাক তোলা’ শাক ‘কাটা’ নয়। কখনোই তারা পুরো গাছটি উপড়ে ফেলে শাক আনবেন না। অতি যত্ন করে পাতাটি তুলে আনবেন। গাছ যেমন আছে তেমনই থাকবে।
কৃষক নারী খবর নিতে চায় প্রকৃতির যে অংশ অনাবাদী - যে অংশ কৃষি সংস্কৃতির সংরক্ষণ করে রাখার কথা, নইলে প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ অসম্ভব -সেই অনাবাদী প্রকৃতি ঠিক আছে কিনা। যেসব গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণী আবাদ করতে গিয়ে আবাদী জায়গায় কৃষক তাদের দমন করেছে, উঠতে দেয় নি, থাকতে দেয় নি, কিষাণি মেয়ে এই দিনে খবর নেয় তারা সব ঠিকঠাক আছে তো? চৈত্র সংক্রান্তিতে চৌদ্দ রকম শাক খাওয়া তো আসলে সব রকম গাছপালা প্রাণ ও প্রাণীর হালহকিকতের খোঁজ নেওয়া। এটা নারীর সূক্ষ জ্ঞান চর্চা। এই জ্ঞান নারীদের মধ্যে মা থেকে মেয়ে, পাড়া প্রতিবেশীরা ভাগাভাগি করে শেখে। ‘চৌদ্দ’ সংখ্যাটা প্রতীকী। আসলে বেশী পাওয়া গেলে আরও ভাল। তবে চৌদ্দ রকম শাক পাওয়াই এখন কঠিন হয়ে গেছে। চৈত্র সংক্রান্তিতে কৃষক মেয়েকে খবর নিতে হবে ‘পুরুষ’ সারাবছর যে ‘চাষ' করল তাতে অনাবাদি জাতি বা প্রজাতির হাল হকিকতের কি দাঁড়াল? ‘চাষ' করার অর্থ আবাদি ফসলের দিকে মনোযোগ দেওয়া, কিন্তু অনাবাদি ফসলের বিশাল ক্ষেত্র যেন তাতে নষ্ট বা কৃষি ব্যবস্থায় গৌণ না হয়ে পড়ে তার জন্যই চৌদ্দ রকম শাক তোলা ও খাওয়ার রীতি চালু হয়েছে।
এটা তাহলে পরিষ্কার গ্রামীণ জনগোষ্ঠির কাছে সাংস্কৃতিক ও ভাবগত তাৎপর্য ছাড়াও চৈত্র সংক্রান্তির সঙ্গে জীবন যাপনের সম্পর্ক অনেক গভীর। একটি বছর যখন পার হয়ে যায়, আবার বছর ঘুরে আরেকটি বছর ফিরে আসে, তখন সবকিছুই একই রকম থেকে যাবার কথা না। হবার কথাও নয়। যেহেতু আমাদের গ্রামীণ পরিবেশ ও জীবের জীবন মূলত কৃষির সাথে যুক্ত, তাহলে কৃষির পরিবর্তনের সাথে আমাদের চাষাবাদে ও খাদ্যব্যবস্থায় কিছু না কিছু পরিবর্তন হবার কথা। তাই প্রকৃতির সঙ্গে সারা বছর কী আচরণ করলাম তার বিচারের দিন চৈত্র সংক্রান্তি। প্রতিবছর কৃষির অবস্থা এক থাকছে না। আবাদ করার অর্থ আমাদের প্রয়োজন ও চাহিদা মেটাবার জন্য প্রকৃতিতে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যা থাকবার কথা তার বদলে নিজেদের চাহিদা মেটাবার জন্য খাদ্য উৎপাদন। চৈত্র সংক্রান্তিকে তাই বলা যায় সারাবছর ব্যাপী আবাদি ফসলের কারণে অনাবাদি প্রকৃতির ক্ষয়ক্ষতি নিরূপনের দিন। সেই জন্যই চৈত্র সংক্রান্তিতে আলান পালান জঙ্গল মাঠ পতিত জমি থেকে লতা পাতা শাকশব্জি কুড়িয়ে খাবার বিধান। কোন জাত বা প্রজাতির অভাব ঘটলে কৃষক নারী বুঝতে পারে কৃষি চর্চায় একটা দোষ ঘটেছে যার সংশোধন দরকার। চৈত্র সংক্রান্তি কৃষির ভুল সংশোধনের দিন।
আমাদের দেশের কৃষি নীতিতে পরিবর্তন হচ্ছে, আসছে প্রযুক্তি নির্ভর কৃষি। তাহলে চৈত্র সংক্রান্তিতে কৃষক যখন তার আলানে পালানে মাঠে ময়দানে কি আছে আর কি নাই তার হিসাব নিতে বেরোয় তখন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় খাদ্য উৎপাদন করার কথা বলে ক্ষতিকর প্রযুক্তি কিভাবে প্রকৃতি ধ্বংস করে। আমাদের খাদ্য ব্যবস্থার ওপর কিভাবে বড় ধরনের আঘাত হানা হয়।