রোমেসা বেগম ও ‘ময়নাগিরি’ ধানের বেচন
নয়াকৃষি আন্দোলন || Tuesday 07 May 2019 ||রোমেসা বেগম নয়াকৃষির একজন কৃষক। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার বাবুপুর গ্রামে তার বাড়ি। তিনি চৈত্র মাসে ময়নাগিরি ধানের জালা ফেলে থাকেন। এই ধানে মুড়ি ভাল হয়।
রোমেসা বেগম নিজে এই ধানের বীজ রেখেছেন। তিনি ধান শুধু ফসলের জন্য চাষ করেন না, ধানের বীছন বা ‘বেচন’ও করেন। বীছন বা জালাকে টাঙ্গাইলে ‘বেচন’ বলে। আমরা রোমেসার ভাষাই এখানে ব্যবহার করছি। ভাষার পার্থক্যের মধ্যে দিয়ে ভূগোল ও প্রাণের বৈচিত্রও ধরা পড়ে। স্থানীয় ভাষা একই সঙ্গে লোকায়ত জ্ঞানের আধার।
রোমেসার বেচন করাই প্রধান কাজ। তিনি মনে করেন, বেচন করার জন্য যে ধরনের উঁচু জমি বা টান জমি দরকার তা সব কৃষকের নাই। তাই সবাই বেচন করতে পারে না। বেচন না করতে পারলে কৃষকেরা ইচ্ছা করলেও ময়নাগিরি ধান চাষ করতে পারবে না। নম্বরি বোরো ধান করার জন্য তাঁর এলাকায় অধিকাংশ উঁচু জমির মাটি কেটে নীচু করে ফেলা হয়েছে, ফলে দেশী জাতের আবাদ কমে গিয়েছে। ধানের বৈচিত্র কমবার একটি বড় কারণ ভূগোলের বৈচিত্র অস্বীকার করা, একাট্টা একরকমের (Monoculture) ফসল করবার জন্য জমিকে একই রকম জমিতে পর্যবসিত করা। উৎপাদন পরিস্থিতি সবার জন্য একাকার করে ফেলা। রোমেসার জমি উঁচু, তাই সেখানে ময়বাগিরির বেচন হতে পারে। সেই বেচন কৃষকরা এখনও পেতে পারে, ফলে এলাকায় ময়নাগিরি ধানের আবাদ আছে।
কেমন ফলন হয় ময়নাগিরির? ফলনের তর্কটা রোমেসার কাছে স্রেফ পরিমানের তর্ক না। বিশেষ বিশেষ জাতের বিশেষ বিশেষ পুষ্টিগুণ আছে, তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যও আলাদা। আধুনিক কৃষি মানুষ স্রেফ জন্তুজানোয়ার অনুমান করে বা মনে করে; আর জন্তুর দরকার শুধু যথেষ্ট পরিমান মতো ভাত খাওয়া। কী খাচ্ছে এমনকি কেমন করে খাচ্ছে সেইসব একদমই বিচার্য নয়। তাই ধানের জাতের মূল্যায়ন আধুনিক কৃষির ক্ষেত্রে সবসময়ই কি পরিমান (?) ফলন হয় সেই তর্কেই সীমাবদ্ধ থাকে। আজকাল পুষ্টির কথা বলা হয় কিন্তু সেটা কোম্পানির স্বার্থে। মানে বীজ কোম্পানিগুলো নতুন আধুনিক জাতে কিভাবে জিংক, ভিটামিন এ ইত্যাদি ঢুকিয়ে দিয়ে ব্যবসা করতে পারবে তার জন্য খাদ্যে পুষ্টির বিষয় আলোচনা হয়। কিন্তু প্রচলিত বিশেষ বিশেষ স্থানীয় জাতের বৈশিষ্ট কী, তার স্বাদ ও পুষ্টিগুণ কেমন, কিম্বা পালা পার্বনে উৎসবে আতিথেয়তায় বিশেষ জাতটির সুনির্দিষ্ট কোন ভূমিকা আছে কিনা ইত্যাদি প্রশ্ন আধুনিক কৃষির নাই। রোমেসাদের কাছে পরিমান যেমন, তেমনি তার গুণও গুরুত্বপূর্ণ। একটি বাদ দিয়ে আরেকটি নয়। স্বাদ ও পুষ্টিগুণ কেমন, কিম্বা পালা পার্বনে উৎসবে আতিথেয়তায় বিশেষ জাতটির ভূমিকা বিচার করেই তার ফলন নির্ণয় করা হয়। যদি না হোত, তাহলে বাংলাদেশের কৃষকরা প্রায় ১৫ হাজার জাতের ধান উদ্ভাবন করতে পারতো না। বলাবাহুল্য, রোমেসা তাই মনে করে ময়নাগিরির পরিমানগত ফলনের বিচার হবে তার স্বাদ, পুষ্টি ও সাংস্কৃতিক মূল্য দিয়ে। একই ধরনের ধানের সঙ্গে তুলনায়। কৃষির সঙ্গে সামাজিকতা, সংস্কৃতি এবং মানুষের সঙ্গে মানুষের বন্ধনের প্রশ্ন জড়িত। রোমেসার বেচন অন্য কৃষকের সঙ্গে তার সম্পর্ক ও বন্ধন তৈরির মাধ্যমও বটে।
ময়নাগিরি ধান ভালই উৎপাদন হয়। ২ পাখি বা প্রায় ৬৬ শতাংশ) জমিতে ২০ মন ধান হয়। ময়নাগিরির জন্য এটা ভাল ফলন। বেচনের দাম ধানের দামের থেকে বেশী। বেচন বিক্রি হয় ১০০০ টাকা। আর ধান বিক্রি হোত ৭০০-৭৫০ টাকা মণ, যখন নম্বরি ধান বিক্রি হোত ৫০০ থেকে সাড়ে ৫০০র মধ্যে । ধানের দাম বছরে বছরে বদলাচ্ছে। নম্বরি ধানের দাম কমলেও ময়নাগিরির দাম বাড়তির দিকে থাকে। কারন তার আলাদা চাহিদা আছে। বেচন সবার কাছে নাই। গ্রামে যত কৃষক আছে তার মধ্যে ৫০% কৃষক ময়নাগিরি ধান চাষ করেন।ঙ্কারন তারা রোমেসার কাছে বেচন পাচ্ছে। অনেকে রোমেসা বেগমের কাছে জানতে চায় ময়নাগিরি ধানের বেচন আছে কি না। মোবাইলে খোঁজ নেয়। ময়নাগিরির চাষের প্রতি কৃষকের আগ্রহ বাড়ছে।
ময়নাগিরি ধান দেখতে খুব সুন্দর। লাল টকটকে। কিন্তু চালের রং সাদা। এই চালের ভাত খেলে মুখে রুচি আসে। এক খাবলা খাইলে আরও এক খাবলা খাইতে ইচ্ছা করে।
ময়নাগিরি ধানের খুব ভাল চিতই পিঠা হয়। চিতই পিঠার সাথে মাষকালাইয়ের ডাল দিয়ে খায়। আবার সজ পাতা, কাঁচা মরিচ, রসুন, পিয়াজ একত্রে বেটে চিতই পিঠা খেলে খুব মজা লাগে। এই ধানের পিঠা পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়- স্বব্জন নিয়ে খেলে খুব ভাল লাগে। ময়নাগিরি এমন এক ধান যার মধ্যে সামাজিক বন্ধনের বার্তা রয়েছে। কৃষক এই ধানের মুড়ি, পিঠা ক্ষীর ইত্যাদি নানান কিছু তৈরি করে যা মূলত বন্ধুত্ব ও সামাজিক বন্ধন চর্চার সাংস্কৃতিক উপায়।
প্রকৃতি ও সমাজের সঙ্গে মানুষের অবিচ্ছেদ্য বন্ধন চর্চার গল্প আমরা রোমেসা বেগম ও আরও অনেক কৃষকের সঙ্গে নয়াকৃষিতে গল্প করি। কৃষকের জগত সম্পূর্ণ নতুল আলোয় দেখবার সৌভাগ্য হয় আমাদের। উচু টান জমিতে এই ধানের চাষ করতে হয় আর উৎসবে এই ধানের অপরিহার্যতার কথাকে স্রেফ তথ্য বলে আর গণ্য করা যায় না। একটা জীবন্ত সমাজের গল্প আমরা শুনি, যে গল্পের নাম ময়নাগিরি। রোমেসা বেগম ময়নাগিরি চাষ করেন শুধুমাত্র বেচন রাখার জন্য বটে, কিন্তু এই বেচন পুরা গ্রামের সঙ্গে তার সম্পর্ক রচনার উপায়। বিনিময় সামাজিকতার যা বিকাশ ঘটায় এই তত্ত্ব তিনি মার্কস পড়ে শেখেন নি, সামাজিক মানুষ হিশাবেই বোঝেন ফসল নিছকই ফসল নয়, এর সঙ্গে সামাজিক বন্ধন ও সংস্কৃতির সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন। তার উচু টান জমিতে বেচন করার উপযোগী হওয়ায় তিনি বেচন বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন এবং বেশী লাভবান হন, সেটা বাড়তি লাভ। কিন্তু আমাদের লাভ হচ্ছে রোমেসার কারণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধানের জাত টাঙ্গাইলে আবাদ হচ্ছে।
রোমেসা বেগমের গল্প থেকে ৮টি ভিন্ন ভিন্ন বিষয় বেরিয়ে আসে
১. উঁচু জমি থাকা এবং রোমেসার মতো কাউকে দেশীয় জাতের বেচন, বীছন বা জালা তৈরি দেশী জাত সুরক্ষায় ভূমিকা রাখতে পারে।
২. ধান নিছকই খাদ্যবস্তু না। সামাজিকতা, পালা পার্বন, নানান উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু। এই উৎসবের ক্ষয় হলে এই ধানের জাতের অস্তিত্বও বিপন্ন হবে।
৩. ধানের বেচন বা গ্রামে উৎপাদকেন্দ্রিক সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা বাংলাদেশে খুবই দুর্বল। রোমেসার গল্প থেকে বোঝা যায় আমাদের আরও উৎপাদন ঘনিষ্ঠ হতে হবে। একাট্টা ফসল চাষের জন্য উঁচু জমিকে নীচু করা প্রাণবৈচিত্রের জন্য মারাত্মক হুমকি। কিন্তু বর্তমান সংকটের সময়েও উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঠিক বিন্যাসের মধ্য দিয়ে স্থানীয় জাত রক্ষার ক্ষেত্রে আমরা উদ্যোগী হতে পারি। বেচন উঁচু জমিতে হয়, কিন্তু আধুনিক কৃষির ফলে সব কৃষকের উঁচু জমি নাই।
৪. রোমেসা একজন নারী উদ্যোক্তা, কিন্তু তাঁর কোন স্বীকৃতি নাই। তিনি উদ্যোক্তা হিশাবেই পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষা এবং বিশেষ ভাবে প্রাণ বৈচিত্র রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। রোমেসাদের চেনা জরুরী হয়ে পড়েছে। যিনি ধানের জাত রক্ষার মধ্য দিয়ে আয় করতে সক্ষম।
৫. প্রতিটি ধানের জাতের নিজস্ব বৈশিষ্ট আছে। ময়নাগিরির চিতই পিঠা মাষকলাইয়ের ডাল দিয়ে খাওয়া বাংলাদেশের খাদ্য ব্যবস্থা বা সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ দিক। আবার সজ পাতা, কাঁচা মরিচ, রসুন, পিয়াজ একত্রে বেটে চিতই পিঠা খেলে খুব মজা লাগে। ধানের জাতকে সংস্কৃতি চর্চার দিক থেকে বুঝতে হবে। ।
৬. প্রাণবৈচিত্র সুরক্ষার সঙ্গে আত্মীয় স্বজন/পাড়াপ্রতিবেশির সাথে সম্পর্ক বাড়ার সঙ্গে বিশেষ জাত উৎপাদন, পিঠা খাওয়া ইত্যাদির সরাসরি ভূমিকা রয়েছে। সামাজিকতা ও সংস্কৃতি চর্চা ধানের জাতের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। সংস্কৃতির ক্ষয় যেমন বিশেষ জাতের ক্ষয়, তেমনি বিশেষ জাতের বিলুপ্তি সংস্কৃতিরও বিলুপ্তি।
৭. ধানের জাতের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পুষ্টির সম্পর্ক সরাসরি। খেতে মজা কথাটা সহজ শোনালেও অসুস্থ অবস্থায় বা অসুস্থ হবার পরে মুখে রুচি ফিরিয়ে আনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ধানের জাতকে রুচি, পুষ্টি ও স্বাস্থের দিক আমরা বিচার করিনা বললেই চলে।
৮. ডিজিটাল টেকনলজি যোগাযোগ বাড়িয়েছে। কৃষকেরা জালা নেবার জন্য মোবাইলে যোগাযোগ করে। কৃষি জ্ঞান প্রচার ও কৃষকের নেটওয়ার্ক বাড়ানোর ক্ষেত্রে মোবাইলের ভূমিকা আরও ভাল করে বোঝা দরকার।
বি: দ্র: কৃষকদের সঙ্গে গল্প করা, গল্পের মধ্যে দিয়ে তাদের অভিজ্ঞতা তাদের মুখে প্রকাশ করতে সহায়তা করা এবং একই সঙ্গে অন্যন্য কৃষকদের দিয়ে তথ্যের সত্যতা নির্ণয় করা ইত্যাদি নয়াকৃষি আন্দোলনরর গুরুত্বপূর্ণ চর্চা। নয়াকৃষি প্রাণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে কোন রোমান্টিক কল্পনা থেকে গড়ে ওঠে নি। কৃষকের সুনির্দিষ্ট সমস্যা স্মাধানের মধ্যে দিয়েই নয়াকৃষির তত্ত্ব ও চর্চা গড়ে উঠেছে। রোমেসা বেগমের সঙ্গে গল্প এই ব্যাপক চর্চারই অংশ। তাঁর তথ্য তাঁর এলাকার অন্যনায় কৃষকরাও জানেন এবং তার সত্যমিথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সব কৃষকই অংশগ্রহণ করেছেন। আমরা রোমেসার অভিজ্ঞতা সবার জন্য সারমর্মে এখানে তুলে ধরেছি।